দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
১৮৬৩-১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ

গীতিকার, কবি ও সঙ্গীতশিল্পী। বাংলা গানের পঞ্চ-স্থপতির একজন। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলোকে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে অভিহিত করা হয়।

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই (রবিবার, ৪ শ্রাবণ ১২৭০),  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বাৎস্য গোত্রীয় বারেন্দ্রশ্রণি ব্রাহ্মণ বংশে  জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পূর্ব-পুরুষদের তালিকায় প্রথম নাম পাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে। এই গ্রন্থের বর্ণানুসারে জনা যায়— মদনগোপাল রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজার সেনাপতি এবং তাঁর অগ্রজ রামগোপাল ছিলেন দেওয়ান। মদনগোপাল রায়বক্সি উপাধি লাভ করেছিলেন। মদনগোপালের পৌত্র কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ও ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। কার্তিকেয় চন্দ্রের সাত পুত্রে মধ্য দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর একমাত্র কনিষ্ঠা ভগ্নী'র নাম মালতী।  তাঁর মা-এর নাম প্রসন্নময়ী দেবী। তিনি ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর।

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কৃষ্ণনগরের
Anglo Vernacular School থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন এবং ১০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। একই কলেজ থেকে তিনি এফ. এ. পাস করেন। এরপর হুগলি কলেজ থেকে বি.এ.পাশ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ম্যালেরিয়াতে প্রায়ই ভুগতেন। এই কারণে শেষের দুটি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ আর্যগাঁথার প্রথমভাগ প্রকাশিত হয়।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই সময় তিনি আবার ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন। এই কারণে, বায়ু পরিবর্তনের জন্য তিনি কিছুদিন দেওঘরে বসবাস করেন। এরপর এখান থেকে তিনি ছাপরা জেলার রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারী স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে হিসেবে যোগদান করেন। এখানে থাকাকালে তিনি বিলেতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বৃ্ত্তি লাভ করেন।এরপর ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কৃষিবিদ্যা উপর লেখাপড়ার জন্য সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান। সেখানকার এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায়
FRAS  ডিগ্রি অর্জন করেন।

ইংল্যান্ডে থাকাকালে ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ
Lyrics of Ind । এই বছরই তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কর্মে নিযুক্ত হন। কিন্তু তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে এলে,  তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা বিলেতে থাকার জন্য  প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে, তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে চাকুরি জীবন শুরু করেন। শুরু থেকেই ইংরেজ অফিসারদের সাথে নানাবিধ সংঘাতের ভিতর দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এই চাকুরির সুবাদে তিনি ভূমি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে সেপ্টেম্বর মজফঃরপুরে বদলী হন। কিন্তু ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত থাকার কারণে ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে বিনা বেতনে ছুটি নিতে বাধ্য হন। ছুটিতে থাকাকালে প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন।

রোগমুক্ত হওয়ার পর, ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি তিনি কাজে যোগদান করেন। পরে বনেলী ও শ্রীনগর স্টেটের সহকারী সেটেলমজযন্ট কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। 

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দিনাজপুরে বদলী করা হয়।

১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবগারি বিভাগের প্রথম ইন্সপেক্টের পদ লাভ করেন।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম সন্তান দিলীপকুমার রায়ের জন্ম হয়।
১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কন্যা মীরাদেবীর জন্ম হয়। এই বছরের ১৭ই মার্চ তিনি ল্যান্ড রেকর্ডস এবং কৃষি বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর পদ লাভ করেন।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ই অক্টোবর তিনি আবগারি বিভাগের কমিশনের সহকারী পদ লাভ করেন। তবে ১৩ই নভেম্বর তাঁকে পুনরায় ইন্সপেক্টর পদে ফিরিয়ে আনা হয়।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করে সুরবালা মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীবিয়োগের পর শোকে অধীর হয়ে তিনি কিছুদিনের জন্য ছুটি নেন।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর তিনি পুনরায় কাজে যোগদান করেন এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে খুলনায় বদলি হন। এখানে কিছুদিন কাজ করার পর, বহরমপুরের গয়ায় বদলি হন।
 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠিত 'খামখেয়ালী সভা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভায় তিনি প্রথম থেকে আসা যাওয়া শুরু করেন। এই সূত্রে তাঁর সাথে রবীন্দ্রনাথের সখ্যাতা জন্মে। [সূত্র : রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড। প্রশান্তকুমার পাল। পৃষ্ঠা : ১২৭।]।


১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় 'পূর্নিমা-মিলন' নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে স্বদেশ পর্যায়ের বহু গান রচনা করেন। একসময় সাহিত্যক্ষেত্রে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সাথে তাঁর তীব্র মতবিরোধ হয়। তারপরেও ভারতবর্ষ পত্রিকাতে (আষাঢ় ১৩২০) তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উচ্চতর আশা ব্যক্ত করে লিখেছিলেন- "আমাদের শাসনকর্তারা যদি বঙ্গসাহিত্যের আদর জানিতেন, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও মাইকেল peerage  পাইতেন ও রবীন্দ্রনাথ knight উপাধিতে ভূষিত হইতেন।"

 

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি তিনি ৫ মাসের জন্য ছুটি নেন। এই সময় তিনি কলকাতায় 'সুরধাম' নামক বাড়ি তৈরি করেন।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি ২৪ পরগণার ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে যোগদান করেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের
 ২৯শে  জানুয়ারি মাসে তিনি বাঁকুড়ায় বদলি হন। এখানে তিন মাস থাকার পর মুঙ্গের বদলি হন। এই সময় তিনি সন্ন্যাস রেগো আক্রান্ত হন। এই সময় তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ক্যালভার্টের কাছে চিকিৎসা নেন এবং এক বৎসরের জন্য ছুটি নেন। এরপর শরীর ক্রমাগত খারাপের দিকে যেতে থাকলে- ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ তারিখে চাকরি থেকে অবসর নেন।

অবসর নেওয়ার আগে তিনি ভারতবর্ষ নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই পত্রিকা প্রকাশের ভার নিয়েছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স। এই পত্রিকার জন্য তিনি সহকারী হিসাবে নিয়েছিলেন অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। কিন্তু পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে। কিন্তু তিনি এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই ৩রা জ্যৈষ্ঠ (১৩২০) তারিখে মৃত্যু বরণ করেন।


 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচনাবলির কালানুক্রমিক সূচি

আর্যগাথা, ১ম খণ্ড (৫ মার্চ ১৮৮২) [কাব্য]
The Lyrics of India (ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রচিত, ১৮৮৬) [কাব্য]
একঘরে (২ জানুয়ারি, ১৮৮৯) [প্রবন্ধ]
আর্যগাথা, ২য় খণ্ড (২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩) [কাব্য]
সমাজ বিভ্রাট ও কাল্কি অবতার (৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫)। [প্রহসন]
বিরহ (১৮৯৭)। [প্রহসন]
আষাঢ়ে (ডিসেম্বর ১৮৯৯) [কাব্য]
হাসির গান (১৮ জুলাই, ১৯০০) [গান]
পাষাণী [২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০০] [নাটক]

ত্র্যহস্পর্শ বা সুখী পরিবার (২৩ ডিসেম্বর, ১৯০০) [প্রহসন]
প্রায়শ্চিত্ত (১১ জানুয়ারি, ১৯০২) [প্রহসন]

মন্দ্র (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯০২) [কাব্য]
তারাবাঈ (২২ সেপ্টেম্বর,১৯০৩) [নাটক]
রাণা প্রতাপসিংহ (৮ মে, ১৯০৫) [নাটক]
দুর্গাদাশ (৫ নভেম্বর ১৯০৬) [নাটক]

আলেখ্য (৮ জুলাই, ১৯০৭) [কাব্য]
নূরজাহান (১ মার্চ, ১৯০৮) [নাটক]
সোহরাব-রুস্তম (২৩ অক্টোবর ১৯০৮) [নাটক]
সীতা (৬ নভেম্বর, ১৯০৮) [নাটক]
মেবারপতন (২৭ ডিসেম্বর, ১৯০৮) [নাটক]
সাজাহান (৮ আগষ্ট, ১৯০৯) [নাটক]
চন্দ্রগুপ্ত (২৪ আগষ্ট, ১৯১১) [নাটক]

পূনর্জন্ম (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯১১) [প্রহসন]
পরপারে (২৮ আগষ্ট, ১৯১২) [নাটক]

ত্রিবেণী (৫ সেপ্টেম্বর, ১৯১২) [কাব্য]

আনন্দ-বিদায় (১৬ নভেম্বর, ১৯১২) [প্রহসন]
ভীষ্ম (৮ জানুয়ারি, ১৯১৪) [নাটক]
কালিদাস ও ভবভূতি (১০ আগষ্ট, ১৯১৫) [আখ্যান]
সিংহল বিজয় [১৩ অক্টোবর, ১৯১৫] [নাটক]

বঙ্গনারী [১০ এপ্রিল, ১৯১৬] [নাটক]

 

পত্রিকায় প্রকাশিত কিন্তু অগ্রন্থিত রচনা
বিলাতের পত্র
চিন্তা ও কল্পনা
বাগ্মী ও সংবাদপত্র
স্বরচিত জীবনী
কীর্তন
বিষম সমস্যা
কাব্যে নীতি
মোহিনী
আমার নাট্যজীবনের আরম্ভ
অভিনেতার কর্ত্তব্য


সূত্র: