ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ | জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচি


ঝরা-পালক


একদিন খুঁজেছিনু যারে-
 

        একদিন খুঁজেছিনু যারে

বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি আঁধারে,

        মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,

        নিঝুম ঘুমের ঘাটে,- কেয়াফুল,- শেফালির দলে !

-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে-মাঠে শরতের ভোরে

হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরো-ঝরো

                    কামিনীর ব্যথার শিয়রে,

যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে!

           আর্ত কোলাহলে

তুলিয়াছি দিকে-দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়,-

           আজ মনে হয়

পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা !

         -শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,

        শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা

দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া !

মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর

                                   শোনে নাই কেউ,

গাগরীর কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের

                            গাঙিনীর ঢেউ !

নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকা পথে চুপে-চুপে

                            ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি !

         মনে হ্য় শুধু আমি, -আর শুধু তুমি

         আর ওই আকাশের পউষ-নীরবতা

রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে-কানে কতো কাল

        কহিয়াছি আধো-আধো কথা ।

  -আজ বুঝি ভুলে গেছো প্রিয়া !

  পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের- হিয়া

একদিন ছিলো তব গোধূলির সহচর,- ভুলে গেছো তুমি !

         এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি

আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,- শুধু অবসাদ !

                   মহুয়ার,-ধুতুরার স্বাদ

        জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা-ফোঁটা ধরি

দুরন্ত শোণিতে বার-বার নিয়েছে যে ভরি !

মসজেদ-সরাই-শরাব

ফুরায় না তৃষা মোর,- জুড়ায় না কলেজার তাপ !

দিকে-দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ,- আলেয়ার শিখা !

       পদে-পদে নাচে ফণা,-

                          পথে-পথে কালো যবনিকা !

       কাতর ক্রন্দন,-

       কামনার কবর-বন্ধন !

কাফনের অভিযান,- অঙ্গার-সমাধি !

         মৃত্যুর সুমেরু অন্ধকারে বার-বার উঠিতেছে কাঁদি !

মর্‌মর্ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন,-

        আধো আঁধারের দেশে

        বার-বার আসে ভেসে

        কার সুর !-

কোন্ সুদূরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর

                                কেঁদে মরে মন !       

                                                                       

               আলেয়া

         প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া

নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া !

-হেথা, গৃহ-বাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা,

ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা

        চুপে-চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি !

আকাশের বুকে-বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী

        ডুবে যায় ধীরে-ধীরে আঁধার-সাগরে !

ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের ’পরে

        নিশি নেমে আসে গাঢ়,- স্বপন-সঙ্কুল !

        শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল

        বনমরালীর সাথে ঘুমায়েছে কবে !

        বেণুবনশাখে কোন্ পেচকের রবে

                 চমকিছে নিরালা যামিনী !

        পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগ-কামিনী

আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায় !

                  শ্মশান-শয্যায়

      নেভ-নেভ কোন্ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে

      ক্ষুধিত আঁধার আসি জমিতেছে ধীরে !

      নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুটি মুদে

                       স্বপ্নের বুদ্বুদে

বিলসিছে যবে ক্লান্ত ঘুমন্তের দল-

           হে অনল,-উন্মুখ, চঞ্চল

           উন্নমিত আঁখিদুটি মেলি

                     সন্তরি চলিছো তুমি রাত্রির কুহেলি

            কোন্ দূর কামনার পানে !

                   ঝলমল দিবা-অবসানে

            বধির আঁধারে

                     কান্তারের দ্বারে

            এ কি তব মৌন নিবেদন !

            -দিকভ্রান্ত,-দরদী,-উন্মন !

পল্লীপসারিনী যবে পুণ্যরত্ন হেঁকে গেছে চ’লে

         তোমার পিঙ্গল আঁখি ওঠেনি তো জ্ব’লে

আকাঙ্ক্ষার উলঙ্গ উল্লাসে !

         -জনতায়,-নগরীর তোরণের পাশে,

অন্তঃপুরিকার বুকে,- মণিসৌধ-সোপানের তীরে,

মরকত-ইন্দ্রনীল-অয়ষ্কান্ত-খনির তিমিরে

যাওনি তো কভু তুমি পাথেয়-সন্ধানে !

ভাঙ্গা-হাটে- ভিজা মাঠে- মরণের পানে

                শীত প্রেতপুরে

একা-একা মরিতেছো ঘুরে

         না জানি কি পিপাসার ক্ষোভে !

আমাদের ব্যর্থতায়,- আমাদের সকাতর কামনায় লোভে

         মাগিতে আসোনি তুমি নিমেষের ঠাঁই !

-অন্ধকার জলাভূমি,- কঙ্কালের ছাই,

        পল্লীকান্তারের ছায়া,- তেপান্তর পথের বিস্ময়

                 নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময়

        করিয়াছে বিমনা তোমারে !

                 রাত্রি-পারাবারে

        ফিরিতেছো বারম্বার একাকী বিচরি !

                 হেমন্তের হিম পথ ধরি,

        পউষ-আকাশতলে দহি-দহি-দহি

                 -ছুটিতেছো বিহ্বল বিরহী

        কতো শত যুগজন্ম বহি !

                 কারে কবে বেসেছিলে ভালো

                 হে ফকির,- আলেয়ার আলো !

কোন্ দূর অস্তমিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া

         চিত্তে তব জাগিতেছে কবেকার প্রিয়া !

সে কোন্ রাত্রির হিমে হ’য়ে গেছে হারা !

নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু,-

                  আঁধার-সাহারা !

আজো তব লোহিত-কপোলে

চুম্বন-শোণিমা তার উঠিতছে জ্ব’লে

                 অনল-ব্যথায় !

-চ’লে যায়-মিলনের লগ্ন চ’লে যায় !

দিকে-দিকে ধূমবাহু যায় তব ছুটি

অন্ধকারে লুটি-লুটি-লুটি !

ছলাময় প্রেতবধূদের পিছে

ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার

                          অগ্নি-অভিসার !

বহ্নি-ফেনা নিঙারিয়া পাত্র ভরি-ভরি,

       অনন্ত অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পাণ্ডুলিপি গড়ি,

উষার বাতাস ভুলি,- পলাতকা রাত্রির পিছনে

যুগ-যুগ ছুটিতেছো কার অন্বেষণে !

 

                   অস্তচাঁদে

ভালোবাসিয়াছিলাম আমি অস্তচাঁদ, —ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!

অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী, ঢেউয়ের কলসী,

                       নিঝঝুম বিছানার ’পরে

মেঘ-বৌ’র খোঁপাখসা জোৎস্নাফুল চুপে-চুপে ঝরে,—

চেয়ে থাকি চোখ তুলে যেন মোর পলাতকা প্রিয়া

মেঘের ঘোমটা তুলে প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!

সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে-ফিরে-ফিরে

মাঠে-ঘাটে একা-একা, —বুনোহাঁস জোনাকির ভিড়ে!

দুশ্চর দেউলে কোন্ কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,

দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,

কোথা পিরামিডতলে, —ঈসিসের বেদিকার মূলে,

কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,

কোন্ মন-ভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর সনে

আমারে দেখেছে জোৎস্না, চোর চোখে অলস নয়নে!

 

আমারে দেখেছে সে যে আসীরীয় সম্রাটের বেশে

প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে,

হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি

কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!

ভোরগেলাসের সুরা, তহুরা, করেছি মোরা চুপে চুপে পান,

চকোরজুড়ির মতো কুহুরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!

পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,

নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!

নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে-পুরে, ঘুমের রাজবধূ

চুরি ক’রে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!

সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া

কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া

লভেছিনু উল্লাস,উতরোল!আজ পড়ে মনে

সাধ-বিষাদের খেদ কতো জন্মজন্মান্তের, —রাতের নির্জনে!

 

আমি ছিনু ‘ক্রবেদুর্’ কোন্ দূর ‘প্রভেনস্’-প্রান্তরে!

দেউলিয়া পায়দল্, অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে

সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!

আঙুরলতায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি

ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;

মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!

‘অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুনচোখে চেয়েছিল চাঁদ,

মিলননিশার শেষে বৃশ্চিক, —গোক্ষুরাফণা, —বিষের বিস্বাদ!

 

স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু অশ্বারোহী,

নির্মম-কৃতান্ত-কাল, তবু কী যে কাতর, —বিরহী!

কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!

অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!

তখন রতনশেজে গিয়েছিলো নিভে মধুরাতি,

নীল জানালার পাশে ভাঙা হাটে চাঁদের বেসাতি

চুপে-চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!

ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে

কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!

কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ আলোর মোহানা!

 

বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,

গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!

‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রপালি রাতে

কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!

অপরাজিতার ঝাড়ে নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!

মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিলো তারে খুঁজি!

তারি লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,

তাহারি লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু, ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!

তাহারি নধর অধর নিঙাড়ি উথলিলো বুকে মধু,

জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!

মনে পড়ে কি তা! চাঁদ জানে যাহা, —জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,

বুকের আগুনে খুন চড়ে মুখ চুন হ’য়ে যায় একেলা বসি!