যতীন্দ্রনাথ দাস
১৯০৪-১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ
ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি বিপ্লবী।

৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবর কলকাতার শিকদার বাগানে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বঙ্কিমবিহারী দাস, মায়ের নাম সুহাসিনী দেবী। ডাক নাম খেঁদু।

১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাতৃহারা হন। এই সময় যতীন এবং তাঁর ছোট ভাই কিরণ পিতার তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে ওঠেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ভবানীপুর মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে এই সময় তিনি  মহাত্মা গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সংক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই সময় তিনি অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত হন।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ভবানীপুরের গিরীশ মুখার্জী রোডের একটি বাড়িতে থাকাকালিন যতীন সুবার্বান রোডের জনৈক দেবেন বোসের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত  শুরু করেন। এখানেই তিনি পরিচিত হন রাসবিহারী বসুর শিষ্য ও সহকর্মী বিপ্লবী নেতা শচীন্দ্রচন্দ্র সান্যালের সঙ্গে। পরে শচীন্দ্রচন্দ্রের হিন্দুস্থান রিপাব্লিক্যান এ্যাসোসিয়েশনে (
Hindustan Republican Association , সংক্ষেপে H.R.A.) যোগদান করেন। পরে এই দলের বৈপ্লবিক সংগঠন কার্যের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় তিনি উন্নতর হাত বোমা তৈরি করার কৌশল রপ্ত করেছিলেন । তিনি নিজে বোমা তৈরি করতেন এবং কিছু সহযোদ্ধাকে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস কমিটির সদস্য হন। এই সময় তিনি উত্তর বঙ্গে প্রবল বন্যা হলে, তিনি নেতাজি সুভাষ বসুর সহযোগী হয়ে বন্যর্তদের সাহায্য করেন।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২শে অক্টোবর বেঙ্গল অর্ডিনেন্স জারি হয় এবং নির্বিচারে সন্দেহভাজন গ্রেফতার শুরু হয়। এরই ভিতরে দলের অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কাকোরি রেলস্টেশনের কাছে বিপ্লবীরা দলবল নিয়ে ট্রে ডাকাতি করেন। এই ডাকাতিতে ব্রেকভ্যানের লোহার সিন্দুক ভেঙে প্রায় চার হাজার টাকা ডাকাতি করেছিলেন। এই ডাকাতির জন্য অস্ত্রের যোগান দিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। তখন তাঁর ছদ্মনাম ছিল কালিবাবু। এর কিছুদিন পর, বেঙ্গল অর্ডিনেন্সের আওতায় তাঁকে গ্রেফতার করে
মেদিনীপুর জেলের কুখ্যাত ৪৪ নং সেলে জানালাবিহীন ঘরে রাখা হয়। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে,  ১৯২৬ সালের ২৮শে মে তাঁকে আলিপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। ঐ বছরের অগস্ট মাসে তাঁকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠানো হয়। জেল কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারে যতীনদাস  ও পান্নালাল মুখার্জী অনশন শুরু করেছিলেন এবং ২২ দিন অনশনের পর গোয়েন্দা বিভাগের ডি.আই.জি. লেম্যানের হস্তক্ষেপে তাঁরা অনশন ভঙ্গ করেন। এরপর তাঁকে পাঞ্জাবের দুর্গম সিয়ানওয়ালি জেলে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। অবশেষে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।


১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এই বছরের অক্টোবরে পাঞ্জবে সাইমন কমিশান আসে। এই কমিশনান ৩০শে অক্টোবর লাহোরে পৌঁছালে লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে এক বিরাট প্রতিবাদী মিছিল যাত্রা স্টেশান অবরোধ করে এবং শ্লোগান দেয়- ধ্বনি তুললো ‘গো ব্যাক সাইমন’। সে সময়ে পাঞ্জাবের পুলিশ প্রধান স্কট এবং তার সহকারী স্যন্ডর্সকে নিয়ে পুলিশকে দিয়ে ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এতে আহত হন এবং তিনি ১৭ই নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। এর প্রতিশোধ নেবার শপথ গ্রহণ করেন ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ ও তাঁর অনুগত তরুণ পাঞ্জাবী বিপ্লবীরা। ১৭ই ডিসেম্বর লাহোরের প্রধান সড়কে ভগত সিং ও রাজগুরু দয়ানন্দ বৈদিক মহাবিদ্যালয়ের সামনে স্যন্ডর্সকে গুলি করে হত্যা করেন। স্যন্ডর্স এর হেড কন্সটেবল চন্দন সিং স্যন্ডর্সকে সাহায্যার্থে এগিয়ে এলে চন্দ্রশেখর আজাদ তাকে গুলি করে ভূপাতিত করেন। এরপর এঁরা প্রচুর ইস্তেহার ছড়িয়ে বিপ্লবীরা লাহোর ত্যাগ করেন। ভগত সিং কলকাতয় এসে যতীনদাসের সঙ্গে দেখা করে বিপ্লবীদের জন্য বোমা তৈরীর কাজে সাহায্য করতে অনুরোধ করলে তিনি যতীনদাস রাজি হন।

ভগত সিং এর অনুরোধে যতীন্দ্রনাথ বোমা তৈরির কোশল শেখানোর জন্য আগ্রা যান। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে গোপনে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ ব্যবহার শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং  ঝাঁসির জঙ্গলে বোমা পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল, দিল্লীতে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেসন বসেছে। কংগ্রেসী আসনে মতিলাল নেহেরু, মদনমোহন মালব্য যেমন আছে, তেমনি সভায় উপস্থিত রয়েছেন কুখ্যাত লর্ড সাইমন। সভায় Trade Dispute Bill এবং Public Safety Bill পাশ করানো হচ্ছিল। সেই সময়েই অধিবেসন কক্ষে একটা বোমা ফাটানো হয়েছিল। ভগত সিং এবং বাংলার বটুকেশ্বর দত্ত তাঁদের হাতের রিভলবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘আমরা কাউকে হত্যা করতে আসিনি। বিপ্লবের পথ আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু আজ আমরা শুধু প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। অত্যাচারী গভর্নমেন্টের জন স্বার্থ বিরোধী কাজের প্রতিবাদ।’ ইচ্ছে করেই ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ধরা দিলেন। পরে এই দুইজনের জিজ্ঞাসবাদ করে, বিপ্লবীদের বহু গোপন সংবাদ জানতে পারেন এবং পুলিশ পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বাংলা ও বিহার জড়িয়ে এক আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্রের সূত্র আবিষ্কার করলো। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের নামের তালিকায় ছিলেন – ভগত সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, শুকদেব, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, যতীনদাস, ভগবতীচরণ ভোরা, শিব বর্মা, জিতেন স্যান্যাল, ফনী ঘোষ, ললিত মুখার্জী, জয়গোপাল সহ মোট ত্রিশ জন। এর ভিতরে ফণীঘোষ, ললিত মুখার্জী ও জয় গোপাল রাজসাক্ষী হয়ে যায়।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুন  যতীন্দ্রনাথকে কলকাতার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তাঁকে আনা হয় লাহোর পুলিশ ফাঁড়িতে, পরে তাঁকে লাহোর জেলে পাঠানো হয়। ১৩ জুলাই থেকে ভগৎসিং ও বটুকেশ্বর দত্তের সমর্থনে তিনি অনশন শুরু করেন। ৬৩ দিন অনশনের পর তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।