১.৯
চেতনা ও রূপ

আমি'র চেতনায় আছে জগৎ সংসার। তাই 'আমি' আছে বলেই জগৎ আছে। 'আমি'র চেতনার ভিতরে আছে জগতের রূপ। এই বিপুল বিশ্বচরাচর জুড়ে এত আয়োজন। 'আমি' আছে বলেই জগৎ সৃষ্টি সার্থক। বিষয়টি প্রতিটি মানুষের বোধের বিচারে সত্য। কিন্তু চরম সত্য নয়। কোনো মানুষের মৃত্যুর অর্থ যদি হয়, আত্মার বিনাশ। অর্থাৎ একটা চেতনার বিনাশ। সেই মানুষটির বিচারে, সে নাই তো জগৎ নাই। কিন্তু জগৎ থেকে যায় অন্যের চেতনায়। একজন জীবিত মানুষ অন্য একজন মানুষের মৃত্যুর পরও জগতের অস্তিত্ব খুঁজে পায় তার নিজের চেতনার ভিতর দিয়ে।

 

প্রতিটি মানুষ এই জগৎকে যে চেতনার ভিতর দিয়ে উপলব্ধি করে, সেটা তার একান্তই নিজস্ব উপলব্ধি। প্রতিটি মানুষের ভিতরে জগতের যে রূপ অবস্থান করে তা এক রকম নয়। ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার বিচারে এবং উপলব্ধি করার প্রক্রিয়ার ভিতরে জগতের রূপ নানাভাবে প্রকাশ পায়। একজন আদর্শ দৃষ্টি শক্তির অধিকারীর কাছে জগতের রূপ একরকম, জন্মান্ধের কাছে অন্যরকম। এরূপ পঞ্চেন্দ্রিয়ের গুণাগুণের বিচারে একই জগতের সকল মানুষের কাছে জগতের রূপ একরকম হয় না। এমন কি পাশাপাশি দুটি মানুষের কাছে জগতের রূপ একরকম হয় না। কিছু সাধারণ উপলব্ধির বিচারে সকল মানুষ কিছুটা একই রকম অনুভব করে। কিন্তু সেটা হলো সকলের অনুভবের গড় মান। কিন্তু বিশেষ মানের বিচারে প্রতিটি মানুষের জগৎ পৃথক।


প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যা অন্যান্য সত্তা থেকে ওই সত্তাকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করে। সত্তার এই বিশেষ গুণই হলো তার নিজস্ব রূপ। এই রূপ প্রতিটি 'আমি'র কাছে তার অনুভবের একক বা সংমিশ্রিত একটি বিমূর্ত ধারণা। এবং এই ধারণা প্রতিটি 'আমি'র কাছে চেতনার সৃষ্টি করে এবং তার চেতনাতেই অবস্থান করে। প্রতিটি মানুষ যে 'আমিত্ব' নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, শৈশব থেকেই সে 'আমিত্ব' নানা ধরনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির দ্বারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠে। নানা রকমের অনুভূতির সংমিশ্রণে ক্রমান্বয়ে মিশ্র অনুভূতির জন্ম হয়, এই অনুভূতি জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং চেতনার মধ্য দিয়ে একটি বিমূর্ত অনুভবের সৃষ্টি করে। এই অনুভবের ভিতরে রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে এইভাবে যত ধরনের রূপ, আমাদের মনোলোকে সৃষ্টি হয় এবং তা মনোলোকেই রয়ে যায়। এই রূপের  স্বরূপ বিবেচনা করলে ৪টি বিষয় প্রাধান্য পায়। এগুলো হলো

১. সত্তার রূপবৈচিত্র্য: চারপাশের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল সত্তাই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজ করে। এটি হলো সত্তার রূপধর্ম। এই রূপ এককভাবে বা অন্য রূপের সমন্বয়ে প্রকাশিত হতে পারে। যেমন একখণ্ড লোহা, এর নিজস্ব ধর্ম-রূপ আছে। লোহা দিয়ে তৈরি হয় দা। এতে থাকে লোহার রূপ এবং দা-এর রূপ। আকার অনুসারে দা আবার নানা ধরনের হয়। প্রতিটি সত্তা যতধরমের রূপ পরিগ্রহ করে, তার সামাগ্রিক অবস্থাই হলো তার রূপবৈচিত্র্য।


২. আমি'র রূপ বিচার:
একটি সত্তার কী রূপ, তা অনুভব করে 'আমি' নামক সত্তা। এক্ষেত্রে 'আমি'র অনুভবটাই মূখ্য। স্বাভাবিক দেখার ক্ষমতা আছে এমন লোকের কাছে আগুনের রূপটা, আগুনের একটি বিশিষ্ট ধর্মকে প্রকাশ করবে। অন্ধজনের কাছে এ রূপের কোনো মূল্য নেই। এখানে আগুনের পূর্ণরূপ ধ্রুব। কিন্তু নানা আমির বিচারে ধ্রুব নয়। এমন কি একজন আদর্শ ইন্দ্রিয়ক্ষমতাধারী মানুষের বিচারে কোনো সত্তার প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে না। মূলত মানুষ ইন্দ্রিয় দ্বারা যা অনুভব করে, তার বাইরের সকল রূপই অতীন্দ্রিয়। কোনো অগ্নিকুণ্ড থেকে যদি অতি-বেগুনি-রশ্মি নির্গত হয়, তাহলে মানুষ তা দেখতে পায় না। এই কারণে আমরা বস্তু জগতের যা দেখি সেটাই সব দেখা নয়। মানুষের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার বিচারে, কোনো সত্তারই পূর্ণ রূপ দেখা হয়ে উঠে না। পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা মানুষ যা অনুভব করে এবং যা অনুভব করতে পারে না, তার সম্মিলিত মানই হবে সত্তার প্রকৃত রূপ্।

 

৩. আমি'র  অভিজ্ঞতা: মানুষের রূপগত ধারণা হলো তার ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধির সামগ্রিক বিচার। মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপগত ধারণা জন্মলগ্নে খুব একটা বেশি থাকে না। মাতৃগর্ভের স্মৃতি মানুষ স্মরণ করতে পারে না। তাই সে সেখানকার কোনো ধরনের রূপকেই অনুভবের ভিতরে আনতে পারে না। এখানে মস্তিষ্কের পূর্ণবিকাশের বিষয়টা জড়িত থাকে। মাতৃগর্ভের স্মৃতিকে ধরে রাখার মতো মস্তিষ্ক ক্ষমতা অর্জন করে না বলে, মানব শিশুর অনুভব চিরতরে হারিয়ে যায়।

জন্মের পর থেকে মানবশিশু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে। এরপর সকল অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে মনের ভিতর মিশ্র অনুভব সঞ্চিত হতে থাকে। আর এই অনুভূতির মধ্য দিয়ে নানা ধরনের রূপের জন্ম হয়। ধরা যাক, একটি শিশু মোমবাতির আলো প্রথম দেখছে। তার কাছে আলো দেখার একটি অনুভব তৈরি হবে। এই আলোকশিখার একটি দৈহিক আকার আছে এবং আলোটা স্থির না থেকে কাঁপছে। এই তিনটি অনুভূতি মিলিত হয়ে, তার মনের ভিতর একটি মিশ্র অনুভবের সৃষ্টি হবে। এই মিশ্র অনুভবের সূত্রে শিশুর মনে একটি উপলব্ধি ঘটবে। এই উপলব্ধি স্মৃতিতে থাকবে জ্ঞান হিসেবে। এই জাতীয় জ্ঞান থেকে সৃষ্টি হবে একটি ভিন্নতর মৌলিক অনুভব। এই অনুভবই প্রদান করবে মৌলিক রূপ।

 

৪. আমি'র সততা: 'আমি' তার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সত্তার যে রূপকে চিনতে শেখে, তার সাথে অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে তুলনা করে একটি সত্যে উপনীত হতে চায়। 'আমি' যেসকল মৌলিকরূপকে অনুভবে রাখে, তার মধ্য দিয়ে সে একটি সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। ধরা যাক, দূরের মাঠে একটি গরু এবং একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এমন একজন দর্শক যার স্মৃতিতে আগে থেকে মানুষ এবং গরুর মৌলিক রূপটি রক্ষিত আছে। তার কাছে রূপের একটি অবয়বগত মান হিসেবে গরু ও মানুষ উপস্থাপিত হবে। দর্শক মাঠের দুটি প্রাণীর মৌলিক রূপের পার্থক্য অনুসারে গরু এবং মানুষকে আলাদা করে চিনতে পারবে। এখানে দর্শক হিসেবে যে মানুষটি দেখছে, তার ভিতরের 'আমি' এই মানুষ এবং গরুর পার্থক্য নিরুপণের জন্য মনোজগতে তুলনামূলক বিচারের মধ্য দিয়ে একটি সত্যে উপনীত হবে। প্রাথমিকভাবে এই সত্যের প্রধান রূপটিই প্রাধান্য পাবে। যেমন এক্ষেত্রে গরুর গায়ের রঙ, মানুষের উচ্চতা গায়ের রঙ ইত্যাদি প্রাধান্য পাবে না। প্রয়োজনে সে অন্যান্য উপকরণের মৌলিক রূপের দিকে নজর দেবে।  'মাঠের মানুষটি লম্বায় কতটা' যদি সেটা জানার প্রয়োজন হয়। একটি মাঠে সাদা ও কালো রঙের গরু যদি থাকে। গরুর অবয়গত রূপটি হবে মৌলিক রূপ। এই মৌলিক রূপ ধরে দুটি গরু চেনা যাবে। কিন্তু সাদা বা লাল রঙ, ওই দুটি গরুকে সুনির্দিষ্ট করবে। যদি গরু দুটি মৃত হয়। তাহলে জীবিত গরু দুটোর জীবিত থাকার বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনা করে মৃত গরুকে শনাক্ত করা যাবে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে গরুর মৌলিক অবয়বগত রূপই  প্রাধান্য পাবে। এখানে আমি'র সততা নির্ভর করে কোনো সত্তা সম্পর্কে সে কতটুকু জানতে পেরেছে, তার উপর।

 

আমরা প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সময়ই এমন অনেক সহায়ক উপাদানকে অগ্রাহ্য করি।  পান করার জন্য এক গ্লাস পানি যদি আপনার প্রয়োজন হয়, আপনি কলস থেকে গড়িয়ে নিয়ে খেতে পারেন। খাওয়ার উপযোগী পানির সাধারণ পরিচয়ে আপনি যে সত্যটা উপলব্ধি করবেন, একজন রসায়ন বিজ্ঞানীর কাছে পানির সত্যটা হবে আরো ব্যাপক।

চেতনায় রূপের ক্রমবিকাশ:
যে কোনো 'আমি'র ক্রমবিকাশ শুরু হয়, তার ভ্রূণ দশা থেকে। ভ্রূণ দশায় মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গরূপ থাকে না বলে, আমি'র কোনো অনুভব স্থায়ী রূপ পায় না। আবার যেদিন থেকে থেকে মস্তিষ্ক রূপ নির্ধারণের উপযোগী হয়ে উঠে, তখন থেকে সকল অনুভব যে স্থায়ী রূপ পায় তাও না। ভুল ভাঙার খেলায় চলে রূপের ভাঙা গড়ার খেলা। শৈশবের দৈত্য-দানব, রাক্ষস-খোক্কশের যে রূপ শিশুর মনে ধরা থাকে, বড় হয়ে তার একটা রূপ মনে থেকে থাকে, কিন্তু সত্যের বিচারে তার অবস্থান হয় কল্পজগতে।

জন্মের পর পরই শিশুর কাছে মায়ের সামগ্রিক রূপ থাকে না। সে মায়ের কণ্ঠস্বর শোনে, এটি তার কাছে কণ্ঠস্বরের একটি মৌলিক রূপ হিসেবেই চিহ্নিত হবে। যার দ্বারা সে অন্যান্য নারীকণ্ঠ থেকে মায়ের কণ্ঠকে পৃথক করতে পারবে। মায়ের নাক, মুখ, চোখ, হাসি ইত্যাদি ছোটো ছোটো দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে শিশুর মনে তৈরি হবে একটি মূর্তিমতী রূপ। এর সাথে যুক্ত হবে মায়ের স্নেহ-মমতা, স্পর্শ, অঙ্গসৌরভ, স্নেহ, তিরস্কার, রাগ ইত্যাদি। এরূপ অজস্র রূপের ভিতর দিয়ে মা ও শিশুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। যেকোনো মানুষকে তার মায়ের রূপ বর্ণনা করতে বললে, সে অজস্র উপমা, গল্প দিয়ে তা উপস্থাপন করার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু তারপরে মনে হবে, মায়ের পূর্ণাঙ্গ রূপ তার বলা হলো না। এটা শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, বোধ করি সকল ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে।

 

বহুবার শোনা গানের প্রারম্ভিক যন্ত্রসঙ্গীত শুনেই বলা যায়, কি গান শুনতে বসেছি। এটা এতটাই সোজা ব্যাপার যে, অনেকে এটাকে হয়তো অনুভবের উদাহরণ হিসেবে আনতেই রাজি হবেন না। কিন্তু রাগসঙ্গীতের ক্ষেত্রে? কোনো গায়ক যখন রাগসঙ্গীতের আসরে বসে কয়েকটি স্বর নিয়ে একটু আলাপ করেন, তখন অভিজ্ঞ শ্রোতা রাগরূপটি অনুভব করতে পারেন। এমনকি দেখা যায়, শিল্পী যে বন্দিশ পরিবেশন করবেন তা হয়তো, শ্রোতা আগে শোনে নি। কিন্তু শ্রোতার অনুভবে আছে বহু রাগের ছাঁচ। সে শিল্পীর কয়েকটি স্বর নিয়ে আলাপ শুনেই আগের ছাঁচের সাথে মিলিয়ে ঠিকই রাগ নাম উল্লেখ করতে পারবেন। তালজ্ঞান যাঁর আছে, তিন ত্রিতালের বোলবাণী ও চলন শুনেই বলে দিতে পারেন। তা সে তবলায় বাজুক আর খোলে বাজুক। তা একক বাদন হোক আর সঙ্গত হোক। মূলত এই কাজটি হয়, অনুভূতির ছাঁচে। এই ছাঁচ মূলত স্মৃতিতে থাকে একক দল গঠন করে। যে কোনো বিষয়ের শৈলী যখন কারো সামনে উপস্থিত হয়, তখন পুরো শৈলীকে সে অনুভব করে এবং স্মৃতিতে রক্ষিত ছাঁচের সাথে মিলিয়ে চেনার চেষ্টা করে।

 

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মনে অসংখ্য মৌলিক রূপ সঞ্চিত থাকে। তার অধিকাংশই সে স্বাভাবিক মনে করে। এরূপ মনে হওয়ার পিছনে দুটি প্রধান কারণ থাকে। প্রথমটি হলো মানুষের জিন সঙ্কেতের ভিতরে রূপ তৈরির প্রক্রিয়া থাকে। ফলে বহু অনুভব মিলে যখন কোনো রূপ তৈরি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই হয়। এর জন্য 'আমি'কে কোনো ইচ্ছা শক্তির দ্বারস্থ হতে হয় না। জিনসঙ্কেতে থাকে মূলত কিছু অনুভবের ছাঁচ। যার দ্বারা একটি ধারণা তৈরির সুযোগ থাকে। বাস্তবে সে যা অনুভব করে তার সাথে ওই ছাঁচের মিল ঘটিয়ে সত্যিকারের অনুভবের কাজটা হয়। পাশের দুটি ছবি রয়েছে। ছবি দুটি যথাযথভাবে আঁকা না হলেও, একজন দর্শক অনুভব করবেন, এর একটা ত্রিভুজ, অপরটি আয়তক্ষেত্রে। এই দুটি জ্যামিতিক কাঠামোর সাথে আগে পরিচয় থাকলে, অনুভবটা দ্রুত ধরা পড়বে। এই অনুভবটা মনের ভিতরে মৌলিক রূপের জন্ম দেয়। 

দ্বিতীয় কারণ হলো
শৈশব থেকে মানুষ যত ধরনের অনুভবের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠে, যত ধরনের রূপকে সে মনে ঠাঁই দেয়, তার সবগুলোর হদিস মানুষ নিজেই স্মরণ করতে পারে না। রূপ অনেকটা অধরা হয়ে থাকে স্মৃতিতে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে নানা ছলে রূপ ধরা দেয়। কিন্তু ইন্দ্রিয়বাহিত অনুভূতি যখন 'আমি'র কাছে পৌঁছায়, তখন মনের উপরিতলে যথাযথ রূপসমূহ ধরা পড়ে। যখনই কোনো ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতি 'আমি' অনুভব করে, তখন তার স্মৃতিতে থাকা রূপের সাথে সে মেলাতে চায়। স্মৃতির রূপের সাথে নতুন রূপের সমন্বয় করতে গিয়ে, 'আমি' নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে। তারও একটি রূপ তৈরি হয়। ধরা যাক একটি কিশোরের কাছে ডিঙি নৌকার একটি রূপ আছে। একদিন সে একটি পাল তোলা নৌকা দেখলো। সে আগের দেখা ডিঙি নৌকার রূপের সাথে পাল তোলা নৌকার রূপকে মিলিয়ে নেবে। তারপর সেটাকেও নৌকা হিসেবে চিনবে। একই সাথে পাল তোলা নৌকার একটি রূপের জন্ম নেবে এবং তা স্মৃতির অন্তর্গত হবে। মূলত প্রতিটি রূপে একটি মৌলিক আদল থাকে। ওই মৌলিক আদলকে অনুসরণ করেই নতুন নতুন রূপের ভিতরেও মৌলিক রূপকে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে 'আমি' মিশ্র রূপের ভিতর দিয়ে একাধিক রূপকেও অনুভব করতে পারে, আবার একই সাথে মিশ্ররূপকেও অনুভব করতে পারে।

 

মানুষ যে রূপকে কখনো দেখে নি, তার সংস্পর্শে এলে সে হতচকিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তার কাছে নতুন রূপের প্রকৃতি অনুসারে অভিজ্ঞতার জন্ম নেয়। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই ওই রূপের দ্বারা মানুষ আনন্দ, দুঃখ বেদনা ইত্যাদির মতো অনুভবকে ধারণ করে। শিশু জ্বলন্ত মোমবাতির আলো দেখে, আলোর রূপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে। আবার ওই আলো ধরতে গিয়ে যে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তার হবে, সে রূপ হবে ভিন্নতর। উভয় অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তার মনের ভিতর একটি মিশ্র রূপের জন্ম নেবে। এরপর যখন সে আবার জ্বলন্ত মোমবাতি দেখবে, সে হাত বাড়িয়ে তা ধরতে যাবে না। কারণ, তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে, জ্বলন্ত মোমবাতির আলোর রূপ তার জানা হয়ে গেছে। পূর্ব-অভিজ্ঞতার আলোকেই মানুষ রূপের প্রকৃতি বিচার করে। আর এই অভিজ্ঞতার দ্বারাই সে নির্বাচন করে, কোনো রূপকে সে গ্রহণ বা বর্জন করবে। এর ভিতর দিয়ে 'আমি'র ভিতরে ঔচিত্যের জন্ম নেয়।

 

রূপকে চেনার কাজটি মনের গভীর কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির বিচারে তা নানাভাবে হতে পারে। উপরের আলোচনা সাপেক্ষে রূপ অনুভব করার ক্ষেত্রকে দুটি পর্যায়ে ঘটে বলে অনুমান করা যায়। যেমন

অনেক সময়, কোনো রূপকে 'আমি' যথাযথভাবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে 'আমি'র স্মৃতিতে ওই  সত্তার কোনো রূপগত নিদর্শন নেই। অনেক সময় কোনো সত্তাকে চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু ঠিকঠাক চেনা যায় না। এক্ষেত্রে 'আমি' একটি সত্তার ভিতরে চেনা-অচেনা দুটি রূপই যুগপৎ কাজ করে, ফলে 'আমি' চেনা-অচেনার সংশয়ে ঘুরপাক খায়। বা স্মৃতি-বিভ্রাটের কারণে আগের অভিজ্ঞতালব্ধ রূপকে 'আমি' চিনতে পারে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির বিচারে রূপের প্রকরণে পার্থক্য সৃষ্টি করে। ইন্দ্রিয়ভেদ সংবেদনের মাধ্যমে এই রূপ গড়ে উঠে। দেখার ভিতর দিয়ে যে রূপের আদল পাওয়া যায় শ্রবণ, আঘ্রাণ, স্পর্শন বা আস্বাদনে তার রূপ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। যেমন

রূপের াবমূর্তি:
প্রতিটি অনুভূতির একক রূপ থাকে। আবার অনেকগুলো রূপ মিলে একটি বড় রূপ তৈরি হয়। প্রতিটি রূপ মনোজগতে বিরাজ করে।  অনুভবের ভিতরে রূপের মূর্তমান দশাই হলো ভাবমূর্তি। যেমন আগুনের একটি সাধারণ রূপ আছে। মোমবাতির আগুন, দিয়াশলাইয়ের আগুন, চুলার আগুনে একটি সাধারণ রূপ থাকে। এটি আগুনের ভাবমূর্তি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ আগুনের সাধারণ রূপের সাথে বাড়তি কিছু উপদান যুক্ত হয়ে পৃথক পৃথক রূপও তৈরি হয়। ফলে মোমবাতির আগুন, দিয়াশলাইয়ের আগুন, চুলার আগুনের পৃথক পৃথক রূপ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে মূল রূপের সাথে
ছোটো ছোটো রূপ একীভূত হয়ে জন্ম নেয়, একটি অখণ্ড রূপ। এক্ষেত্রে আগুনের সাধারণ রূপ হবে ভিত্তি। আর এর সাথের অন্যান্য ছোটো ছোটো রূপ নিয়ে তৈরি হবে, পৃথক পৃথক আগুনের রূপ। এই রূপ অনুভবের ভিতর দিয়ে যে পূর্ণাঙ্গ ধারণার জন্ম নেয় প্রতিটি সত্তার ভাবমূর্তি। ভাবমূর্তি নানা ভাবে তৈরি হতে পারে। যেমন

রূপের আশ্রয়েই জগতের প্রকাশ। স্বস্তি-অস্বস্তির প্রাথমিক রূপের উন্নততর দশায় আনন্দরূপ প্রস্ফুটিত হয়। আবার সুসমন্বিত বহুবিধ আনন্দের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে যা, তাই হলো সুন্দরের রূপ। এর সাথে যুক্ত হয় অলঙ্কার, ভাবরস ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রূপের রূপান্তর ঘটে। আবার সৃজনশীল কল্প-বাস্তব দশায় এসে যে মঙ্গলময় রূপের প্রকাশ ঘটে তা হয়ে যায় শিল্প। অকল্যাণকর রূপের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে বর্জ্য-শিল্পের। আর কল্যাণকর নান্দনিক রূপের ভিতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় সুকুমার শিল্প। সুকুমার শিল্প নানা ভাগে বিভক্ত। যেমন কাব্য, নাট্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যাদি সবই সুকুমার কলা এবং এদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব রূপ।