এনি বেসান্ত
১৮৪৭-১৯৩৩
নারী অধিকার আন্দোলনকারী, লেখিকা, বাগ্মী, এবং আইরিশ ও ভারতীয় স্বায়ত্ব শাসনের সমর্থক।

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের লণ্ডনের ক্ল্যাপহ্যামের এক মধ্যবিত্ত আইরিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ জন্মগ্রহণ করেন।

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পাঁচ বছর বয়সে, পিতার মৃত্যু হয়। এই সময় তাঁর মা হ্যারো স্কুলে ছেলেদের জন্য একটি বোর্ডিং চালাতেন। তাঁর স্বল্প আয়ে এনির প্রতিপালনে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই তিনি তাঁর বন্ধু এলেন ম্যারিয়াতকে এনির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। এরপর এনি মারিয়াতের তত্তাবধানে বড় হয়ে উঠেন। এই সময় তিনি আইরিশ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। বিশেষকরে এ বিষয়ে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁর ম্যানচেস্টারে বন্ধুরা।

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিলাতি ধর্মপ্রচারক পাদরী ফ্রাঙ্ক বেসান্তকে (১৮৪০-১৯১৭) বিবাহ করেন। পরে তিনি  ফ্রাঙ্ক লিংকনশায়ারের সিবসেতে যাজক হন। এই স্বামীর ঔরসে তিনি দুটি সন্তানের জননী হন। এঁদের নাম ছিল আর্থার এবং মাবেল।

এনি চিরাচরিত ধর্মমতের বিরোধী ছিলেন। ফলে স্বামীর সাথে মনোমালিন্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের এঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এই সময় তিনি ন্যাশনাল সেকুলার সোসাইটির (এনএসএস) একজন বক্তা, একজন লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর এই কার্যক্রমের বিশেষ সহয়তা করেছিলেন চার্লস। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণ অভিযানকারী চার্লস নোল্টনের একটি বই প্রকাশ করার কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। তবে এই বিতর্ক তাঁদের বিখ্যাত করে তুলেছিল। এই সূত্রে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি  ব্র্যাডলফ নর্থাম্পটনের এমপি নির্বাচিত হন।

১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মার্চ তিনি, লীসেস্টারের হাম্বারস্টোন গেটে, লীসেস্টার সেকুলার সোসাইটির নতুন সেক্যুলার হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অন্যান্য বক্তারা ছিলেন জর্জ জেকব হোলিওক, হ্যারিয়েট ল এবং চার্লস ব্র্যাডলফ। 

এই সময় আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা উদারপন্থী এবং মৌলবাদীদের সাথে একটি জোট গঠন করেন। বেসান্ত আইরিশ হোম রুল আন্দোলনের নেতাদের সাথে দেখা করেন। বিশেষ করে, যিনি ভূমিযুদ্ধের মাধ্যমে, জমিদারদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রামে, আইরিশ কৃষককে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন, সেই মাইকেল ডেভিটের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি পরবর্তী কয়েক দশক ধরে ডেভিট এবং তার ল্যান্ড লীগের পক্ষে অনেকবার বলেছিলেন এবং লিখেছিলেন। এছাড়া  তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পুষ্ঠ ইউনিয়নের কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

এই সময় তিনি শ্রমিকশ্রেণির জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করার বিষয়ে খুব সতর্ক ছিলেন। যে সময়ে বেকারত্ব চরম অবস্থায় পৌঁছেছিল।  ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের কিছু বেকার তরুণ-তরুণী ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। এই অবস্থায় ১৩ই নভেম্বরের তিনি এদের জনসভায় বক্তব্য রাখতে রাজি হন। পুলিশ এই জমায়েতকে আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে সেনাবহিনীকে ডাকা হয়। সেনা সদস্যরা সন্ত্রাসী কায়দায় বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করে। এতে বহু মানুষ আহত হন একজন মারা যান। অবশিষ্ট বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশকেই গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময় বেসান্ত নিজেই গ্রেফতার বরণ করার জন্য পুলিশের কাছে যান। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার পরিবর্তে নিরাপদে স্থান ত্যাগে বাধ্য করেন। পরে এই ঘটনাটি 'রক্তাক্ত রবিবার' হিসাবে পরিচিত লাভ করে। এরপর বেসান্ত কারাগারে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য আইনি সহায়তা আয়োজনে এবং তাদের পরিবারের জন্য সমর্থন দেওয়ার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন দেশলাই কারখানা কর্মী ধর্মঘটের সাথে একাত্মতা ঘোষণা। উল্লেখ্য দেশলাই কারখানা কর্মীদের অধিকাংশই ছিল তরুণী। কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অনেকে ফসফরাস-ঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই সময় দেশলাই কর্মী, ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য, বারোজ এবং বেসান্তের সাহায্য চেয়েছিল। বেসান্ত রাজি হন এবং এঁদের পাশে দাঁড়ান।

এই সময় তিনি ফেবিয়ান সোসাইটি এবং মার্কসবাদী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন (এসডিএফ) উভয়ের পক্ষে একজন স্বনামধন্য বক্তা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।  এরপর তিনি টাওয়ার হ্যামলেট্‌স এর জন্য লন্ডন স্কুল বোর্ডে নির্বাচিত হন। যদিও সেই সময়ে অল্প সংখ্যক মহিলাই ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন, তবুও তিনি ভোট পর্বে শীর্ষস্থান লাভ করেন।

লন্ডনে বসবাসরত সংগ্রামরত তরুণ আইরিশ লেখক জর্জ বার্নার্ড শ', এবং ফেবিয়ান সোসাইটির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বেসান্ত শ'কে বেশ পছন্দ করা শুরু করেছিলেন এবং তাঁর সাথে বসবাসের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু শ' এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সাথে হেলেনা ব্লাভাৎস্কির দেখা হয়। হেলেনার সংস্পর্শে এসে তাঁর ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এসই সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে তার আগ্রহ কমতে থাকে। তিনি ব্রহ্মজ্ঞানী সমাজের সদস্য হন এবং অচিরেই তিনি বক্তা হিসেবে সমাজে একটি সম্মানে জায়গা অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি ব্রহ্মচর্চা সম্পর্কিত কাজের অংশ হিসাবে, তিনি ভারতে আসেন।

১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেন্দ্রীয় হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন।
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আন্তর্জাতিক অর্ডার অফ কো-ফ্রীম্যাসোনারি প্রথম বিদেশী লজ লা ড্রোয়া হুমাঁ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনেক অংশে লজ স্থাপন করেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রহ্মজ্ঞানী সমাজের সভাপতি হন। এই সময় এর আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর ছিল মাদ্রাজের আদিয়ার।

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, তিনি ভারতে গণতন্ত্রের প্রচারের জন্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মধ্যেই কর্তৃত্ব পেতে, হোম রুল লীগ চালু করতে সহায়তা করেছিলেন। এই সূত্রে ভারতের তৎকালীন বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসের সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসর ৩৩তম অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে, বেসান্ত তার আশ্রিত এবং দত্তক পুত্র জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তিকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, যাঁকে তিনি দাবি করেন নতুন মেসায়া এবং বুদ্ধের অবতার বলে। অবশ্য ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণমূর্তি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারী স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা এবং থিওসফির কারণগুলির জন্য প্রচার চালিয়ে যান।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর মৃত্যবরণ করেন।