২.২
আনন্দ

মানুষ অস্বস্তিদশা থেকে স্বস্তিদশায় বার বার ফিরে আসতে চায়। যখন সে স্বস্তিবোধে ফিরে আসে তখন তাকে আমরা ভালো-লাগা বলতে পারি। স্বস্তি বা অস্বস্তি উভয়ই মূলত তুলনামূলক একটি দশা বিশেষ। স্বস্তিদায়ক দশার প্রতিটি স্তরে জন্ম নেয় ভালো-লাগার বোধ। ধরা যাক একটি দৃশ্য দেখে কারো ভালো লেগেছিল। এর অর্থ এই নয় যে, ওই দৃশ্যটি দেখার আগে সে অস্বস্তিতে ছিল। কিন্তু দৃশ্যটিকে প্রথম দেখার আগে, তখন হয়তো তার দেহ ও মন সাধারণ স্বস্তিদশাতেই ছিল। সে যখন দৃশ্যটি দেখলো, তখন তার মন, দেখার ভিতর দিয়ে ভিন্নতর এবং অধিকতর স্বস্তিদায়ক দশার দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করলো। যা থেকে সৃষ্টি হলো দেখার সুখ এবং সেখান থেকেই সৃষ্টি হলো আনন্দের অনুভূতি। এই আনন্দের অনুভূতি যদি তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে, তাহলে তার ভিতরে ভালোলাগার বোধ তীব্রতর হয়ে অনু্ভূত হবে। এই বোধ যদি তাকে দৃশ্যটি বারবার দেখার জন্য তাড়িত করে, তাহলে মনের ভিতর জন্ম নেবে আকাঙ্ক্ষা। আকাঙ্ক্ষা পূরণের তীব্র ইচ্ছা লোভে পরিণত হয়। আকাঙ্ক্ষার গভীরে থাকে আকর্ষণ। যখন কোনো নান্দনিক বিষয় উপভোগ করার জন্য কেউ আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠে, তখন তার মনের ভিতরে এক ধরনের আকৃষ্টজনিত টানের সৃষ্টি হয়। এই টানই হলো আনন্দলাভের প্রতি আকর্ষণ।

গড় স্বস্তি-অস্বস্তিবোধের সূত্রে আমরা স্বাভাবিকভাবে 'ভালো আছি' বলি, সে ভালো থাকাটা স্বাভাবিক স্বস্তিবোধের চেয়ে একটু উঁচু স্তরের। ধরা যাক কোনো একজন, একটি গড় স্বস্তি-অস্বস্তিদায়ক তাপমাত্রায় আছে। এই তাপমাত্রায় সে ভালো আছে বলছে। সময়টা যদি গরমকাল হয়, তাহলে শরীর জুড়িয়ে দেওয়া হঠাৎ একটু শীতল বাতাস তার ভিতরে ভালোলাগা নামক বোধের জন্ম দেবে। এই বোধ খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও মোহিত করবে। ফলে মনের ভিতর যে সুখানুভূতির জন্ম দেবে, তা উচ্চতর ইতিবাচক স্বস্তিবোধ থেকে জন্ম নেবে।

যে কোনো ইতিবাচক উদ্দীপনামূলক অনুভূতি, মানুষের মনে বিশেষ সুখদায়ক দশার সৃষ্টি করে। সুখ মুলত একটি প্রবহমান কার্যক্রম। কোনো অনুভূতি যখন অস্বস্তিদায়ক দশা থেকে স্বস্তিদায়ক দশার দিকে অগ্রসর হয়, তখন যে চলমান অনুভূতির জন্ম হয়, তখন তাকে সুখানুভূতি বলা হয়। যতক্ষণ এই স্বস্তিদায়ক দশার উন্নতি হতে থাকে, ততক্ষণ সুখানুভূতি থাকে। যখন তা থামে, তখন সুখবোধও থেমে যায়। কিন্তু মনের ভিতর এর রেশ থেকে যায়। ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার সূত্রে সৃষ্ট সুখবোধ মনের ভিতরে দীর্ঘক্ষণ বা দীর্ঘকাল স্মৃতি হিসেবে থেকে যায়, কিন্তু সুখ থাকে না। অবশ্য সুখবোধ স্মরণ করে নতুনভাবে সুখের ভাব মনে আনা যায়। কিন্তু আগের সুখটি কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না। বরং সুখের স্মৃতি রোমন্থন করে নতুন সুখের জন্ম দেওয়া যায়। সদ্য ঘটে যাওয়া সুখবোধ অতীত হলেও এর রেশটুকু এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, মনে হয় এখনই ঘটলো। মনে হয় না, এটি ছিল একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা মনে যে আবেশিত দশার সৃষ্টি হয়, তাই আনন্দ। অন্যভাবে বলা যায়, মনের ভিতর ছড়িয়ে পড়া সুখবোধই হলো আনন্দ।

স্বস্তি-অস্বস্তি জোয়ার-ভাটায় সুখের অবস্থান পাল্টায়। একটি সুনির্দিষ্ট সুখদশা একটি উচ্চশিখরে পৌঁছার পর, তার গতি হয় নিম্নমুখী। যদিও সুখের অনুভূতির প্রাবল্যে উঠাপড়া ক্রিয়া চলে, তবুও সুখানুভূতি আন্দোলিত হয়। একসময় প্রবল সুখানুভূতিও একঘেঁয়েমিতে পর্যবসিত হয়। ফলে মনের ভিতরে ছড়িয়ে পড়া সুখ মিলিয়ে যেতে থাকে এবং একই সাথে আনন্দও হ্রাস পেতে থাকে। একসময় তা অস্বস্তির দিকে অগ্রসর হয়।
 

আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তার স্মৃতি প্রশান্তিরূপে মনে থাকতে পারে দীর্ঘদিন। আনন্দের জন্ম ঘটমান সুখানুভূতির প্রবহমান ধারায়। তাই প্রতিমুহূর্তের আনন্দ সময়ের সুতোয় যে গিট তৈরি করে, তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। এরই ভিতর দিয়ে একটি আনন্দদায়ক অনুভূতি ম্লান হয়ে যায় এবং এক সময় তা নিরানন্দে পরিণত হয়। কিন্তু দীর্ঘ বা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তা আবার জাগ্রত হয়ে উঠতে পারে বা উঠে। কোনো আনন্দদায়ক গান কয়েকবার বা কয়েকদিন শোনার পর আর শুনতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু তার আনন্দদায়ক অনুভূতিটা থেকে যায় স্মৃতিতে। কিছুদিন পর আবার ওই গান শুনে পুরোনো আনন্দটা ফিরে আসে। তবে সে শোনার সাথে কিছু স্মৃতিকাতরতাও থাকে।
 

ধরা যাক, একজন মানুষ স্বস্তি-অস্বস্তিনিরপেক্ষ দশায় আছে। এমন সময় একটি সুমিষ্ট সুর শুরু হলো। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হচ্ছে, ওই সুরটি ওই মানুষটির মনে স্বস্তিদায়ক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থায় তার ভিতরে ধ্বনির দ্বারা একটি স্বস্তিদায়ক দশার শুরু হবে। প্রাথমিক অবস্থায় সুরটি স্বস্তিদায়ক দশার উচ্চ স্তরের দিকে অগ্রসর হবে। এই অবস্থায় ওই মানুষের মনে একধরনের সুখানুভূতির জন্ম দেবে। এই সুখানুভূতি যদি তার মনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা আনন্দে পরিণত হবে। মানুষের মন যদি ধীরে ধীরে সাধারণ স্বস্তি দশা থেকে আনন্দ দশায় উন্নীত হতে থাকে, তখন সুখের ক্রমোন্নতির ধারায় বোধের দ্বারা আবেশিত হয়। কিন্তু হঠাৎ পাওয়া কোনো বিষয় বা দ্রুত ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা থেকে যখন মানুষ আনন্দ পায়, তখন কিছুক্ষণের জন্য সে তার আশ-পাশের সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে যায়। আনন্দের এই তীব্র অনুভূতি ম্লান হয়ে গেলে দেখা যায়, আনন্দ পাওয়ার মুহূর্তে তার কিছুই মনে নেই।

 

মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিতে আনন্দ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু এত সাধের আনন্দ বেশিক্ষণ থাকে না। যে সুর শুনে শ্রোতা আনন্দে আপ্লুত হয়, সেই সুরটি যদি অপরিবর্তিতভাবে একটানা বাজতে থাকে তাহলে শ্রোতার মনে একঘেয়ে অনুভূতির সৃষ্টি করবে। ফলে, তার ভিতরে জন্ম নেবে অস্বস্তি এবং শোনার আনন্দময় অনুভূতিটি ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী হয়ে অস্বস্তির দিকে চলা শুরু করবে। আনন্দ প্রাপ্তির ক্রমধারায় যে সুখানুভূতি পাওয়া যায়, আনন্দের নিম্নগামিতায় তা হ্রাস পেতে থাকে। একই সাথে মনের ভিতরে ছড়িয়ে পড়া আনন্দ ম্লান হতে থাকবে।

কিন্তু যদি ওই সুরের সাথে একটু পর তালযন্ত্রের সঙ্গত শুরু হয়, তখন শ্রোতার শ্রবণানুভূতিতে বৈচিত্র্য আসবে, শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে একটু মুক্তি পাবে এবং আরও একটু শুনবে। এই সুরটি যদি একই সাথে নানা ধরনের ধ্বনির নকশা তৈরি করতে থাকে, তা হলে শ্রোতার মনে গতির সঞ্চার হবে। সুখের পরে সুখের ঢেউয়ে সেই গতির সরলরেখায় আন্দোলিত অনুভূতির সঞ্চার হবে, এর ফলে সমগ্র শ্রবণ প্রক্রিয়ার ভিতর বিচিত্র আনন্দের অনুভূতি সক্রিয় থাকবে। কোনো শিল্পী যদি বৈচিত্র্য দিয়ে তার সুরকে উপস্থাপিত করতে না পারেন, তাহলে শ্রোতা আনন্দ লাভ থেকে বঞ্চিত হবেন। শিল্পের বৈচিত্র্যের জন্য শুরুটাও জানতে হয়, শেষ করাটাও জানতে হয়। মনকে ভরিয়ে দেওয়াও জানতে হয়, আবার শূন্য করে দেওয়াটাও জানতে হয়।
 

আনন্দ গ্রহণকারীর বিচারে আনন্দের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন

আনন্দ প্রাপ্তির প্রকৃতি
আনন্দের অনুভব 'আমি' গ্রহণ করে 'মন'-এর মাধ্যমে। তাই আনন্দের আধারও মন। মনের কাছে আনন্দের উপাদানগুলো ইন্দ্রিয় দ্বারা বাহিত হয়ে। তাই ইন্দ্রিয়ভেদে আনন্দের প্রকৃতি হয়ে উঠে ভিন্ন ভিন্ন। ইন্দ্রিয়ভেদে এদের নাম হয়ে থাকে, শোনার আনন্দ, দেখার আনন্দ, ঘ্রাণের আনন্দ, স্পর্শের আনন্দ ও আস্বাদনের আনন্দ। এর বাইরে রয়েছে অতীন্দ্রিয় আনন্দ। যেমন খাদ্যগ্রহণের পর মনে যে আনন্দের সঞ্চার হয়, তার অনুভুতি শরীরের স্বয়ংক্রিয়-পদ্ধতির দ্বারা। এর বাইরে ঈশ্বর ভাবাবেশে মনে তৈরি হতে পারে অলৌকিক আনন্দ। আনন্দের প্রকৃতি অনুসারে সবগুলো আনন্দ একই রকম হয় না। প্রকৃতির বিচারে একে ৩টিভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটো হলো- মৌলিক আনন্দ, যৌগিক আনন্দ ও মিশ্র আনন্দ।

আনন্দের স্পর্শকাতরতা
মানুষের চলমানমান জীবনযাত্রা আনন্দ-বেদনার ধারায় প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে বেদনা মানুষকে যত দ্রুত প্রভাবিত করে, ততটা আনন্দ করে না। মানুষ আনন্দের স্বস্তিদায়ক অনুভূতি সহজাত জীবনপ্রবাহে ধরে রাখতে চায়। বেদনা চায় না বলেই তা দ্রুত মনের উপর প্রভাব ফেলে। প্রাত্যহিক জীবনে আনন্দের চেয়ে বেদনার আবেদনও বেশি। ধরা যাক একটি করিডোরে কিছু মানুষ হাসি ঠাট্টায় মগ্ন। আপনি দর্শক হিসেবে দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখে সহজেই এড়িয়ে যেতে পারেন, বিষয়টা ওদের বলে। ওদের আড্ডায় খুব বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেলে বড় জোর ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকাতে পারেন। হয়তো কিছুটা বিরক্তও হতে পারেন। কিন্তু ওই দলের কেউ যদি চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সাথে সাথে আপনি প্রবল আগ্রহ নিয়ে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করবেন। শুধু আপনি নন, আশপাশে আপানার মতো আরও অনেকেই সচকিত হয়ে একইভাবে কান্নার কারণ জানার আগ্রহ প্রকাশ করবেন। 
কখনও কখনও এমন কোনো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়, যা দেখে দর্শক মাত্রেই তীব্র আনন্দে আপ্লুত হয়ে যায় কিম্বা পরম দুঃখে ভেঙে পরে। যেমন সুস্থ শিশুর জন্মটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং সেটাই হয় আনন্দের। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনা অপ্রত্যাশিত এবং নেতিবাচক বলেই এই জাতীয় ঘটনা মনোবেদনার জন্ম দেয়। এই কারণেই বলা হয়, আনন্দের চেয়ে বেদনার স্পর্শকাতরতা অনেক বেশি।

 

আনন্দ নানাভাবে আমাদের জীবনকে স্পর্শ করে। প্রাত্যহিক জীবন প্রবাহে স্বস্তি-অস্বস্তিবোধেরও একটি গড় মান আছে। এই মানটি নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের মানসিকতার উপর। আনন্দ-বেদনার গড় মান আছে। যে ব্যক্তি অল্প শোকে কাতর হয়ে যায়, তার জীবনের আনন্দের ভাগ কম। আবার যে ব্যক্তি জীবনের বেদনাগুলো সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে, তার জীবনে আনন্দের ভাগ বেশি। যে ব্যক্তি সবসময় আনন্দরসে জীবনকে আর্দ্র করে রাখতে পারেন, তাঁর জীবন হয়ে উঠে প্রায় সদানন্দের মেলা।

 

প্রবহমান জীবনযাত্রায় মানুষ বিচিত্রভাবে আনন্দ লাভ করে। এর একটি সহজাত জীবনযাত্রার ভিতরে পায় একটি সত্যের বিচারে। স্বাভাবিক সঙ্গীতের আনন্দ, স্বাভাবিক চিত্রকলার আনন্দ, স্বাভাবিক প্রেমের আনন্দ আমরা প্রত্যহিক জীবনের ঘটমান ঘটনাবলির ভিতরে পাই। এছাড়া প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য থেকেও আমরা যে আনন্দ পাই তাও স্বাভাবিক এবং সত্যাশ্রয়ী। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রায় এ সবের বাইরে এমন কিছু বিষয় যুক্ত হয়, যা স্বাভাবিক নয় কিন্তু সেসব থেকে আমরা আনন্দ পাই। এক্ষেত্রে কর্তা আনন্দ নিজে যতটা পায়, অন্যের সাথে ভাগাভগি করে যেন বেশি পায়। একে বলা যায় অস্বাভাবিক আনন্দ। এই অস্বাভাবিক আনন্দের প্রকৃতি হতে পারে নানা ধরনের। যেমন

আনন্দাবেগ থেকে সৃষ্ট প্রক্ষোভ

মনে আনন্দের সঞ্চার হলে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানাভাবে। কেউ আনন্দে হাসে, কেউ চোখের জল ফেলে। কেউ চিৎকার আনন্দকে সবাইকে জানিয়ে দেয়। কোনো কোনো আনন্দ থাকে নিজের জন্য, এই আনন্দে আত্মতৃপ্তি থাকে এবং তা নিজের ভিতরে অনুভব করে। মানুষের মনে হতে পারে শারীরীক ও মানসিকভাবে।

আনন্দের উত্তোরণ:
যেকোনো আনন্দই হলো একটি স্বস্তিদশা থেকে উচ্চতর স্বস্তিবোধে উত্তোরণের প্রক্রিয়া। সকল আনন্দেরই রয়েছে একটি উত্তোরণ রেখা। একটি পর্যায়ে এসে উত্তোরণ থেমে যায়। জীবনের ছোটখাটো আনন্দ দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। অনেকক্ষণ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার পর কাঙ্ক্ষিত বাস পেয়ে গেলে আনন্দ দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু কিছু আনন্দ আছে যা দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছালে আনন্দের অপূর্ণতার সৃষ্টি হয়। এই বিশেষ ধরণের আনন্দ পেতে হয় পর্যায়ক্রমে বা পর্যাক্রমেই আনন্দের সঞ্চারঘটে। এই জাতীয় আনন্দকে বলা হয়, সঞ্চারমান বা পর্যায়ক্রমিক আনন্দ। যেমন খেয়াল গান শোনার আনন্দ ঘটে পর্যায়ক্রমে। চট্‌জলতি শেষ করলে, খেয়ালগান শোনার আনন্দই নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের যৌনমিলনও এই পর্যায়ের আনন্দ। এই জাতীয় আনন্দ প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের এই আনন্দ মনে আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। এই আকাঙ্ক্ষা পূরেণের ভিতর দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের আনন্দের জন্ম হয়। এই আকাঙ্ক্ষাই পর্যাক্রমে পূর্ণ আনন্দ-পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।

 

প্রকৃতি ও আনন্দ

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। কেন মানুষ ঈশ্বরে সৃষ্টি না বলে প্রকৃতির সন্তান বলা হলো, এ নিয়ে মৌলবাদী চিৎকার উঠতেই পারে। এই চিৎকারে আবেগ থাকে, অন্ধবিশ্বাস থাকে কিন্তু যুক্তিটা থাকে না বা যুক্তি মানার মানসিকতা থাকে না। মৌলবাদীরা এই জাতীয় চিৎকারে নিজেদের বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। আস্তিকতাবাদে ঈশ্বর সবকিছুর স্রষ্টা। তাই প্রকৃতিও ঈশ্বরের সৃষ্টি। একই ভাবে মানুষও প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির সন্তান বলেই মানুষকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। টিকে থাকার সংগ্রামে মানুষ জয়ী বলেই, মানুষের প্রথম আনন্দ লাভ করে বেঁচে থাকার মধ্যে। এবার মানবতাবাদীরা প্রশ্ন তুলবেন বলবেন, শুধু কি বেঁচে থাকাটাই আনন্দ? একটি পর্যায়ে বেঁচে থাকাটাই আনন্দ। এই আনন্দের সূচনা হয়েছিল জীবজগতের আদিম সদস্যের সৃষ্টি লগ্ন থেকে। এখনও আছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের একটি কথা বলি। পাকিস্তানী সৈন্যরা পাবনা জেলার সুজানগর সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নিরীহ ৩০০ শতাধিক পুরুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় স্কুল মাঠে হত্যা করে। এই সময় দু'চারজন মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পরও বেঁচে যায়। এই বেঁচে যাওয়া মানুষ এবং তাদের পরিবারের কাছে বেঁচে যাওয়াটাই আনন্দের ছিল।

 

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির মতো মানবিক মৌলিক উপকরণ সংগ্রহ এবং এগুলোর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানুষ নানা ধরনের আনন্দ পায়। বেঁচে থাকার আনন্দের প্রাথমিক ধাপের পরে প্রকৃতির প্রজাতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়ে যায় বটে, কিন্তু প্রজাতির বিলুপ্তিকে রক্ষা করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন প্রজনন। জীবজগতের প্রজাতিভেদ প্রজননের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। এ সকল প্রজাতির একটি অংশ, স্ত্রী-পুরুষ সত্তার দৈহিকমিলনে প্রজননের প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। এখানে প্রকৃতি কৌশলী। প্রকৃতি প্রজাতির ভিতরে যৌনানন্দের আকাঙ্ক্ষা দিয়েছে। এই আনন্দ লাভের জন্য প্রজাতি যৌনকর্ম করে। এর ফলে শিশুর জন্ম হয় এবং প্রজাতি প্রকৃতিতে টিকে থাকে।

এখানেও মূল লক্ষ্য টিকে থাকার। জীবজগতের সদস্য হিসাবে মানুষের প্রজনন প্রক্রিয়াও প্রকৃতির অংশ। খাওয়ার আনন্দের ভিতর দিয়ে মানুষ দেহ টিকেয়ে রাখে, আর যৌনকর্মের ভিতর দিয়ে প্রজাতি টিকে থাকে। মানুষ অন্যান্য মানবেতর প্রাণীদের চেয়ে চৈতন্যের বিচারে উন্নত। তাই মানুষ শুধুই পশুর মতো যে কোনোভাবে যৌনকামনা চরিতার্থ করার ভিতর সার্বিক আনন্দ পায় না। অবশ্য কোনো কোনো মানুষ ধর্ষণ করে। এর ভিতর দিয়ে তার মানবেতর পশুচরিত্রের প্রকাশ পায়। ধর্ষণের প্রক্রিয়াটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ কর্ম নয়, কিন্তু মনুষ্য প্রজাতির জন্য শোভন নয়, কাম্যও নয়।

প্রকৃতি ও যৌনানন্দ: মানুষ একলিঙ্গিক। প্রজাতি রক্ষা করার জন্য, মানুষের প্রধান ধারায় রয়েছে নারী ও পুরুষ। এর বাইরে অপ্রধান ধারায় রয়েছে নপুংশক। প্রধান ধারার মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষের ভিতরে রয়েছে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যার দ্বারা নারী-পুরুষ পরস্পরের সাথে দৈহিকভাবে মিলিত হতে পারে। জন্মসূত্রে দৈহিক এই বৈশিষ্ট্যের ব্যবস্থা অনুসারে উভয়ের ভিতরে মনোগত প্রকৃতিও তৈরি হয়ে যায়। নারীপুরুষের মনোগত এবং দেহগত বৈপরীত্য থাকলেও মনোগত আকাঙ্ক্ষা থাকে পরস্পরমুখী। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের কারণে নারী-পুরুষের মনে যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে এবং এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রক্রিয়া আনন্দের উদ্ভব হয়। এই আনন্দটা যৌনকর্মে অংশগ্রহণকারী নারীপুরুষের। এর ভিতর দিয়ে প্রজাতি সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি প্রকৃতি করে নেয়। সন্তানের প্রতি স্নেহের সঞ্চারে মধ্য দিয়ে প্রকৃতি প্রজাতি সংরক্ষণের অপর একটি বড় অংশ সম্পন্ন করে।

যৌনানন্দের প্রাথমিক আবেদন সৃষ্টি হয়, দর্শন, শ্রবণ
ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে। বিপরীত লিঙ্গের দর্শনের ভিতর দিয়ে প্রাথমিকভাবে মোহের সৃষ্টি হয়। মূলত স্বাভাবিক দেখার স্বস্তিবোধকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত হওয়ার সূত্র মন আবেশিত হয় এবং মনে আনন্দের সঞ্চার হয়। বিপরীতলিঙ্গের কণ্ঠস্বর, অঙ্গসৌরভ এই মোহের বিস্তার ঘটে। ফলে আনন্দের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। পুরুষোচিত  দৈহিক গড়নের বলিষ্ঠতা, উচ্চতা, কণ্ঠস্বর, অঙ্গসৌরভ নারীর মনে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করে। একই ভাবে নারীর মুখশ্রী, গাত্রবর্ণ, বক্ষসৌন্দর্য, কোমর, নিতম্ব, কণ্ঠস্বর, অঙ্গসৌরভ পুরুষের মনে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। এই আকাঙ্ক্ষার সূত্রে প্রাথমিকভাবে নারী-পুরুষ পরস্পরের অঙ্গ স্পর্শ করে। প্রাথমিকভাবে হাতের স্পর্শ বা আলিঙ্গনের মতো ঘটনা ঘটে। এইভাবে পরস্পরকে দৈহিকভাবে পাওয়ার আনন্দের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। প্রাথমিক এই আনন্দের ভিতর দিয়ে পরস্পরকে আরও গভীরভাবে দৈহিকভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। যৌনকামনা জাগ্রত হয়। এই আকাঙ্ক্ষা দ্বারা তাড়িত হয়ে, আলিঙ্গন, মুখচুম্বন, হাতের দ্বারা পরস্পরে দেহে হস্তসঞ্চালন, আলিঙ্গন, অঙ্গসৌরভের অনুভব যৌনকামনার দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছায়। পুরুষের স্পর্শে নারী আবেশিত হয়ে নিজের দেহের অধিকার পুরুষের হাতে তুলে দেয়। এই পর্যায়ে পুরুষ নারীদের বিভিন্ন স্থানে হাতের সঞ্চালন এবং চুম্বন করে। বিশেষ করে স্তন, নিতম্ব এবং যোনিসংলগ্ন স্থানে স্পর্শ করে। এরই ভিতর দিয়ে পুরুষাঙ্গ দৃঢ়তর হয়ে উঠে, নারী স্তনবৃন্ত দৃঢ়তর হয় এবং যোনির ভিতরে রসের সঞ্চার ঘটে। পুরুষের আগ্রাসন এবং নারীর সমর্পণের ভিতর দিয়ে যোনিতে শিশ্নের অনুপ্রবেশ ঘটে। নারীর পুরুষের রতিস্খলেনর ভিতর দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে। ‌একটি পর্যায়ক্রমিক আনন্দের ভিতর দিয়ে একটি সময় পর্যন্ত নারীপুরুষ অতিবাহিত করে। এরপর পুরো বিষয়টি স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। এই স্মৃতিতে আনন্দের স্মৃতিময় অনুভব থাকে আর থাকে পরস্পরকে পাওয়ার প্রশান্তি।

 

মানুষের আকাঙ্ক্ষিত আবেগ আনন্দ। কিন্তু সবচেয়ে স্পর্শকাতর আবেগ বেদনা। অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই বেদনা মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তাই প্রতিদিনের আনন্দ-সংবাদ যতটা স্মৃতিতে ধরা থাকে, তার চেয়ে বেশি ধরা থাকে ছোটো ছোটো বেদনাগুলো। সবচেয়ে মধুর সঙ্গীত বেদনার, সবচেয়ে আবগে তাড়িত কাহিনি বিরহের কিম্বা বিচ্ছেদের। বেদনাকে সহ্য করতে পারে না, বলেই আনন্দাশ্রু কেউ মুছিয়ে দেয়না সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে। কিন্তু বেদনার অশ্রু যে মুছিয়ে দেয় এবং সে নিজেও অশ্রুপাত করে।