ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
১৭১২ – ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি ও গীতিকার এবং মঙ্গলকাব্যের শেষ কবি।

১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার পেঁড়ো-বসন্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র। এঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং উপাধি ছিল মুখোপাধ্যায়। জমিদারি লাভের পর নরেন্দ্রনারায়ণ রায় পদবী ধারণ করেছিলেন। ভারতচন্দ্রের শৈশবকালে নরেন্দ্রনারায়ণের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হলে, তিনি শ্বশুড়বাড়ি মণ্ডলঘাট পরগণার নওয়াপাড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই কারণে ভারতচন্দ্রের শৈশব কেটেছে মাতুলালয়ে। এখানে থাকার সময়ে তিনি তাজপুর গ্রামের টোলে ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠ করেন।

১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে নরোত্তম আচার্যের কন্যা সারদা দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। এই সময় অভিজাত অধিকাংশ পরিবারগুলো ফারসি শিখতেন। ভারতচন্দ্র টোলে লেখাপড়ার কারণে ফারসি জানতেন না। পরে তাঁর বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় তিনি  বাঁশবেড়িয়ার পশ্চিম দেবানন্দপুর গ্রামের রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে ফারসি ভাষা শেখেন। এই সময়ে রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ তাঁর জমিদারি ফিরে পেয়ে নিজ জমিদারিতে ফিরে গেলেও, তিনি মাতুলালয়েই থেকে যান।

১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দেবানন্দপুর গ্রামের রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে থাকার সময়, একদিন তাঁর উপর 'সত্যনারায়ণ' পাঠের ভার পড়ে। তিনি প্রচলিত পুঁথি পাঠ না করে, তাঁর নিজের রচিত  'সত্যনারায়ণ' কাব্য পাঠ করেন। এই সূত্রে তিনি কবি হিসেবে স্থানীয়দের কাছে প্রশংসিত হন।

দেবানন্দপুরের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পিত্রালয়ে ফিরে আসেন। এই সময় খাজনা বাকি পড়ায় বরধমানের রাজা নরেন্দ্রনারায়ণকে নানাভাবে নিগৃহীত করেন। রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারতচন্দ্র বর্ধমান রাজদরবারে গেলে, রাজা কোনো কথা না শুনে জমিদারি ইজারা বিলুপ্ত করেন এবং ভারতচন্দ্রকে কারাগারে পাঠান। ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে কারারক্ষকের দয়ায় তিনি গোপনে মারহাট্টা শাসিত কটকে পালিয়ে সুবেদার শিবভট্টর কাছে আশ্রয় লাভ করেন। এখানে তিনি বেশ কিছুদিন সন্ন্যাসীর বেশ ধরে কাটান। এরপর ভারতচন্দ্রের ভায়রা ভাই তাঁকে শ্বশুড়বাড়িতে নিয়ে আসেন।  এই সময় ফরাসডাঙার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। একদিন নবদ্বীপের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ফরাসডাঙায় এলে, ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মহারাজের সাথে ভারতচন্দ্রের পরিচয় করিয়ে দেন। কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রের কাব্য শুনে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে চল্লিশ টাকা বেতন সভাসদের সদ্স্য করে নেন। এই সূত্রে তিনি কৃষ্ণনগরে বাস করতে থাকেন। এই সময় কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি 'অন্নদামঙ্গল' এবং 'বিদ্যাসুন্দর' রচনা করেন।

এরপর কৃষ্ণচন্দ্র বার্ষিক ছয় শত টাকায় চব্বিশ পরগণার মুলাজোড়া গ্রাম ইজারা দেন। এছাড়া উক্ত গ্রামের গঙ্গাতীরে একটি বাড়ি তৈরির জন্য রাজা তাঁকে ১০০ টাকা দান করেন। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর ছেড়ে সপরিবারে মুলাজোড়া গ্রামে বাস করতে থাকেন। এর কিছুদিন পরে তাঁর পিতা ভারতচন্দ্রের কাছে এসে বাস করতে থাকেন। এই গ্রামে অবস্থানকালে তিনি 'রসমঞ্জরী' কাব্যসহ আরও কিছু কবিতা রচনা করেন।

এর কিছুদিন পর, বর্ধমানের মহারাণী বামদেব নাগের নামে, কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে বামদেবের নামে মূলাজোড়া কিনেন নেন। বামদেব নানাভাবে ভারতচন্দ্রের উপর অত্যাচার করতে থাকলে, পরম দুঃখে 'নাগাষ্টক' কবিতা রচনা করেন। এই কবিতা পাঠ করার পর, কৃষ্ণচন্দ্র ব্যথিত হন এবং তা বর্ধমানের মহারাণীর কাছে পাঠান। 'নাগাষ্টক' পাঠ করে মহারাণী ভারতচন্দ্রের উপর অত্যাচার বন্ধ করার আদেশ দেন।

 ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বহুমূত্র রোগে মৃত্যুবরণ করেন।

[ভারতচন্দ্র রায়ের গানের তালিকা]


সূত্র :
বাঙালির গান। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত। এপ্রিল ২০১।