হাফেজ শিরাজি
ইরানের   ফার্সি ভাষার কবি। তাঁর প্রকৃত নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। কৈশোরে তিনি কোরান শরিফ মুখস্ত করার কারণে প্রথমে হাফেজ শামসুদ্দিন মোহাম্মদ নামে পরিচিত হন। পরে হাফেজ নামেই সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কাব্য রচনার জন্য তিনি বুলবুল-ই-শিরাজ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।  এছাড়া ইরানে তিনি "লিসান-উল-গায়েব" (অজ্ঞাতের বাণী), "তর্জমান-উল-আসরার" (রহস্যের মর্মসন্ধানী) নামে সম্ভাষিত হয়ে থাকেন।

আনুমানিক খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তিনি শিরাজ অঞ্চলের মোসল্লা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। হাফেজের পিতা বাহাউদ্দীন ইসপাহান নগরীর ব্যবসায়ী ছিলেন। পরে ইসপাহান নগর থেকে ব্যবসার সুবিধার জন্য শিরাজে এসে বসবাস করা শুরু করেন। কিন্তু হাফেজের শৈশবকালে পিতার মৃত্যুর কারণে তাঁর মা প্রচণ্ড আর্থক সঙ্কটে পড়েন। তাই আর্থিক সংকট মোচনের জন্য কৈশোর থেকে হাফিজকে অর্থোপার্জন নামতে হয়। কোনো কোনো মতে ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তাঁর মা তাঁকে জনৈক ধনবান বণিকের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। এই বণিকের কাছে থাকার সময় তিনি শিক্ষালাভের সুযোগ পান।

শৈশব থেকে তিনি সহজাত ক্ষমতায় কবিতা রচনা করতে পারতেন। এই সূত্রে তাঁর কাব্য খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কথিত আছে হাফেজ শিরাজের উত্তরে পর্বতের উপরে "বাবা-কুহী" নামক এক দর্গায় ধর্মোৎসবের জন্য গিয়েছিলেন। ওই উৎসবে ইমাম আলি নামক এক দরবেশের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ইমাম আলি হাফেজের কবিতা শুনে মুগ্ধ হন। এরপর ইমাম আলি হফেজকে রহস্যময় খাবার খেতে দেন এবং বলেন যে, এই খাবারের গুণে এক সময় হাফেজ কবিখ্যাতি লাভ করবেন। অনেকে এই ঘটনাটি অলৌকিক বলে মনে করেন। আবার অনেকের মতে এরূপ কোনো ঘটনা ঘটে নি। সম্ভবত ইমাম আলি হাফেজের কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে এরূপ আশীর্বাদ করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কবি খ্যাতি পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই খ্যাতি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ধারণা করা হয়, আনুমানিক ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে হাফেজ মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

হাফেজ তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিতে কবিতা রচনা করতেন মুখে মুখে। তাঁর জীবদ্দশায় কোনো কাব্যসংকলন প্রকাশিত হয় নি। তাঁর বন্ধু গুল-আন্দামই সর্বপ্রথম তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবিতা সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। গুল-আন্দামের উদ্যোগে প্রায় পাঁচ হাজার কবিতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। ধারণা করা হয়, আরও বহু কবিতা সংগ্রহের বাইরে রয়ে গেছে।

হাফিজ এবং তৈমুর লংকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। উল্লেখ্য ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দের শেষে তৈমুর লং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমরকন্দকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী বানান। এই সময় তিনি, প্রিয়ার গালের তিলের বিনিময়ে সমরকন্দ ও বোখারা নগরী বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কবিতাটি ছিল-

اگر آن ترک شیرازی به دست آرد دل ما را
به خال هندویش بخشم سمرقند و بخارا را

প্রাণ যদি মোর দেয় ফিরিয়ে তুর্কী সওয়ার মনচোরা
প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলের
একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়ে দেব
সমরকান্দ ও রত্নখচা এ বোখারা!

সাম্রাজ্যের রাজধানী কোনো এক কবি বিলিয়ে দিতে চান, তৈমুর লং এই কথা শুনে ভীষণ রেগে যান। ১৩৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুর লং সমগ্র পারশ্য দখল করে নেওয়ার পর তিনি হাফেজকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠান। হাফেজ ভয়ে বলেন যে, তাঁর কবিতার শেষের চরণে "সমরকন্দ ও বোখারা"র পরিবর্তে "দো মণ কন্দ ও সি খোর্মারা" হবে। "। সব মিলিয়ে এর্থ হবে- 'আমি তার গালের তিলের বদলে দু মণ চিনি ও তিন মণ খেজুর দান করব!" আবার কোনো কোনো মতে, হাফেজ নাকি দীর্ঘ কুর্নিশ করে বলেছিলেন, "সম্রাট! আমি আজকাল এই রকমই অমিতব্যয়ী হয়ে পড়েছি!" এই জবাব শুনে তৈমুর এত আনন্দ পান যে, শাস্তি দেয়ার বদলে হাফেজকে তিনি বহুমূল্য পারিতোষিক দেন।

হাফেজের তাঁর মৃত্যুর তাঁর জানাজা এবং কবর দেওয়ার ব্যাপারে একটি প্রচলিত আছে। গল্পটি হলো হাফেজের মৃত্যুর পর একদল লোক তাঁর জানাজা করা ও কবর দিতে অসম্মতি জানায়। এ নিয়ে হট্টগোল হতে থাকলে, এর মীমাংশাএ জন্য একটি পন্থা অবলম্বন করা হয়। সেটি হলো- সেই সময় যে হাফিজের যে সকল কবিতা পাওয়া গিয়েছিল, তা সংগ্রহ করা হয়। এই ক্ষুদ্র সংকলনটি খোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় একজনের হাতে। ওই লোকটি ওই সংকলন খুলে পাওয়া যায় একটি কবিতার দুটি চরণ। এই দুই চরণ দুটি ছিল-

হাফিজের এই শব হ'তে গো তু'লো না কো চরণ প্রভূ
যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।

এরপর বাক-বিতণ্ডাকারীরা হাফেজকে এক আঙুরবাগানে সমাহিত করেন। সে স্থান আজও "হাফেজিয়া" নামে প্রসিদ্ধ। 

বাংলাতে হাফিজের কবিতার অনুবাদ করেছিলেন  কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের নাম 'রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ'।