জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
(১৮৪৯-১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ)
 

সঙ্গীতকার (সুরকার ও গীতিকার), নাট্যকার, আকারমাত্রিক স্বরলিপির প্রচলনকারী, সঙ্গীত গবেষক, পত্রিকা ও বিবিধ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ইত্যাদি বহুবিধ কর্মযজ্ঞের নায়ক।

 

১২৫৫ বঙ্গাব্দের (৪ মে, ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দ) ২২ বৈশাখ তারিখে কলিকাতার জোড়সাঁকোস্থ ঠাকুর বাড়ীতে জন্ম গ্রহণ করেন।  মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর পঞ্চম পুত্র ও সপ্তম সন্তান। এঁর মাতার নাম সারদাদেবী। ইনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর অগ্রজ। রবীন্দ্রনাথ এঁকে সম্বোধন করতেন 'নতুন দাদা'

পারিবারিক গুরুমহাশয়ের কাছে ইংরেজি, বাংলার হাতেখড়ি হয়। এরপর তিনি সেন্ট পলস বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এই স্কুল ছেড়ে দিয়ে পরে মন্টেগু একাডেমীতে। এই বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম অভিভাবকদের পছন্দ না হওয়ায়, তাঁকে ভর্তি করা হয় হিন্দু স্কুলে। পরে এই স্কুল থেকে এনে তাঁকে ভর্তি করা হয়, কেশবন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত কলকাতা কলেজ-এ। এই কলেজ থেকে ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ইনি দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এই বৎসরই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির থিয়েটারের জড়িয়ে পড়ার কারণে কলেজের পাঠ শেষ হয়ে যায়।

 

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মেজভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থলে আহমেদাবাদে যান এবং সেখানে সেতার এবং ফারসি ভাষা শেখা শুরু করেন।
১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আহমেদাবাদ থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। এই বৎসরে
হিন্দু মেলার দ্বিতীয় অধিবেশন হয়। নবগোপাল মিত্রের উৎসাহে, এই অধিবেশনের জন্য তিনি 'উদ্বোধন' নামে একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি পাঠ করেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বৎসরের ৫ জুলাই তারিখে ইনি শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা কাদম্বরী দেবীকে বিবাহ করেন।

১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের স
ম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত 'ব্রাহ্মধর্ম বোধিনীসভা'র প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক ছিলেন। বাংলা ভাষার সুচারু চর্চার জন্য এই বৎসরেই তিনি 'সারস্বত সমাজ' নামে একটি সঙ্ঘ গঠন করেন। ১৮৭৪-৭৫ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু মেলার 'সংশ্লিষ্ট সম্পাদক' পদে ছিলেন। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে 'ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাস থেকে ভারতী নামক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এই বৎসরই সঞ্জীবনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি তাঁর ভগ্নিপতি জানকীনাথ ঘোষালের সাথে পাটের আড়ত খোলেন। এরপর এই আড়ত বন্ধ রেখে তিনি কিছুদিন শিলাইদহে নীল চাষ শুরু করেন। কিন্তু নীলের বাজারে পতন শুরু হলে, তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মে তিনি জাহাজের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু বিদেশী কোম্পানীগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় তাঁর কোম্পানি মার খায়। ফলে, অচিরেই তাঁর এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এই বৎসরের ১৯শে এপ্রিল, তাঁরএঁর পত্নী 'কাদ
ম্বী দেবী' আত্মহত্যা করেন। এই বৎসরেই ইনি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদ থেকে অব্যহতি নেন। এরপর তিনি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে (শ্রাবণ ১৩০৪ বঙ্গাব্দ) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল সঙ্গীতবিষয়ক পত্রিকা বীণাবাদিনী। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো- কলকাতার বাদ্যন্ত্র বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান 'ডোয়ার্কিন এন্ড সন'। এদের ঠিকানা ছিল ২৬৭ নম্বর বহুবাজার স্ট্রিট, কলকাতা।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে 'ভারত সঙ্গীত সমাজ
'-এর মুখপত্র 'সঙ্গীত প্রকাশিকা' নামক পত্রিকাটি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আশ্বিন ১৩০৮ বঙ্গাব্দ (১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ)।
 

তিনি শেষ বয়সে নির্লিপ্তভাবে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। জীবনের শেষ দিনগুলি ইনি  রাচিতে কাটান। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২০ ফাল্গুন (১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মার্চ, ৭৫ বৎসর বয়স) তারিখেঁ ইনি সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন।

 

এঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি আকারমাত্রিক স্বরলিপি। বর্তমানে বাংলাগানের একমাত্র সবার গ্রহণযোগ্য স্বরলিপি হিসাবে, এই স্বররলিপি আদৃত। রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু গানে ইনি সুরারোপ করেছিলেন। ইনি পিয়ানোতে পারদর্শী ছিলেন। এক সময় ইনি পিয়ানোতে ঝড়ের মতো সুর তুলতেন- আর সেই সুরে রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী কথা বসিয়ে যেতেন। তবে রবীন্দ্রনাথের কত সংখ্যক গানে সুরারোপ করেছিলেন তা ঠিক জানা যায় না। এছাড়া ইনি বাংলা গানের প্রচারের উদ্দেশ্যে, ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন 'স্বরলিপি গ্রন্থমালা'। এতে মোট ১৬৮টি স্বরলিপি সম্বলিত গান স্থান পেয়েছিল। 

 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নাট্যকার, অনুবাদক হিসাবেও সেকালে যথেষ্ঠ সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ ছাড়াও বিবিধ ধরণের রচনায় ইনি বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ইনি মোট ১৫টি মৌলিক নাটক রচনা করেছিলেন। আর অনুবাদ করেছিলেন মোট ২১টি নাটক। নিচে তাঁর কৃত এ সকল সাহিত্যকর্মের একটি তালিকা দেওয়া হলো।
 

মৌলিক নাটক

১. কিঞ্চিত জলযোগ (প্রহসন) : ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দ

২. পুরুবিক্রম (নাটক) : ৯ জুলাই ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দ

৩. সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ (নাটক) : ৩০ নভেম্বর ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ

৪. এমন কম্ম আর ক'রব না (প্রহসন) : ৭ জুলাই ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পরে 'অলীকবাবু' নামে প্রকাশিত : ১৩ এপ্রিল ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ।

৫. অশ্রুমতী (নাটক) : ৪ নভেম্বর ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ

৬. মানময়ী (গীতি-নাটিকা)  : ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ । পরিবর্ধিত আকারে 'পুনর্বসন্ত' নামে প্রকাশিত : ১৪ মার্চ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ

৭. স্বপ্নময়ী (স্বপ্নময়ী) : ২৪ মার্চ ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ

৮. হিতে বিপরীত (কৌতুক-নাট্য) : ৭ মে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ

৯. পুনর্বসন্ত (গীতিনাট্য) : মানময়ী'র পরিবর্ধিত আকার। ১৪ মার্চ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ

১১. বসন্ত-লীলা (গীতিনাটিকা) : ২৯ মার্চ ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ

১২. ধ্যান-ভঙ্গ (গীতি-নাটিকা) : ১৫ এপ্রিল ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ

১৫. অলীকবাবু (নাটক) : এমন কম্ম আর ক'রব না (প্রহসন)-এর নূতন রূপ।

১৩. এপ্রিল ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ।


অনুদিত নাটক

ইংরেজি নাটক :

১. জুলিয়াস সীজার (নাটক)। শেক্সপিয়র। ২৮ অক্টোবর ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ।

 

ফরাসী নাটক :

১. হঠা নবাব (প্রহসন)। মোলিয়ের। ২৫ এপ্রিল ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দ।

২. দায়ে পড়ে' দার-গ্রহ (প্রহসন)। মোলিয়ের। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ।

 

বার্মীজ নাটক

১. রজত-গিরি (নাটক)। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ।

 

সংস্কৃত নাটক :

১. অভিজ্ঞান শকুন্তলা (নাটক) : কালিদাস। ১৮ অক্টোবর ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ।

২. উত্তর-চরিত (নাটক) : ভবভূতি। ৭ জুন ১৯০০।

৩. রত্নাবলী (নাটক) : শ্রীহর্ষদেব। ২৬ সেক্টেক্বর ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ।

৪. মালতী-মাধব (নাটক)। ভবভূতি। ২৯ সেক্টেক্বর ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ।

৫. মৃগচ্ছকটিকা (নাটক)। শূদ্রক। ৮ মার্চ ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

৬. মুদ্রারাক্ষস (নাটক)। বিশাখ দত্ত। ৪ জুন ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

৭. বিক্রমোর্বশী (নাটক)। ৪ জুন ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

৮. মালবিকাগ্নিমিত্র (নাটক)। কালিদাস। ১৫ জুন ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

৯. মহাবীর চরিত (নাটক)। ভবভূতি। ৮ অক্টোবর ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

১০. চণ্ডকৌশিক (নাটক)। ক্ষেমীশ্বর। ৪ ডিসেক্বর ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

১১. বেণীসংহার (নাটক)। ভট্টনারায়ণ। ১৪ ডিসেক্বর ১৯০১।

১২. প্রবোধ-চন্দ্রদয় (নাটক)। কৃষ্ণমিশ্র। ২৪ মার্চ ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ।

১৩. নাগানন্দ (নাটক)। শ্রীহর্ষদেব। ১ অগাষ্ট ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ।

১৪. বিদ্ধ-শালভঞ্জিকা (নাটক)। রাজশেখর। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ।

১৫. ধনঞ্জয়-বিজয় (নাটক)। কাঞ্চনাচার্য। ৩ মার্চ ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ।

১৬. কর্পূরমঞ্জরী (নাটক)। ২৩ এপ্রিল ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ।

১৭. প্রিয়দর্শিকা (নাটক)। শ্রীহর্ষদেব। ২৩ মে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ।


সূত্র :