ভিতর ও বাহির

ভিতরের শক্তি তো স্বেচ্ছা! তবে জীবনের কোন্ স্তরে এই শক্তির উদ্ভব হইয়াছে? শুষ্ক তৃণ জল-স্রোতে ভাসিয়া যায়। কিন্তু জীব কেবল বাহিরের প্রবাহ দ্বারাই পরিচালিত হয় না, বরং ঢেউয়ের আঘাতে উত্তেজিত হইয়া স্রোতের বিরুদ্ধে সন্তরণ করে। কোন্‌ স্তরে তবে এই যুঝিবার শক্তি জাগিয়া উঠিয়াছে? ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র জীব-বিন্দু কখনও বাহিরের শক্তি গ্রহণ করে, কখনও ভিতরের শক্তি দিয়া প্রতিহার করে। গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান করিবার ক্ষমতাই তো ইচ্ছা-শক্তি।
    আর ভিতরের শক্তিই বা কিরূপে উদ্ভৃত হইয়াছে? বাহিরের ও ভিতরের শক্তি কি একেবারেই বিভিন্ন? পূর্বে বলিয়াছি যে, বনচাঁড়ালের পাতা দুইটি ভিতরের শক্তিবলে আপনা-আপনিই নড়িতে থাকে। কিন্তু গাছটিকে দুই দিন অন্ধকারে রাখিয়া দেখিলাম যে, পাতা দুইটি একেবারেই নিশ্চল হইয়া গিয়াছে। ইহার কারণ এই যে, ভিতরের শক্তি যাহা সঞ্চিত ছিল তাহা এখন ফুরাইয়া গিয়াছে। এখন পাতা দুইটির উপর ক্ষণিকের জন্য আলো নিক্ষেপ করিলে দেখা যায় যে, পাতা নড়িয়া সাড়া দিতেছে; কিন্তু আলো বন্ধ করিলেই পাতার স্পন্দন থামিয়া যায়। ইহার পর অধিক কাল আলোক নিক্ষেপ করিলে এক অত্যদ্ভুত ঘটনা দেখা যায়। এবার আলো বন্ধ করিবার পরেও পাতা দুইটি বহুক্ষণ ধরিয়া যেন স্বেচ্ছায় নড়িতে থাকে। ইহা অপেক্ষা বিস্ময়কর ঘটনা আর কি হইতে পারে? দেখা যায়, আলোরূপে যাহা বাহিরের শক্তি ছিল, গাছ তাহা গ্রহণ করিয়া নিজস্ব করিয়া লইয়াছে এবং বাহির হইতে সঞ্চিত শক্তি এখন ভিতরের শক্তির রূপ ধারণ করিয়াছে। সুতরাং বাহিরের ও ভিতরের শক্তি প্রকৃতপক্ষে একই; সামান্য বিভিন্নতা এই যে, যাহা পর্দার ওপারে ছিল তাহা এ-পারে আসিয়াছে; যাহা পর ছিল তাহা আপন হইয়াছে। আরও দেখা যায় যে, এইরূপ স্বতঃস্পন্দিত অবস্থায় পাতাটি বাহিরের আঘাতে বিচলিত হয় না। সে এখন বাহিরের শক্তি-নিরপেক্ষ, অর্থাৎ ভিতরের শক্তি দিয়া বাহিরের শক্তি প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হইয়াছে। যখন ভিতরের সঞ্চয় ফুরাইবে কেবল তখনই গ্রহণ করিবে এবং পরে স্বেচ্ছাক্রমে প্রত্যাখ্যান করিবে। জীবনের কোন্ স্তরে তবে ভিতরের শক্তি ও স্বেচ্ছা উদ্ভুত হইয়াছে?
    জন্মিবার সময় ক্ষুদ্র ও অসহায় হইয়া এই শক্তিসাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলাম। তখন বাহিরের শক্তি ভিতরে প্রবেশ করিয়া আমার শরীর লালিত ও বর্ধিত করিয়াছে। মাতৃস্তন্যের সহিত স্নেহ মায়া মমতা অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে এবং বন্ধুজনের প্রেমের দ্বারা জীবন উৎফুল্ল হইয়াছে। দুর্দিন ও বাহিরের আঘাতের ফলে ভিতরে শক্তি সঞ্চিত হইয়াছে এবং তাহারই বলে বাহিরের সহিত যুঝিতে সক্ষম হইয়াছি।
    ইহার মধ্যে আমার নিজস্ব কোথায়? এই সবের মূলে আমি না তুমি?
    একের জীবনের উচ্ছ্বাসে তুমি অন্য জীবন পূর্ণ করিয়াছ; অনেকে তোমারই নির্দেশে জ্ঞান-সন্ধানার্থে জীবনপাত করিয়াছে, মানবের কল্যাণহেতু রাজ্যে-সম্পদ ত্যাগ করিয়া দুঃখ-দারিদ্য বরণ করিয়াছে এবং দেশসেবায় অকাতরে বধ্যমঞ্চে আরোহণ করিয়াছে। সেই সব জীবনের বিক্ষিপ্ত শক্তি অন্য জীবন জ্ঞান ও ধর্মে, শৌর্য ও বীর্যে পরিপূরিত করিয়াছে। ভিতর ও বাহিরের শক্তি-সংগ্রামেই জীবন বিবিধরূপে পরিস্ফুটিত হইতেছে। উভয়ের মূলে একই মহাশক্তি, যদ্‌দ্বারা অজীব ও সজীব, অণু ও ব্রহ্মাণ্ড অনুপ্রাণিত। সেই শক্তির উচ্ছ্বাসেই জীবনের অভিব্যক্তি। সেই শক্তিতেই মানব দানবত্ব পরিহার করিয়া দেবত্বে উন্নীত হইবে।


হাজির

হঠাৎ চীৎকার করিয়া কেহ উত্তর দিল-‘হাজির’! কাহাকেও ডাকিতে শুনি নাই, তথাপি অতি করুণ ও ভক্তি-উচ্ছ্বসিত স্বরে উত্তর শুনিলাম- ‘কি আজ্ঞা প্রভু?’ কে তোমার প্রভু, কাহার হুকুমে এরূপ উদ্দীপ্ত হইলে?
    কি আশ্চর্য! একটি কথাতেই জীবনের সমস্ত স্তরগুলি আলোড়িত হইল। সুপ্তস্মৃতি আজ জাগরিত- যাহা অশব্দ, আজ তাহা শব্দায়মান; যাহা বুদ্ধির অগম্য ছিল, আজ তাহা অর্থযুক্ত হইল। এখন বুঝিতে পারিতেছি, বাহির ছাড়া ভিতর হইতেও হুকুম আসিয়া থাকে। মনে করিতাম, আমার ইচ্ছাতেই সব হইয়াছে। আমি কি এক? একটু মন স্থির করিলেই দুই এর মধ্যে যে সর্বদা কথা চলিতেছে তাহা শুনিতে পাই। ইহারাই আমাকে চালাইতেছে। ইহাদের মধ্যে কুমতি তো আমি, সুমতি তবে কে?
এ সম্বন্ধে ২৭ বৎসর পূর্বের কয়েকটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। কোনোদিনও লিখিতে শিখি নাই, কিন্তু ভিতর হইতে কে আমাকে লিখাইতে আরম্ভ করিল। তাহারই অজ্ঞাতে ‘আকাশ-স্পন্দন ও অদৃশ্য আলোক’ বিষয়ে লিখিলাম। পরে লিখাইল, ‘উদ্ভিদ-জীবন মানবীয় জীবনেরই ছায়া মাত্র’ জীবন সম্বন্ধে বেশী কিছুই জানিতাম না। কাহার আদেশে এরূপ লিখিলাম? লিখিয়াও নিষ্কৃতি পাইলাম না; ভিতর হইতে কে সমালোচক সাজিয়া বলিতে লাগিল-‘এত যে কথা রচনা করিলে, পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছ কি- ইহার কোনটা সত্য, কোন‌্‌টা মিথ্যা?’ জবাব দিলাম, ‘যেসব বিষয় অনুসন্ধান করিতে গিয়া বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা পরাস্ত হইয়াছেন, আমি সে সব কি করিয়া নির্ণয় করিব? তাহাদের অসংখ্য কল-কারখানা ও পরীক্ষাগার আছে, এখানে তাহার কিছুই নাই; অসম্ভবকে কি করিয়া সম্ভব করিব? ইহাতেও সমালোচকদের কথা থামিল না। অগত্যা ছুতার কামার দিয়া তিন মাসের মধ্যে একটা কল প্রস্তুত করিলাম। তাহা দিয়া যেসব অদ্ভুত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইল তাহা আমার কথা দূরে থাকুক, বিদেশী বৈজ্ঞানিকদিগকে পর্যন্ত বিস্মিত করিল।
    অল্পদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে অনেক সুখ্যাতি হইল এবং বিলাতের সংবর্ধনাসভায় নিমন্ত্রিত হইলাম। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক উইলিয়াম রাম্‌সে বহু সাধুবাদ করিলেন; পরে বলিলেন, “কাহারও কাহারও মনে হইতে পারে যে, এখন হইতে ভারতে নূতন জ্ঞান-যুগ আরম্ভ হইল; কিন্তু একটি কোকিলের ধ্বনিতে বসন্তের আগমন মনে করা যুক্তিসংগত নহে।’ সেদিন বোধ হয় আমার উপর কুমতিরই প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকিবে, কারণ স্পর্ধার সহিতই উত্তর দিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, আপনাদের আশঙ্কা করিবার কোনো কারণ নাই, আমি নিশ্চয়ই বলিতেছি, শীঘ্রই ভারতের বিজ্ঞানক্ষেত্রে শত কোকিল বসন্তের আবির্ভাব ঘোষণা করিবে। এখন সেদিন আসিয়াছে; যাহা কুমতি বলিয়া ভয় করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি তাহাই সুমতি। তখনকার শুভলগ্ন পাঁচ বৎসর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। একদিনের পর আর-একদিন অধিকতর উজ্জ্বল হইতে লাগিল এবং সম্মুখের সমস্ত পথগুলিই খুলিয়া গেল।
    এমন সময় যে হুকুম আসিল তাহাতে সোজা পথ ছাড়িয়া দুর্গম অনির্দিষ্ট পথ গ্রহণ করিতে হইল। তখন তারহীন যন্ত্র লইয়া পরীক্ষা করিতেছিলাম। দেখিতে পাইয়াছিলাম, কলের সাড়া প্রথম প্রথম বৃহৎ হইত, তাহার পর ক্ষীণ হইয়া লুপ্ত হইয়া যাইত। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে লিখিয়াছিলাম, দিবারন্তেই পরীক্ষণ শ্রেয়ঃ; কারণ সারাদিন পরীক্ষার পর কল ক্লান্ত হইয়া যায়। অমনি ভিতরকার সমালোচক বলিয়া উঠিল-‘কল কি মানুষ, যে ক্লান্ত হইবে?’
    কলে কেন ক্লান্তি হয়? এই প্রশ্ন কিছুতেই এড়াইতে পারিলাম না। অনেকগুলি আবিষ্কার কেবল লিখিবার অপেক্ষায় ছিল। সে সব ছাড়িয়া দিয়া নূতন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করিতে হইল। ক্রমে দেখিতে পাইলাম, জীবনহীন ধাতুও উত্তেজিত এবং অবসাদগ্রস্ত হয়। উত্তেজনা স্থগিত রাখিলে স্বল্পাধিককালে ক্লান্তি দূর হয়। উদ্ভিদে এই সব প্রক্রিয়া অধিকতররূপে পরিস্ফুট দেখিলাম। এইরূপে বহুর মধ্যে একত্বের সন্ধান পাইয়াছিলাম।
    জীবতত্ত্ববিদের হস্তে এই সব নূতন তত্ত্ব রাখিয়া পদার্থবিদ্যা বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার জন্য ফিরিয়া আসিব, মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু হিতে বিপরীত হইল। রয়্যাল সোসাইটিতে সব পরীক্ষা দেখাইয়াছিলাম। সর্বপ্রধান জীবতত্ত্ববিদ্ বার্ডন স্যাণ্ডারসন্ বলিলেন, ‘জীবনতত্ত্ব সম্বন্ধে আপনি যে পরীক্ষা করিয়াছেন সে সম্বন্ধে আমাদের চেষ্টা পূর্বে নিষ্ফল হইয়াছে; সুতরাং আপনার কথা অসম্ভব ও অগ্রাহ্য। আপনার সম্মুখে সেই প্রশস্ত পথে বহু কৃতিত্ব রহিয়াছে, আপনার অজ্ঞাত পথ হইতে নিবৃত্ত হউন।’ তখন কুমতির প্ররোচনায় বলিলাম, নিবৃত্ত হইব না, এই বন্ধুর পথই আমার। আজ হইতে সোজা পথ ছাড়িলাম। আজ যাহা প্রত্যাখ্যাত হইল তাহাই সত্য। ইচ্ছাতেই হউক অনিচ্ছাতেই হউক, তাহা সকলকে গ্রহণ করিতেই হইবে।
    এই দুর্মতির ফল ফলিতে অধিক বিলম্ব হইল না। সব দিকের পথ একেবারে বন্ধ হইয়া গেল এবং সমস্ত আলো যেন অকস্মাৎ নিবিয়া গেল। কিন্তু ইহার পর হইতেই অন্তরের ক্ষীণ আলো অধিকতর পরিস্ফুট হইতে লাগিল। প্রখর আলোকে যাহা দেখিতে পাই নাই, এখন তাহা দেখিতে পাইলাম। আশা ও নিরাশার অতীত এই ভাবে বিশ বৎসর কাটিল।
    এক বৎসর পূর্বে হঠাৎ যেন নির্দেশ শুনিতে পাইলাম, “বিদেশ যাও।” বিদেশযাত্রা! সেখানে কে আমার কথা শুনিবে? এবার কঠিন স্বর শুনিলাম, “আমার নাম হুকুম, তোমার নাম তামিল! লাভলাভ বলিবার তুমি কে?” আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।
    তারপর সমস্ত দিকের রুদ্ধ দ্বার একেবারে খুলিয়া গেল। কাহার হুকুমে এরূপ হইল? একি স্বপ্ন? বিরোধী যাঁহারা ছিলেন, এখন তাঁহারাই পরম মিত্র হইলেন। যাহা প্রত্যাখ্যাত হইয়াছিল, এখন তাহা সর্বত্র গৃহীত হইল। বিশ বৎসর আগে যাহা কুমতি মনে করিয়াছিলাম, পুনরায় দেখিতে পাইলাম- তাহাই সুমতি।
    সুতরাং কোন্‌টা সুমতি আর কোন্‌টা কুমতি জানি না। কোন্‌টা বড়ো আর কোন্‌টা ছোটো তাহাও মন বোঝে না। সুদিনের বৃহৎ সফলতা ভুলিয়া দুর্দিনের বিফলতার কথাই মনে পড়িতেছে। তখন সর্বত্রই পরিত্যক্ত হইয়াছিলাম, কেবল দুই-এক জনের অহেতুক স্নেহ আমাকে আগলাইয়া রাখিয়াছিল। আজ তাহারা অন্ধকার যবনিকার পরপারে। অস্ফুট ক্রন্দন কি সেথায় পৌঁছিয়া থাকে?
    জীবনের যখন পূর্ণশক্তি তখন কোলাহলের মধ্যে তোমার নির্দেশ স্পষ্ট করিয়া শুনিতে পারিতাম না। এখন পারিতেছি; কিন্তু সব শক্তি নির্জীব হইয়া আসিতেছে। একদিন তোমার হুকুমে মাঝখানের যবনিকা ছিন্ন হইবে, মৃত্তিকা দিয়া যাহা গড়িয়াছিলে তাহা ধূলি হইয়া পড়িয়া রহিবে। কি লইয়া তখন সে তোমার নিকট উপস্থিত হইবে? অল্পই তাহার সুকৃতি, অসংখ্য তাহার দুষ্কৃতি। তবে বলিবার কি আছে? কোন্‌টা সুমতি আর কোন্‌টা দুর্মতি, এই ধন্ধাতেই জীবন কাটিয়াছে। সাফাই করিবার কথা যখন কিছুই নাই, তখন তোমার পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত সে কেবল বলিবে- 'আসামী হাজির!'




বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী
মানুষের অঙ্গভঙ্গী হইতে তাহার ভিতরের অবস্থা বুঝিতে পারা যায়। সকালবেলা তাহার যে আকৃতি থাকে, দিনের শেষে সারাদিনের ক্লান্তিহেতু তাহা পরিবর্তিত হয়। সুখে সে উৎফুল্ল, দুঃখে সে বিবশ। সব জীবজন্তুর মূর্তি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হইতেছে; তাহা কেবল ভিতরের পরিবর্তনজনিত নহে। বাহিরের আঘাতেও তাহার অঙ্গভঙ্গী বিভিন্ন হইয়া যায়। তাড়নায় কুপিতা ফণিনী মুহূর্তেই সংহাররূপিণী হইয়া থাকে।

এইরূপে অহরহ ভিতর ও বাহিরের শক্তির দ্বারা তাড়িত হইয়া জীব বহুরূপী হইয়াছে। ভিতরের শক্তির সহিত বাহিরের শক্তির নিরন্তর সংগ্রাম চলিতেছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাহিরের আঘাতের ফলেই ভিতরের শক্তি দিন দিন পরিস্ফুট হইয়া থাকে।

এক সময়ে ভিতরে কিছুই ছিল না, বাহির হইতে শক্তি প্রবেশ করিয়া ভিতরে সংস্থিত হইয়াছে। যাহা বাহিরে অসীম ছিল, তাহাই ভিতরে সসীম হইল; এবং সেই ক্ষুদ্র তখন বৃহতের সহিত যুঝিতে সমর্থ হয়। সেই ক্ষুদ্র কখনও বাহিরকে বরণ করে, কখনও বা প্রত্যাখ্যান করে। জীবনের এই লীলা বৈচিত্র্যময়ী।

জীবের ন্যায় বৃক্ষের ভঙ্গীও সর্বদা পরিবর্তিত হইতেছে। পাতা কখনও আলোর সন্ধানে উম্মুখ হয়, কখনও প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ হইতে বিমুখ হয়। এই সকালবেলায় বাগানে বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিলাম যে, সূর্যমুখীর গাছটি পূর্বগগনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। পাতাগুলি ঘুরিয়া এরূপে সন্নিবেশিত হইয়াছে যে, প্রত্যেক পাতার উপরে যেন সূর্যরশ্মি পূর্ণরূপে পতিত হয়। ইহার জন্য কোনো পাতা উপরের দিকে উঠিয়া থাকে, আর পাশের পাতাগুলি ডান কিংবা বাম দিকে পাক খাইয়া সূর্যকিরণ পূর্ণমাত্রায় আহরণ করে। বৈকালবেলায় দেখিতে পাইলাম, গাছ ও পাতা পশ্চিমগগনোন্মুখ হইয়াছে, ডাল এবং সব পাতাগুলি ঘুরিয়া গিয়াছে। কি শক্তির বলে এই পরিবর্তন ঘটিল? বাহিরের সহিত ভিতরের এ কি অদ্ভুত সম্বন্ধ! সূর্য তো প্রায় পাঁচ কোটি ক্রোশ দূরে, তবে কি রাখীবন্ধনে গাছ দিবাকরের সহিত এইরূপ সম্মিলিত হইল?

উদ্ভিদ-বিদ্যা সম্বন্ধীয় পুস্তকে দেখা যায় যে, সূর্যিমুখীর এই ব্যবহার ‘হীলিওট্রোপিজ্‌ম্’-জনিত। হীলিওট্রোপিজ্‌মের বাংলা অনুবাদ, সূর্যের দিকে হওয়া। সূর্যমুখী কেন সূর্যের দিকে আকৃষ্ট হয়? কারণ ‘সূর্যের দিকে মুর্খ’ হওয়াই তাহার প্রবৃত্তি! যখন কোনো বিষয়ের প্রকৃত সন্ধান না পাইয়া মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়, তখন কোনো দুর্বোধ্য মন্ত্রতন্ত্র তাহাকে নিশ্চিন্ত করে। তবে সেই মন্ত্রটি সংস্কৃত, লাটিন, কিংবা গ্রীক ভাষায় হওয়া আবশ্যক। সোজা বাংলায় কিংবা অন্য আধুনিক ভাষায় হইলে মন্ত্রের শক্তি থাকে না। এই জন্যই গ্রীক হীলিওট্রোপিজ্‌ম্ মন্ত্রে সূর্যমুখীর ব্যবহার বিশদ হইল!

সে যাহাই হউক, ইহার পশ্চাতে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। এই সব অঙ্গভঙ্গী অদৃশ্য জীববিন্দুর প্রকৃতিগত কোনো পরিবর্তন দ্বারাই সাধিত হয়। জীববিন্দুর পরিবর্তন অণুবীক্ষণযন্ত্রেও অদৃশ্য। তবে কিরূপে সেই অপ্রকাশকে সুপ্রকাশ করা যাইতে পারে? বহু চেষ্টার পর বিদ্যুৎ-বলে সেই অদৃশ্য জগৎকে দৃষ্টিগোচর করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই বিষয়ে দুই-একটি কথা পরে বলিব।

কেবল সূর্যমুখীই যে আলোক দ্বারা আকৃষ্ট হয়, এরূপ নহে। টবে বসানো একটি লতা অন্ধকার ঘরে রাখিয়া দিয়াছিলাম। রুদ্ধ জানালার একটি রন্ধ্র দিয়া অতি ক্ষুদ্র আলোকরেখা আসিতেছিল। পরের দিন দেখিলাম, সব পাতাগুলি ঘুরিয়া সেই ক্ষীণ আলোকের দিকে প্রসারিত হইয়াছে।

লজ্জাবতী লতাতেও এইরূপ ক্রিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। টবে বসানো লতাটি যদি জানালার নিকটে রাখা যায়, তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, সব পাতাগুলি ঘুরিয়া বাহিরের আলোর দিকে মুখ করিয়া রহিয়াছে। টব ঘুরাইয়া দিলে পাতাগুলি পুনরায় নূতন করিয়া ঘুরিয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাতাগুলি কেবল উঠে এবং নামে তাহা নয়, কোনোগুলি ডান দিকে এবং কোনোগুলি বাম দিকে পাক খায়। পাতার ডাঁটার গোড়ায় যে স্থূল পেশী দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার দ্বারাই পাতাগুলি ঘুরিয়া থাকে, কখনও উঠানামা করে, কখনও ডান দিকে কিংবা বাম দিকে পাক খায়। পূর্বে বিশ্বাস ছিল যে, পাতার গোড়ায় একটিমাত্র পেশী আছে যাহার দ্বারা কেবলমাত্র উঠানামা হয়। কিন্তু আমাদের হাত ঘুরাইতে হইলে অনেকগুলি পেশীর আকুঞ্চন এবং প্রসারণের আবশ্যক। অনুসন্ধান করিতে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, লজ্জাবতীর পাতার মূলে চারিটি বিভিন্ন পেশী আছে, যাহার অস্তিত্ব ইতিপূর্বে কেহই মনে করিতে পারেন নাই। একটি পেশীর দ্বারা পাতা উপরের দিকে উঠে, আর-একটির দ্বারা নীচের দিকে নামে, অন্য একটির দ্বারা ডান দিকে পাক খায় এবং চতুর্থ পেশীর দ্বারা বাম দিকে ঘুরিয়া যায়।

ইহার প্রমাণ কি? প্রমাণ এই যে, পালক দ্বারা উপরের পেশীটুকুতে সুরসুড়ি দিলে পাতাটি উপরের দিকে উঠে এবং সেই ঊর্ধ্বে গতি যন্ত্রের দ্বারা লিখিত হয়। এক নম্বরের বা চারি নম্বরের পেশীকে এইরূপে উত্তেজিত করিলে পাতাটি বাম দিকে বা ডান দিকে পাক খায়, দুই নম্বর বা তিন নম্বরটিকে ঐরূপ উত্তেজিত করিলে পাতা নীচে নামে বা উপরে উঠিয়া যায়। সূর্যের আলো এইরূপে পেশীর নানা অংশে নিক্ষেপ করিলে উক্তবিধ সাড়া পাওয়া যায়। তবে সূর্যের আলোক তো সব সময়ে পত্রমূলে পড়ে না, কারণ পাতার ছায়ায় পত্রমূলটি ঢাকা থাকে। লজ্জাবতীর বড়ো ডাঁটাটির সহিত চারিটি ছোটো ডাঁটা সংযুক্ত, এবং সেই ছোটো ডাঁটার গায়ে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা থাকে। আলো সেই ক্ষুদ্র পাতার উপরই পড়ে। পড়িবামাত্রই দেখা যায় যে পাতা নড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু পাতার নড়াচড়া তো সেই দূরের স্থুল পেশীর আকুঞ্চন-প্রসারণ ভিন্ন হইতে পারে না। তবে ছোটো পাতাগুলি আলোর অনুভবজনিত উত্তেজনায় কি সংকেত কোন্ পথ দিয়া দূরে পাঠাইয়া থাকে? এই বিষয়ে অনুসন্ধানে জানিতে পরিলাম যে, চারিটি ছোটো ডাঁটা হইতে পাতার মূল পর্যন্ত চারিটি বিভিন্ন স্নায়ুসূত্র প্রসারিত। তাহা দ্বারাই খবরাখবর পৌঁছিয়া থাকে। এক নম্বরের ক্ষুদ্র পাতাগুলিকে কোনোরূপে উত্তেজিত করিলে একটি মাত্র সূত্র দিয়া পত্রমূলের এক নম্বর পেশীতে উত্তেজনা প্রেরিত হয়, অমনি পাতাটি বাম দিকে পাক খাইয়া যায়। চারি নম্বরের পাতাগুলিকে ঐরূপে উত্তেজিত করিলে ডান দিকে পাক খায়। দুই নম্বরের পাতাগুলিকে উত্তেজিত করিলে বড়ো পাতাটি নীচের দিকে পড়ে। তিন নম্বরের ছোটো পাতাগুলিকে উত্তেজিত করিলে উপরের দিকে উঠিয়া যায়। সুতরাং দেখা যায়, পাতার বাহির হইতে ভিতরের দিকে হুকুম পাঠাইবার চারিটি রাশ আছে। কে সেই বল্‌গা টানিয়া সংকেত পাঠায়?

কেবল তাহাই নহে। কোনো নির্দিষ্ট দিকে চালিত করিবার জন্য একটা বল্‌গা টানিলে তাহা সাধিত হয় না। নৌকার একটি দাঁড় টানিলে নৌকা কেবল ঘুরিতে থাকে। দিশাহীন তবে এক দিকের টান। অন্ততঃ দুই দিকের দুইটি সমবেত টান দ্বারা গন্তব্যপথ নির্দিষ্ট হয়। এক সময়ে দুইটি দাঁড় টানা আবশ্যক।

পতঙ্গ আলোর দিকে ছুটিয়া যায়। তাহার দুইটি চক্ষুর উপর আলো পড়ে। প্রত্যেক চক্ষুর সহিত তাহার এক-একটি পাখার সংযোগ। একটি চক্ষু অন্ধ হইলে সে আর আলোর দিকে যাইতে পারে না। এক-দাঁড়ের নৌকোর ন্যায় কেবল ঘুরিতে থাকে। যখন দুইটি চক্ষুর উপর আলো পড়ে, কেবল তখনই দুইটি ডানা একসঙ্গে একই বলে আন্দোলিত হয়, এবং সে সোজা পথে আলোর দিকে ধাবিত হয়। আলো যদি পাশে ঘুরাইয়া রাখা যায়, তাহা হইলে উহা কেবল একটি চক্ষুর উপর পড়ে, সেইজন্য একটি পাখা প্রবল বেগে-স্পন্দিত হয় এবং পতঙ্গটি ঘুরিয়া যায়। ঘুরিয়া যখন আলোর সোজাসুজি আলোমুখীন হয় এবং আলো দুইটি চক্ষুর উপর সমানভাবে পড়ে, তখন দুইটি পাখাই সমানভাবে একই শক্তিতে স্পন্দিত হইতে থাকে এবং পতঙ্গ তাহার অভীষ্ট লাভ করে- জীবনে কিংবা মরণে!

দুইটি দাঁড়ের দ্বারা তরণী কেবল নদীবক্ষের উপরই গন্তব্য দিকে ধাবিত হইতে পারে। কিন্তু সর্বদিগ্‌বিহারী জীব কখনও দক্ষিণে কখনও বামে, কখনও ঊর্ধ্বে কখনও বা অধোদিকে ধাবিত হইতে চাহে। এরূপ সর্বমুখী গতি নিরূপণ করিবার অন্ততঃ চারিটি রশ্মির আবশ্যক।

লজ্জাবতী পাতার প্রতি কোষই আলোক ধরিবার ফাঁদ। সেই আলোর উত্তেজনা এক-একটি স্নায়ুসূত্র ধরিয়া পত্রমূলের পেশীতে উপস্থিত হয়। যতক্ষণ-না চারিটি ডাঁটার পত্রসমষ্টি সমানভাবে আলোকমুখীন হয়, ততক্ষণ চারিটি বল্‌গার টানের ইতরবিশেষ হইয়া থাকে। পত্ররথ তখন দক্ষিণে কিংবা বামে, ঊর্ধ্বে কিংবা নিম্নে চালিত হয়।
 
সবিতার রথ
সারথি তবে কে? দিবাকর নিজকে কোটি কোটি অংশে বিভক্ত করিয়া ধরাপৃষ্ঠে অধিষ্ঠিত। জানালার ক্ষুদ্র রন্ধ্র দিয়া সূর্যদেবের শত শত মূর্তি মেঝের উপর দেখিতে পাই।
 
সবিতা তবে প্রতি পত্রকে তাঁহার রথরূপে গ্রহণ করেন। পত্রের চারিটি বল্‌গা তাঁহারই হস্তে। অনন্ত আকাশ বাহিয়া সীমাহীন তাঁহার গতি। কিন্তু এই অসীম পথ প্রদক্ষিণ করিবার সময়ও ধূলিকণার ন্যায় এই পৃথিবী এবং তাহা হইতে উত্থিত ক্ষুদ্র লতার অতি ক্ষুদ্র পাতাটিরও আহ্বান উপেক্ষা করেন না। নিজের শক্তির দ্বারা প্রতি জীববিন্দুকে স্পন্দিত করেন এবং ক্ষুদ্র পাতাটির গতি নিরূপণ করিয়া থাকেন। জীবন জীবনের গতির মূলে সেই শক্তি প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে।
সর্বভূতের চালক তুমি, তোমার তেজোরাশিকে কে উদ্দীপ্ত রাখিতেছেন!
ছাত্রসমাজের প্রতি 

ছাত্রসমাজের সভ্যগণ,
তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমরা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তব পক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে কিন্তু তাহার প্রভাব অন্তরে প্রবেশ করিতে পারে নাই। আমি এখনও তোমাদের মত ছাত্র ও শিক্ষার্থী। এখনও স্কুলে যাইবার পুরাতন গলিতে পৌঁছিলে স্মৃতিদ্বারা অভিভূত হই। আমার শৈশবের শিক্ষকদর্শনে এখনও হৃদয় চিরন্তন ভক্তিপ্রবাহে উচ্ছ্বসিত হয়। তবে তোমাদের অপেক্ষা শিক্ষার জন্য দীর্ঘতর সময় পাইয়াছি; অনেক ভূল সংশোধন করিতে পারিয়াছি এবং অনেক বার পথ হারাইয়া পরিশেষে গন্তব্য পথের সন্ধান পাইয়াছি। আজ যদি কোন ভুলচুক কিম্বা দুর্বলতার বিরুদ্ধে তীব্রভাষা ব্যবহার করি তবে মনে রাখিও যে সে সব কষাঘাত হইতে নিজেকে কোনদিন বঞ্চিত করি নাই। কুসুমশয্যায় সুপ্ত থাকিবার সময় অতীত হইয়াছে; কণ্টকশয্যাই আমাদিগকে এখন জাগরিত রাখিবে।

এখন আমাদের দেশে সচরাচর দুই শ্রেণীর উপদেষ্টা দেখিতে পাওয়া যায়। কেহ কেহ আমাদের জাতীয় দুর্বলতার চিত্র অতি ভীষণ রূপে চিত্রিত করেন। যে দেশে এরূপ জাতিভেদ ও দলাদলি, যে দেশ দাসত্বসুলভ বহু দোষে দোষী, যে দেশে পরস্পরে এত হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা দেখা যায়, সে দেশে কি কোনদিন উন্নতি হইতে পারে? আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইরূপ ভয়ানক ভবিষ্যদ্‌বাণীর পর তাহাদের নিদ্রার কোন ব্যাঘাত হয় না। যদি যথার্থই বুঝিয়া থাক যে দেশে এরূপ দুর্দিন আসিয়াছে তবে কেন বদ্ধপরিকর হইয়া তাহার প্রতিবিধান করিতে চেষ্টা কর না। আমি দেখিতে পাই ছাত্রদের মধ্যে, আমাদের নেতারা কেন এ কাজ করিলেন, কেন এ কাজ করিলেন না, এরূপ বচসা দ্বারাই সময় অতিবাহিত হয়। পরের কর্তব্য কি তাহা নিষ্পত্তি করিবার আমি কে? আমি কি করিতে পারি ইহাই কেবল আমার ভাবিবার বিষয়।

আবার অন্যদিকে এক দল আছেন যাহারা অতীত কালের কথা লইয়া বর্তমান ভুলিয়া থাকেন। ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞানে আমাদের পুর্বপুরুষদের কিছুই অবিদিত ছিল না’ আমাদের পূর্ব ঐশ্বর্য যদি এতই মহান তবে আমাদের অধ:পতনের হেতু কি? ইহার প্রতিবিধান কি নাই? আমরা যদি সেই মহান পূর্বপুরুষদের প্রকৃত বংশধর হই তাহা হইলে আমরা নিঃসন্দেহে পূর্বগৌরব অধিকার করিতে পারিবই পারিব।

পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণ উপলক্ষে আমি দ্বিবিধ জাতীয় চরিত্র লক্ষ্য করিয়াছি। একজাতীয় চরিত্র এই যে, তাঁহারা গতকালের স্মৃতি লইয়া বৃথাগর্বে ভুলিয়া আছেন। পৃথিবী যে স্থাবর নয়, ইহা যে চিরপরিবর্তনশীল এ কথা তাহাদের বোধগম্য হয় না। এইসব-ধর্মাক্রান্ত জাতির চিহ্ন পর্যন্ত পৃথিবী হইতে মুছিয়া যাইতেছে। ইজিপ্ট আসীরিয়া এবং বাবিলন-ইহাদের গত স্মৃতি ছাড়া আর কি আছে?

চীনদেশে ভ্রমণকালে সে স্থানের বিখ্যাত কয়েকজন পণ্ডিতের সহিত আমার পরিচয় হয়। তখন জাপান মাঞ্চুরিয়া গ্রাস ব্যাপারে প্রবৃত্ত ছিল। আমি আমার চীনা বন্ধুদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা কি করিয়া চীনের স্বাধীনতা রক্ষা করিবেন? তখন তাঁহারা বলিলেন, চীনদেশের মত যে দেশ বহু প্রাচীন কাল হইতে সভ্যতার শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে, সে দেশকে কি সেদিনের জাপান পরাভূত করিতে পারে! বরঞ্চ আমাদের সভ্যতাই জাপানকে পরাস্ত করিবে। এইসব কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে শীঘ্রই চীনের সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত হইবে।

অন্যদিকে তাঁহাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান পুরাতন কথা বলিয়া সময় অপচয় করিতে চাহেন না। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ লইয়া তাঁহারা যথেষ্ট ব্যস্ত। তাঁহাদের নিকট শুনিলাম যে মানবসমাজের নিয়ম আর law of hydrostatic pressure একই। যে স্থানে pressure বেশি সে স্থান হইতে জলস্রোত অল্প pressure-এর দিকে ধাবিত হয়। জীবন স্রোতও সজীব হইতে নির্জীবের দিকে। পৃথিবীতে সজীব নির্জীবের স্থান অধিকার করিবে।

অথচ সেই জাপানে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে বিদ্যা ও বুদ্ধিতে ভারতবর্ষীয় ছাত্র সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানদেরও উপরে উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছে। বিদ্যাবুদ্ধির ত্রুটি নাই, তবে এরূপ দুর্দশা কেন।

আমি আজ ত্রিশ বৎসর যাবৎ শিক্ষকতার কাজ করিতেছি। ইহার মধ্যে ন্যূনকল্পে দশ হাজার ছাত্রের সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে। তাহাদের চরিত্রে কি কি গুণ তাহা জানি আর কি কি দুর্বলতা তাহাও উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি। প্রধানতঃ, তাহাদের স্বভাব অতি কোমল, সাধারণতঃ তাহারা বড় ভালোমানুষ, একবার পথ দেখাইয়া দিলে অনেকেই সেই পথ অনুসরণ করিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ জলপ্লাবন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি দুর্ঘটনার সময় ছাত্রদের মধ্যে অদ্ভুত কার্যপরায়ণতা দেখা গিয়াছে। এতগুলি ছেলে কি সুন্দররূপে নিজকে organise করিয়াছে। বেশি কথা না বলিয়া অতি সংযতভাবে কি সুন্দররূপে লোকসেবা করিয়াছে। এরূপ শুশ্রূষা করিবার ক্ষমতা, এরূপ ধৈর্য, এরূপ কষ্টসহিষ্ণুতা, এরূপ অসন্তুষ্টি অভাব সচরাচর দেখা যায় না। আমি যেসব গুণ বর্ণনা করিলাম তাহা পুরুষে প্রায় দেখা যায় না, সচরাচর নারীজাতিই এসব মহৎ গুণের অধিকারিণী।

ইহার বিপরীত কেন্দ্রে কোন কোন পুরুষ দেখিতে পাওয়া যায় যাহাদের চরিত্র সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকার। তাঁহাদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা একেবারেই নাই, তাঁহারা কিছুই মানিয়া লইতে চাহেন না, তাঁহারা সর্বদাই অসন্তুষ্ট, তাঁহাদের হৃদয় দুর্জয় ক্রোধে পূর্ণ। এইরূপ লোকের জাতীয় জীবন স্থান কোথায়?

আমি এইরূপ প্রকৃতির একজনকে জানিতাম তিনি চিরস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সমাজের নির্মম বিধানে তাঁহার ক্রোধ সর্বদা উদ্দীপ্ত থাকিত। আশ্চর্য এই যে ক্রোধ ও মমতা অনেক সময় একাধারেই দেখিতে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের ন্যায় কোমলহৃদয় আর কোথায় দেখিতে পাওয়া যায়? তিনি কোন বিধানই মানিয়া লইতেন না; অসীম শক্তিবলে তিনি একাই সমাজের কঠিন শৃঙ্খল ভগ্ন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

এই প্রকার দুর্দান্ত ও ক্রোধপরায়ণ লোক কখন কখন জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন। তাহাদের জীবন নিষ্ফলতাতেই পর্যবসিত হয়, তাহাদের ধৈর্য নাই, তাহাদের সহিষ্ণুতা নাই। দেশব্যাপী রোগের সেবা ও পরিচর্যা? পীড়ারও অন্ত নাই, শুশ্রূষারও অন্ত নাই, এরূপ কতকাল চলিবে? ইহার কি প্রতিবিধান নাই? কি করিয়া ম্যালেরিয়া দেশ হইতে দূর করা যায়? এরূপ জঙ্গল ও ডোবার মধ্যে মানুষ কি করিয়া বাঁচিতে পারে? ইহার প্রতিকার নিশ্চয়ই আছে।

তাছাড়া আরও শত শত কার্য আছে, সাধারণের মধ্যে শিক্ষা প্রচার, জ্ঞান প্রচার, শিল্প ও বিজ্ঞানের উন্নতি, দেশে বিদেশে ভারতের মহিমা বৃদ্ধি করা। দুর্বল ভালমানুষের দ্বারা এসব হইবে না, এইসবের জন্য বিক্রমশীল পুরুষের আবশ্যক, তাহাদের পূর্ণ শক্তির আঘাতে সব বাধাবিঘ্ন শূন্যে মিশিয়া যাইবে।

আর যে শান্তির ক্রোড়ে আমরা এতদিন নিশ্চেষ্ট ও সুপ্তভাবে জীবন যাপন করিয়াছি, জগৎ হইতে সেই শান্তি অপসৃত হইতেছে। শান্তি কোন জাতির পৈতৃক অথবা চিরসম্পত্তি নহে; বল দ্বারা, শক্তি দ্বারা, জীবন দ্বারা শান্তি আহরণ করিতে এবং রক্ষা করিতে হয়। বলযুক্ত হও, শক্তিমান্ হও, এবং তোমাদের শক্তি দেশের সেবায় এবং দুর্বলের সেবায় নিয়োজিত হউক।

‘গ্রন্থপরিচয়’ ও ‘জগদীশচন্দ্রের বাংলা রচনাসূচী’ মুদ্রিত হইয়া যাইবার পর রচনাটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়াছে- এইজন্য ঐ দুই বিভাগে ইহার উল্লেখ করা সম্ভব হয় নাই। সাধারণ ব্রহ্মসমাজের অন্তর্গত ছাত্রসমাজের সভায় এই অভিভাষণ পঠিত বা কথিত হইয়া থাকিবে।