১.১০
বুদ্ধি

জীবের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় দুটি মৌলিক আচরণের মাধ্যমে। এর একটি স্বয়ংক্রিয়, অপরটি ঐচ্ছিক। একজন মানুষ খাদ্যগ্রহণ করবে কিনা তা ঐচ্ছিক, আর খাদ্য পরিপাকের কাজটি হবে স্বয়ংক্রিয়। স্বয়ংক্রিয় কাজ দেহের সহজাত ক্ষমতার দ্বারা সম্পন্ন হয়। কিন্তু ঐচ্ছিক কাজ চলে মনের ইচ্ছায়। মৌলিকত্বের বিচারে এই দুটি ধারার বাইরে জীবের কার্যক্রম অনেক সময়ই স্বয়ংক্রিয় এবং ঐচ্ছিক কার্যক্রমের সংমিশ্রণে সংগঠিত হয়। যেমন মানুষ খাদ্য মুখের ভিতরে নিয়ে, চিবাবে না গিলবে সেটা ঐচ্ছিক, কিন্তু খাদ্য মুখে নেওয়ার পর লালা গ্রন্থি থেকে রসক্ষরণ স্বয়ংক্রিয়। কিন্তু দেহের ভিতরে কিছু প্রবেশ করলে, সেখানে ইচ্ছার কোনো কার্যক্রম থাকে না। দেহের ভিতরে প্রবেশ করেছে এমন কিছুর কার্যক্রম থামাতে হলে, অন্যকিছু দ্বারা তাকে প্রভাবিত করতে হয়ে। যেমন কেউ যদি বিষ খায়, তাহলে বিষ-নিবারক উপাদান খেয়ে বিষের কার্যক্রম থামানো যায় কিম্বা কোনো কিছুর দ্বারা পেটের বিষ বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিষ বা বিষনিবারক, উভয়ই পেটে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। উভয়ের উপরই ইচ্ছার কোনো প্রভাব কাজ করে না।

জীব যত ধরনের কাজ করে তার একটি অংশ হলো পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য।  এর জন্য জীবের দেহগত কিছু ক্ষমতা আছে। আবার এই ক্ষমতা কিভাবে কাজে লাগাবে তার কৌশলটুকুও জন্মগতসূত্রেই পায়। এই সূত্রে জীব যতধরনের ক্ষমতা ধারণ করে, তার সবটুকুই সহজাত ক্ষমতা। এই সহজাত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে প্রবৃত্তির দ্বারা। দেহের ক্ষয়পূরণের জন্য জীবের ভিতরে ক্ষুধা অনুভব হলো সহজাত প্রবৃত্তি। মূলত খাদ্য গ্রহণ, আত্মরক্ষা, বংশবৃদ্ধি এ সবই প্রবৃত্তির অংশ। যতক্ষণ এগুলো স্বাভাবিকভাবে ঘটে ততক্ষণ প্রবৃত্তির অংশ থাকে। জীব জগতের আদিস্তরে জীব প্রবৃত্তির দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। জীবধারণের এই সকল উপকরণে যখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে থাকলো, তখন প্রবৃত্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এর ফলে জীবের বুদ্ধির বিকাশ ঘটলো। পরিবেশ বা পরিস্থিতি সাপেক্ষে জীবের টিকে থাকার প্রচেষ্টাকে তাই বুদ্ধির আদি স্তর বলা হয়। এই স্তরে সৃষ্টি হয়েছিল পরিবেশ বা পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করার প্রচেষ্টা। নানা প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার সূত্রে জীবের দৈহিক ক্রমবিবর্তনের সাথে সাথে বুদ্ধিরও ক্রমবিবর্তন ঘটেছে। এই কারণে উন্নততর জীবে বুদ্ধির বিকাশ বেশি দেখা যায়। জীবজগতে মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেছে এবং জয়লাভও করেছে। সেই কারণে মানুষ জীবজগতে বুদ্ধির বিচারে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকারী হয়েছে।

বুদ্ধি সম্পূর্ণ ঐচ্ছিককার্য ক্রমের অংশ। এই কার্যক্রমে মানুষ তার দেহের স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতা এবং দেহের বাইরের নানা উপকরণ ব্যবহার করে। এর সাথে থাকে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, চেতনা, বোধ ইত্যদির মতো মানসিক উপকরণ।
মানুষ মস্তিষ্কে রক্ষিত জ্ঞানের সুসমন্বিত রূপ হলো প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা মানুষের ভাবনার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে এবং মানসিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ইচ্ছা এবং প্রজ্ঞাজাত ক্ষমতার দ্বারা জীবসত্তায় বুদ্ধির প্রকাশ পায় এবং সমস্যা সমাধানের সূত্রে নবতর সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়। এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন হয় উপযুক্ত মস্তিষ্ক, আর 'আমি' নামক সত্তার সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ। এই উভয়ের সমন্বয়ে প্রকাশ পায় বুদ্ধি।

ধরা যাক, একটি গরম লোহার দণ্ড রয়েছে। 'আমি' জানে এই গরম লোহায় হাত দিলে কি ঘটতে পারে। সে যদি জানে ওই লোহায় হাত দিলে হাত পুড়বে, তা হলে অভিজ্ঞতা তাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখবে। 'আমি'র কাছে সমস্যা হলো হাত না পুড়িয়ে কিভাবে লোহাটিকে স্থানান্তর করা যায়। এক্ষেত্রে 'আমি' অন্য অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। ধরা যাক 'আমি'র কাছে কিছু অভিজ্ঞতা আছে। এগুলো হলো

এই অভিজ্ঞতার আলোকে 'আমি' সবচেয়ে উপযুক্ত পথটি বেছে নেবে এবং গরম লোহাকে স্থানান্তর করবে। 'আমি'র এই পুরো কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে বুদ্ধির প্রকাশ পাবে। দেখা যায় বুদ্ধির জন্য কিছু অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের উপস্থিতির দরকার পড়ে। যেমন

বুদ্ধির এই খেলায় তৈরি হয়েছে বিজ্ঞান। যা জানা হয়ে গেছে, তা জ্ঞান। আর যা বিশেষ ভাবে জানার চেষ্টা, সেটা হলো বিজ্ঞান। জানার চেষ্টার ভিতর দিয়ে যে জ্ঞান অর্জিত হয়, সেটা বিজ্ঞান-জাত, কিন্তু তা আর বিজ্ঞান থাকে। একটি কারখানা থেকে প্রতিদিন বৈদ্যুতিক পাখা উৎপাদন হচ্ছে, এটি বিজ্ঞান নয়। যতদিন বৈদ্যুতিক পাখা বানানোর প্রচেষ্টা ছিল, ততদিন বিজ্ঞান ছিল। প্রথম সফল পাখাটি ছিল বিজ্ঞানের প্রথম ফসল। এরপর যত পাখা তৈরি হবে, তা প্রথমটির প্রতিরূপ মাত্র।

বুদ্ধি বা বিজ্ঞানের চর্চার ভিতরে মস্তিষ্কের ভিতরে কার্যক্রম চলে, তাকে বলা হয় চিন্তন। যখনই মানুষ কোনো সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নেয় তখনই চিন্তন শুরু হয়। এর প্রাথমিক পর্যয়ে মানুষ তার সমস্যাকে স্মৃতির অস্থায়ী ভাণ্ডারে উত্থাপন করে। এরপর উত্থাপিত বিষয়ের ভালোমন্দ বিচার করে। ভালোটা মেনে নিলেও সমস্যা মনের ভিতর এক ধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এই অস্বস্তি থেকে স্বস্তিতে ফিরে আসার উপায় খোঁজে মনে মনে। এই খোঁজার চেষ্টাটাকেই বলা যায় চিন্তন। এই প্রচেষ্টায় অসংখ্য সমস্যা সমাধনের পথ থাকতে পারে। এর ভিতর থেকে উপযুক্ত পথ খুঁজে পাওয়া যায় চিন্তনের মাধ্যমে। আর এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় 'বুদ্ধির প্রয়োগ'। যে সকল কার্যক্রমে চিন্তন-এর বিষয় থাকে না, সেখানে বুদ্ধির প্রকাশের চেয়ে প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত যান্ত্রিক-প্রকাশটাই বড় হয়ে উঠে। প্রতিদিন সকালের নাস্তা বানানোর নব নব প্রক্রিয়ায় বুদ্ধির প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সকালের নাস্তা খাওয়াটা হয়ে উঠে যান্ত্রিক। যেকোনো নতুন বিষয় উপস্থাপনে বুদ্ধির প্রকাশ ঘটে। কিন্তু ওই বিষয় নিয়মিত চর্চার ভিতর দিয়ে ওই বুদ্ধিজাত বিষয় যান্ত্রিক হয়ে উঠে।

মানুষ বহু বিষয় নিয়ে চিন্তন করে। এর কিছু থাকে বস্তুবাচক জগতের, কিছু থাকে অবস্তুবাচক আবার কিছু থাকে মিশ্র। আবার অনেক সময় চিন্তন হয় সরল কখনো তুলনামূলক। এই সকল বিচারে মনোবিজ্ঞানীরা চিন্তনকে নানাভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী
মানুষ স্বাভাবিকভাবে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়, তাকে তাকে বলা যায় গড় বুদ্ধিমত্তা। কোনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো কোনো মানুষ অন্যান্য মানুষদের তুলনায় অগ্রগামী থাকে। ওই সকল মানুষের বিচারে অন্যান্য মানুষকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা হয় না। যেমন একজন মানুষ গণিতশাস্ত্রে পণ্ডিত। তার এই পাণ্ডিত্যের বিচারে অন্যান্য মানুষকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলা হয় না। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বিচারের একজন মানুষ কোনো বিশেষ সমাজের বিচারে কম বুদ্ধির হতে পারে। যেমন একজন সাহিত্যের অধ্যাপকের জ্ঞান, একজন নিরক্ষর কৃষকের ফসল ফলানোর জ্ঞান সমান নয়। ফসল ফলানোর জ্ঞানের বিচারে সাহিত্যের অধ্যাপক অজ্ঞ, কিন্তু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নয়।

স্বাভাবিক বুদ্ধি বিচার করা হয়, আটপৌরে জীবনের গড় কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে। একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে অকারণে পাশের ডোবায় নেমে গেল। এটি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অস্বাভাবিক। এরূপ অসংলগ্ন জীবনযাত্রা যার, সাধারণভাবে পাগল বা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু পাগল এবং বুদ্ধি-প্রতিবন্ধীর মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো পাগলের পাগলামি সাময়িকভাবে সৃষ্টি হয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী জিন-ঘটিত বা জন্মসূত্রে মস্তিষ্কের সুগঠনের অভাবে তৈরি হয়, এটি স্থায়ী বিষয়। একজন মানুষ নানা কারণে যে কোনো বয়সে পাগল হতে পারে। পক্ষান্তরে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দশা হলো জন্মগত সমস্যা।
 
মানুষের বুদ্ধির বিকাশের ক্ষেত্রে জিনঘটিত বিষয়টির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যেমন মানবদেহের ক্রোমোজোম ঘটিত সমস্যার কারণে ডাউন্স সিনড্রোম জাতীয় বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী দশার উদ্ভব হয় হয়। উল্লেখ্য মানব দেহের কোষে ক্রোমোজোমের স্বাভাবিক সংখ্যা ৪৬টি। এই ক্রোমোজোমগুলো ২৩টি জোড়ায় সাজানো থাকে। এর ২১ সংখ্যক জোড়ার সাথে যদি একটি বাড়তি ক্রোমোজোম থাকে, তাহলে ডাউন্স সিনড্রোম সৃষ্টি হয়। এই জাতীয় বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর ব্যক্তিবিশেষ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়।

বুদ্ধ্যঙ্ক
IQ (Intelligence Quotient)
মানুষের বুদ্ধির পরিমাপের জন্য একটি বিশেষ ধরনের গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করা হয়। এই গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে মানুষের বুদ্ধির যে মান পাওয়া যায়, তাকেই বলা হয় বুদ্ধ্যঙ্ক। গাণিতিকি সূত্রে বলা হয়, যে কোনো বয়সের মানুষের মানসিক বয়সকে প্রকৃত বয়স দিয়ে ভাগ করে, ঐ ভাগফলকে ১০০ দিয়ে গুণ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় তাকে বুদ্ধ্যঙ্ক  বলে। ধরা যাক, একটি ১০ বছরের ছেলে ১০ বছরের উপযোগী প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হলো। এক্ষেত্রে ছেলেটির প্রকৃত বয়স ১০ ও মানসিক বয়স ১০। তাহলে ওই ছেলেটির বুদ্ধ্যঙ্ক হবে ১০০।

মানুষের বুদ্ধির পরিমাপ নিয়ে বিভিন্ন সময় মনোবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই বিষয়টি প্রথম উপস্থাপন করেন ফরাসি মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড বিনে
(Alfred Binet)। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্যারিসের একটি স্কুলের ফলাফল খুব খারাপ হলে, স্কুল কর্তৃপক্ষ এর কারণ এবং সমাধানের জন্য আলফ্রেড বিনের শরণাপন্ন হন। বিনে এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই বুদ্ধির পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই সূত্রে তিনি কিছু প্রশ্নোত্তরে ভিতর দিয়ে বুদ্ধির পরিমাপ করার ব্যবস্থা করেন। এই কাজে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন সাইমন নামক একজন সহকারী। পরবর্তী সময়ে এই পরীক্ষাট 'বিনে সাইমন স্কেল' নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। এই স্কেলের প্রশ্নের ধরণ গুলোছিল মুখস্থ করা, মনে করা, চিনতে পারা, তুলনা করা, সম্বন্ধ নির্ণয় করা, বিচার করা, ভুল খুঁজে বের করা, সংখ্যার নানা ধরনের ব্যবহার করা ইত্যাদি। বিনে বুদ্ধিকে একটি বিশেষ মনোগত শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে বুদ্ধি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েছিলন। তিনি মনে করতেন শৈশব থেকে একটি বয়স পর্যন্ত বুদ্ধির শক্তি বৃদ্ধি পায়। এই সূত্রে তিনি প্রশ্নগুলোকে বয়স অনুসারে সাজিয়েছিলেন। এর বয়সের শেষ ধাপ ছিল ১৫ বৎসর। এর ফলে বয়সভিত্তিক একটি মাপকাঠি তৈরি হয়েছিল। বয়সভিত্তিক এই বুদ্ধির মাপকে বলা হয় মানসিক বয়স (Mental Age/ MA)। ধরা যাক একটি ১০ বছরের উপাযোগী প্রশ্নমালা আছে। যদি কেউ ওই প্রশ্নমালার উত্তরগুলো ঠিকঠাক দিতে পারে, তাহলে তার মানসিক ববস হবে ১০। এক্ষেত্রে তার প্রকৃত বয়স ১২, ১৪ ইত্যাদি যা কিছু হতে পারে।

 

এরপর বিনে মানসিক বয়সের সাথে প্রকৃত বয়সের সমন্বয় করে, কোনো ব্যক্তির যথার্থ বুদ্ধির পরিমাপ নির্ণয় করেন। এক্ষেত্রে তিনি মাসিক বয়সকে প্রকৃত বয়স দ্বারা ভাগ করে একটি মান নির্ণয়ের ব্যবস্থা করেন। এই মানের সাথে ১০০ স্থির মান গুণ করে বুদ্ধ্যঙ্ক স্থির করা হয়। এই ১০০ হলো যেকোনো বয়সের বুদ্ধির গড় মান। এই পদ্ধতিতে বুদ্ধ্যঙ্কের সূত্র হয়-
        বুদ্ধ্যঙ্ক= মানসিক বয়স*১০০/প্রকৃত বয়স।

বুদ্ধ্যঙ্কই যে একমাত্র বুদ্ধি পরিমাপের মাপকাঠি, তা পরম সত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তবে অনেকটাই বুদ্ধির আন্দাজ করা যায়। ১০ বছরের ছেলে ১০ বছরের উপযোগী প্রশ্নটি কি হবে, তার সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। একটি ধাঁধাকে নানা দিক থেকে উত্তর দেওয়া যায়। কেউ হয়তো একটি বিশেষ দিক ছাড়া অন্যদিকটা জানেই না। কিম্বা আগে থেকেই উত্তরটি সে জানে। তাহলে বুদ্ধ্যঙ্কের প্রশ্ন হয়ে যাবে বুদ্ধু'র। আজকাল তো আবার বুদ্ধ্যঙ্কের প্রশ্নোত্তরের বইও পাওয়া যায়। সে সব বই আগেই পড়া থাকলে, আর পরীক্ষকও যদি ওই বই অনুসারে প্রশ্ন করে থাকেন, তা হলে পরীক্ষার্থী সকল প্রশ্নের ঠিকঠাকই দেবেন। যাহোক প্রচলিত পদ্ধতিতে বুদ্ধ্যঙ্কের বিচারে বুদ্ধির যে মান নিরূপণ করা হয়, তা হলো

বুদ্ধ্যঙ্কের হিসেবে দেখিয়ে যেকোনো মানুষকে বুদ্ধু বানিয়ে দেওয়া যায়। একজন বৈষয়িক লোকের কাছে, ঘরছাড়া গান-পাগলা লোক নির্বোধের পর্যায়ে পড়ে। কেউ কেউ ঘুষ খাওয়াকে নৈতিকজ্ঞানহীন মানুষ হিসেবে বিচার করে, আবার অভাবের সংসারে কেউ ঘুষ খায় না বলে, সে নির্বোধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কেউ কাজে খুব ভালো, কিন্তু কাজের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। কেউ বাক্যে বাক্যবাগীশ, কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা।

 

এসকল কারণে বিনে প্রশ্নের ধরণ করেছিলেন স্বাভাবিক। যেমন গরম না ঠাণ্ডা, সপ্তাহের নামগুলো কি? পুথিগত বিদ্যাকে এই মান নির্ণয় থেকে বাদ রাখা হয়। এছাড়া স্থান-কাল ভেদে প্রশ্নের ধরণ নির্ধারণ করা হয়। তা না হলে সমাজের সকল স্তরে বুদ্ধ্যঙ্কের প্রশ্ন একই রকম হতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রশ্নের ধরন কেমন হতে পারে তার উল্লেখযোগ্য নমুনা দেওয়া হলো।

১. শনাক্তকরণ ও নামকরণ
এই প্রক্রিয়ায় কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিছু বিষয় উপস্থাপন করে, প্রশ্ন করা হবে, বিষয়টি কি এবং এর নাম কি? যেমন একটি নৌকার ছবি দেখিয়ে উত্তর নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে একটি সমাজের প্রাপ্তমনষ্ক মানুষের জানার বিষয় থেকে প্রশ্ন করা হবে। বাঙালির কাছে গরু পরিচিত প্রাণী, কিন্তু হায়না নয়। তাই বাঙালির কাছে 'হায়না'র ছবি দেখিয়ে যথার্থ উত্তর আশা করা যায় না।
 

২. মুখস্থ: একটি বিষয় একটি পংক্তি একবার পাঠ করে কতটা যথার্থ উত্তর পাওয়া যাবে। এটা যান্ত্রিক স্মৃতির অংশ বলে স্মৃতিশক্তির অংশ। কিন্তু এই শক্তি, বুদ্ধিশক্তির সহায়ক।

 

৩. স্মরণ: কোনো বিষয় দেখে, শুনে বা পড়ে তা নিজের মতো করে উপস্থাপন করার ক্ষমতা। এই পর্যায়ে এলোমেলোভাবে অঙ্ক দেখিয়ে তা বলার প্রক্রিয়াটা পর্যবেক্ষণ করা হয়। অঙ্কগুলোর সজ্জা হতে পারে ১, ৯, ৫, ৩ ইত্যাদি।

 

৪. তুলনা: কাছাকাছি , দূর-সম্পর্ক বিচারে করে তুলনা করা। এগুলো হতে পারে, ছুটো বড়, হাল্কা-ভারি। হতে পারে হাতি ঘোড়ার মধ্যে পার্থক্য। একই সাথে বিপরীতার্থক বিষয় উল্লেখ করা হতে পারে। যেমন- ঠাণ্ডার বিপরীত গরম, হাল্কার বিপরীত হবে ভারি ইত্যাদি।


৫. ধারাবহিক বর্ণন: কোনো কিছুকে ক্রমিকধারায় গণনা করা। কিম্বা পাশাপাশি রঙ রেখে পর্যায়ক্রমে বলে যাওয়া।

 

৬. অম্ভবতা নির্ণয়: যদি বলা যায়, গরু গাছে উঠে পাতা খায়। এর ভিতরে সম্ভবতা ও অসম্ভবতা নির্ণয় করা।


৭. সূত্রনির্ভর প্রশ্ন: একটি বিবরণ দিয়ে তার মতো আর একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবার চেষ্টা। যেমন- মানুষ হাটে, মাছ কি করে? উত্তর হবে সাঁতার কাটে।

 

৮. বিচারকরণ: বিবেচনা করে উত্তর খুঁজে বের করা। যেমন-গরমকালে মানুষ পাখা ছাড়ে কেন?

 

৯. সেটতত্ত্ব: একই জাতীয় বস্তুর শ্রেণিকরণের চেষ্টা। যেমন- কাগজ, কলম, কালি এগুলো লেখার সামগ্রী কিনা। একই সাথে এমন প্রশ্ন হতে পারে,  কাগজ, কলম, রসগোল্লা, কালি এগুলোর ভিতরে কোনটি লেখার উপকরণ নয়।

 

১০. শূন্যতা পূরণ: সাধারণত যৌক্তিক বিচারে যা হওয়া উচিৎ, তা না থাকলে তা খুঁজে বের করে উত্তর দেওয়া। যেমন- স্বাভাবিক অঙ্কক্রম ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হতে পারে- ১, ৩, ৫, ৭, ৯  অঙ্কগুলোর ভিতরে কোনো অঙ্কগুলো নেই, তা খুঁজে বের করো।

 

১০. সমস্য ও তার সমাধান: কিছু সমস্যাবাচক প্রশ্ন করে, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা। যেমন- একটি ঠোঙায় চারটি কমলা নেওয়া যায়। ৮টি কমলার জন্য কয়টি।


সমাজ, বয়স, পরিবেশ ইত্যাদিভেদে প্রশ্নের ধরণ এবং প্রকরণ নানা রকম হতে পারে।

বিনে-সাইমন স্কেল তৈরি হয়েছিল ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০৫, ১৯০৮, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনবার সংস্কার হয়। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বিনের মৃত্যুর পর এর সংস্কার বন্ধ হয়ের যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্টের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টারম্যান ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন আর এর পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। এই সংস্করণের নাম স্ট্যাফোর্ড-বিনে স্কেল। পরবর্তী সময়ে এই স্কেলের আরও সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

 

ছোটো রূপ দিয়ে দিয়ে ভাবমূর্তি গড়ে উঠে তার ভিতর দিয়ে মানুষের মনের গভীরে যে অনভূতির সঞ্চার হয়, তাই দিয়ে মন বিভিন্ন দশায় উপনীত হয়। এরই ভিতর দিয়ে মানুষের মনে 'বিচার' নামক কার্যক্রম শুরু হয়। এই বিচারের ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় কিছু মানবিক বিশেষ অনুভূতি। এই বিশেষ অনুভূতি থেকে জন্ম নেয় ন্যায়-অন্যায়, সাহস, হীনমন্যতা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার আগে জানতে হয় মন এবং মনের বিচার। তাই পর পর দুটি অধ্যায়ে আলোচনা করবো 'মন ও মনোজগৎ' সম্পর্কে।