১.১২
আবেগ ও প্রক্ষোভ
মানুষের মনোজগতের অংশ হলো আবেগ। মানুষ তার জীবনযাপনের মধ্যে প্রতিনিয়ত কিছু বোধের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই বোধ মানুষের মনে নানা ধরনের উপলব্ধির জন্ম দেয়। এই উপলব্ধির ফলে মনোজগতে নানা ধরনের অবস্থার সৃষ্টি করে। এই মানসিক অবস্থাই হলো আবেগ। আর এই আবগের কারণে মানুষ যে ক্রিয়াত্মক প্রকাশ ঘটে, তাই হলো প্রক্ষোভ। ধরা যাক হঠাৎ করে কেউ একটি সাপ দেখলো। এর ফলে তার মনে একটি বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হলো। এই বিশেষ অবস্থাকে যদি আমরা ভয় বলি, তাহলে সেটা হবে আবেগ। এই আবেগ থেকে কেউ চিৎকার করতে পারে, পালাতে চেষ্টা করে, কাঁপতে থাকে কিম্বা জড় পদার্থের মতো স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকে। এই জাতীয় প্রতিটি আচরণ হবে প্রক্ষোভ।
আবেগ মনোজগতের আর প্রক্ষোভ শরীরের ক্রিয়াত্মক অংশের। প্রক্ষোভ মানুষের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হতে পারে। এই বিচারে প্রক্ষোভের প্রকাশ দুই ভাবে হতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
১. স্বয়ংক্রিয় প্রক্ষোভ: আবেগের প্রকারভেদে শরীরে অভ্যন্তরে নানা ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে, সেটা আমরা বাইরে থেকে দেখি না। প্রক্ষোভের প্রকৃতি অনুসারে, শরীরের অভ্যন্তরে গ্রন্থিজাত রসের ক্ষরণ হয়, হৃদপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পায়, স্নায়ু ও পেশীঘটিত নানাধরনের কার্যক্রম সংঘটিত হয়। এর ফলে মানুষের বাহ্যদর্শন বা কার্যকলাপে কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ভয়ে কারো মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কেউ কাঁপতে থাকে। এই জাতীয় বাহ্যদর্শনের কারণ যাই থাকে, মানুষ নিজ ইচ্ছায় করতে পারে না। আবেগজাত অনুভূতি থেকে আপনাপানি উৎপন্ন হয়। তাই কেউ যখন ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, তখন কোনোভাবে তার ভয়কে দূর করতে পারলে, আপনাআপনি প্রক্ষোভ দূর হয়ে যায়। এসকল ক্ষেত্রে সরসারি প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কিন্তু আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করলেই প্রক্ষোভ দূর হয়ে যায়।
কিছু কিছু স্বয়ংক্রিয় প্রক্ষোভ তৈরি হয়, শারীরিক স্বাভাবিক চাহিদা থেকে। যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি।২. স্বেচ্ছা প্রক্ষোভ: আবেগজাত বোধ, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদির দ্বারা মানুষ আবেগ দূর করতে পারে বা জাগ্রত করতে পারে। ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়া, রাগে-দুঃখে কাউকে আঘাত করা ইত্যাদি মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে করে। এর পিছনেই শরীরের ঐচ্ছিক ও স্বয়ংক্রিয় উপকরণগুলো কাজ করে। মানুষ যখন পালিয়ে যায়, তখন তার পেশীঘটিত কার্যকলাপ, গ্রন্থিঘটিত রসসঞ্চারের মতো ঘটনা ঘটে, কিন্তু পালানোর জন্য দৌড়ানোটা ইচ্ছা শক্তির মধ্যেই ঘটে।
৩. স্মৃতিকাতরতাজনীত প্রক্ষোভ: এই জাতীয় প্রক্ষোভ ঘটে থাকে অতীতের কোনো বিশেষ ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। বহু আগে কারো সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। যখনই এই কথা মনে পড়ে, তখনই তার মনে বেদনার অনুভব সৃষ্টি হয়। এই অনুভবের ভিতর দিয়ে তার মন বেদনা-ভারাক্রান্ত হয়। এর ফলে সে হয়তো কাঁদে বা বিলাপ করে। এই জাতীয় প্রক্ষোভ নানা কারণে ঘটতে পারে।
৪. রস প্রক্ষোভ: এই জাতীয় প্রক্ষোভ ঘটে থাকে মানুষের সৃষ্ট কোনো শিল্পকর্ম থেকে। এই প্রক্ষোভের কারণে নাটক বা কাহিনিচিত্র দেখে মানুষ কাঁদে হাসে। রসের প্রকৃতি অনুসারে এই জাতীয় প্রক্ষোভ প্রকরণের প্রকারভেদ ঘটে।
৫. মিশ্র প্রক্ষোভ: মানুষের বহু প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয় একাধিক অনুভূতির সংমিশ্রণে। মানুষ রেগে গিয়ে যখন কাউকে আঘাত করে বসে, তখন তা স্বেচ্ছা প্রক্ষোভ। কিন্তু বেদনায় চোখের জল পড়ে, তা স্বায়ংক্রিয়। অনেকক্ষেত্রেই দুটো একই সাথে ঘটে। শিশুরা অনেক সময় বেদনায় কাঁদে এবং একই সাথে কাছের কাউকে আঘাত করে। যৌনকামনার ক্ষেত্রে মিশ্র প্রক্ষোভ ঘটে। যৌনকর্মে কামের ভাব দ্বারা মনোগত প্রক্ষোভের জন্ম হয় এবং দেহের সক্রিয়তায় দ্বারা ঐচ্ছিক প্রক্ষোভ প্রকাশ পায়।
সকল
মানুষের প্রক্ষোভ একরকম হয় না। কেউ কেউ প্রবল শোককে শক্তিতে পরিণত করে, কেউ বা অল্প
শোকে কাতার আর অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। সামান্য কথায় কেউ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়,
কেউ বা প্রবল আপত্তিজনক কথাতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারে। প্রক্ষোভের ভিতর দিয়ে
মানুষের আবেগের তীব্রতা অনুভব করা যায়। মনোবিজ্ঞানীরা প্রক্ষোভের ভিতর দিয়ে মনের
সন্ধান করে থাকেন। একালের মনোবিজ্ঞানীরা প্রক্ষোভের প্রক্রিয়াগুলোকে পরিমাপ করার
জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি ও যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। যেমন প্রক্ষোভের কারণে নাড়ির
স্পন্দন মাপার জন্য ব্যবহার করেন স্ফিগমোগ্রাফ
(Sphygmograph)
যন্ত্র, রক্তের চাপ মাপার
জন্য স্ফিগমোমানোমিটার
(Sphygmomanometer)
যন্ত্র,
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস মাপার জন্য নিউমোগ্রাফ
(Pneumograph)
যন্ত্র। এই সকল যন্ত্রের মাধ্যমে মূলত শরীরের ভিতরে স্বয়ংক্রিয়
প্রতিক্রিয়াকে অনুধাবন করার চেষ্টা করা হয়। আবার প্রক্ষোভের মাপার জন্য ব্যবহার করা
হয় সাইকোগ্যালনোমিটার (Psychogalvanometer)।
স্বাভাবিকভাবে মানুষ মৃদু বিদ্যুৎ প্রবাহ সহ্য করতে পারে।
এই সহ্যক্ষমতা সবার সমান হয় না। মানুষের প্রক্ষোভের সময়, শরীরের বিদ্যুৎ প্রবাহের
সহ্যক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। সাইকোগ্যালনোমিটার দিয়ে মূলত প্রক্ষোভের সময় শরীরের
বিদ্যুৎ প্রবাহের সহ্যক্ষমতাকে পরিমাপ করা হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষার নাম দিয়েছেন
সাইকোগ্যালনো
প্রতিক্রিয়া (Psychogalvanic
Response
বা
P.G.R)।
প্রক্ষোভের কারণে মস্তিষ্কের আলফা তরঙ্গের পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিক অবস্থায়
মস্তিষ্কে আলফা তরঙ্গ আবরতন হয় প্রতি সেকেণ্ডে ৭.৫ থেকে ১২.৫ বার। কিন্তু
প্রক্ষোভের সময় এই তরঙ্গের পরিবর্তন ঘটে। মূলত যখন চিন্তা করে বা আবেগ-অনুভূতি
দ্বারা তাড়িত হয়, তখন মানুষের মস্তিষ্ক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ
সৃষ্টি করে। গবেষণাগারে মাথার খুলির উপর বহুমুখী ইলেক্ট্রোড লাগিয়ে
ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি তথা ইইজি'র মাধ্যমে এসব তরঙ্গ সংকেত ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
এসব সংকেতের মাত্রা বৃদ্ধি করে তা কম্পিউটারে পাঠিয়ে সেই ব্যক্তির ইচ্ছা কি সেটা
কিছুটা অনুধাবন করা যায়। মস্তিষ্ক পাঠের এই পদ্ধতিকে বলা হয় ব্রেন-কম্পিউটার
ইন্টারফেস বা বিসিআই।
বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের এই তরঙ্গের বিভিন্ন স্তরকে শনাক্ত করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। নিচে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
ডেল্টা
তরঙ্গ (Theta
wave): কম্পাঙ্ক মান
০ থেকে ৪ হার্টজ। এই অবস্থাকে বলা হয়, গভীর ঘুমের অবস্থা। এই
দশায় মস্তিষ্ক মূলত জীবনধারণের জন্য যতটুকু কার্যক্রম করার প্রয়োজন ততটুকুই
করে।
থিটা
তরঙ্গ (Theta
wave): কম্পাঙ্ক মান
৪ থেকে ৭ হার্টজ। এই অবস্থাকে বলা হয়, গভীর ঘুমের পূর্বাবস্থা।
কথিত আছে যোগীরা এই স্তরে এসে মহাচৈতন্য দশায় পৌঁছাতে পারেন। কম্পাঙ্কের মান
৪-এর নিচে নেমে গেলে মানুষ গভীর ঘুমে পৌঁছায়।
আলফা
তরঙ্গ (Alpha wave):
কম্পাঙ্ক মান ৭.৫ থেকে ১২.৫ হার্টজ। মনের প্রশান্ত দশা বা মনের
শিথিল দশায় এই তরঙ্গ ক্রিয়াশীল থাকে। ঘুমানোর আগে মানুষ বিটা দশা থেকে
আলফা দশায় পৌঁছায়। এই তরঙ্গ ৭ এসে পৌঁছালে মানুষ ঘুমের প্রাথমিক স্তরে এসে
পৌঁছায়।
বিটা তরঙ্গ (Beta wave): স্বাভাবিক জাগ্রত দশায় মস্তিষ্কের কম্পাঙ্ক উচ্চস্তরে থাকে। এর সীমা হলো ১২.৫ থেকে ৩০ হার্টজ্। এই বৃহৎ সীমাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগ তিনটি হলো-
নিম্ন বিটা তরঙ্গ (Low Beta Wave): ১২.৫ থেকে ১৬ হার্টজ্।
বিটা তরঙ্গ (Beta Wave): ১৬ থেকে ২০ হার্টজ্।
উচ্চ বিটা তরঙ্গ (High Beta Wave): ২০ থেকে ৩০ হার্টজ্।
মানুষের জাগ্রত অবস্থার
বিভিন্ন আবেগ বা প্রক্ষোভের কারণে বিটা তরঙ্গের হেরফের ঘটে। আনন্দ, দুঃখ,
ক্ষোভ, দুঃশ্চিন্তায় মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্কের পরিবর্তন ঘটে।
গামা তরঙ্গ (Gama wave): এই তরঙ্গের সীমা ৩০ থেকে ১০০ হার্টজ। উচ্চতর প্রজ্ঞা বা গভীর চেতনার ভিতরে মানুষ প্রবেশ করলে, মস্তিষ্কে উচ্চতর তরঙ্গের সৃষ্টি করে। ধ্যান জগতে মস্তিষ্ক এই উচ্চতরঙ্গে সক্রীয় হয়ে উঠে।
প্রক্ষোভ সৃষ্টির ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি রস বিশেষভাবে কাজ করে। এর ভিতরে বিশেষ উল্লেখ করার মতো রসক্ষরণকারী গ্রন্থি হলো সুপ্রারেনাল। শরীরের অভ্যন্তরে বৃক্কের উপরে এই গ্রন্থির অবস্থান। রাগ, ভয় ইত্যাদির কারণে শরীরে শর্করা জাতীয় উপাদান কমে গেলে, এই গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন এবং নরঅ্যাড্রেনালিন রস বের হয়ে আসে। উভয়ের পারস্পরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, মানুষকে রাগ বা ভয়জনীত অস্থিরতা থেকে শান্ত দশায় ফিরিয়ে আনার জন্য। এই প্রক্রিয়ায় হৃদপিণ্ডের অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠে। এর ফলে হৃদকম্পন বেড়ে যায়। হৃদপিণ্ডের অতি-সক্রিয়তার কারণে অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এই সময় হৃদপেশীর সংকোচনও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এর ফলে হৃদপিণ্ডের রক্তসরবরাহ ধমনীতে চাপের সৃষ্টি হয়। ফলে ভয় বা রাগের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। এই সময় হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। অনেক সময় সংকুচিত ধমনী দিয়ে হঠাৎ অধিক বেগে রক্ত সঞ্চালনের ফলে, ধমনী ছিঁড়ে যায়। তাছাড়া ডায়াবেটিক রোগীদের সাধারণত রাগ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেওয়া হয়। কেন না রাগ বা মানসিক চাপের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত অ্যাড্রেনালিন রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা একজন ডায়াবেটিক রোগীর জন্য খুবই বিপদজনক।
মানুষের আবেগ এবং এর দ্বারা সৃষ্ট প্রক্ষোভের সংখ্যা অনেক। তবে আবেগের বিচারে মনের অবস্থাকে কয়েকটিকে মনুষ্যজাতি সরাসরি নাম দ্বারা প্রকাশ করে থাকে। এগুলো হলো— আনন্দ, রাগ, ভয়, দুঃখ, অভিমান, ভালোবাসা। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।