শৈলজারঞ্জন মজুমদার

বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকার এবং রসায়নবিজ্ঞানের শিক্ষক।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই (৪ শ্রাবণ ১৩০৭ বঙ্গাব্দ) নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতার নাম রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার। মায়ের নাম সরলা সুন্দরী। তিনি ছিলেন পিতামাতার অষ্টম সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ।

 

শৈলজারঞ্জন মজুমদার-এর জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের এভাবেই আশীর্ব্বাণী

   জন্মদিন এল তব আজি,
   ভরি লয়ে সংগীতের সাজি
   বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিণীর রসায়নে
   পূর্ণ হল তোমার জীবনে।
   কর্মের ধারায় তব রসের প্রবাহ যেথা মেশে
   সেইখানে ভারতীর আশীর্ব্বাদ অমৃত বরষে।

৮-৯ বছর বয়সে পাঠশালায় পড়ার সময়, তিনি তাঁর ঠাকুরমার (প্রখ্যাত লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর পিসিমা) কাছে গান শেখেন। তারপর তিনি স্থানীয় শিল্পীদের কীর্তন, শ্যামাসংগীত, বাউল, ভাটিয়ালী, প্রভৃতি লোকসঙ্গীত শুনে শুনে কিছু কিছু গান আয়ত্ত করেন। উল্লেখ্য তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজে গান-বাজনা কিছুটা নিন্দনীয় বলে গণ্য হতো। এ কারণে গান শেখার ব্যাপারে তাঁর পরিবারে কিছুটা বাধা ছিল। তবে বাড়িতে গান শেখার ক্ষেত্রে আপত্তি না করলেও, অভিভাবকরা প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে গান গাওয়াকে পছন্দ করতেন না।

তাঁর রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন আইনজীবী। তাঁর কর্মস্থল ছিল নেত্রকোণা সদরে। এই সূত্রে রমণীকিশোরের বাসস্থান ছিল নেত্রকোণা শহরের সাতপাই (থানার পশ্চিমে) এলাকাতে। এই সময় তিনি নেত্রকোণার দত্ত হাই উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন এবং ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।

 

এরপর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার বিদ্যাসাগর আইএসসি পাশ করেন। এই সময় আত্মীয়তার সুবাদে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর কলকাতার বাড়িতে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। উল্লেখ্য সেখানে সঙ্গীতের  চর্চার ছিল। ওই বাড়িতেই ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথের (তখনকার ভাষায় রবিবাবুর) গান শোনেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের নিজ কণ্ঠে 'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার' গান এবং 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে' কবিতার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হন।

 

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতা থেকে নেত্রকোণায় এসে স্থানীয় শিল্পীদের রবীন্দ্রসঙ্গীতসহ অন্যান্য গান, কবিতা আবৃত্তি শেখান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নেত্রকোণায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রথম অনুষ্ঠান উদ্যাপন করেন। এ প্রসঙ্গে শৈলজারঞ্জন মজুমদার নিজেই বলেছেন "সমগ্র বাংলাদেশে এর আগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর কোনো অনুষ্ঠান হয়নি।"
 

কল্যাণীয়েষু,
তোমাদের নেত্রকোণায় আমার জন্মদিনের উৎসব যেমন পরিপূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হয়েছে এমন আর কোথাও হয়নি। পুরীতে আমাকে প্রত্যক্ষ সভায় (?) নিয়ে সম্মান করা হয়েছিল। কিন্তু নেত্রকোণায় আমার সৃষ্টির মধ্যে অপ্রত্যক্ষ আমাকে রূপ দিয়ে আমার স্মৃতির যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কবির পক্ষে সেই অভিনন্দন আরো অনেক বেশি সত্য। তুমি না থাকলে এই উপকরণ সংগ্রহ করত কে? এই উপলক্ষে বৎসরে বৎসরে তুমি আমার গানের অর্ঘ্য পৌঁছিয়ে দিচ্ছ তোমাদের পল্লীমন্দিরের ভোগমণ্ডপে এও কম কাজ হচ্ছে না।
আমার জন্মদিন প্রতিবৎসর তোমাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে উৎসব
আমাকে এনে দিচ্ছে ক্লান্তির ডালিতে নতুন বোঝা। এবার পাহাড়ে এখনো দেহমনে অবসাদ আসক্ত হয়ে আছে। পৃথিবী জুড়ে যে শনির সম্মার্জনী চলেছে বোধ হচ্ছে তার আঘাত এসে পড়বে আমার ভাগ্যে।
দেখা হলে নৃত্যকলা সম্বন্ধে মোকাবিলায় তোমার সঙ্গে আলাপ করব।
ইতি ২৫। ৫। ৩৯
তোমাদের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঝড়ের কারণে ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানটি দুই দিন পর অর্থাৎ ২৭ শে বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শৈলজারঞ্জন মজুমদারের তত্ত্বাবধানে নেত্রকোণায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের ধারাবাহিকতাটি বজায় ছিল।

 

আইএসসি পাশ করার পর, তিনি কলকাতার স্কটিশ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি (দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান) পাশ করেন। এরপর তিনি তাঁর পিতার ইচ্ছায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে আইন পাশ করেন।

 

এই সূত্রে তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সহযোগিতায় প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ শীতল মুখোপাধ্যায়ের কাছে এস্রাজ শেখার সুযোগ পান। এ সময়ে তিনি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন এবং তাঁর দলের সদস্য হিসেবে জোড়াসাঁকোয় 'পাগলাঝোরা' অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পান। এই অনুষ্ঠানের পরে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণের করতে সক্ষম হন এবং তাঁর কাছ থেকে তিনটি গান শেখার সৌভাগ্য জোটে। এই সময় তিনি কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রত্যেক রবিবারের আসরে যেতেন এবং এই সূত্রে তাঁর বহুবার রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠের গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।


১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিনিকেতনে রসায়নশাস্ত্রে অধ্যাপকরূপে যোগাদান করেন এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন। এই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছেও কিছু গান শেখেন। এইভাবে গান শেখার পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি করা শুরু করেন। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম স্বরলিপি তৈরি করেন। এই গানটি ছিল 'মম মন উপবনে'। এই স্বরলিপিটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী পত্রিকার কার্তিক ১৩৪১ সংখ্যায়।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ছোটদের গান শেখানোর দায়িত্ব দেন।  এই বৎসরে ইনি 'রবীন্দ্র পরিচয় সভা'র গীতোৎসব-শরৎ পর্ব' অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। পরবর্তী চার বছর তিনি শান্তিনিকেতনের অন্যতম সঙ্গীত শিক্ষক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।


১৯৩৬ সালে ইনি নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার স্বরলিপি তৈরি ও প্রকাশ করেন।
১৯৩৮ সালে ইনি নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার সাতটি গান ছাড়া- সকল গানের স্বরলিপি তৈরি করেন।
১৯৩৯ সালে ইনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন।
১৯৪১ ইনি কলিকাতার 'গীতবিতান' শিক্ষায়তনের সূত্রপাতে প্রেরণা সঞ্চার করেন। এই বৎসরে 'বিসর্জন'-এর স্বরলিপি রচনা ও প্রকাশ করেন।
১৯৪৪ সালে যুবরাজ করুণসিংহের আমন্ত্রণে, কাশ্মীরে 'চিত্রাঙ্গদা' ও 'ভানুসিংহের পাদবলীর'র দল নিয়ে যান। রেঙ্গুনে 'টেগোর সোসাইটি'র আমন্ত্রণে ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার) রবীন্দ্রগীতি ও নৃত্যনাট্যের চর্চার ব্যবস্থা করেন।
১৯৫৭ সালে স্বরবিতান ত্রিপঞ্চাশত্তম এবং পঞ্চপঞ্চাশত্তম খণ্ডের স্বরলিপি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। এই বৎসরে ইনি কলিকাতায় 'সুরঙ্গমা' সঙ্গীত বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫৯ সালে 'বিশ্বভারতী'র সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পুনর্নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
১৯৬০ সালে 'বিশ্বভারতী'র সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেন এবং কলিকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন।
১৯৬১ সালে স্বরবিতান অষ্টপঞ্চাশত্তম স্বরলিপি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
১৯৬৪ সালে স্বরবিতান ঊনষষ্টিত্তম স্বরলিপি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
১৯৭১ সালে স্বরবিতান ষষ্টিত্তম স্বরলিপি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
১৯৭৪ প্রাক্তনী সুরঙ্গমার উদ্যোগে সম্বর্ধনা ও প্রভূত সম্মাননা লাভ করেন।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে আসেন এবং বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। এই সময় তাঁর সাথে ছায়ানট-এর প্রত্যক্ষ সখ্য গড়ে উঠে। তিনি ছায়ানটে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে সঙ্গীত শিক্ষা দান করেন এবং সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
 

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্বভারতী থেকে 'দেশিকোত্তম' সম্মাননা পান।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে-তে তিনি পরলোকগমন করেন।

তাঁর এই সুদীর্ঘ জীবনে বহু ছাত্রছাত্রীকে সঙ্গীতে শিক্ষা দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, অরুন্ধতী দেবী। ইনি বিভিন্ন সময়ে বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রভারতী, রাঁচি, ভাগলপুর, পাটনা, বর্ধমান প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ পরীক্ষকরূপে গেছেন। গ্রামোফোন রেকর্ড এবং সিনেমায় গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুমোদনকার্যের সাথে প্রথমদিকে সংযুক্ত ছিলেন।

 

শৈলজারঞ্জন মজুমদার রবীন্দ্রনাথের যে সকল গানের স্বরলিপি করেছিলেন, তার তালিকা

শৈলজারঞ্জন মজুমদার-কৃত সংশোধিত স্বরলিপি

শৈলজারঞ্জন মজুমদার-কৃত নৃত্যনাট্যের স্বরলিপি

শৈলজারঞ্জন মজুমদার সম্পাদিত স্বরবিতানের তালিকা

স্বরবিতানের যে সকল খণ্ড প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সহায়তা করেছিলেন।



সূত্র :
দৈনিক জনকণ্ঠ, ৪ মে ২০১২