জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান
(১৮৫৬-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ)
পার্শী ব্যবসায়ী এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের একজন পথিকৃৎ।

১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন পারশ্যের একজন ব্যবসায়ী। জামশেদজির পিতা ব্যাবসায়ে বিপুল ক্ষতির সম্মুখিন হলে, তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা দারিদ্র সীমার নিচে নেম যায়। এই অবস্থায় জামশেদজিকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। শুধু তাই নয়, পরিবারের সাহায্য করার জন্য ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে 'এলফিনস্টোন ড্রামাটিক ক্লাব'-এ থিয়েটারের প্রোববয়ের কাজ করতে হয়। এই সময় তিনি কিছু কিছু নাটকে অভিনয়ও করেছেন। উল্লেখ্য ১৮৬০-৬১ খ্রিষ্টাব্দে দিকে এলফিনস্টোন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এই সখের ক্লাবটি স্থাপন করেছিলেন।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই অপেশাদার ক্লাব একটি পেশাদার থিয়েটার কোম্পানীতে পরিণত হয়। কিন্তু ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানির কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি করাচি শহরে আসেন এবং এখানে স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। এক বছরের ভিতরে তিনি ব্যবসায় বিপুল সাফল্য লাভ করেন। কিন্তু ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অধিকতর ব্যবসায়িক প্রসারের আশায় কলকাতা আসেন।

জামশেদজী এক বছরের ভিতরে কলকাতায় তাঁর ব্যবসায়কে সুসংহত করেন। এই সেনানিবাসে নানান দ্রব্য সরবরাহের করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন। কলকতায় পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের ব্যবসার বিপুল সম্ভাবানা দেখে তিনি এলফিনস্টোন ক্লাবের নাটক মান্ডালির জে আর সাক্লোথের সাথে অংশীদারী ব্যবসার জন্য চুক্তি করেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জামশেদজি ৫ ধর্মতলায় অবস্থিত একটি বিশাল ভবন ক্রয় করেন। এই ভবনে ছিল করিন্থিয়ান হল নামক এক থিয়েটার মঞ্চ। সে সময়ে এই মঞ্চে পার্শি ও হিন্দি নাট্যদলগুলো মাঝে মাঝে তাঁদের নাটক মঞ্চস্থ করতো।

জামশেদজি এই সময় তাঁর সকল ব্যবসাকে জেএফ ম্যাডান এন্ড কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসেন। তাঁর ব্যবসায়িক প্রসার ঘটেছিল কলকাতার বাইরে লক্ষ্ণৌ ও দার্জিলিং-এ। এই সময় ভারতে গ্রামোফোন রেকর্ড এবং চলচ্চিত্রের ব্যবসার অপার সম্ভাবনা দেখে এ সকল ব্যবসার দিকে নজর দেন। তিনি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য প্যারিসের 'পাথে ফ্রেরেস' কোম্পানী থেকে প্রজেক্টর ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করেন। চলচ্চিত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি করিন্থিয়ান হল এবং বিভিন্ন মাঠে বায়োস্কোপ দেখানোর ব্যবস্থা করেন। সে সময়ে এইসব বায়োস্কোপে 'পাথে প্রোডাকশনস' কোম্পানীর নির্মিত ছবিই দেখানো হতো। এইসব বায়োস্কোপ শোয়ের আয়োজন করা হয়েছিল এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানীর নামে। একই বছরে আলফ্রেড থিয়েটার কিনে সেখানেও ম্যাডান বায়োস্কোপ শো শুরু করেন।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ প্রতিষ্ঠা করেন 'এলফিনস্টোন পিক্‌চার প্যালেস'। বর্তমানে এর নাম 'চ্যাপলিন সিনেমা'। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাডান থিয়েটার আর 'প্যালেস অফ্‌ ভ্যারাইটিস'।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যবসায়ে তিনি 'ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড' নামে একটি যৌথ উদ্যোগ কোম্পানী স্থাপন করেন। এই কোম্পানী এবং এর সহযোগী ভারতীয় থিয়েটার হাউসগুলোর উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাডানের প্রযোজনায় তৈরি হয় 'বিল্বমঙ্গল' নামক নির্বাক চিত্র। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর এ ছায়াছবিটি প্রথম প্রদর্শন হয়েছিল 'কর্ণওয়ালিস থিয়েটার'-এ। দ্রষ্টব্য [প্রচারপত্র]

জামশেদজি উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ভারতের বাইরে থেকে অভিজ্ঞ বেশকিছু পরিচালকের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এঁরা ছিলেন- ইউজেনিও দে লিগুরো, ক্যামিল লে গ্রাঁদ আর জর্জিও ম্যানিনি। লিগুরো পরিচালনা করেছিলেন নল দময়ন্তী (১৯২০) ও  ধ্রুব চরিত্র (১৯২১), লে গ্রাঁদ পরিচালনা করেছিলেন রত্নাবলী (১৯২২), আর ম্যানিনি পরিচালনা করেছিলেন সাবিত্রী সত্যবান (১৯২৩)।  ম্যাডান থিয়েটারের প্রযোজনায় বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ (১৯২২ আর ১৯২৮), দুর্গেশনন্দিনী (১৯২৭) আর রাধারাণী (১৯৩০) ছবিগুলি তৈরি হয়ে। রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প গিরিবালা (১৯২৯) তৈরি হয়েছিল।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জামশেদজি  ফ্রেমজি ম্যাডানের মৃত্যু হয়।