৩.২.৩
কাব্যালঙ্কার
কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে সকল উপকরণ ব্যবহার করে অলঙ্কৃত করা হয়, তার
সমষ্টিগত নাম কাব্যালঙ্কার। অলঙ্কারকে শাস্ত্রীয় মোড়কে প্রথম বাঁধার চেষ্টা
করেছিলেন সম্ভবত ভারতীয় ঋষিরা। কাব্যের সৌন্দর্যকে শাস্ত্রী পরিভাষায় শনাক্ত
করার প্রয়াসের
সূত্রে অলঙ্কারের
সৃষ্টি হয়েছিল ধীরে ধীরে। অলঙ্কারশাস্ত্রের শাস্ত্রীয় রূপ পাওয়ার আগেই ঋগ্বেদ
(১।১১।৫৫) এবং শতপথ ব্রাহ্মণে (১২।৫।১।৫) উপমা নামক অলঙ্কার সম্পর্কে আভাষ
পাওয়া যায়। শিল্পের সৌন্দর্য পর্যালোচনার আঙ্গিকে শাস্ত্র হিসেবে প্রথম পাওয়া
যায়, ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র। এই গ্রন্থের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। সব ধারণা
মিলিয়ে বড় মাপে বলা যায়, এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে। নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তির বিষয়ে ভরত একটি গল্পের
অবতারণা করেছেন। গল্পটির সারমর্ম হলো−
একবার মহাদেব ও অন্যান্য দেবতারা ব্রহ্মাকে পঞ্চম বেদ তৈরির অনুরোধ করেন। এই বেদ হবে সকল বর্ণের (শ্রেণি) উপযোগী। এতে থাকবে দৃশ্য ও শ্রব্যের ক্রিয়াত্মক এবং উপভোগ্য। ব্রহ্মা তখন ঋগ্বেদের পাঠ্য, সামবেদের গান, যজুর্বেদের ক্রিয়াকাণ্ড এবং অথর্ববেদের রস মিলিয়ে সর্বসাধারণের উপভোগের উপযোগী নাট্যশাস্ত্র রচনা করেন। ভরত সেই শাস্ত্রকেই গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন এবং এর নামকরণ করেন 'নাট্যশাস্ত্র'।
পৌরাণিক এই গল্পের সত্যাসত্য বিচার ছাড়াই স্বীকার করে নেওয়া হয়, ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রথম প্রবক্তা ভরতমুনি। এর দীর্ঘসময় পরে আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর ভিতরে 'কাব্যদর্শ' রচনা করেন আচার্য দণ্ডী। এর পরে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে ভামহ রচনা 'কাব্যালঙ্কার'। মূলত ভরত, দণ্ডী এবং ভামহ ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বহু গুণীজনের দ্বারা তা সম্প্রসারিত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের পণ্ডিতরা মূলত সাহিত্য, অভিনয়, সঙ্গীতের বিষয়গুলোর নিয়ে অলঙ্কারের বিচার করেছেন। সংস্কৃত লেখকরা মূলত ছিলেন কবি। তাই তাদের কাছে কাব্যই ছিল সাহিত্য। কালক্রমের ভারতীয় ভাষাগুলোতে গদ্যের দ্বারা কাহিনি বা বিষয় প্রকাশের সূত্রে গদ্য লেখা শুরু হয়। সে সময় সাহিত্যের অংশ হিসেবে পরিণত হয় কাব্য-সাহিত্য ও গদ্য সাহিত্য। তাই কাব্যালঙ্কারের বিচারে সেকালের সাহিত্য বিবেচিত হয়েছে।
গোড়ার দিকে আচার্য দণ্ডী 'কাব্যাদর্শ' গ্রন্থে কাব্যালঙ্কারের একটি প্রাথমিক
রূপরেখা দিলেও, এর বিস্তার ঘটেছে ভামহ-এর কাব্যালঙ্কারে। এরপর বামন পূর্ববর্তী
ভামহের সূত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করে রচনা করেছিলেন 'কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি' নামক
গ্রন্থ। একই সূত্র ধরে পরবর্তী নানাজন নানা ধরনের গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বলাই বাহুল্য কাব্যালঙ্কারে উপকরণের বাহন হলো শব্দ। এক্ষেত্রে শব্দ বলতে বুঝানো
হয়ে থাকে, অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। কাব্যের শব্দের স্বরূপ কি হবে, সে বিষয়ে
আনন্দবর্ধন (অনুমানিক খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী) তাঁর ধ্বন্যালোক গ্রন্থে ব্যাখ্যা
করেছেন। তাঁর মতে শব্দের ৩টি শক্তি (অর্থের বিচারে) আছে। শক্তি ৩টি হলো−
অভিধা: একে বলা হয় আভিধানিক অর্থ। কোনো শব্দ বলার যে বা যে সকল অর্থ প্রকাশিত হয়। যেমন মানুষ, গরু, গাছ ইত্যাদি। কিন্তু অনেক সময় শব্দের বহু-অর্থকতা শ্রোতাকে বিভ্রান্ত করে। যেমন-
কর্ (নামপুরুষে তুচ্ছার্থে অনুজ্ঞায়)= তুই কাজটি কর্
কর (আলো)= আজি এ প্রভাতে রবির কর
কর (রাজস্ব)= এ বছর কর পরিশোধ করা হয় নি
কর (হাত)=করাঘাতে দ্বার গেল খুলে
কর (পদবী)=লোকটির নাম বিমল কর।
কোনো কোনো শব্দ
বাক্যভেদে শব্দের অর্থ পাল্টালেও। কোনো কোনো ধ্বনির অর্থ সর্বাগ্রে মনে আসে।
যেমন 'পানি (জল)' এবং 'পাণি (হাত) বাংলাতে একই রকমভাবে উচ্চারিত হয়। কিন্তু এই
শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে প্রথমে জল অর্থটাই মনে আসে।
লক্ষ্মণা:
যখন বাক্যে কোনো শব্দের 'অভিধা'
প্রাধান্য লাভ না করে অন্য অর্থকে প্রকাশ করে, তখন তাকে বলা হয় 'লক্ষ্মণা'।
যেমন- অঙ্কে তার মাথা নাই।
এখানে মাথা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বুদ্ধি অর্থে।
ব্যঞ্জনা: যেখানে বাক্যের অর্থ অভিধা, লক্ষ্মণা অনুসারে হয় না। এক্ষেত্রে বাক্যের প্রকৃতি অনুসারে বিশেষ শব্দ বিশেষ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যেমন- পুরো বিষয়টি আমার নখদর্পণে। এখানে 'নখদর্পণ' শব্দটি পৃথকভাবে কোথাও ব্যবহার করা যায় না। বাস্তবেও এমন কোনো বস্তু নেই। কিন্তু বাক্যে একটি বিশেষ অর্থকে প্রকাশ করে।
ভারতীয় শাস্ত্রকাররা উপস্থাপনার বিচারে কাব্যকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগ দুটি হলো- দৃশ্য কাব্য এবং শ্রব্যকাব্য। অভিনয়ের মাধ্যমে যে কাব্যকে দৃশ্যমান করা হয়ে থাকে, তাই দৃশ্যকাব্য। পক্ষান্তরে শ্রব্যকাব্য হলো- যা শুধুই শ্রবণ করার উপযুক্ত। দৃশ্য বা শ্রব্য যে কাব্যই হোক না কেন, শব্দ বাক্যের প্রকাশ ঘটে শ্রোতা কাছে। দৃশ্যকাব্যে দৃশ্যটা প্রকট থাকে বলে অনেক সময় ধ্বনির মহিমা নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকে না। কিন্তু শ্রব্যকাব্য পুরোটাই মনজগতের। এর ধ্বনিরূপ চিত্তালোকে বিমূর্ত হয়ে ধরা পড়ে, অবশেষে তারও একটি রূপ তৈরি হয়।
শব্দের রয়েছে দেহগত রূপ। এই রূপ শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু শব্দের যে বিমূর্তরূপ, তা ধরা পড়ে অনুভবে। শব্দের দেহগতরূপ ধরা দেয় শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাছে। দেহগতরূপটি অর্থবহ হয়ে যখন মানুষের মনকে আলোড়িত করে, তখন তা হয়ে ওঠে বোধের। কাব্য সুন্দর হয়ে উঠে শব্দের মূর্ত-বিমূর্ত আনন্দময় উপস্থাপনায়। তাই কাব্যালঙ্কার বিচার করা হয় ধ্বনিরূপ এবং তার অর্থগত রূপের বিচারে। এই সূত্রে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে কাব্যালঙ্কারকে দুটি ভাগে বিচার করা হয়েছে। কাব্যে ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিরূপ এবং শব্দ অর্থভেদে এই ভাগ দুটি হলো− শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার।
শব্দালঙ্কার: এই অলঙ্কারের বিষয় ধ্বনি-সৌন্দর্য। যে
কোনো শব্দের ধ্বনিসমূহ
একভাবে বা সমন্বিত অবস্থায় শ্রবণেন্দ্রিয়ে সুখবোধের জন্ম হয়। বিষয়টি
অনেকক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের মানসিকতার উপর নির্ভর করলেও কাব্যের ক্ষেত্রে একটি
সাধারণ মান লক্ষ্য করা যায়। যার দ্বারা অধিকাংশ মানুষের মনে আনন্দের সঞ্চার হয়।
আবার বাক্যের শব্দগুলোর পৃথক ধ্বনি-আনন্দগুলো সমন্বিত হয়ে একটি মিশ্র আনন্দের
সৃষ্টি হয়। শব্দের এই মিশ্র আনন্দই হলো শব্দ সৌন্দর্য।
আমার যদি কাব্যের শব্দগুলোকে সূক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে প্রতিটি
শব্দের ভিতরে পাবো পৃথক পৃথক বর্ণের ধ্বনিরূপ। যেমন- কথা শব্দটি ভাঙলে পাবো-
ক্+অ+থ্+আ। ধ্বনি সৌন্দর্যে শব্দের এই ছোটো ছোটো ধ্বনি এককগুলো বিশেষ
গুরুত্ববহন করে। ব্যাকরণে কথিত অর্থের বিচারে যে ধ্বনিসমূহ শব্দরূপ তৈরি করে,
শব্দালঙ্কারে তা বিচার্য নয়।
ভারতীয় ঋষিরা সংস্কৃত কাব্যের শব্দের ধ্বনিপ্রকৃতির বিচারে শব্দালঙ্কারকে ছয়টি
ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো−
অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, ধ্বন্যুক্তি ও পুনরুক্তবদাভাস।
অনুপ্রাস: একই ধ্বনি বা একাধিক ধ্বনি শুনতে একই রকম মনে হয়, এমন
ধ্বনির পুনরাবৃত্তিতে কাব্যে যে ধ্বনি-সৌন্দর্য তৈরি হয়, তাকেই বলা হয়
অনুপ্রাস।
যেমন−
নারীর
ললিত লোভন লীলায় এখনি কেন এ ক্লান্তি।
[চিত্রাঙ্গদা, ৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
এখানে 'ল' ধ্বনি অনুপ্রাসের সৃষ্টি করেছে।
অনুপ্রাসে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো মূলত একপ্রকার ধ্বনিসাম্য তৈরি করে। তবে
স্বরধ্বনিগুলো ব্যঞ্জনধ্বনির বাহক হিসেবে ধ্বনিসাম্যে সাবলীল গতি এবং
ধ্বনিতরঙ্গের সৃষ্টি করে। এই ধ্বনিসাম্য মস্তিষ্কের ভিতরে সুখদায়ক ধ্বনির
অনুরণন ঘটে। ফলে শ্রবণের আনন্দ তৈরি হয়। যখন এরূপ ধ্বনিসাম্যের দ্বারা মনে
বহুবিধ সুষম আনন্দের প্রবাহ ঘটে, তখন ধ্বনিসৌন্দর্যের সৃষ্টি করে।
অনুপ্রাসে অর্থটা মূখ্য নয়, কিন্তু অর্থকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে বলে,
অনুপ্রাসকে শব্দালঙ্কারে উচ্চাস্থান দেওয়া হয়।
অলঙ্কারশাস্ত্র মতে অনুপ্রাস পাঁচ
ধরনের হতে পারে। এগুলো হলো- বৃত্ত্যনুপ্রাস, ছেকানুপ্রাস, অন্ত্যানুপ্রাস,
শ্রুত্যনুপ্রাস ও লাটানুপ্রাস।
১. বৃত্ত্যনুপ্রাস: মাধুর্যব্যঞ্জক, ওজোগুণাবাচক এবং প্রসাদব্যঞ্জক
বৃত্তি আছে এমন এমন অনুপ্রাসই হবে বৃত্ত্যনুপ্রাস। এই বিচারে বৃত্তিকে এই
তিনটি নামে অভিহিত করা হয়। ধ্বনিপ্রকৃতি অনুসারে এই বৃত্তি তিনটি নির্ধারিত
হয়। যেমন
মাধুর্যব্যঞ্জক বা উপনাগরিকা বৃত্তি: র, ল, ণ, শিষ ধ্বনি ব্যতীত
অন্যান্য সকল যুক্তব্যঞ্জনধ্বনি ও সানুনাসিক ধ্বনির পুনরাবৃত্তিকে
উপনাগরিকা বৃত্তি বলা হয়। যেমন−
নীল-অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর হে গম্ভীর!
[গীতবিতান,
প্রকৃতি
৫৫।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
এখানে 'ঞ্জ' ধ্বনি অনুপ্রাস সৃষ্টি করেছে।
ওজোগুণবাচক
বা
পুরুষাবৃত্তি: যখন
ণ, শিষ ধ্বনির
পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমন-
ণ ধ্বনি: করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন বসন খোলো [ঝুলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
শিষ ধ্বনি:
অতি নির্মল হাসবিভাসবিকাশ
আকাশনীলাম্বুজ-মাঝে
[গীতবিতান। প্রকৃতি-১ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
প্রসাদব্যঞ্জক বা কোমলাবৃত্তি: যখন
র ও ল ধ্বনির
পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমন-
র ধ্বনি:
ফেরে দ্বারে দৌবারিক,
ভীষণ মুরতি,
পাণ্ডব-শিবির দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা শূলপাণি!
[মেঘনাদ বধ, প্রথম সর্গ। মাইকেল মধুসূদন]
ল ধ্বনি:
হেরো ক্ষুব্ধ ভয়াল বিশাল নিরাল পিয়ালতমালবিতানে
[গীতবিতান।
প্রকৃতি-১ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
২.
ছেকানুপ্রাস: ছেকা শব্দের অর্থ হলো−
পণ্ডিত বা বিদগ্ধজন। পণ্ডিতদের ব্যবহারযোগ্য অনুপ্রাস হিসেবে এর এরূপ
নামকরণ করা হয়েছে। এই অনুপ্রাসে যুক্ত ও বিযুক্ত উভয় প্রকার ব্যঞ্জনধ্বনির
পুনরাবৃত্তিকে বুঝায়। যেমন−
নীল-অঞ্জনঘন
পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর হে গম্ভীর!
[গীতবিতান,
প্রকৃতি
৫৫।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
ন এবং সানুনাসিক ধ্বনির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে যুক্ত ও বিযুক্ত দশায়।
৩.
অন্ত্যানুপ্রাস:
এই অনুপ্রাস অন্ত্যমিল আছে এমন কবিতার চরণের শেষের মিল দ্বারা নির্ধারিত
হয়। এক্ষেত্রে ব্যঞ্জন এবং এর সাথে থাকা স্বরধ্বনিকেও বিবেচনা করা হয়।
খেলা, বেলা, ঢেলা অন্ত্যানুপ্রাস হতে পারে, কারণ এখানে ল ধ্বনির সাথে যুক্ত
আ ধ্বনিও ব্যবহৃত হয়েছে। খেলা, চলি, বলো ইত্যাদি অন্ত্যানুপ্রাস তৈরি করবে
না। কারণ, ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে রয়েছে আ, ই, ও।
প্রাচীন সংস্কৃতি কবিতায় অন্ত্যমিল থাকতো না। শঙ্করাচার্য, জয়দেবের মতো
কিছু কবি এর ব্যবহার করেছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তনের আগে, বাংলা
কবিতা মাত্রেই অন্ত্যমিল ছিল। এছাড়া আধুনিক বাংলা গদ্য কবিতা ছাড়া,
অন্ত্যমিল বাংলা কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। কাজী নজরুল ইসলামের
'বাতায়ন-পাশে গুবাগ তরুর সারি' কবিতার চারটি চরণে উদাহরণ দেওয়া হলো।
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করি' সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
-নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ।
৪.
শ্রুত্যনুপ্রাস:
একই রকম শোনায় এমন ধ্বনি সমূহের পুনরাবৃত্তি ঘটলে শ্রুত্যনুপ্রাস বলা হয়।
এক্ষেত্রে একই ধরনের অল্প-প্রাণ ও মহা-প্রাণের বৃত্তি লক্ষ্য করা যায়। ক ও
খ, ট ও ঠ ইত্যাদির দ্বারা এই জাতীয় ধ্বনি অনুপ্রাস সৃষ্টি করে। যেমন-
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা প্রভাত বেলা [সোনার তরী।
রবীন্দ্রনাথ]
৪.
ল্যাটনুপ্রাস: অনেকেই
বাংলা কাব্যে
ল্যাটানুপ্রাসের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। এই অনুপ্রাসে শব্দের ধ্বনিগত
পুনরাবৃত্তি ঘটলেও শব্দের তাৎপর্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন-
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এখানে প্রথম কালো দেহের রঙকে প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় কালো নিবিড়তর কালোকে
প্রকাশ করেছে। তৃতীয় কালো চোখের রঙকে নির্দেশিত করেছে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে
কালো শব্দটি কৃষ্ণবর্ণ অর্থকেই নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে কালো শব্দটি
ল্যাটানুপ্রাস হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি তা না হতো, তাহলে তা যমক হয়ে যেতো।
যমক:
শব্দালঙ্করের একটি পৃথক প্রকরণ
হিসেবে বিবেচিত হয়। যমক অনুপ্রাসের মতোই তবে এক্ষেত্রে ধ্বনি এবং অর্থ
দুটোকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। কোনো বিশেষ শব্দ যখন ভিন্ন ভিন্ন অর্থে
পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন যমকের সৃষ্টি হয়। তা নাহলে ল্যাটানুপ্রাস হয়। একটি
প্রবাদ আছে, 'যা নাই ভারতে, তা নাই ভারতে। এখানে প্রথম ভারতটি মহাভারত নামক
মহাকাব্য আর দ্বিতীয় ভারত ভারতবর্ষ। এর অর্থ দাঁড়ায়−
যা মহাভারত নামক মহাকাব্যে নেই, তা ভারতবর্ষেও নেই।
শ্লেষ বা শব্দশ্লেষ: বাক্যের কোনো শব্দ যখন একাধিক অর্থ ধারণ করে এবং উভয় অর্থের বিচারে ওই শব্দকে বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি করে তখন শ্লেষ বা শব্দশ্লেষ অলঙ্কার হয়। যেমন-
শুন নলিনী, খোলো গো আঁখি-
ঘুম এখনো ভাঙিল না কি!
দেখো, তোমারি দুয়ার-'পরে
সখী, এসেছে তোমারি রবি॥
[গীতবিতান। প্রেম ও প্রকৃতি -৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
এখানে রবি শব্দটি সূর্য বা রবীন্দ্রনাথ, উভয় অর্থেই বিবেচিত হতে পারে।
বক্রোক্তি: ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে অথচ একই রকম শোনায়, এমন শব্দ
ব্যবহার করে কেউ যখন কোনো বিষয় উপস্থাপন করে এবং তার উত্তরে যখন মূল অর্থকে
এড়িয়ে বক্রভাবে অন্যরকম উত্তর দেয়, তখন তা বক্রোক্তি হয়। যেমন-
'মশায় বুঝি পানাসক্ত!'
'আজ্ঞে হাঁ, তবে সঙ্গে জর্দা থাকা চাই'।
প্রম বক্তা পানাসক্ত বলতে মদে আসক্ত কিনা জানতে চেয়েছেন। উত্তর অপর বক্তা
মূল বিষয় এড়িয়ে পান-এ আসক্তের বিষয় অবতারণা করে, জর্দার কথা বলেছেন।
ধ্বন্যুক্তি: ভাষাতে এমন কিছু শব্দ থাকে, যার সাথে ধ্বনি মিলিয়ে সহচর শব্দ তৈরি করা হয়। এই সহচর শব্দের অর্থ থাকতেও পারে আবার নাও পারে। এই জাতীয় শব্দকে ধ্বন্যুক্তি বলা হয়। অবশ্য বাংলা কবিতায় বা গদ্যে এই অলঙ্কারকে অনেকে স্বীকার করেন না। যেমন-
তার পরে এল গণৎকার,
গণনায় রাজা চমত্ৎকার,
টাকা ঝন্ ঝন্ ঝনৎকার
বাজায়ে সে গেল চলি।
[পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথ]
এখানে 'ঝন্ ঝন্' শব্দটি ধন্যুক্তি তৈরি করেছে।
পুনরুক্তবদাভাস: একই অর্থে দুই শব্দের ব্যবহারের ফলে এই অলঙ্কারের
সৃষ্টি হয়। মূলত শব্দের অর্থকে বিশেষভাবে দৃঢ়তার সাথে প্রকাশের জন্য এই
জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাংলা কবিতায় বা গদ্যে এই অলঙ্কারকে অনেকে
স্বীকার করেন না। এই জাতীয় শব্দগুলো হলো-
বিরাট বড়, নিশীথরাত্রি, স্রোতস্বিনী নদী ইত্যাদি।
অর্থালঙ্কার: সাধারণভাবে বলা
হয়,
শব্দের বিচারে যে অলঙ্কারকে বিবেচনা
করা হয়, তাই অর্থালঙ্কার। এক্ষেত্রে অবশ্যই অর্থের শব্দের শোভিত করার গুণকে
বুঝায়। ধ্বনির বিচারে যে সৌন্দর্য ফুটে, তাতে বুদ্ধির খেলা নেই, আছে শুধু শোনার
আনন্দ। যদিও শব্দালঙ্কারে কিছুটা বুদ্ধির খেলা আছে, কিন্তু তা মূখ্য নয়।
প্রবাদ আছে, যত বাক্য তত বাক্যালঙ্কার। এর দ্বারা মূলত অর্থালঙ্কারের অসীম
সংখ্যাকে নির্দেশিত করে। বাস্তবে অর্থালঙ্কার পাওয়া যায়, কিন্তু অসীম নয়।
অলঙ্কারে শ্রেণি ও এর ভুক্তির বিচারে কিছু অলঙ্কারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই
বিচারে মোটা দাগে ৫ ধরনের অর্থালঙ্কার পাওয়া যায়। এগুলো হলো- সাদৃশ্যবাচী,
বিরোধমূলক, গূঢ়ার্থমূলক, শৃঙ্খলামূলক ও গৌণ।
সাদৃশ্যবাচী
অলঙ্কার: অর্থালঙ্কারের জগতে একে প্রধান স্থান দেওয়া হয়। যদিও এর নাম
সাদশ্যবাচী, কিন্তু বিবেচনা করা হয় সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিষয়ের বিচারে। একই
বিষয়ের ভিতরে বৈচিত্র্য নেই, তাই একই বিষয়ের ভিতরে আনন্দ তীব্ররূপ লাভ করে
না। বৈসাদৃশ্য বৈচিত্র্য আনে, আর সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যের ভিতরে বিরোধ বা
তুলনার ভিতর দিয়ে শব্দের অর্থ-জগতে আনন্দের জোয়ার-ভাটা চলে। এরই ভিতর দিয়ে
জন্ম হয় বিচিত্রধরনের সৌন্দর্যের অনুভব। এসবের ভিতর দিয়ে একটি বিষয়ের সাথে
অন্যরকম বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয় সাদৃশ্যবাচী অলঙ্কার।
সাদৃশ্যবাচী অলঙ্কারকে বুঝতে হলে এর চারটি বিশেষ উপাদনকে স্বীকার করে নিতে
হয়। এদের পারভাষিক নাম উপমেয়, উপমান, সামান্য ধর্ম ও সাদৃশ্যাবাচী শব্দ।
উপমেয়: বর্ণনায় যা মূখ্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই উপমেয়। যেমন- 'ললাটে যতনে পরিলাম টিপ' এখানে মূখ্য উপকরণ টিপ। কপালটা আধার। টিপ পড়াটা মূখ্য বলেই 'টিপ' হবে উপেময়।
উপমান: যখন মূখ্য বিষয়ের সাথে অন্যকিছুর তুলনা করা হয়, তখন তুলনীয় বিষয়টি হয়ে যাবে উপমান। মুখ খানা চাঁদের মতো। এখানে মুখ প্রধান বিষয়, তাই মুখ হবে উপমেয়। চাঁদের সাথে মুখকে তুলনা করা হচ্ছে, তাই মুখ এখানে উপমান।
সামান্য ধর্ম: যখন একটি বিষয়ের সাথে অন্য বিষয়ের তুলনা করা হয়, তখন একটি সাধারণ ধর্ম কাজ করে। যেমন মুখ সুন্দর এবং চাঁদও সুন্দর। উভয়ের সৌন্দর্যকে একীভূত করা প্রকাশ করা হবে যে সৌন্দর্যকে আদর্শ ধরে, সেটা হতে পারে অবাস্তব, হতে পারে কল্পলোকের ভাবনা। কিন্তু উভয়ের ভিতরে মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য যে সাধারণ মান তৈরি হয়, তাই সামান্য ধর্ম।
সাদৃশ্যবাচী শব্দ: দুটি ভিন্নতর গুণের বিষয়কে যে সাধারণ বিষয়
দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাই হয়ে যায় সাদৃশ্যবাচী শব্দ। 'যদি চাঁদের মত
মুখ' হয়। তাহলে, মুখ হবে উপমেয়, চাঁদ হবে উপমান, আর উভয়ের ভিতরে
সমন্বয়কারী সশব্দ 'মত' হবে সাদৃশ্যবাচী শব্দ। সাদৃশ্যবাচী শব্দ হিসেবে
ব্যবহৃত হয়−
উপমা, কল্প, তুল,
তুলনা, তুল্য, পারা, প্রায়, যেন, যেমতি, যেমন, মত, সম, সদৃশ, হেন
ইত্যাদি।
লক্ষ্য করা যায় সকল বাক্যে উল্লিখিত উপাদান বা অঙ্গ থাকে না। কয়টি অঙ্গ থাকে এবং কিভাবে থাকে তার উপর ভিত্তি করে সাদৃশ্যবাচী অলঙ্কারকে নানা ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলো হলো− উপমা,
উপমা:
যখন দুটি ভিন্নজাতীয়
বস্তুর বৈসাদৃশ্যতা উল্লেখ না করে শুধু এদের গুণ, অবস্থা বা ক্রিয়াত্মক
কোনো ধর্মকে সাদৃশ্যের বিচারে একটি বাক্যে উপস্থাপন করা হয়।
ছিনু মোরা,
সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে,
কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে
বাঁধি নীড়, থাকে সুখে;
[চতুর্থ সর্গ, মেঘনাদবধ কাব্য]
এখানে 'মোরা' সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই 'মোরা' উপমেয়। এর সাথে
তুলনা করা হয়েছে 'কপোত-কপোতী', তাই এই শব্দটি উপমান। এর সামান্য ধর্ম
হলো 'থাকি সুখে'। আর সাদৃশ্যবাচী শব্দ হলো 'যথা'। আর পুরো বিষয়টি একটি
বাক্যে প্রকাশ পেয়েছে, তাই 'উপমা' অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে।
উপমার প্রকৃতি অনুসারে
পাঁচ ধরনের হয়। এই ধরনগুলো
হলো−
পূর্ণোপমা,
লুপ্তোপমা, মালোপমা, বিম্ব-প্রতিবিম্বের উপমা এবং স্মরণোপমা।
পূর্ণোপমা: যে উপমায় চারটি অঙ্গই (উপমেয়, উপমান, সাধারণ ধর্ম এবং সাদৃশ্যবাচী) থাকে। উপরের 'ছিনু মোরা..থাকে সুখে' অংশটি পূর্ণোপমার উদাহরণ।
লুপ্তোপমা:
যে উপমায়
চারটি অঙ্গের (উপমেয়, উপমান, সাধারণ ধর্ম এবং সাদৃশ্যবাচী)
এক বা একাধিক অঙ্গ অনুপস্থিত থাকে। যেমন-
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন
[বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ]
এই কবিতায়, 'বনলতা সেন' উপমেয় 'পাখির নীড়ের' উপমান, মতো
সাদৃশ্যবাচী, কিন্তু সাধারণ ধর্ম অনুপস্থিত।
মালোপমা:
যে উপমায়
চারটি অঙ্গের (উপমেয়, উপমান, সাধারণ ধর্ম এবং সাদৃশ্যবাচী)
একাধিক উপমান থাকে। যেমন-
মলিনবদনা দেবী, হায়রে যেমতি,
খনির তিমিরগর্ভে, সূর্যকান্তমণি,
কিম্বা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশিতলে।
এখানে সূর্যকান্তমণি এবং রমা দুটি উপমান ব্যবহৃত হয়েছে।
বিম্ব-প্রতিবিম্বের উপমা: এই জাতীয় উপমায়, উপমেয় ধর্মকে বিম্ব
এবং উপমানের ধর্ম-কে প্রতিবিম্ব বিবেচনা করা হয়। যেমন-
প্রেমের জোয়ার বহে হৃদয় ছাপিয়া, যেমন বর্ষায় জোয়ার আসে
দুকুল প্লাবিয়া আকুল শ্রাবণে।
'প্রেমের জোয়ার' উপমেয় অর্থাৎ বিম্ব, 'বর্ষায় জোয়ার' উপমান অর্থাৎ
প্রতিবিম্ব। 'দুকুল প্লাবিয়া' একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। কিন্তু
হৃদয় নদী আর প্রকৃতির নদী একাকার হয়ে যায় এই উপমায়, বিম্ব আর
প্রতিবিম্বের সূত্রে।
স্মরণোপমা: কোনো কিছুর উপলব্ধির অনুভব যদি অনুরূপ অন্যকিছুকে
মনে করিয়ে দেয়। ফলে স্মরণের সূত্রে এক ধরনের উপমার জন্ম দেয়।
অতিরক্ত উপমা
ভারতীয় মূল উপমার বাইরে কেউ কেউ অন্য ধরনের কিছু উপমাকে মান্য
করেন। এর ভিতরে বিশেষভাবে স্বীকার করা হয় মহোপমাকে।
মহোপমা: এটি মূলত
গ্রিক উপমা। গ্রিক কবি হোমার তাঁর মহাকাব্যে এই জাতীয় উপমা ব্যবহার
করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর ইলিয়াড মাহকাব্যের ষষ্ঠ সর্গে এর চমৎকার
প্রয়োগ রয়েছে। হোমারের অনুকরণে এই উপমা ব্যবহার করেছিলেন মাইকেল
মধুসূদন দত্ত। অধ্যাপক সুধীরকুমার দাশগুপ্ত তাঁর 'কাব্যশ্রী'
গ্রন্থে, মহাকাব্যের উপমা হিসেবে এর নাম দিয়েছিলেন 'মহোপমা'। এখানে
এই নামটিই ব্যবহার করা হলো।
এই জাতীয় উপমায় উপমেয়-এর চাইতে উপমান মহা-মহিমায় প্রকাশিত হয়। ফলে
পাঠক উপমেয়কে ভুলে গিয়ে, উপমানের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়েন। যেমন-
কাঁদিলা মাধবপ্রিয়া, উল্লাসে শুষিলা
অশ্রুবিন্দু বসুন্ধরা শুষে শক্তি যথা
যতনে হে কাদম্বিনী, নয়নাম্বু তব,
অমূল্য মুকুতাফল ফলে যার গুণে
ভাতে যবে স্বাতীসতী গগনমণ্ডল।"
এখানে উপমেয় 'শুষিলা অশ্রুবিন্দু বসুন্ধরা', আর উপমান 'শুষে শক্তি
যথ...নয়নাম্বু'।
রূপক:
উপমেয়কে গোপন না করে,
তার উপর উপমানের অভেদ রূপকে আরোপ করে রূপক অলঙ্কার তৈরি করা হয়। এতে
উপমেয় এবং উপমানের গুণকে একীভূত করে প্রকাশ করা হয়। যেমন-
এমন মানব জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলতো সোনা।
এখানে 'মানব' শব্দ 'মানব জীবন' অর্থকে ধারণ করে। এর পরের শব্দ 'জমিন'
শব্দটি 'চাষযোগ্য ভূমি' হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার জমিনে চাষা
করলে যেমন ফসল ফলে, মানবজীবনে জ্ঞানের চর্চা সময় মতো করলে সৃষ্টি হতো
অমূল্য সম্পদ। এখানে উপমেয় 'মানব' আর উপমান 'জমিন' সামান্য ধরম 'আবাদ
করা'-এর মাধ্যমে রূপক তৈরি করে করেছে। রূপকের প্রকৃতি অনুসারে ৪টি ভাগে
ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো- নিরঙ্গ, সাঙ্গ, পরম্পরিত ও অধিকারূঢ়।
নিরঙ্গ রূপক: একটি উপমেয়কে অবলম্বন করে যদি একাধিক উপমান রূপকতার সৃষ্টি করে, তাহলে তা নিরঙ্গ রূপক হয়। উপমানের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটি হলো 'কেবল রূপক' ও 'মালা রূপক'
কেবল রূপক:
এক্ষেত্রে একটি উপমেয় ও একটি উপমান থাকে। যেমন-
হৃদি-পদ্মে চরণ রাখ বাঁকা ঘন শ্যাম
এখানে একটি উপমেয় 'হৃদি' এবং একটি উপমান 'পদ্ম'।
মালা রূপক:
এক্ষেত্রে একটি উপমেয় থাকে, কিন্তু উপমান থাকে একাধিক। যেমন-
হাথক দরপণ মাথক ফুল
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।
'হাতের আয়না, মাথার ফুল, নয়নের কাজল, মুখের পান' উপমানগুলো ব্যবহার করা
হয়েছে উপমেয় কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে। বলাই বাহুল্য উপরের পংক্তি দুটিতে
কৃষ্ণ উহ্য রয়েছে।
সূত্র:
ছন্দ-মীমাংশা ও অলংকার সমীক্ষা। শ্রীপরেশ ভট্টাচার্য
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়