৩.১
দেহালঙ্কার
দেহ হলো 'আমি'র নিজস্ব ঘর। এই ঘরের ভিতরে থাকে 'মন'। ভিতরের এই অংশ বিমূর্ত। ত্রিমাত্রিক জগতের বস্তুধর্মে দেহ দেখা যায়, তা হলো দৈহিক অবয়ব। মনজগতের রূপ-দর্শনের বিচারে দৈহিকরূপের একটি আদল থাকে। এই আদলে থাকে দৈহিক রূপের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। দেহের এই স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে বৃদ্ধির জন্য যে সকল উপকরণ ব্যবহৃত হয়, তার সবই অলঙ্কার। এই অলঙ্কার শুধু দেহকে ঘিরে। এর দুটি অবলম্বন আছে। এই অবলম্বন দুটো হলো দেহকাণ্ড ও বর্ধিত অংশ।
দেহকাণ্ড: মানুষের দেহ হলো মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো
অংশ। এর ভিতরে গলার নিচ থেকে যৌনাঙ্গ পর্যন্ত মূল দেহকাণ্ড।
এর মূলে রয়েছে যৌনাঙ্গের আবরণের বিষয় এবং
সাথে দেহকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করার বিষয়। মূলত দেহকাণ্ডের সবচেয়ে সবচেয়ে গোপনীয়
অংশ হলো যৌনাঙ্গ (শিশ্ন ও যোনি)। বহু আগে আদিম মানুষ তাদের নগ্নতার প্রাথমিক
উপকরণ হিসেবে দেহকাণ্ডের এই দুটি অংশকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।
দেহের
স্বাভাবিক রূপ হলো নগ্ন রূপ। মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার কারণে দেহকে আবরিত করার
চেষ্টা করেছিল। জীব হিসেবে প্রকৃতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে,
অনেকক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে অক্ষম। যেমন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় শরীরকে রক্ষার
জন্য কোনো দৈহিক উপকরণ নেই। উন্নতর প্রাণীকূলে মানুষ প্রাকৃতিগতভাবে নগ্ন।
ধারণা করা আদি মানবগোষ্ঠীর শরীর লোমাবৃত ছিল। অর্থাৎ আদিম মানুষ নগ্ন ছিল না।
আধুনিক মানুষের ত্বকে ঢেকে রাখার মতো লোম রয়েছে মাথায়, যৌনাঙ্গ ঘিরে আর পুরুষের
মুখমণ্ডলের পিছের অংশের দাড়ি। কোনো কোনো পুরুষে বক্ষদেশ জুড়ে ঘন লোম দেখা যায়।
শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম মানুষ পশুর চামড়া, মোটা গাছের বাকল
ব্যবহার করতো। একই ভাবে মরুভূমির লু হাওয়া বা প্রচণ্ড রৌদের প্রকাপ থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য বিস্তৃত গাছের পাতা ব্যবহার করতো। অরণ্যচারী মানুষ ডালাপালার আঘাত
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শরীরের কোমল অংশগুলোকে চামড়া বা গাছের বাকল দিয়ে রক্ষা
করতো। এরই ভিতর দিয়ে মানুষের ভিতরে ধীরে ধীরে নগ্নতা ত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে
উঠেছিল। বহুদিনের চর্চিত অভ্যাসের ভিতর দিয়ে মানুষ যৌনাঙ্গকে আবরিত করে রাখার
ভিতরে 'সভ্য মানুষ'-এর একটি সংস্কারকে ধারণ করতে সমর্থ হয়েছিল। কালক্রমে এরা
গাছের বাকল ও পশুর চামড়ার ত্যাগ করে, উপযুক্ত হাল্কা আবরক হিসেবে উদ্ভাবন
করেছিল সুতির কাপড়। আর
দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে, নারী-পুরুষ
তাদের পোশাককে নিজেদের মতো নকশা করে নিয়েছিল।
মানুষের সহজাত সৌন্দর্যবোধ থেকে মানুষ একসময় কাপড়কে রঙিন করা শিখলো। পোশাকের
গায়ে লতাপাতা, ফুল পাখির নকশা করতো। অর্থাৎ পোশাক অলঙ্কৃত করার চেষ্টা শুরু হয়ে
গিয়েছিল। কালক্রমে পোশাকের বিচারে দেহালঙ্কারে রূপ দুটি ধারায় বিকশিত হলো। এই
ধারাটি হলো−
পোশাকের অলঙ্কার: প্রতিকূল
প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হোক আর লজ্জা নিবারণের জন্যই হোক,
পোশাক প্রাথমিকভাবে দেহকে আবৃত করার একটি উপকরণ মাত্র। এই উপকরণকে
সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য যা কিছু যুক্ত করা হবে, তা হবে পোশাকের অলঙ্করণ।
যেমন শাড়িটা হলো আবরক উপকরণ। কিন্তু এর রঙিন পাড়, নকশা, রঙের বৈচিত্র্য এই
সবই হলো শাড়ির অলঙ্করণ।
পোশাকই যখন অলঙ্কার: দেহকে অবলম্বন করে দেহকে আবৃত করে, এমন যে কোনো আবরণই পোশাক। কিন্তু যে পোশাক দেহের সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্যই ব্যবহৃত হয়, তখন সে পোশাকই হয়ে উঠে অলঙ্কার। কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি যা পরিবেশ অনুসারে আবৃত করার স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করে তা আবরণ, আর যা বাড়তি আনন্দের উপকরণ হিসেবে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তা আভরণ। বিয়ের আসরে কনের গায়ের পোশাক একই সাথে আবরণ এবং আভরণ। কিন্তু প্রকৃষ্ট আভরণ হলো তার মাথায় দেওয়া চুমকি বসানো লাল চেলি। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আভরণের রূপ পাল্টায়। ইউরোপে সাদা রঙের জমকালো পোশাক বিয়ের জন্য আভরণ হয়ে যায়। আর ভারতবর্ষে সাদা রঙের শাড়ী বৈধব্যের। একটি স্বামী লাভের জন্য, অন্যটি স্বামী হারানোর জন্য। আমেরিকার সমুদ্রসৈকতে বিকিনি পড়া মেয়েদের জন্য পোশাক কি অলঙ্কার সেটা বাঙালি মেয়েরা বুঝতে পারে না। কারণ বাঙালি সমাজে বিকিন পোশাক, নাকি নগ্নতার ব্যঙ্গ সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। তাই পোশাক যখন অলঙ্কার হবে, তখন তা আগে পোশাক হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
বঙ্গদেশের পোশাক: বঙ্গদেশের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত নেগ্রিটোরা পোশাক পড়তো,
না কি নগ্ন থাকতো সে বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর্যদের ভারতবর্ষে আসার
আগে, ভারতবর্ষের বসবাসকারীদের সাধারণভাবে বলা হয় অনার্য। এদেরকে সাধারণভাবে
নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মোঙ্গোলীয় জাতির লোকদের একীভূত করে
বিবেচনা করা হয়। সম্ভবত প্রোটো-অস্ট্রালয়েড-দের ভিতরে প্রথম নগ্নতা বোধ জাগ্রত
হয়। হিমালয় সংলগ্ন প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, গাছের
বাকল পিটিয়ে পাতলা করে পরতো। তিব্বত, ভুটান, সিকিম, নেপাল অঞ্চলের আদিবাসীরা
পশুর চামড়াজাত মোটা পোশাক পরতো। সেই তুলনায় হিমালয়ের পাদদেশের আদিবাসীদের পোশাক
ছিল অনেকটা হাল্কা। গরমের সময় নগ্ন শরীরে থাকলেও নিম্নাঙ্গকে আবরিত করে রাখার
অভ্যাস গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে।
আর্যদের সময় সমগ্র ভারতবর্ষের বাকল থেকে তৈরিকৃত কাপড় ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, বঙ্গদেশে এক সময় কাপড় তৈরি হতো গাছের
বাকল থেকে। সেকালের আর্য-অনার্য বা মিশ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা গাছের বাকলকে
পিটিয়ে কাপড়ের মতো পাতলা করে, তারপর তা শুকিয়ে পরিধান করা হতো। সাঁচির
বৌদ্ধস্তূপের স্তম্ভে মানুষের অবয়বগুলোতে যে কাপড়ের আবরণ দেখা যায়, তা বাকল
থেকে তৈরি হওয়া বস্ত্রই মনে হয়। বাকল থেকে তৈরি কাপড়কে বলা হতো ক্ষৌম। এর ভিতরে
সেরা জাতের ক্ষৌম-কে বলা হতো 'দুকুল'। বঙ্গ নামক জনপদের দুকুলের রঙ ছিল স্নিগ্ধ
সাদা। পুণ্ড্র নামক জনপদের দুকুলের রঙ ছিল শ্যামবর্ণের আর সুবর্ণকুডোর দুকুল
ছিল উজ্জ্বল। উল্লেখ্য বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়
রাজবাড়িডাঙ্গা'র রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি
সন্নিকটে চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে কর্ণসুবর্ণ ছিল বলে ধারণ করা হয়। প্রাচীনকালে
এর নাম ছিল সুবর্ণকুডো।
বঙ্গদেশ পুরুষেররা সে সময়ে দুকুল পরতো নিম্নাঙ্গে। বাংলার নারীরা সম্ভবত এর
সাথে পৃথক পাতলা দুকুল পরতো কাঁচুলির মতো করে। সরাসরি বাকল থেকে কাপড় তৈরির
পরিবর্তে, বঙ্গদেশে এক সময় সুতিবস্ত্রের প্রচলন শুরু হয়েছিল। এক্ষেত্রে শণ,
পাট, অতসি ইত্যাদি গাছের বাকল ব্যবহার করে সুতা তৈরি করা হতো।
চাণক্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০-৪০০ অব্দের দিকে বঙ্গ এবং
মগধে রেশমের চাষ হতো। তার অর্থ চীনদেশ থেকে রেশম তৈরির কৌশল ভারতে এসেছিল
কিম্বা ভারতে স্বতন্ত্রভাবে রেশম তৈরির কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছিল। সে সময়ে রেশম ছিল
অতি মূলবান সূতা। রাজাদের কাছে উৎকৃষ্ট পাটের কাপড় এবং রেশমের কাপড় ছিল রত্ন
স্বরূপ। গাছের বাকল থেকে উৎপন্ন কাপড়ের পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে
কার্পাস তুলা থেকে সুতা তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছিল। চাণক্যের মতে- বঙ্গ,
মথুরা, কলিঙ্গ, কাশী, বৎসদেশ, মহিষদেশ-এ কার্পাস সুতার কাপড় তৈরি হতো। এরপর
ভিতরে বঙ্গদেশের কার্পাস সুতার কাপড় ছিল উৎকৃষ্ট।
উল্লেখ্য, চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশম সুতা আবিস্কৃত হয়। এর সর্বপ্রাচীন নমুনা
পাওয়া গেছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের। কথিত আছে- খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ শতাব্দীতে
লেইজু (Leizu) নামের এক সম্রাজ্ঞী বাগানে বসে সহচরীদের নিয়ে চা পান করছিলেন,
এমন সময় একটি রেশমগুটি তার চায়ের পাত্রে এসে পড়ে, তার এক বালিকা সহচরী দ্রুত
পাত্র থেকে গুটিটি তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, গুটি
থেকে এক ধরনের মিহি সুতো বের হচ্ছে। সম্রাজ্ঞী বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে
সিদ্ধান্ত নেন যে, এই সুতা থেকে উন্নত মানের কাপড় বোনা সম্ভব। এরপর সম্রাজ্ঞীর
আদেশে রেশমগুটি সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করা হয় এবং পরে সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরি
করা হয়। পরে সম্রাজ্ঞীর আদেশে প্রাসাদের ভিতরে মেয়েরা প্রথম রেশম কাপড় তৈরি করা
শুরু করে। সে সময় প্রাসাদ রমণীদের একটি বড় বিনোদনের বিষয় ছিল রেশম বুনন। তারপর
হাজার বছর ধরে রেশমি কাপড় কিভাবে তৈরি করা হয়, তা চীনারা গোপন রাখে। রেশম
আবিষ্কারের ফলে চিত্রশিল্পের ক্ষেত্র এক বিশাল অগ্রগতি হয়। চীনে রেশমি কাপড়ের
উপর আঁকা ছবির সূত্রে এক স্বতন্ত্র চিত্রশৈলীর ধারা তৈরি হয়েছিল। বাইজেন্টাইন
সম্রাট জাস্টেনিয়ানের আদেশে দুজন ইউরোপীয় পাদ্রী গোপনে রেশম উৎপাদনের কৌশল
শিখে নেন। ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, ইউরোপে রেশম চাষ শুরু হয়। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে
ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো ছিল ইউরোপের সর্বাধিক রেশম উৎপাদন শহরে
পরিণত হয়েছিল।
বাংলার সবচেয়ে মূলবান কাপড় ছিল মসলিন। দীনেশচন্দ্র সেন-এর 'বৃহৎ বঙ্গ' নামক
গ্রন্থ থেকে মসলিন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। প্লিনির মতে, রোমের মেয়েরা
নাকি জনসাধারণের সামনে নগ্ন দেহ দেখাতো মসলিন পরার ছুতোয়। মসলিন তৈরি হতো মূলত
বৃহত্তর ঢাকার বিভিন্ন অংশে। আর রেশম তৈরি হতো উত্তরবঙ্গে। উভয় কাপড়েরই তৈরি
শুরু হয়েছিল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০-৩০০ অব্দের দিকে। কবি ইয়েটেস-এর বিবরণ থেকে
জানা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে গ্রিসে ভারতের মসলিনের কাপড় পরার চল
ছিল। বোল্টস-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নসেনাকে প্রায়
নগ্ন দেখে, আওরঙ্গজেব তাঁকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। উত্তরে জেবুন্নেসা বলেছিলেন,
তিনি সাতবার মসলিন কাপড়টি ঘুরিয়ে পরেছেন।
বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণে পাওয়া যায়, সিংহলরাজ চাঁদ সওদাগরের কাছে পট্টবস্ত্র
পেয়ে বাঙালিদের মতো করে বস্ত্র পরছেন। পরার ধরন হলো 'একখানি কাচিয়া পিন্ধে, আর একখানি
মাথায় বান্ধে, আর একখানি দিল সর্বগায়।' সম্ভবত সেকালে বঙ্গদেশের অভিজাত পুরুষরা
তিন টুকরো কাপড় ব্যবহার করতো। এর ভিতরে মাথায় বাঁধা কাপড়টি ছিল পাগড়ি। স্থানীয়
লোকেরা এর নাম দিয়েছিল পাগ। গায়ের কাপড় ছিল চাদর আর পরনে ছিল ধুতি জাতীয় কৌপিন।
সেকালের মানুষ ধুতি পরতো কাছা দিয়ে। কাছা ছিল ঢিলাঢাল। কিন্তু কর্মজীবী পুরুষ
তা পরতো 'মালকোচা' দিয়ে। মল্লবীরেরা প্রতোযোগিতার সময় পরনের কাপড় আঁটোসাঁটো করে
কাছা দিত। এই থেকে 'মালকোচা শব্দটি এসেছে। সেকালের গামছাকে বলা হতো শাঙালি। আর
গা-মোছা শব্দ কালক্রমে গামছা শব্দে পরিণত হয়েছে। সন্ন্যাসীদের পোশাকের রঙ ছিল
পীত। অন্যান্য সাধুরা পরতেন সাদা রঙের ধুতি। একসময় পাগড়ি ছিল অভিজাত বাঙালি
পুরুষের পোশাক। খালি গায়ে এবং পাগড়ি ছাড়া ঘরের বাইরে বেরুনো অসভ্যতার মধ্যে
পরতো।
১২০৪
খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি গৌড় বিজয়ের পর থেকে বঙ্গদেশে
মুসলমানি পোশাক প্রবেশ করে। সনাতন হিন্দু ধরমে সেলাই করা পোশাক পরা নিষিদ্ধ
ছিল। ফলে পুরুষরা তিন টুকরো কাপড় ব্যবহার করতো। কালক্রমে পরনের কৌপিন লম্বা করে
পরার রীতি চালু হয়। সেই সাথে কোচার ঝুলও বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদার সাথে সঙ্গতি
রেখে তৈরি হয় ধুতি। এই বিচারে বাঙালি পুরুষের আদি পোশাক হলো ধুতি। মুসলমানদের
সূত্রে বঙ্গদেশে সেলাই করা পোশাকের প্রচলন ঘটে। গোড়ার দিকে আরবের লোকেরা ধুতি
পরতো লম্বা করে কোচা ছাড়া। পরার ধরন ছিল সেলাইবিহীন লুঙ্গির মতো। পারশ্যে এই
জাতীয় পোশাকের নাম ছিল তাহবন্দ। বাংলাতে এই শব্দ হয়েছিল তহবন, তবন। লুঙ্গি নামক
পোশাকটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত কিন্তু নামটা এসেছে বর্মি শব্দ থেকে। চট্টগ্রাম
অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানদের সূত্রে আগত এই শব্দটি তবন শব্দটিকে প্রায় অপসারিত
করেছে।
আরবের লু হাওয়ার প্রভাব থেকে ত্বক রক্ষার জন্য উর্ধাঙ্গে ছিল ঢিলেঢালা আবরণ,
সেটাও ছিল অনেকটা চাদরের মতো। একই কারণে এরা মাথায় বড় পাগড়ি জাতীয় কাপড় পরতো।
এই বিচারে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ভারতের পোশাকের খুব একটা তফাৎ ছিল না। বাহারি
পোশাকের চল হয়েছিল বাগদাদের আব্বাসী শাসনামলে। কালক্রমে মধ্যপ্রাচ্যের সকল
অঞ্চলে এর প্রভাব পরে। এদের মাধ্যমে পায়জামা জাতীয় পোশাকের প্রচলন হয়েছিল।
সেলাই করে পোশাক বানানোর রীতি অনুসারে গায়ের চাদরকে এরা জামা জাতীয় পোশাকে
পরিণত করেছিল। এরই নানা প্রকরণ তৈরি হয় ধীরে ধীরে। বঙ্গদেশে আগত মুসলমানরা
পায়জামা জাতীয় পোশাক পরতো নিম্নাঙ্গে আর উর্ধাঙ্গে ছিল কুর্তা জাতীয় পোশাক।
ধর্মান্তরিত মুসলমানরা বহুদিন পর্যন্ত ভারতীয় ধুতি পরতো। মুসলামনি পোশাক পরার
রীতি প্রথম গ্রহণ করে অভিজাত হিন্দুরা। প্রথম দিকে ঘরের ভিতর ধুতি ব্যবহার
করতো। কিন্তু বিশিষ্ট মহলে যাওয়ার সময় পায়জামা এবং মুসলামানি কুর্তাই ব্যবহার
করতো। আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে অভিজাত শ্রেণির হিন্দু-মুসলমান কারুকার্য করা নানা
ধরনের জামা পরতো। বাংলাদেশের মোল্লার যে জোব্বা জাতীয় যে পোশাককে ইসলামী মনে
করেন। সেটা মূলত আরব-উপদ্বীপের পোশাক। ইসলামের আবির্ভাবে আগে থেকেই ওই অঞ্চলের
ইহুদী, খ্রিষ্টান এবং পৌত্তালিকরা পরতো। মুসলমানদের বাহারি পাগড়ি ভারতীয় হলেও,
রঙ, পড়ার কৌশল পারশ্যের পাগড়ি দ্বারা প্রভাবিত।
মধ্যবিত্ত হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পুরুষ মানুষ গরমকালে খালি গায়ে থাকতো
অন্দর মহলে। কিন্তু ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় কুর্তা জাতীয় পোশাক পরতো উর্ধাঙ্গে,
আর নিম্নাঙ্গে পরতো পায়জামা। মধ্যবিত্ত সমাজে সকল সম্প্রদায়ের লোকই পায়জামা বা
ধুতি পরতো। ব্রিটিশ শাসন আমল পর্যন্ত মুসলমানরা ধুতিকে হিন্দু পোশাক মনে করতো
না। ফলে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই ধুতি এবং পায়জামা পরতো। পাঞ্জাবি নিয়ে
হিন্দুদের ভিতর কোনো বিতৃষ্ণা ছিল না। কিন্তু ফতুয়াকে নিম্নবর্গের মুসলমানদের
পোশাকই বিবেচনা করা হতো। মুসলমান সৈনিকদের পরনে উর্দি ছিল।
সাধারণ হিন্দু সৈনিকদের দেহের ঊর্ধাঙ্গে পোশাক ছিল না। এদের পরনে থাকতো
আঁটোসাঁটো খাটো মালকোচা মারা ধুতি। নিরাপত্তার জন্য কখনো ঊএ্ধাঙ্গে বর্ম পরতো।
মূলত মুসলমান আমলে হিন্দু
সৈনিকরা, সামরিক পোশাক পরা শিখেছিল।
কিন্তু সাধারণভাবে মুসলমানরা ঢিলেঢালা জামা পরতো। ফারসিতে এর নাম ছিল পিরহান।
বাঙালিরা এর নাম দিয়েছিল পিরান। খাটো ঝুলের হাতাওয়ালা বা হাতা ছাড়া পিরান পরতো
নিম্নশ্রেণি-পেশার মানুষ। শ্রমজীবী বাঙালি মুসলমানরা গোড়ার দিকে অধিকাংশ সময় খালি
গায়েই থাকতো। পরনে থাকতো ধুতি বা লুঙ্গি। মাথায় থাকতো গামছা। কিন্তু
কুটুমবাড়িতে যাওয়ার সময়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এরা পিরান পরতো। একসময় ধর্মীয় অনুষ্ঠান
ছাড়া গ্রাম বাংলার মানুষ টুপি পরতো না। কিন্তু মসজিদের ইমামসাহেবরা সবসময় টুপি
পরতো। শ্রমজীবী মুসলমানরা মাঠে কাজ করার সময় মাথালি বা গামছা বেধে
রাখতো। অভিজাতদের অনেকে পরতো মণিযুক্ত ফেজ টুপি।
সাধারণভাবে দেহকাণ্ডের সবচেয়ে গোপনীয় অংশকে অলঙ্কারণ করে মানুষ দেহকাঠামোর
সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে চায় না। কখনও কখনও যৌনকর্মীরা শিশ্ন বা যোনিকে অলঙ্করণ
করে ধাতব 'আঙটা' দিয়ে। কখনো কখনো যৌনাঙ্গের শ্রীবৃদ্ধির জন্য কামোদ্দোপনা জাগানোর জন্য
উল্কি আঁকে। এগুলো মানুষের স্বাভাবিক দেহালঙ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
দেহকাণ্ডের দ্বিতীয় আগ্রহজনক এবং অস্বস্তিকর দেহালঙ্কার ঘটে নারীর স্তনকে ঘিরে।
এই অলঙ্করণে ঘটে অনেকটাই 'দেখা না দেখায় মেশা' দর্শন।
নারীর স্তন সমতল বক্ষ থেকে উদগত একটি অংশ। স্বাভাবিকভাবে চোখে পড়ে। যৌনাবদেনে
এর ভূমিকা আছে। সৌন্দর্য সুররক্ষার স্তনকে আবৃত করা বা
বেঁধে রাখাটা জরুরি বিবেচিত হয়েছে অনেক আগে থেকেই। প্রাচীন ভারতে এর প্রচলন
ঘটেছিল কাঁচুলি জাতীয় আবরকের মাধ্যমে। প্রাচীন পদকর্তাদের ভাষায় ছিল আঙিয়া।
অভিজাত নারীরা আঙিয়াকে নান্দনিক করার জন্য রঙিন করতো, নকশা তৈরি করতো এর উপরে।
একালের ব্রেসিয়ার বা বক্ষবন্ধনীর চেয়ে এর আবেদন ছিল ভিন্নতর। তবে সাধারণ ঘরের
নারীরা স্তনকে আবৃত করতো শাড়ি জাতীয় কাপড়ের লম্বা আচ্ছাদনে। মধ্য-এশিয়া এই
স্থান দখল করেছিল ওড়না জাতীয় বাড়তি বস্ত্র। বঙ্গনারীরা শাড়ির নিচে অন্তর্বাস
বলতে কিছুই পড়তো না। মূলত বাঙালি মেয়েদের পোশাক ছিল এক পরতের
বিশাল থান কাপড়। হাতের বিচারে সাধারণ মাপ ছিল বার হাত। এই দীর্ঘ কাপড়ই কালক্রমে
শাড়িতে পরিণত হয়েছে। মেয়েরা নিম্নাঙ্গে পায়ের গোড়ালি ও হাঁটুর মধ্যবর্তী অঞ্চল
পর্যন্ত ঝুলিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে পরিধান করতো। এর বর্ধিত অংশ কোমর পেঁচিয়ে বক্ষকে
আবরিত করে কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে পরতো। ঘোমটার রেওয়াজ ছিল না। তবে কাজের সময়,
শাড়ির বর্ধিত অংশ, যা আঁচল হিসেবে থাকতো তা কোমরে শক্ত করে পেঁচিয়ে বাধতো।
সনাতন পদ্ধতির এই শাড়ি পড়ার রীতিতে, শাড়ির নিচে আলাদা কোনো কাপড় পরার রেওয়াজ
ছিল না। ফলে শাড়ি ভেদ করে উরু পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠতো। এই কারণে মেয়েরা কোমরে
কাপড়ের বাড়তি প্যাচঁ দিয়ে আব্রু রক্ষা করা হতো।
রবীন্দ্রনাথের মেজোবৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী) প্রথম
অনুভব করেন যে, মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরুবার জন্য কোনো ভদ্রোচিত পোশাক নেই।
সেকালের অভিজাত ঘরের মেয়েরা ঘরের ভিতরে বালুচরি, জামদানির মতো সূক্ষ্ম বুনোটের
পাতলা বাহারি কাপড় পরতো বটে, কিন্তু শাড়ির নিচে ব্লাউজ জাতীয় পোশাক বা পেটিকোট
পরতো না। এই সময় অভিজাত ঘরের মেয়েদের কেউ কেউ ইংরেজ নারীদের মতো গাউন পরতো।
সেকালের বোম্বে শহরের পারশি মেয়েদের পোশাকের আদলে, জ্ঞানদানন্দিনী ব্লাউজ,
পেটিকোটের সমন্বয়ে শাড়ির পড়ার শৈলী পরিবর্তন করে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত
করেছিলেন। গোড়ার দিকে এই রীতির নাম ছিল 'বোম্বাই দস্তুর'। পরে এই বিশেষ রীতির
শাড়ি পড়ার শৈলী পরিচিতি লাভ করেছিল 'ব্রাহ্মিকা শাড়ি' নামে। কেউ কেউ একে
'ঠাকুরবাড়ির শাড়ি'-ও বলতো। এই রীতিতে শাড়ি পড়ায় কিছু অসুবিধা ছিল। কেশবচন্দ্রের
কন্যা কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী এই রীতির পরিবর্তন করেন। তিনি কাঁধ থেকে
ঝোলানো অংশটি কুচিয়ে ব্রোচ আটকানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর সুনীতি দেবীর বোন
ময়ুরভঞ্জের রানী সুচারু দেবী, হিন্দুস্থানী রীতি অনুসরণে, সামনে আঁচল করে পরার
রীতির সাথে জ্ঞানদানন্দিনীর রীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে ভিন্নতর রূপ দান করেন। একালের
বাঙালি মেয়েরা সেই রীতি অনুসরণেই শাড়ি পরে থাকেন।
সে
আমলের ব্লাউজের হাতা ছিল লম্বা, আধুনিক নাম থ্রি-কোয়াটার। এই সবই ছিল শরীরের
উর্ধাঙ্গকে আবৃত রাখা রাখার জন্য। এর ভিতর দিয়ে স্তনের যে আভাষ পাওয়া যায়, তা স্বাভাবিক
বলে, ঠিক অশালীন মনে হয় নেই। আধুনিককালের মেয়েদের অনেকে ব্লাউজের উপরের দিকটার
সীমানা এতটাই নিচু করে যে, স্তন-বিভাজক স্পষ্ট দেখা যায়। এরূপ দেহ প্রদর্শনকে
অনেকেই শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। এর সাথে অনেকে হাতা-কাটা ব্লাউজ পড়েন। অনেকে
ব্লাউজকে এতটাই স্বচ্ছ কাপড়ে বানান, যে নিচের বক্ষবন্ধনী স্পষ্টই দেখা যায়।
পোশাকই যখন অলঙ্কার হয়ে উঠে, তখন পোশাক এবং এর অলঙ্কার একই সাথে সৌন্দর্য
প্রকাশের কাজ করে। মূলত দুটি বিশেষ প্রেক্ষাপট এক্ষেত্রে সক্রিয়
থাকে। এই প্রেক্ষাপট দুটো হলো-
স্বাভাবিক সৌন্দর্য প্রকাশে: স্বাভাবিক শব্দটি এখানে আপেক্ষিক। কারণ
পরিবেশভেদে স্বাভাবিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন- কোনো গ্রামীণ পরিবেশে,
স্বাভাবিক পোশাক যদি লুঙ্গি হয়। সেখানে বিশেষ পরিস্থিতে শহুরে ভাবধারায় পুষ্ট
যুবক অলঙ্কার হিসেবে ফুল প্যান্ট পড়বে। কিন্তু শহরের যুবকের কাছে যদি প্যান্ট
আটপৌরে পোশাক হয়, তাহলে তা অলঙ্কারে পরিণত হবে না। মূলত আটপৌরে জীবনের স্বাভবিক
পোশাকেও বাড়তি উপাদান যুক্ত করে যখন অলঙ্কৃত করা হয়, তখন সেই অলঙ্কৃত পোশাকই
অলঙ্কার হয়ে উঠতে পারে। এটা হবে স্বাভাবিক সৌন্দর্যের ভিতরে একটু বাড়তি
সৌন্দর্য দেওয়ার চেষ্টা মাত্র।
আনুষ্ঠানিক সৌন্দর্য প্রকাশে: স্বাভাবিক আটপৌরে জীবনের বাইরে এসে মানুষ যখন
আনুষ্ঠানিক পোশাকের আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের বিচারে পোশাক নির্বাচিত
হয়। ঈদ, পূজা বা বড় দিনের পোশাক আর বিয়ের পোশাকের পার্থক্য আছে। নৃত্যশিল্পী
এবং নৃত্য উপভোগকারীর পোশাক একই রকম হয় না। বিশেষ অনুষ্ঠানে বিশেষ পোশাকই বিশেষ
অলঙ্কার হয়ে উঠে।
দেহের বর্ধিত অংশের
অলঙ্কার:
দেহের বর্ধিত অংশ বলতে এক্ষেত্রে বুঝানো হয়েছে, দেহকাণ্ড থেকে উদগত
অংশ। এই অংশগুলো হলো-
উল্লেখিত অংশগুলোর অলঙ্করণে ব্যবহৃত উপাদানগুলোকে একত্রে বলা হয়েছে-
দেহের বর্ধিত অংশের
অলঙ্কার। দেহের এই অংশের অলঙ্কার শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়,
সামাজিক মর্যাদারও প্রতীক। কেউ যখন হীরকের হার পড়েন, তখন তার ভিতর দিয়ে
তাঁর বা তাঁর পরিবারের আর্থিক সামর্থের বিষয়টিও ফুটে উঠে। গহনার নকশা, পোশাক, বয়স, স্থান নানাবিধ
বিচারে অলঙ্কার নির্বাচনের ভিতর দিয়ে রুচির মানও নির্ধারিত হয়। অলঙ্করণের
কোনো কোনো উপাদান বৈবাহিক অবস্থা, বয়স ইত্যাদির সাথে সমন্বিত রূপও ফুটে উঠে।
হিন্দু নারীর শাঁখা অলঙ্কারের চেয়ে বড় হলো, তাঁর সধবার পরিচয়। বয়স্ক মহিলারা
বয়সের বিবেচনায় অলঙ্কার ধারণে বয়সের ভাবনাটাও মাথায় রাখেন।
মানব সভ্যতার
উষালগ্নে, মানুষ তাঁর সৌন্দর্যবোধের তাড়নায় দেহকাণ্ডকে আবৃত করার পাশাপাশি
দেহের বর্ধিত অংশের অলঙ্করণের দিকে হাত বাড়িয়েছিল।
শুরু হয়েছিল নিজেকে দিয়ে। রঙিন ফুল, পুষ্পরেণু, পাতা, পাথর ইত্যাদি দিয়ে
নিজেদের সুন্দর করতো। অলঙ্করণের উপাদানকে বারবার ব্যবহারের
জন্য একসময় মানুষ ধাতু ব্যবহার আরম্ভ করেছিল। ধাতবগুণ এবং রঙের বিচারে এক সময়
সোনা এবং রূপার ব্যবহার শুরু হয়। একই সাথে রঙিন এবং উজ্জল পাথরের ব্যবহার শুরু
হয়েছিল দেহের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। কালক্রমে দেশে দেশে অলঙ্কারের নানা রূপ লাভ
করেছে। ভারতবর্ষে এক সময় কানের অলঙ্কার নারী-পুরুষ সবাই ধারণ করতো। বর্তমানে
অলঙ্কার ব্যবহারে নারীরাই মূল স্থান দখল করে রয়েছে। অলঙ্কারের উপকরণ হিসেবে
হাতে সোনা, রূপা, পাথর, মাটি, কাঠ, প্লাস্টিক ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। ভারতীয়
নারীদের অলঙ্করণে ন্যূনতম দেহস্থান হলো হাত, কান, গলা এবং আঙুল। সেকারণে বিয়ের কনে সাজাতে তাই ন্যূনতম অলঙ্কারে খোঁজা হয়,
দুল, হার ও চুড়ি, আংটি। একটু বাড়তি উপকরণ থাকতে পারে, নাকের নথ বা নোলক। কখনো
কখনো হাতের আঙুলের পাশাপাশি পাশে পায়ের আঙুলেও আংটি পড়া হয়। এর সবগুলোরই রয়েছে
নানা রকমফের। মাথায় টায়রা এবং কপালের টিকলি সাধারণ সজ্জায় ব্যবহৃত হয় না।
কোমরের বিছা, বাহুতে অঙ্গদ জাতীয় অলঙ্কার অনুষ্ঠান ছাড়া পড়া হয় না। একসময়
মেয়েরা ঘরেও নূপুর পড়তো। এখন এটা হয়ে গেছে নাচের অলঙ্কার। এছাড়া দেহসজ্জার জন্য
ব্যবহৃত পোষাক বা আবরণ হয়ে উঠে আভরণ। পোশাক এবং অলঙ্কারের সাথে থাকে রঙের
ব্যবহার। এক্ষেত্রে চোখ, ওষ্ঠাধর কপোল, দেহের অনাবৃত অংশকে সুশোভিত করার জন্য
ব্যবহার করা হয় নানাবিধ উপকরণ। এছাড়া রয়েছে দেহের স্বাভবিক গন্ধকে মনোগ্রাহী
করার জন্য ব্যবহৃত হয় নানা ধরণের গন্ধদ্রব্য। এ সবই দেহকে অলঙ্করণ করার জন্য।
ভারতবর্ষের দেহের বর্ধিত অংশের অলঙ্কার:
ভারতবর্ষের আদি মানগোষ্ঠীর মানুষ
নেগ্রিটোরা দেহকে সাজানোর জন্য কি ধরণের উপকরণ ব্যবহার করতো তা এখন আর জানার
উপায় নেই। ভারতে আগত পরবর্তী নৃগোষ্টী হিসেবে প্রোটো-অষ্ট্রালায়েডরা, নেগ্রিটোদের চেয়ে একটু অগ্রসর ছিল।
যতদূর জানা যায়, এদের ভাষার ছিল। ভারতবর্ষের আদি কৃষির পত্তন ঘটেছিল এদের হাতে।
এরা ধাতুর ব্যবহারও জানতো। ধারণা করা হয়, ফুল, পাতা দিয়ে দেহ সাজানোর পাশাপাশি,
মাটির ও ধাতব অলঙ্কার ব্যবহার করতো। কিন্তু সেসব নমুনা কালের গর্ভে হারিয়ে
গেছে। তাই অনুমান ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
ভারত-উপমহাদেশের সভ্যতার আদি নমুনা পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার সূত্রে। সিন্ধু
অঞ্চলে প্রাপ্ত তাম্র, রৌপ্য ও স্বর্ণের অলঙ্কারের সূত্রে দেহ-অলঙ্কার আদি
রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এই উপাদানগুলোর ভিতরে রয়েছে মূল্যবান পাথর ও ধাতুর
তৈরি চুলের কাঁটা, কানের দুল, গলার হার, চুড়ি, আঙটি ইত্যাদি। এই সময় পুঁতির
অলঙ্কারের নমুনা পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার যে দলটি
ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, এরা বেদ এবং অন্যান্য গ্রন্থাদি প্রণয়ন করে। এই সকল
গ্রন্থের ভিতর দিয়ে দেহ-অলঙ্করণের কথা জানা যায়। যজুর্বেদের আমলের ঋষিরা মনে
করতেন স্বর্ণের ভিতরে ঐন্দ্রজালিক শক্তি রয়েছে। তাই দেহে স্বর্ণ ধারণ করলে,
দেহে ওই শক্তির সঞ্চার হয়। তবে বেদব্রাহ্মণে অলঙ্কার ব্যবহারের কঠোর নিয়মরীতি
ছিল। বাৎসয়ন রচিত কামসূত্রে চৌষট্টি কলার ভিতরে রয়েছে রত্নবিদ্যা, মালা ও হার
গাঁথার কৌশল, কর্ণাভরণ তৈরি এবং অলঙ্কার ব্যবহারের বিচিত্র কলাকৌশলকে ধরা
হয়েছে। বৈদিক যুগে এবং পরবর্তী পৌরাণিক যুগে সুগন্ধি ব্যবহারের এবং কিছু
অলঙ্কার ধারণ করা উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সে সময়ে সধবাদের অলঙ্কার ধারণে কিছু বিধি
ছিল। যেমন- স্বামী যখন প্রবাসে থাকলে, তখন স্বামীর কল্যাণে সাধ্বী স্ত্রী মাঙ্গলিক অলঙ্কার ধারণ করতো। কোনো পুরুষ কোনো
নারীর প্রতি প্রেম নিবেদন করার ক্ষেত্রে প্রণয়ীকে কানের দুল ও আঙটি জাতীয়
অলঙ্কার উপহার দিত। রামায়ণে (আনুমানিক খ্রিষ্টীপূর্ব চার থেকে ছয় শতকএ
রচিত) পাওয়া যায়, রত্নখচিত আঙটি, সোনার সরু হার, শঙ্খবলয়, কণ্ঠহার, উষ্ণীষ ও
স্বর্ণমুকুট। উল্লেখ্য, হনুমান লঙ্কায় বন্দিনী সীতার কাছে গিয়েছিল রামের
অঙ্গুরীয় নিয়ে রামের দূত হিসেবে। সীতার সাথে দেখা করে ফেরার সময় সে সীতার
মুক্তার তৈরি কেশাভরণ নিয়ে এসেছিল।
বঙ্গীয় অলঙ্কার:
বৃহৎ ভারতীয়
সংস্কৃতির পূর্বভারতীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছে বঙ্গদেশ। তাই বঙ্গাদেশের অলঙ্কারের সাথে
রয়েছে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির
সম্পর্ক নিবিড়। বঙ্গদেশে নেগ্রিটো থেকে যে প্রাকৃত জনের সূত্রপাত ঘটেছিল। তার সাথে
নানাজাতের মানুষের সংমিশ্রণে বাঙালি দেহ তৈরি। একইভাবে তৈরি হয়েছে ভাষা তথা
অন্যান্য সকল সাংস্কৃতিক উপাদান।
ভারতে ও বাংলাদেশে অলঙ্কারের প্রধান এবং মূল্যবান ধাতু হলো স্বর্ণ। মূলবান বলে অনেক
আগে থেকেই
ভারতীয়দের কাছে স্বর্ণালঙ্কার বিপদের বন্ধুও। হীরা বা অন্যান্য মূল্যবান ধাতুও এই
পর্যায়ে পড়ে। আদি প্রাকৃত-জন এবং পরবর্তী মিশ্র জাতি সত্তার সাংস্কৃতিক বিকাশের
সূত্রে বাঙালির দৈহিক অলঙ্কারের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠছিল। ভারতীয় অলঙ্কারের
ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছিল মুসলমান শাসনামালে। নেগ্রিটো,
প্রোটো-অষ্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, আর্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ধারায় একটি
অলঙ্কারের ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টব্দ পর্যন্ত
এই ধারা একটি সনাতন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। এই সময়ে ধাতুর তৈরি ভারি গহনা ব্যবহৃত
হতো।
বাংলাদেশে অলঙ্কারের আদিতম নিদর্শন হিসেবে, ১০০০ খ্রিষ্টাপূর্বাব্দের দিকে
উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত
গহনাকে নমুনা হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলায় মূল্যমানের পাথরের পুঁতির
অলঙ্কার প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের আদি অলঙ্কারে কিছু ধারণা পাওয়া যায়, পাহাড়পুর ও
মহাস্থানগড়ের টেরাকোটার মূর্তিগুলো থেকে। এসব নমুনা দেখে ধারণা করা যায় যে, সে
আমলে নরনারী উভয়েই অলঙ্কার পরতো। এরা কানে দুল, বাহুতে বাজুবন্ধ, হতে বালা
জাতীয় সাধারণ অলঙ্কার পরতো। মেয়েরা পায়ে পরতো মল। অবশ্য পোড়ামাটিতে অঙ্কিত
অলঙ্কারগুলোতে সূক্ষ্ণ নকশা ততটা ফুটে উঠেনি। ফলে এই নমুনাগুলোকে সাদামাটা মনে
হয়। কিন্তু কালো পাথরে মূর্তিগুলোর অলঙ্কারের সূক্ষ্ম কারুকার্য লক্ষ্য করা যায়। এরূপ একটি নমুনা
পাওয়া যায়, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর-এ সংরক্ষিত খ্রিষ্টীয় দশ শতকের একটি মারীচী
প্রতিমূর্তিতে। এ মূর্তির সাথে রয়েছে শিরোভূষণ, দুজোড়া অনন্ত, বালা,
দুটি কণ্ঠহার, মল ও কানের দুল। কানের দুলের অবয়ব বর্তুলাকার। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি
ছোট্ট কৃত্রিম গোলাপ। গলার ক্ষুদ্র হারে ও বাজুবন্ধে পত্রপল্লবের কারুকাজ রয়েছে। মণিবন্ধে
রয়েছে উন্মুক্ত জাফরিকাটা নকশা। গলার হারটি গোলাকার পুঁতির। আর কোমরে রয়েছে কোমরবন্ধ।
এরূপ আরও একটি চমৎকার নিদর্শন রয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দেবী গৌরীর
মূর্তিতে। এই সময়ের সাহিত্যে থেকেও নানা ধরনের অলঙ্কারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
বিশেষ করে আঙটি, মাকড়ি, বালা, কঙ্কন সাতলহরী হার, মল ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়।
মুসলমান
আমলে সনাতন এই ধারায় যুক্ত হয়েছিল, আরব, পারশ্য, তুর্কি অলঙ্কারের ধারা।
১২০০-১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ধারা বাংলার অলঙ্কারকে প্রবলভাবে প্রভাবিত
করেছিল। এই ধারারা গহনার সূচনা ঘটেছিল মুসলমান সম্রাট ও নওয়াবদের অন্দরমহলে।
কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে অভিজাত জমিদার পরিবারে। রত্নখচিত আঙটি, হার, মাথার টায়রা,
টিকলি, বালা ইত্যাদির নকশায়। এসব গহনা তৈরি করার সামর্থ সাধারণ নিম্নবিত্ত
জনগোষ্ঠীর লোকদের ছিল না। এদের অলঙ্কার ছিল সাধারণ চুড়ি, দুল, মালা ইত্যাদির
ভিতরে। বিয়েতে এরা বহুকষ্টে একটু ভারি এবং কারুকাজ করা গহনা তৈরি করাতো।
ইংরেজদের
শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ১৭৫০-১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ধীরে ধীরে মুসলমান
শাসনব্যবস্থা হ্রাস পেতে পেতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু এর ভিতরে সনাতন সংস্কৃতি ও মুসলিম
সংস্কৃতির গহনা একাকার হয়ে সাধারণ ধারার সৃষ্টি করেছিল। এর সাথে ইউরোপীয় অলঙ্কারের
ধারা মিলমিশে আধুনিক অলঙ্কারের ধারার সূচনা হয়ে। এই সংমিশ্রণও ঘটেছিল হিন্দু রাজা
আর মুসলমান নবাবদের দ্বারাই। ইংরেজদের সূত্র ভারতীয় অলঙ্কারে প্রধাগত মসৃণ
ধারবিশিষ্ট হীরার পাত ও রত্নপাথরের ব্যবহার ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছিল বিচিত্র পলকাটা
রত্নপাথরের ছাঁটযুক্ত ইউরোপীয় রীতি। এই ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল প্রাচীন ও
বহুমাত্রিক নকশাকাটা ভারি ও জমকালো অলঙ্কার এবং তা পুনরায় জনপ্রিয় হয়। ঢাকার নওয়াবদের
কিছু সূক্ষ্ম অলঙ্কারে মোগল প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় শৈলীর প্রভাবের পরিচয়
পাওয়া যায়। কলকাতার বিখ্যাত মণিকার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত
ঢাকা সংগ্রহে চৌদ্দটি রত্নালঙ্কারের অ্যালবাম-এ সেকালের নওয়াবদের মধ্যে কিভাবে
মুগল ও ইউরোপীয় রুচির সংমিশ্রণ ঘটেছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়।
স্থানভেদে অলঙ্কারের প্রকৃতি:
শিরোভূষণ: বাংলার মানুষের আদি শিরোভূষণ বলতে ছিল, ফুল, পাখির পালক।
কালক্রমে রাজশক্তির সৃষ্টি হলে, রাজা এবং পারিষদবর্গ পাগড়ি জাতীয় কাপড় ব্যবহার
করা শুরু করে। রাজার শ্রেষ্ঠত্বের কারণে, পাগড়ির একটু জমকালো হতো। এর সাথে
রত্ন থাকতো। কালক্রমে তাই হয়ে যায় রাজমুকুট। সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবনে
কার্যকারণ ছাড়া শিরোভূষণ বলে কিছু ছিল না। কৃষকরা কাজের জন্য মাথালি ব্যবহার
করতো মাঠে কাজ করার সময়। মেয়েদের শিরোভূষণ বলতে ছিল শাড়ির বাড়তি আঁচল। অনুষ্ঠান
উপলক্ষে মেয়েরা ফুল বা ফুলের মালা ব্যবহার করতো। তবে মেয়েরা চুলকেই অলঙ্কারে
পরিণত করতো খোঁপা বা বিনুনি করে। বিয়ের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে বর-কনে মাথায় পড়তো
সোলার টোপর। হিন্দু বিবাহরীতিতে এখনও এই রীতি আছে। কালক্রমে মেয়েদের মাথায় উঠে
এসেছিল বাহারি নকশাদার টায়রা এবং টিকলি।
মুখমণ্ডল: মাথার পরে আসে মুখমণ্ডল। সমগ্র দেহে যত ধরনের অলঙ্কার আছে, তার বেশিরভাগ অংশ দখল
করে আছে মুখমণ্ডল। মুখশ্রীর চর্চা ছেলেদের ভিতর ততটা প্রবল নয়। বাঙালি সমাজে এই
চর্চাটা খুব ভালোভাবে নিতে পারেনি এখনও। সখ করে কানে কেউ কিছু ধারণ করলেও, তা
সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠে না। বাঙালি সকল গোষ্ঠীর কাছেই মুখমণ্ডলের জন্য
মেয়েদের অলঙ্কার আদরণীয়।
সাধারণত উৎসবে মেয়েরা ভারি ও নকশাদার কানের অলঙ্কার পরে। আটপৌঢ়ে জীবনে হাল্কা
কানপাশা জাতীয় অলঙ্কার পরে। এক্ষেত্রে সোনা, রূপা, ইমিটেশান, প্লাস্টিক, মাটির
তৈরি নানা রকমের কানের গহনা ব্যবহৃত হতে পারে। নাকের অলঙ্কারে ভিতরে এখনও
রয়েছে নথ ও নোলক। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় অনেক সময়ই নথ বা নাকের ফুল সধবাদের
সাধারণ অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিকাদের ভিতরে নাকের অলঙ্কার খুব বেশি
দেখা যায় না। চোখের অলঙ্কার বলতে ছিল কাজল বা সুরমা। এ দুটোই ছিল খোলা চোখকে
সুন্দর করার জন্য। একালের মেয়েরাও একই কারণে চোখকে অলঙ্কৃত করে, পাশাপাশি চোখকে
ঢাকার জন্য পড়ে কালো বা রঙিন গগলস্।
মুখমণ্ডলের জন্য শুধু অলঙ্কার নয় এর সাথে আছে প্রসাধন। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো,
প্রসাধনও ব্যবহৃত হয় মুখমণ্ডলকে শোভিত করার জন্য। কিন্তু প্রসাধন নিজে কোনো
পৃথক সত্তা নিয়ে নিজেকে জাহির করে না। প্রসাধন শুধুই উপাদান। এর কাজ রঙ বদলের
খেলা। এই রঙ কোথায় কিভাবে আছে সেটি বিষয় নয়, বিষয় হলো রঙটি যথাস্থানে যথাযথ
বর্ণ প্রদান করতে পারে কিনা। কপালের টিকলির যেমন বিশেষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে,
ঠোঁটের কৃত্রিম রঙের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। যখন ওষ্ঠাধরকে রঞ্জিতকে, তখনই
তার মূল্য। তাই টিকলি অলঙ্কার এবং লিপিষ্টিক দণ্ড প্রসাধনের উপকরণ। অলঙ্কার
পরতে হয়, আর প্রসাধন মাখতে হয়। বঙ্গদেশে কালো মেয়ের কদর কাব্যে যতটা, বাস্তবে
তার চেয়ে অনেক বেশি কদর ফর্সা মেয়ের। তাই দেহের অনাবৃত অংশ, বিশেষ করে মুখের রঙ
ফর্সা করার জন্য নানা ধরনের প্রচেষ্টা ছিল আদিকাল থেকেই। একসময় বাংলা মেয়েরা
মুখের রঙ ফর্সা করার জন্য বা ঔজ্জ্বল্যের বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতো পুষ্পরেণু।
আধুনিক কালে সেটাই হয়ে গেছে ফেস পাউডার। পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে চোখ, গাল
ভ্রূরুর নিম্নভাগে নানা ধরনের রঙের সমন্বয়ের জন্য নানাধরনের উপকরণ। আগের দিনে
মেয়েরা ঠোঁটকে রঙিন করার জন্য পান খেতো, কিম্বা বনজ রঙ ব্যবহার করতো। একালের
মেয়েদের ঠোঁট রাঙানোর উপকরণ ওষ্ঠরঞ্জনী। ভারতীয় বা বঙ্গীয় প্রসাধন সামগ্রীর
তালিকায় একটি মিশ্র উপকরণ হলো- টিপ। এটা কেউ পরে কেউ অঙ্কন করে। সিঁদুরের টিপ,
নীলের টিপ, চন্দনের ফোঁটা ইত্যাদি লেপন বা অঙ্কন করা যায়। কিন্তু পরার উপযোগী
নানা ধরনের রঙিন টিপও পাওয়া যায়। এক সময় মনে হতো টিপের নিজের কোনো অলঙ্কার নেই।
বর্তমানে অনেকে নকশাদার টিপ পড়েন। এসব টিপের কিন্তু রয়েছে নিজস্ব শৈল্পিক গুণ।
কণ্ঠদেশ:
গলার হারের ক্ষেত্রেও আধুনিকারা সাধারণ সজ্জার সাথে পুঁতির মালা, কাঠের মালা,
ইমিটেশনের, ধাতব পাতলা চেন জাতীয় অলঙ্কার পরে। অনেকে ছেলেদের গলাতেও হাল্কা
সোনার চেন পড়তে দেখা যায়। খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ধর্মীয় আদর্শে ক্রুশ ব্যবহার
করে। তবে অলঙ্কার হিসেবে অন্যান্য ধর্মের কেউ কেউ ক্রুশ পড়ে থাকে। ভারতবর্ষের
আদিবাসীরা গলায় পরতো ফুলের মালা। ধীরে ধীরে পুঁতির সে মালার স্থান দখল করে
নিয়েছিল স্বর্ণ-রৌপের মতো মূল্যবান ধাতু, এছাড়া ছিল রত্নহার। মুসলমান আমলে
কাশ্মীরের গোলাপ নামের অলঙ্কার একসময় বাংলার অভিজাত মুসলমান নারীরা পরতো। এর
লকেট অংশে একটি স্বর্ণের গোলাপ থাকতো। এই গোলাপের মাঝখানে লাল চুনি এবং
উজ্জ্বল কাটা হীরা দিয়ে পুষ্প-পল্লব তৈরি করা হতো। এর পিছনে থাকতো একটি
ক্ষুদ্রাকৃতির কুরআন নমুনা। বঙ্গের চাইতে ভারতের পশ্চিমঞ্চলে পাথরের কাজ হতো
বেশি। ব্রিটিশ আমলে হিরের ইউরোপীয় কাটের প্রচলন হয়। 'কাশ্মীরি গোলাপ'-এর কাটা
হিরে ছিল ইউরোপীয় আদর্শে।
বাহু:
বঙ্গদেশের আদিবাসীরা বাহুতে ফুলের বলয় তৈরি করে পরতো। ধাতবযুগের গোড়ার দিকে
লোহা বা তামার তৈরি বলয় ধারণ করতো। কালক্রমে এই অলঙ্কারের ধাতু
হিসেবে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের ব্যবহার শুরু হয়ে। রাজরাজারা নকশাদার বাহুর নকশায়
ব্যবহার করতেন পান্না ও হীরা। মুসলমান আমলে কবচ নামের অলঙ্কারের
প্রচলন ঘটেছিল। এতে মক্কার ছবি বা আল্লার নাম খোদাই থাকতো। বাংলার আদিবাসীদের
ভিতরে কব্জিতে ফুলের মালা পরতো। এই রীতিটি এখনও রয়েছে। দামি চুড়ি বা বালা পরলেও
উৎসবে অনেকেই ফুলের মালা পরে। একসময় গ্রামবাংলা নারী-পুরুষ সবাই বকুলফুলের
মালা পরতো। ধাতবযুগে ব্যবহৃত হতো লোহার বা তামার বলয়। পরবর্তী সময়ে হাতের
অলঙ্কার হয়ে গিয়েছিল স্বর্ণ বা রৌপ্যের। হিন্দু সধবা নারীরা এর সাথে পরে শাঁখা।
সাধারণ পাতলা সোনার চুড়ির পাশাপাশি তৈরি হয়, নানা ধরনের মজবুত ভারি বালা, কঙ্কন
ইত্যাদি। অভিজাত শ্রেণির নারী-পুরষদের সাধারণ অলঙ্কার ছিল আঙটি। মহাভারতে পাওয়া
যায়, দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিচ্ছেদ ও মিলনের পিছনে রয়েছে একটি বিশেষ আংটি। এক
সময় সকল
আঙুলে আঙটি পরার চল ছিল। সবচেয়ে কম পরা হয় বুড়ো আঙুলে। আর সবচেয়ে বেশি পরা
হয় অনামিকায়। বাগদানের আঙটির জন্য অনামিকাই সুনির্দিষ্ট। আংটির জন্য ধাতু
হিসেবে স্বর্ণই প্রধান্য পায়। কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্র মতে অষ্টধাতুর আঙটিই
ব্যবহৃত হয়। এই আঙটির সাথে থাকে ভাগ্যনিয়ন্ত্রক পাথর। ভাগ্য গণনার বিচারে এতে
যে কোন পাথরই ব্যবহৃত হতে পারে। আঙুলের কড় পেরিয়ে নখে পৌঁছুলে দেখা যায় বাহারি
রঙের নখপালিশ। এছাড়া রয়েছে হাতের তালু ও অগ্রবাহু জুড়ে মেহেদীর আল্পনা। এ সবই
অলঙ্করণের রকমফের।
কোমর: বঙ্গের আদিবাসীরা দীর্ঘ ফুলের মালা পেঁচিয়ে পরতো উৎসবে। এতে ব্যবহৃত হতো উজ্জ্বল হলুদ গাঁদা ফুল। এর মাঝে মাঝে থাকতো লাল গাঁদা। এই সূত্রে অভিজাত নারীরা পরতো কোমর বিছা জাতীয় দীর্ঘ রুপার অলঙ্কার। তবে এই অলঙ্কারটির প্রচুর প্রচলন ছিল, তা বলা যায় না।
পদযুগল: আদি মানবগোষ্ঠী খালি পায়ে চলাফেরা করতো। কিন্তু আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বা ঠাণ্ডা এবং গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, পা-এর আবরক তৈরি করেছিল। কালক্রমে তা জুতায় বা চপ্পল জাতীয় উপকরণে পরিণত হয়। আধুনিক মানুষের কাছে পায়ের এই আবরক একই সাথে পায়ের রক্ষক এবং সৌন্দর্যবর্ধক উপকরণ। সেই বিচারে 'পদরক্ষক' একই সাথে পদমর্যদারক্ষক অলঙ্কারও বটে। এই অলঙ্কার বাদ দিলে যে 'খালি পা' অন্যভাবে। পায়ের সেবা গোড়া থেকেই ছিল মেয়েমহলে। একসময় তেলাকুচা জাতীয় ফল বা বনজ লতা দিয়ে পায়ের প্রান্তদেশ বা আঙুল রঙিন করাতো আদিবাসী নারীরা। যান্ত্রিক যুগে সেটাই হয়েছিল শিশিতে ভরা আলতা। বাড়ির ছোটো মেয়েরা অনেক সময় পড়তো ধাতুর বা কাঠের নূপুর। অনেক সময় নববধূরাও নূপুর পরতো। এখন নূপুরের স্থান হয়েছে নরতক নর্তকীর পায়ে। তবে অনেক আধুনিকাদের পায়ে আঙটি পড়তে দেখা যায়।