৩.২.
কাব্যা
লঙ্কার


কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে সকল উপকরণ ব্যবহার করে অলঙ্কৃত করা হয়, তার সমষ্টিগত নাম কাব্যালঙ্কার। অলঙ্কারকে শাস্ত্রীয় মোড়কে প্রথম বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন সম্ভবত ভারতীয় ঋষিরা। কাব্যের সৌন্দর্যকে শাস্ত্রী পরিভাষায় শনাক্ত করার প্রয়াস
ের সূত্রে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছিল ধীরে ধীরে। অলঙ্কারশাস্ত্রের শাস্ত্রীয় রূপ পাওয়ার আগেই ঋগ্বেদ (১।১১।৫৫) এবং শতপথ ব্রাহ্মণে (১২।৫।১।৫) উপমা নামক অলঙ্কার সম্পর্কে আভাষ পাওয়া যায়। শিল্পের সৌন্দর্য পর্যালোচনার আঙ্গিকে শাস্ত্র হিসেবে প্রথম পাওয়া যায়, ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র। এই গ্রন্থের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। সব ধারণা মিলিয়ে বড় মাপে বলা যায়, এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে। নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তির বিষয়ে ভরত একটি গল্পের অবতারণা করেছেন। গল্পটির সারমর্ম হলো

একবার মহাদেব ও অন্যান্য দেবতারা ব্রহ্মাকে পঞ্চম বেদ তৈরির অনুরোধ করেন। এই বেদ হবে সকল বর্ণের (শ্রেণি)  উপযোগী। এতে থাকবে দৃশ্য ও শ্রব্যের ক্রিয়াত্মক এবং উপভোগ্য। ব্রহ্মা তখন ঋগ্বেদের পাঠ্য, সামবেদের গান, যজুর্বেদের ক্রিয়াকাণ্ড এবং অথর্ববেদের রস মিলিয়ে সর্বসাধারণের উপভোগের উপযোগী নাট্যশাস্ত্র রচনা করেন। ভরত সেই শাস্ত্রকেই গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন এবং এর নামকরণ করেন 'নাট্যশাস্ত্র'।

পৌরাণিক এই গল্পের সত্যাসত্য বিচার ছাড়াই স্বীকার করে নেওয়া হয়, ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রথম প্রবক্তা ভরতমুনি। এর দীর্ঘসময় পরে আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর ভিতরে 'কাব্যদর্শ' রচনা করেন আচার্য দণ্ডী। এর পরে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে ভামহ রচনা 'কাব্যালঙ্কার'। মূলত ভরত, দণ্ডী এবং ভামহ ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বহু গুণীজনের দ্বারা তা সম্প্রসারিত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। 

 

প্রাচীন ভারতের পণ্ডিতরা মূলত সাহিত্য, অভিনয়, সঙ্গীতের বিষয়গুলোর নিয়ে অলঙ্কারের বিচার করেছেন। সংস্কৃত লেখকরা মূলত ছিলেন কবি। তাই তাদের কাছে কাব্যই ছিল সাহিত্য। কালক্রমের ভারতীয় ভাষাগুলোতে গদ্যের দ্বারা কাহিনি বা বিষয় প্রকাশের সূত্রে গদ্য লেখা শুরু হয়। সে সময় সাহিত্যের অংশ হিসেবে পরিণত হয় কাব্য-সাহিত্য ও গদ্য সাহিত্য। তাই কাব্যালঙ্কারের বিচারে সেকালের সাহিত্য বিবেচিত হয়েছে।


গোড়ার দিকে আচার্য দণ্ডী 'কাব্যাদর্শ' গ্রন্থে কাব্যালঙ্কারের একটি প্রাথমিক রূপরেখা দিলেও, এর বিস্তার ঘটেছে ভামহ-এর কাব্যালঙ্কারে। এরপর বামন পূর্ববর্তী ভামহের সূত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করে রচনা করেছিলেন 'কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি' নামক গ্রন্থ। একই সূত্র ধরে পরবর্তী নানাজন নানা ধরনের গ্রন্থ রচনা করেছেন।

বলাই বাহুল্য কাব্যালঙ্কারে উপকরণের বাহন হলো শব্দ।  এক্ষেত্রে শব্দ বলতে বুঝানো হয়ে থাকে, অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। কাব্যের শব্দের স্বরূপ কি হবে, সে বিষয়ে আনন্দবর্ধন (অনুমানিক খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী) তাঁর ধ্বন্যালোক গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে শব্দের ৩টি শক্তি (অর্থের বিচারে) আছে। শক্তি ৩টি হলো

ভারতীয় শাস্ত্রকাররা উপস্থাপনার বিচারে কাব্যকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগ দুটি হলো- দৃশ্য কাব্য এবং শ্রব্যকাব্য। অভিনয়ের মাধ্যমে যে কাব্যকে দৃশ্যমান করা হয়ে থাকে, তাই দৃশ্যকাব্য। পক্ষান্তরে শ্রব্যকাব্য হলো- যা শুধুই শ্রবণ করার উপযুক্ত।  দৃশ্য বা শ্রব্য যে কাব্যই হোক না কেন, শব্দ বাক্যের প্রকাশ ঘটে শ্রোতা কাছে। দৃশ্যকাব্যে দৃশ্যটা প্রকট থাকে বলে অনেক সময় ধ্বনির মহিমা নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকে না। কিন্তু শ্রব্যকাব্য পুরোটাই মনজগতের। এর ধ্বনিরূপ চিত্তালোকে বিমূর্ত হয়ে ধরা পড়ে, অবশেষে তারও একটি রূপ তৈরি হয়।

 

শব্দের রয়েছে দেহগত রূপ। এই রূপ শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু শব্দের যে বিমূর্তরূপ, তা ধরা পড়ে অনুভবে। শব্দের দেহগতরূপ ধরা দেয় শ্রবণেন্দ্রিয়ের  কাছে। দেহগতরূপটি অর্থবহ হয়ে যখন মানুষের মনকে আলোড়িত করে, তখন তা হয়ে ওঠে বোধের। কাব্য সুন্দর হয়ে উঠে শব্দের মূর্ত-বিমূর্ত আনন্দময় উপস্থাপনায়। তাই কাব্যালঙ্কার বিচার করা হয় ধ্বনিরূপ এবং তার অর্থগত রূপের বিচারে। এই সূত্রে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে কাব্যালঙ্কারকে দুটি ভাগে বিচার করা হয়েছে। কাব্যে ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিরূপ এবং শব্দ অর্থভেদে এই ভাগ দুটি হলো শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার


সূত্র: