৩.১
শিল্প ও শিল্পী

অনুভূতি থেকে জ্ঞানের উদ্ভব। মানুষের জানার স্পৃহা রয়েছে তার সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে। শিশুকালের অজস্র প্রশ্নের ভিতর দিয়ে সে জগৎকে জানতে চায়। শৈশবের অজস্র প্রশ্ন ও বড়দের কাছ থেকে পাওয়া উত্তর এবং নিজের উপলব্ধি দিয়ে শিশুর জগৎ তৈরি হতে থাকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে শিশুর জগৎ পাল্টায়, জিজ্ঞাসার ধরনও পাল্টায়। প্রাপ্তমনস্ক হতে হতে, তার জ্ঞানের জগৎ নানাভাগে বিভাজিত হয়ে যায়। এই জগতে স্থান পায়, তার প্রাত্যহিক চাহিদা এবং তা পূরণের জ্ঞান, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান, এমনি আরও কত কি। এর সাথে থাকে ভালো লাগার বোধ, নিজের পছন্দ-অপছন্দের ধারণা। জীব হিসেবে প্রকৃতিতে টিকে থাকার জ্ঞান মানুষ অর্জন করেছে প্রয়োজনে। এই প্রয়োজন হতে পারে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য বা কোনো সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য। টিকে থাকার জীবনযুদ্ধটা হলো মানুষের জৈবিক ধর্ম। এর ভিতরে মানুষ অনুভব করে, বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু শুধু বেঁচে থাকার আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী, অল্পেতেই তাই একঘেঁয়েমিতে রূপ লাভ করে। এই ঘেঁয়েমি দশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ চায় বৈচিত্র্য। আনন্দের বৈচিত্র্যে সৃষ্ট মিশ্র-আনন্দের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য মানুষ পেতে পারে, প্রকৃতি থেকে, অন্যের বা নিজের সৃষ্টি কর্ম থেকে। সৌন্দর্যের বিশাল অঙ্গনে, মানুষের সৌন্দর্যময় সৃষ্টই শিল্প। একটি পাহাড়ের যত সৌন্দর্যই থাক, তা শিল্পকর্ম নয়। কিন্তু অনেক খারাপভাবে আঁকা পাহাড়ের ছবিটিকে বলা হবে শিল্পকর্ম। আর যে মানুষ শিল্পকর্মটি করেন, তিনি শিল্পী। ভবিষ্যতের রোবোট যদি ছবি আঁকা, গান করার মতো কাজ করতে পারে, তাকেও শিল্পী বলা যাবে। তবে তার নাম হয়তো হবে শিল্পী রোবোট।

প্রকৃতির সৃষ্টি শিল্পকর্ম নয় কারণ শিল্পীর রয়েছে নিজস্ব বোধ। শিল্পী নিয়ম মানেন এবং নিয়ম ভাঙেন। প্রকৃতি নিয়মের শৃঙ্খলে বন্দী। সে শিল্পের জন্য নিয়ম ভাঙতে পারে না। প্রকৃতি নিয়ম মানে স্বেচ্ছায়, এমন নয়। প্রকৃতি নিয়ম মানতে বাধ্য কারণ সে তার নিজেরই সৃষ্ট নিয়মের দাস।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গড়ে ঠে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে। সেই সৃষ্টি কারো কাছে আনন্দ কি বেদনাময়, প্রকৃতি তার তোয়াক্কা করে না। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের খেলা নিজের জন্যও নয় অন্যের জন্যও নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রকৃতিতে যা ঘটে, তা বিধিবদ্ধ নিয়মে ঘটে মাত্র। মানুষ তার ভালো-মন্দের বিচার করে নিজগুণে। এ নিয়ে তর্ক করাও যেতে পারে। যদি বলি মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তাই প্রকৃতির ভিতরে ভালো মন্দ দেখার কাজটি প্রকৃতি মানুষের জন্যই করে। বা এটাও বলা যায়, প্রকৃতির যা কিছু সৌন্দর্য আছে তা গ্রহণ করার সহজাত ক্ষমতা প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে। তাই প্রকৃতি নামক স্রষ্টা অকারণে কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি করে না। প্রকৃতি সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, মানুষ বা শিল্পবোধ আছে এমন কোনো মানবেতর জীবের জন্যও। পৃথিবীর বিচারে হয়তো এই নিয়ে বিতর্ক তোলাই যেতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্বের সকল সৌন্দর্য কি শুধু অন্যের উপভোগের জন্য? প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় মঙ্গলগ্রহে যে সৌন্দর্যময় আলো ছড়িয়ে পড়ে, তা কি সৃষ্টি হয়েছে, মানুষ কবে গিয়ে সেটা দেখবে তার জন্য? কোনো 'আমি' তা উপভোগ করে না বলে, সে সৌন্দর্য ব্যর্থ হয়ে যায় বটে, কিন্তু সৌন্দর্য তো সৃষ্টি হয়।

সত্যানুসন্ধানের পথ ধরে বিজ্ঞান অগ্রসর হয়। তার একটি লক্ষ্য থাকে। সেখানে আবিষ্কারকের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, ব্যর্থতা বা পরিতৃপ্তি আছে। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনের পথে ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠে না। ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন মানুষের জন্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংসের লক্ষ্যে। অর্জিত জ্ঞানে ব্যক্তি ফ্লেমিং নেই। তাই কেউ পেনিসিলিনের ভিতরে ফ্লেমিং-এর অনুসন্ধান করে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানে রবীন্দ্রনাথ আছেন। তাই তাঁর গানের ভিতরে কেউ যখন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ভাবনা খুঁজতে চান, সেটা একেবারেই বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না।

শিল্পের স্বরূপ

যে নিজস্ব ধর্মের উপর ভিত্তি করে শিল্পকর্ম প্রতিভাত হয়, তাই হলো- শিল্পের স্বরূপ। আর কল্প-বাস্তবতায় মঙ্গলময় যে কোনো নান্দনিক সৃজনশীল কর্ম হলো- শিল্প বা শিল্পকর্ম। একে যদি আমরা শিল্পের সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যায় শিল্পের স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে ৪টি মূল উপাদানের উপর।  যেমন-

১. কল্প-বাস্তবতা: মানুষ তার চারপাশের জগৎকে অনুভব করে, বাস্তবতার নিরিখে। সেখানে শিল্পের স্থান নেই। শিল্পের জগৎ বাস্তব জগতের বাইরে এসে অনুভব করার বিষয়। বাইরের এই জগতটি হলো- কল্পজগৎ। কোনো বাস্তবতাকে যখন কল্পজগতের সাথে মিশিয়ে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা হয়ে যায় কল্প-বাস্তব জগতের বিষয়। ধরা যাক কোনো শিল্পী কোনো একটি অবয়বের মূর্তি তৈরি করলেন, তাহলে দেখা যাবে তিনি কোনো একটি বাস্তব মূর্তির রূপ অনুকরণ করছেন। যিনি শিল্পী তিনি ওই মূর্তি তৈরি সময় তার কল্পনার কিছু অংশ যুক্ত করে দেবেন। ফলে একটি কল্প-বাস্তব রূপ তৈরি হবে। আবার এমনও হতে পারে শিল্পী তার কল্পনা থেকে এমন একটি রূপ তৈরি করলেন যার কোনো বাস্তব রূপ জগতে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে শিল্পী তার কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ফলে শিল্পীর কল্পলোক হয়ে যাবে বাস্তবতার অংশ। যদি এই শিল্পকর্ম কোনো অলীক দৈত্যের মূর্তি হয়, তাহলে তাকে শিল্পী এমন ভাবে স্থাপন করবেন, যেন ভারসাম্যের অভাবে মূর্তিটি ডিগবাজি না খায়। এক্ষেত্রে শিল্পী মূর্তির ভারসাম্য নির্ধারণ করবেন বাস্তবতার নিরিখে।

আবার অন্য দিক থেকে কল্প-বাস্তব রূপ বিচার করা যেতে পারে। ধরা যাক কোনো চিত্র পরিচালক ৩৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ঘটনা অবলম্বনে প্রাগৈতিহাসিক কোনো সভ্যতাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করছেন। দেখা গেল ওই চলচ্চিত্রের কোনো একটি দৃশ্যে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি দেখা যাচ্ছে। দর্শক বাস্তবতার নিরিখে ওই দৃশ্য দেখে ব্যথিত হবেন। দর্শক কল্পনার দোহাই দিয়ে এটা মেনে নিতে পারবেন না। এখানে দর্শক প্রাগৈতিহাসিক যুগের কল্পলোকে অবস্থান করবেন এবং একই সাথে বাস্তবতার নিরিখে ঘটনাটি দেখার চেষ্টা করবেন। এরই মধ্য দিয়ে তৈরি হবে 'কল্প-বাস্তব'-এর অনুভব।
 

২.
সৃজনশীল কর্ম:  কল্প-বাস্তবতার নিরিখে সৃষ্ট কাজটিতে শিল্পীর সৃজনশীলতা থাকতেই হবে। যদি তা না হয়, তবে তা হবে অনুকরণ। এখানে 'সৃজনশীল' বলতে ধরা হয়েছে, শিল্পির নতুন সৃষ্টির উদ্দীপনা। এর ভিতর শিল্পী হিসেবে তিনি রাখবেন তাঁর স্বকীয়তা বা তাঁর স্বাক্ষর। ধরা যাক কোনো চিত্রকর্মী দ্যা ভিন্সির সৃষ্ট 'মোনালিসা'  ছবিটিকে নিখুঁতভাবে আঁকলেন। নিখুঁত অঙ্কনের জন্য ওই চিত্রকর্মীকে আমরা বাহবা দেব, কিন্তু শিল্পীর আসনে স্থান দেবো না। কারণ, এতে তাঁর কোনো সৃজনশীল ক্ষমতার প্রকাশ ঘটবে না। কারণ ওই চিত্রের মধ্য দিয়ে শিল্পীর স্বকীয়তা বা স্বাক্ষর প্রকাশিত হবে না। এমন কি যদি কোনো দক্ষ শিল্পী দক্ষ হাতে পাহাড়ের ছবি নিখুঁত ভাবে আঁকেন তাহলেও তিনি অনুকরণই করবেন। সেখানে ক্যামেরায় তোলা ছবির সাথে তাঁর আঁকা ছবির পার্থক্য থাকবে না। শিল্পী যা চোখে দেখেন তা বাস্তব ছবি, আর মন-ক্যামরায় যে ছবি তুলবেন, যেখানে থাকবে তাঁর মনের আলো-ছায়ার খেলা। এই বাস্তবতার সাথে আলো-ছায়ার খেলা মিশিয়ে শিল্পী হয়ে উঠবেন স্রষ্টা। এখানে শিল্পী হয়ে উঠবেন 'একমেবাদ্বিতীয়ং'।

এ্যারিস্টোটেলের কাছে শিল্প ছিলো রূপের 'অনুকরণ'। যেহেতু শিল্পে থাকে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর, তাই এ্যারিস্টোটেলের এই ধারণাকে স্বীকার করে নেওয়া যায় না। শিল্পভাবনার ক্ষেত্রে প্লেটো অনেকটাই অগ্রসর ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন অনুকরণ হলো জ্ঞানবৃত্তি। এর সাথে সুষমামণ্ডিত করার প্রেরণা যুক্ত হলে শিল্পের প্রকাশ ঘটে। এই সুষমামণ্ডিত করার প্রেরণা আসে ভাবাবেগ থেকে। প্লেটোকে  অনুসরণ করলে, বলা যায় ভাবাবেগের মিশ্রণটাই হলো সৃজনশীলতা।

. মঙ্গলময় কর্ম: যদি কোনো সৃষ্টির ভিতরে  শিল্পী মঙ্গলময় অনুভবকে শিল্পভোগীর কাছে পৌঁছাতে না পারেন, তবে তা যথার্থ শিল্প হয়ে উঠবে না। যে শিল্পকর্ম মানুষের সুকুমার মনোবৃত্তিকে ধ্বংস করে দেয় বা অমঙ্গলের অশুভ বার্তা পাঠায়, তা কল্পবাস্তবতা এবং সৃজনশীলতার বিচারে যতই নিখুঁত হোক, তা শিল্প-বর্জ্য রূপ পরিত্যাজ্য হবে। ধরা যাক, কোনো চিত্র, গান, গল্প ইত্যাদি যদি মানুষের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় এবং এর প্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে, তবে তা শিল্প-বর্জ্যের তালিকায় স্থান পাবে। এক সময় ক্রোচে এবং আরও অনেকে মনে করেছিলেন-  শিল্পীর সৃজনশীল কল্পনাবৃত্তি থেকে শিল্পের উদ্ভব। শিল্পীর কোনো সামাজিক দায় নেই। ক্রোচের এই ভাবনায় রয়েছে শিল্পীর নিরপেক্ষতার বিষয়। বাস্তবে তেমনটা মেনে নেওয়া যায় না। শিল্পীর সামাজিক দায় থাকাটা জরুরি। নইলে শিল্পীর অনেক সৃষ্টিই বর্জ্য শিল্প তালিকায় স্থান পাবে। কোনো শিল্পীর শিল্পরকর্ম যদি কোনো আদর্শকে আঘাত করে, এর ফলে দাঙ্গার মতো ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে বসে, তাহলে তার দায় শিল্পীকে নিতেই হবে। যদি শিল্পের সাধনা সত্য-সুন্দরে হয়, তাহলে সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠা দায়বদ্ধতা আপনা-আপনি তৈরি হয়ে যায়। শিল্পে আবগের স্থান আছে, কিন্তু অতিরঞ্জনের দ্বারা কলুষিত না হয়, সেটাও শিল্পীরই দেখার বিষয়।

৪. নান্দনিক কর্ম: শিল্পীর সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম হবে আনন্দপ্রদায়ী, যা সুসমন্বয়ে প্রবহমান ধারায় হবে সৌন্দর্যমণ্ডিত বা নান্দনিক। সাধারণভাবে কল্পবাস্তবতা, সৃজনশীলতা এবং মঙ্গলময়তার মধ্য দিয়ে শিল্পের কাঠামো তৈরি হবে, আর নান্দনিকতার স্পর্শে শিল্প প্রাণ পাবে। শিল্পের সকল উপাদনের সুসমন্বয়ে যে নান্দনিক রূপ সৃষ্টি হবে, তার ভিতর দিয়ে ফুটে উঠবে 'সুকুমার কলা'।


শিল্পের উপাদান
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সকল উপাদান মানুষের মন বা 'আমি' নামক সত্তাকে মুগ্ধ করে, তাকে ওই উপাদানসমূহের সুসমন্বিত দশার উপলব্ধি হিসেবে সৌন্দর্য বলা যায়। এই সৌন্দর্য রয়েছে প্রকৃতিতে কিম্বা মনুষ্যসৃষ্ট উপাদানে। সৌন্দর্য সৃষ্টির বেদনায় বা আকাঙ্ক্ষায় শিল্পী শিল্পকর্ম করেন সুসমন্বিত আনন্দসমূহের সংমিশ্রণে এবং তা করার চেষ্টা করেন সযত্নে। এক্ষেত্রে তিনি কিছু নির্বাচিত উপকরণ ব্যবহার করেন। শিল্পের মাধ্যমের বিচারে এ সকল উপকরণ নানা ধরনের হতে পারে। এর মূলে থাকে ইন্দ্রিয়। 'আমি' ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদানের সমন্বয়ে কোনো বিমূর্ত উপকরণ তৈরি করে নিতে পারে বা কল্পলোকে ভিন্ন উপকরণের জন্ম দিতে পারে।

শিল্পকর্মের জন্য ব্যবহৃত সে সকল উপাদান, পঞ্চেন্দ্রিয়ের এক বা একাধিক ইন্দ্রিয় দ্বারা শনাক্ত করা যায়, তার সবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান। রঙ, রেখা, বিন্দু, স্বর, মুদ্রা, মৃদু, কোমল, কঠোর, ঝাল, টক, ফুলের গন্ধ, পেঁয়াজের গন্ধ ইত্যাদি সবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান। কিন্তু এই উপাদানগুলো নিজে কোনটিই শিল্পের উপাদান নয়। শিল্পীর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই উপাদানগুলো শিল্পের উপাদান হয়ে উঠে। কোনো চিত্র শিল্পীর কাছে লাল রঙ আছে। সেটা যতক্ষণ না তিনি ব্যবহার করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তা শিল্পের উপাদান হয়ে উঠবে না। এটি হচ্ছে উপাদানের ব্যবহারিক মূল্য। কিন্তু লাল রঙটা শিল্পে ব্যবহার করা যায়, অর্থাৎ লাল রঙ এই গুণটুকু ধারণ করে, সে বিচারে লাল রঙের গুণমান আছে। প্রকৃতির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সবকিছুই শৈল্পিকগুণমানে বিরাজ করে। শিল্পকর্মে সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য সেগুলোকে ব্যবহার করার কারণেই সেগুলোর ভিতর ব্যবহারিক মূল্যের সৃষ্টি হয়। এই বিচারে শৈল্পিক উপাদানকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

শিল্পজগতের বাসিন্দা
সৃজনশীল মানুষ বিজ্ঞানের সাধনা করে, বিষয়ের দুর্বোধ্যতা অপসারণ করার চেষ্টা করে সত্যকে জানার জন্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। শিল্পী সৌন্দর্যের ভিতরে সত্য, কিম্বা সত্যের মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যে পৌঁছাতে চায় আনন্দ লাভের জন্য। এখানে আত্মোপলব্ধিটাই বড়।
এই বিচারে শিল্প হলো মানুষের বিশেষ সৃষ্টি। শিল্পীর সৌন্দর্যমণ্ডিত ধ্যানের ভিতর দিয়ে শিল্পকর্ম গড়ে ‌ওঠে। ধ্যানের ভিতর দিয়ে শিল্পী যে সৌন্দর্যকে অনুভব করেন, তাকে যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে পারার ভিতরে রয়েছে শিল্পীর সার্থকতা।
 
যিনি শিল্পকে ভালবাসেন তিনিই শিল্পজগতের বাসিন্দা। যিনি শিল্পকর্ম করেন, তিনি স্রষ্টা, যিনি শুধুই তা উপভোগ করেন, তিনি ভোক্তা। এই বাসিন্দাদের একদল আছেন যাঁরা স্রষ্টার সৃষ্টিকে লালন-পালন করেন শিল্পের আনন্দে।

শিল্পকর্ম জীবনকে নানা আঙ্গিকে দেখার অপার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। তবে এই আনন্দ শুধুই ইন্দ্রিয়ের ভোগের বিষয় নয়। শিল্প সত্য এবং সুন্দরকে প্রকাশ করে। তাই শিল্পের সংগ্রাম অসত্য এবং অসুন্দরের বিরুদ্ধেও। এই সংগ্রামে শিল্পী একটি লক্ষ্যে অনেকটা পথ চলতে পারেন, কিন্তু চরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না। তাই শিল্পীর পথচলা হলো অতৃপ্ততা পূরণের জন্য মহাযাত্রা। শিল্পের পথ অবাধ, তাকে বাধতে গেলে পরম সত্য ও সুন্দর থেমে যায়। কিন্তু শিল্পী সে পথে চলতে চলতে এক সময় নিজেই থেমে যায়। তাই অতৃপ্ততার ভিতর দিয়ে শিল্পীর ঘটে মহাপ্রয়াণ।

জীবনের নানা রঙ, নানা রূপ। এক জীবনে সকল রং ও রূপের দেখা মেলে না। তাই শিল্পী বারবার তার দেখার ক্ষেত্র পরিবর্তন করেন। অনেক সময়ই শিল্পীর এই পরিবর্তনকে অস্থিরতা বলা হয়। মূলত নানা দিক থেকে দেখার প্রচেষ্টাটাই হলো শিল্পের প্রাণ। এই প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে সে চলমান জগতকে নানাভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষের কাছে যা অস্থিরতা, শিল্পীর কাছে তা সৌন্দর্য-সন্ধানের ধ্যান।

শিল্পের উপাদানের সংমিশ্রণের সার্থকতা
একক আনন্দ কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে না। সৌন্দর্য হলো একাধিক আনন্দের সুসমন্বিত দশায় উৎপন্ন মিশ্র আনন্দ। আনন্দের
একক উপাদানের মাধ্যমে শিল্পকর্ম বিকশিত হয় না। যে শিল্পী দ্বিতীয় ধাপের উপাদানগুলোর সুসমন্বয়টা যথাযথভাবে করতে পারবেন, তিনিই তাঁর সৃষ্টিকে যথাযথ রূপ দিতে পারবেন। শিল্প সৃষ্টিতে সমন্বয় হলো, ক্ষুদ্র সৌন্দর্যের অনুভূতিকে ছড়িয়ে দিয়ে একটি একক মিশ্র সৌন্দর্যে পরিণত করা। একজন রন্ধনশিল্পী রসনার সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন, তখন তিনি একটি মিশ্র অনুভূতির সৌন্দর্যকেই উপস্থাপন করেন। কেউ যখন একবাটি পায়েস খেয়ে পরিতৃপ্ত হন, তখন তিনি মূলত একটি মিশ্র অনুভূতিতেই পরিতৃপ্ত হন। চিনি, চাল, দুধ, এলাচ, দারচিনি, কিশমিশ ইত্যাদির নিজস্ব স্বাদ গন্ধ আছে। আলাদা আলাদা করে আস্বাদন নিলে মিশ্র অনুভূতির পায়েসের কখনোই স্বাদ পাওয়া যাবে না। উপাদানের যথাযথ সংমিশ্রণেই শিল্পের সার্থকতা। সংমিশ্রণে ত্রুটিতে সৌন্দর্যের পতন হয়, ছন্দেরও পতন হয়। শিল্পের উপাদানসমূহের সুসমন্বয়টা অত্যাবশ্যক, কিন্তু এর বাধ্যবাধকতা নেই। শিল্পীর শৈল্পিক বোধ এই সংমিশ্রণের পিছনে নিরন্তর কাজ করে।


১. একটি পাতা এবং ফুলের সমন্বিত কাঠামো


২. একটি আবর্তিত পুষ্পকোড়ক


৩. প্রথম দুটি আলপনার সমন্বয়ে সৃষ্ট নতুন আলপনা

প্রশ্ন হলো শিল্পী এই সংমিশ্রণের খেলা কতটুকু খেলবেন। বিষয়টি নির্ভর করে শিল্পী কোথায় থামতে চান। শিল্পীর ইচ্ছাকে বাদ দিলে, সংমিশ্রণের প্রক্রিয়াটি অসীম। একই কারণে সৌন্দর্যও অসীম। ধরা যাক আপনি কিছু রেখা দিয়ে পাতা আঁকলেন। আবার ফুল ও কুঁড়িও আঁকলেন। এখানে পাতা, ফুল কুঁড়ি এ সবই শৈল্পিক। এবার এগুলোর সমন্বয়ে একটি একক তৈরি করলেন। শিল্পী এখানে থেমে যেতে পারেন। তাঁর হয়তো এটুকই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু শিল্পী যদি না থেমে আরও কিছু যুক্ত করতে চান, তা হলে দ্বিতীয় চিত্রটি তৈরি করতে পারেন। একই কারণে শিল্পী তৃতীয় চিত্রটি আঁকতে পারেন। এইভাবে নানা উপাদান যুক্ত করে করে, শিল্পী একটি অসীম আল্পনা জগতে প্রবেশ করতে পারেন।

প্রকৃতির সৌন্দর্যও এই কারণে অসীম। আমরা একটি ফুল দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, এই ফুলটি আবার একটি গাছের অংশ। গাছটি কোনো বাগান বা প্রান্তরের অংশ। বৃহৎ পরিসরে ছোটো ছোটো সৌন্দর্য দেখা হয় না। কিন্তু ছোটো ছোটো সৌন্দর্যগুলো আছে বলেই বড় সৌন্দর্য বড় হয়ে ওঠে।

শিল্পের অনুকৃতি ও বিকৃতি
শিল্প মাত্রেই নান্দনিক বিকৃতি। এর মূলে থাকে মূল বিষয় থেকে সরে এসে একটু নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া। এই সাজিয়ে নিতে গেলে মূল বিষয়ে থাকা যায় না। শিল্পী যখন মূল বিষয়ে স্থির থাকেন, তখন তা হয় অনুকৃতি। আর সাজানোর জন্য যা করেন, তা হলো বিকৃতি। শিল্পের জন্য দুই দরকার।

বাস্তবের ছয় ফুট লম্বা মানুষকে একটি এক বর্গফুট ফ্রেমের ভিতরে যখন আনা হয়, তখন অনুকৃতিকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়। চলচ্চিত্রে কাহিনির সাথে আবহসঙ্গীত থাকে। কাহিনিটি অনুকৃতি, কিন্তু আবহসঙ্গীতটা বিকৃতি। কাহিনিকে নান্দনিক করার জন্য সঙ্গীত পরিচালক যে সুরকে কাহিনির সাথে যোগ করে দেন, তার ভিতরে থাকে পরিচালকের নান্দনিক বোধের পরিচয়। কোনো পাহাড়ের দৃশ্য যখন কোনো শিল্পী আঁকেন, তখন পাহাড়ের মতো করেই আঁকবেন। সেখানে যে পাহাড়ের নিজস্ব রূপ রয়েছে, তা থাকতেই হবে। যেনো পাহাড়টাকে অন্য কিছু মনে না হয়। এটা হবে পাহাড়ের অনুকৃতি আকার প্রয়াস। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শিল্পী পাহাড়ের রূপের সাথে আরও যা কিছু আছে, যার ভিতরে পাহাড়টা পৃথক সত্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, সে রূপগুলোকে যথাযথভাবে না এঁকে বুঝিয়ে দেন, পাহাড়ের সাথে আরও কিছু আছে। এখানেই ঘটে বিকৃতি।
শিল্পের জন্য এই বিকৃতির মধ্যেই আছে শিল্পের মূল্য। সেখানে সব মিলিয়ে পাহাড়টাকে শিল্পী কিভাবে দেখে বা দেখান, তার ভিতরে তার শৈল্পিক সত্তার প্রকাশ ঘটে। মনে রাখা দরকার, কুশলীশিল্পী যে বিকৃতি ঘটান, তা তার অপারগতা নয়, বরং তা পারঙ্গমতা। শিল্পী অনুকৃতি তৈরি করার সময়, যে সকল শৈলীর আশ্রয় নেন, তার বৈশিষ্ট্যের বিচারে তৈরি হয়, এতে থাকে শিল্পীর স্বাক্ষর।

শিল্পের যত সমালোচনা এই বিকৃতিটা নিয়েই। এই বিকৃতিটাকেই বলি সুন্দর বা কুৎসিত, সুখপ্রদ কিম্বা ভয়াবহ। আনন্দের কিম্বা বিষাদের। বিষয়টা শিল্পের নয়। বিষয়টা হলো যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা। এক্ষেত্রে শিল্পী সকল অনুকৃতি বা বিকৃতি প্রশ্রয় দেন না। পোশাক ত্যাগ করে মলত্যাগের দৃশ্য সচল বা স্থির চিত্রে, কিম্বা অভিনয়ে শিল্পী অনুকৃতি হিসেবে উপস্থাপন করবেন কি? কিন্তু ইঙ্গিত বা বিকৃতির মাধ্যমে বিষয়টা বুঝিয়ে দিতে পারেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এমন অনেক বিষয় আছে যা, স্বাভাবিক কিন্তু গোপনীয়। মল-মূত্র ত্যাগ, সঙ্গম ইত্যাদি সর্বসমক্ষের নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক অনুশাসন বা সামাজিক মূলবোধকে অস্বীকার করলে, সত্য থেকে দূরে সরে যেতে হয়। মার্কিন মুলুকে সাগর সৈকতে মেয়েরা যে পোশাক পড়ে, তা যদি শিল্পের কথা বলে কক্সবাজারের সাগর সৈকতের দৃশ্য যুক্ত করা হয়, তা হবে শিল্প-বিকৃতি। বিকৃতিটা শৈল্পিক হতে পারে। কিন্তু যা শিল্পের সত্যকে বিকৃত করে, তাই হলো শিল্প-বিকৃতি। সংস্কৃতির বিচারে তাই হয়ে যাবে অপসংস্কৃতির অংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকাশ্যে বিচরণরত  বিকিনি পড়া নারী, বঙ্গ-সংস্কৃতির অংশ কি? এটাকে অবশ্য অপসংস্কৃতি না বলে কুসংস্কৃতি বলা যেতে পারে।

শিল্পী অনেক সময় নান্দনিক কারণেই কিছু সৃষ্টি করেন। তা বাস্তবের উপদান দিয়ে বা কল্পজগৎ থেকে আমদানী করতে পারেন। প্রতীক অর্থে শিল্প-বিকৃতি এড়িয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন 'হিজ মাস্টার্জ ভয়েজ'-এর 'কুকুর এবং গ্রামোফোনের চোঙা'। কোনো কোনো কল্পমূর্তি নানাভাবে চর্চিত হতে হতে, বাস্তবের উপদানের মতো হয়ে যায়। যেমন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ও তার দৈত্য।

লিওনার্দো দ্যা ভিন্সির আঁকা 'বেদী-পশ্চাৎ চিত্র' ১৪৭২-৭৫।

বিকৃতিটাকে কতদূরে নিয়ে যাবে- এ ভাবনাটা শিল্পীর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একটা প্রাকৃতিক দৃশ্যকে শিল্প যথাসম্ভব বাস্তবের মতো করলেও বিকৃতি থাকবে। সেটা মেনে নিয়েই আমরা তাকে বাস্তবধর্মী ছবি বলতে পারি। এমনকি বিশ্বাসের অংশ হিসেবে এর সাথে যদি দেবদূত বা উড়ন্ত সসার থাকে, তাহলেও তা বাস্তবধর্মী হবে। গির্জার পিছনের দেয়ালে লিওনার্দো দ্যা ভিন্সির আঁকা ছবিটিতে দেখি, অপার্থিব উপাদান হিসেবে দেবদূত। কিন্তু বাকি উপাদানগুলো পার্থিব এবং বাস্তব। এই ছবির পিছনের পার্সপেক্টিভ ভিউ এতটাই পরিমিত এবং সুসমন্বিত যে, পিছনের দেওয়ালটা অতিক্রম করে দৃষ্টি সুদূরে প্রসারিত হয়ে যায়। মসৃণতার দিক থেকে ছবিটা আলোকচিত্রের মতো, কিন্তু ক্যামেরায় এই ছবি তোলা সম্ভব নয়। কারণ, দ্যা ভিঞ্চির সময়ে বসে, এই ছবি তোলা সম্ভব নয়। তিনি সময়ের বহুদূরে বসে এঁকেছেন তাঁর শৈল্পিক ভাবনা থেকে। এখানেই শিল্পকর্মের মহত্ব। অধরা ধরা দেয় দেয় শিল্পীর কাছে, কল্পনা বাস্তবধর্মী হয়ে উঠে শিল্পকর্মের ভিতরে। এই জাতীয় ছবিও অনুকৃতি বা বিকৃতি যাই বলা যাক না কেন, কিন্তু স্বকীয়তার বিচারে দ্যাভিঞ্চি অনন্য।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে পিকাসোর আঁকা head-of-a-man-with-hat

বিষয়টি অন্যভাবে দেখলে, বিষয়টি প্রতীকীও বটৈ। অর্থাৎ দ্যা ভিঞ্চি এই ছবিতে যা উপস্থাপন করেছেন, তার ভিতরে রয়েছে তাঁর অনেক ভাবনার একটি দৃশ্যমান ফসল। হতে পারে ঈশ্বরের সাথে মেরির সম্পর্কের একটি প্রতীকী ভাব। একইভাবে প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক যে বিষয় শিল্পী যা ভাবেন বা  অনুভব করেন, তার ভিতরে একটি প্রতীকীমূল্য জন্মে। এমন ভাবনা থেকে কিছু রেখা দিয়ে ছবি আঁকলে, তা হয়ে যা প্রতীকী ছবি। তাতে দৃশ্যকে আবিষ্কার করার আনন্দ আছে, কিন্তু দৃশ্যের নিজস্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ থাকে না। প্রতীকের ভিতর দিয়ে শিল্পের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় পাবলো পিকাসোএবং অন্যান্যদের হাতে তৈরি হয়েছিল কিউবিজম। এদের লক্ষ্য ছিল নৈসর্গিক উপাদানের পরিবর্তে জ্যামিতিক উপাদান ব্যবহার করে সৌন্দর্যকে প্রকাশ করা। জ্যামিতিক উপাদান হিসেবে এঁরা ব্যবহার করেছিলেন গোলাকার, কোণাকার এবং  অনিশ্চিত বক্ররেখা। এই জাতীয় ছবিতে বাস্তবের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ নেই।  ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পিকাসো একনাগাড়ে বাস্তবধর্মী অনেক ছবি এঁকেছেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পিকাসো ক্রমে ক্রমে বাস্তবধর্মী ছবি থেকে প্রতীকধর্মী ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই সময়ে আঁকা বিজ্ঞাপনচিত্রে (Advertisement for tavern "Four cats") এর আভাষ পাওয়া যায়, তাঁর এই পরিবর্তনের ধারায়। তবে এই সময়ে তাঁর কিছু বাস্তবধর্মী ছবিও পাওয়া যায়। এই ছবিগুলো অঙ্কনশৈলীর দিক থেকে বাস্তবধর্মী, কিন্তু ভাবের দিক থেকে দ্বান্দ্বিকতার প্রতীক। এই বিষয়টি পাওয়া যায়, তাঁর  Science and Charity চিত্রকর্মে। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দকে বলা যায়, পিকাসোর বাস্তবধর্মী চিত্রকর্ম থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টার বৎসর। ফলে এই বৎসরে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় নানা ধরনের পরীক্ষামূলক ছবি। এই সময়ে তাঁর ভিতরে নিজেকে ভাঙার অস্থিরতা চরম অবস্থায় পৌঁছায়। তিনি এই পর্যায় Head of a Man in El Greco style এবং Portrait of Casagemas নামের দুটি ছবি আঁকেন। এই ছবি দুটি, যেনো বাস্তবধর্মী হয়েও যেনো তা নয়। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তাঁর ছবি অভিব্যক্তিবাদী (Expressionism) এবং অন্তর্মুদ্রাবাদ (Impressionism) আদর্শের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময়ের তাঁর আঁকা La chata চিত্রকর্মটি তাঁর প্রথম অভিব্যক্তিবাদী চিত্রকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে Lola হলো তাঁর প্রথম অন্তর্মুদ্রাবাদী ছবি। এই ধারার দ্বিতীয় চিত্রকর্মটি হলো Portrait of Josep Cardona। এই ধারা অনুসরণ করে পিকাসো একসময় কিউবিজমে পৌঁছে যান। পিকাসোর এই উত্তরণ শিল্পের উত্তরণ। একটি বিষয়ের বাস্তবতা বাইরে যতটা থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে, তার ভিতরে। যাকে অনুভব করা যায়, কিন্তু দেখানো যায় না।

শিল্পের শ্রেণিবিভাজন
কোনো বিষয়ের বিচারে শিল্পকর্ম অখণ্ড সত্তায় বিরাজ করে। একটি গান বা একটি দৃশ্যকে যদি শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে তা অখণ্ড হিসেবই বিবেচনা করি। একটি হাতভাঙা মানুষের মূর্তিকে শিল্পকর্ম যখন বলা হয়, তখন ভাঙা হাতের উপস্থিতি মনে রেখেই করা হয়। কিন্তু ভাঙা হাতের জন্য আক্ষেপ কিন্তু মনে থেকেই যায়। আবার একটি হাতকেই যদি আলাদাভাবে শিল্পকর্ম হিসেবে নির্বাচন করা হয়, তাহলে যতটুকু শিল্পী দেখাতে চান, ততটুকুই শিল্পকর্ম হবে। এখানে হাত অখণ্ড সত্ত্বা হিসেবেই উপস্থাপিত হবে।

শিল্প বিমূর্ত, তাই তার স্থান মনে। শিল্পের মূল্য 'আমি'র সৌন্দর্যবোধের উপর নির্ভরশীল। মানুষের অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজের সাথে শিল্পকর্মের পার্থক্য গড়ে তোলে তার সৌন্দর্য। যেহেতু সৌন্দর্যবোধ মানুষে মানুষে ভিন্ন, তাই শিল্পের মর্যাদাও মানুষে মানুষে ভিন্ন মাত্রা পায়। সেই কারণেই একই গান কারো কাছে খুব ভালো লাগে, আবার সেই গান অন্যের কাছে কুৎসিত মনে হয়।

মানুষের মন প্রাত্যহিক আটপৌরে কাজের ভিতর দিয়ে স্থবির হয়ে যায়। শিল্পকর্ম সেই স্থবির দশা দেখে মুক্তি দেয়। আর সেই মুক্তিই মানুষকে দেয় আনন্দ। শিল্প মানুষকে ভোগের পথে সঞ্চালিত করে, কিন্তু শিল্পবোধই মানুষকে বিকৃতচারিতা েকে বিরতও রাখে। সার্বিক বিচারে শিল্পকলাকে প্রধানত দুটিভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগদুটো হলো- চারুশিল্প (fine art) এবং কারুশিল্প (crafts)

শিল্পের মূল্য
চিত্রপ্রদর্শনীতে
গিয়ে শোনা যায়, অমুকের ছবি অত টাকায় বিক্রয় হয়েছে। কিসের পরিমাপে এই মূল্য নির্ধারিত হয়, সে প্রশ্নটা উঠতেই পারে। 'মোনালিসা'র দাম যদি ১০০ টাকা হয়, আর চিত্রপ্রদর্শনীর বিক্রয়কৃত ছবির মূল্য যদি ৫০ টাকা হয়, তাহলে কি বলা যাবে সৌন্দর্যের বিচারে  'মোনালিসা' ছবিটি বিক্রয়কৃত ছবির চেয়ে দ্বিগুণ সৌন্দর্য ধারণ করে? মূলত শিল্পকর্মের জন্য যে দাম ধরা হয়, তা হলো শিল্পের বাণিজ্যিক মূল্য। এই মূল্যের দাম নানা কারণে কমবেশি হয়। এর সাথে যুক্ত থাকে শিল্পীর সুনাম। দ্যা ভিঞ্চির অতি সাধারণ একটি পেন্সিলের খসড়া অতি মূল্যে বিক্রয় হতে পারে। পক্ষান্তের অতি যত্নে আঁকা একালের কোনো ছবি হয়তো ওই দামে বিক্রয় হবে না। একই সাথে প্রাচীনত্বের বিচার করা হয়। সস্তায় কেনা শিল্পকর্ম সৌন্দর্যের বিচারে সকল সময় সস্তা হয় না।

শিল্পকর্মের শিল্পমূল্য নির্ধারণের কোনো মাপকাঠি নেই। শিল্পমূল্য নির্ভর করে সৌন্দর্যের আবেদনের বিচারে। যেহেতু সকল ব্যক্তির কাছে সকল সৌন্দর্য সমান আবেদন তৈরি করতে পারে না, তাই একই শিল্পকর্ম সবার কাছে সমান মূল্য পায় না। প্রিয়ার গালের তিলের জন্য সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে কেউ প্রস্তুত, কিন্তু তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এমন কেউ, যে পুরো প্রিয়ার মূল্য হিসেবে একটি তিল-কণাও বিলিয়ে দিতে রাজি হবেন না। শিল্পের বাণিজ্যক মানের বিচারে যে স্বত্বাধিকার তৈরি হয়, তার নিরিখে শিল্পকর্মের মালিকানা হস্তান্তর হতে পারে। কিন্তু শিল্পের অধিকার হস্তান্তরযোগ্য নয়। একটি ছবি কিনে, আমি তার বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করতে পারি, কিন্তু শিল্পের অধিকারে বলতে পারি না এই ছবিটি আমার। স্বত্বাধিকার নেই বলে, রবীন্দ্রনাথের কোনো বই যে কেউ ছেপে বাণিজ্য করতে পারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রচনাকে পরিবর্তন কোনো স্বত্বাধিকার আইনেই মান্য করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে বা চিত্রকর্মে এমন বিকৃতি ঘটে না, কিন্তু গানে ঘটছে। অনেকেই স্বত্বাধিকারের দোহাই দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের গানে আড়ি দিচ্ছেন, তান বা বিস্তার জুড়ে দিচ্ছেন। মূলত এঁরা এসবের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের শিল্প-স্বত্বাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। এঁরা শিল্প-স্বত্বাধিকারের অমর্যাদা দিয়ে সীমালঙ্ঘনের পাশাপাশি, শিল্পাঙ্গনকে কলুষিতও করছেন এ কথা বলতে বাধা দেখি না। 

শিল্পের সাধনা ও সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা
একালের শিশুদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, বড় হয়ে তোমরা কি হবে? উত্তর দেয় পুলিশ হবো, মিষ্টিওয়ালা হবো, বাদামওয়ালা হবো ইত্যাদি। কেন তারা এসব পেশার প্রতি আগ্রহ দেখায়, তারা যথাযথ উত্তর মনোবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই দিতে পারবেন। আমরা সাদা চোখে দেখি, শিশুরা বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে শৈশবের লক্ষ্য থেকে সরে আসে। অভিভাবকরা শিশুর তুষ্টির জন্য প্রথমদিকে তাদের ইচ্ছাগুলোকে সায় দেয় বটে, কিন্তু যতই তারা বড় হয়ে উঠতে থাকে, অভিভাবকরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণের পরিমাণ ততই বাড়িয়ে দিতে থাকে। অভিভাবকদের সে প্রচেষ্টার সূত্রে বড় হয়ে ওঠা শিশুরা বেড়ে ওঠে তথাকথিত মানুষ হয়ে। আর্থ-সামাজিক নিষ্পেষণের জন্য সভা-সমিতি আছে, জাতিসত্তা বিলুপ্তি কিম্বা ভাষার মৃত্যুরোধে হাহাকার আছে, কিন্তু প্রতিভার নিষ্পেষণ বা অবদমনের প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কি কোনো দায় নেই? যদি দৈহিক আঘাতের জন্য যদি শিশুদের পাশে দাঁড়াই, তবে শিশুর শৈশবের আনন্দ কেড়ে নির্যাতিত করার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াবো না কেন?

একালের শিশুদেরকে বড় করে তোলা হয়, অর্থোপর্জনের যন্ত্র হিসেবে। এর সাথে কোনো কোনো শিশু সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদির পাঠ নেয় বটে, কিন্তু মূল পাঠ হিসেবে নেয় না। জীবন বাঁচানোর জন্য শিল্প-কলকারখানা দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়, জীবন সাজানোর জন্য শিল্পকলার দিকে ততটাই কম নজর দেওয়া হয়। দুইয়ের দরকার আছে। তবে তার অনুপাতটাও জানা দরকার। এই দরকার-অদরকারের দ্বন্দ্বের ভিতরে বড় হয়ে ওঠা মানুষরা, বড় হয়ে অনেক বেশি অর্থোপর্জনের জন্য ঘুষের চাকরি নেবে কিনা, অনৈতিকভাবে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিতে আসক্ত হবে কিনা, এসব অমূল্য বা মূল্যহীন ভাবনা দুর্মূল্যের বাজারে পাত্তা পায় না। অর্থোপার্জনের যন্ত্র হিসেবে যে যতটা সার্থক, তার মানবজন্মও ততটাই সার্থক, তেমনটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এর ভিতর দিয়ে এইসব অভিভাবকেরা আবার নতুন প্রজন্মের কাছে সততা বা নৈতিকতার মতো ক্রমান্বয়ে দুর্লভ হয়ে ওঠা গুণগুলোরও প্রত্যাশা করে।

মানুষ যেমন তার জন্মের জন্য দায়ী নয়, তেমনি এই সমাজের তরুণরাও বলতে পারে তাদের এইভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তারা দায়ী নয়। সৌভাগ্যের বিষয় এর ভিতরেও কিছু তরুণ এই জাতীয় বড় মানুষ হয়ে উঠে না। আবার অনেক তরুণ বিদ্রোহ করে বসে বড় মানুষ না হয়ে উঠার জন্য। আমাদের এখন দরকার এই রকম অনেক বিদ্রোহী মানুষ। যারা বড় মানুষ না হয়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার সাধনা করতে পারে।

সত্যিকারের মানুষ হতে সত্যের সাধনা দরকার। এই সততার সাধনা নিজের জন্য, অন্যের কাছে জাঁক করে বলার জন্য নয়। দেখা যায়, যাঁরা আড়ম্বরের সাথে বলেন 'আমি কখনো মিথ্যা বলি না'- সেটাই হয় তাদের বড় মিথ্যাচার। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে প্রথম দরকার আত্মসমালোচনা। আমি কি পারি আর কি পারি না, সেটা দিয়েই শুরু হতে পারে; যা পারি তা যেন আরও ভালোভাবে পারি, এই প্রতিজ্ঞার ভিতর দিয়ে।

মানুষের দৈহিক গুণাগুণের মতই তার কর্মগুণও তার কোষস্থ জিনসঙ্কেতে থাকে। এই জিনসঙ্কেতের কারণেই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিরাজ করে এবং তা অনেক সময়ই প্রচ্ছন্ন থাকে বা প্রচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করা হয়। অথচ এই প্রচ্ছন্ন গুণের চর্চার ভিতর দিয়েই সে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে। মানুষ তার গড় ক্ষমতায় অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারে। ধরা যাক, একজন মেধাবী ছাত্র ডাক্তার হতেও পারবে আবার প্রকৌশলীও হতে পারবে। কিন্তু হয়তো সে জানে না, আইনজীবী হলে সবচেয়ে ভালো হতে পারতো। এই সত্যটি মেনে নিলে, আইনজীবী হতো তার অধিকতর সত্যিকার মানুষ হওয়ার চর্চা। আবার এই তিনটি বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে হয়তো সে আরও বেশি সাফল্য পেতে পারতো। সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠার জন্য প্রথম দরকার নিজেকে চেনা। সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠার সাথে নানারকম প্রলোভনও থাকে। কোনো শিল্পীর গান শেখার জন্য কেউ মরিয়া হয়ে উঠে, অথচ হয়তো সে জানেই না, সেটা তার নিজের ক্ষেত্রই নয়। তার উচিৎ সঙ্গীতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য যতটুকু সঙ্গীত শেখা, ততটুকুই। তাছাড়া ভালো শ্রোতা হওয়ার জন্যও সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া যেতে পারে।

তরুণদের কাছে একটি বড় প্রশ্ন থাকে, 'নিজের ক্ষেত্রটি চিনব কি ভাবে'? এই প্রশ্নের সাথের উত্তরটাও তার নিজের কাছেই থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই পারিপার্শ্বক অবস্থা এবং প্রলোভন তরুণদের বিভ্রান্ত করে। দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের কিছু সহজাত ক্ষমতা থাকে, সেটা সে যত ভালোভাবে পারে অন্যেরা তা পারে না। নিজের ক্ষেত্র চেনার এটা একটি প্রাথমিক স্তর। সে হয়তো মাটির পুতুল তৈরি করে সহজাত দক্ষতায়, হয়তো খুব ভালো গান করে সহজাত গুণে, হয়তো গাছ বা প্রাণীর প্রতি অপরিসীম আগ্রহ আছে। সেটাই তার ক্ষেত্র। সে ভালো অঙ্ক পারে না, কিম্বা ছবি আঁকতে পারে না, তার জন্য হীনমন্যতায় ভোগার কারণ নেই। বরং অহঙ্কারের সাথে তার বলা উচিৎ- 'আমি যা পারি, তোমরা তা পার না'। কখনো দেখা যায় কারও ভিতরে একাধিক বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকে। এক্ষেত্রেও তাকেই বেছে নিতে হবে কোনটি তার জন্য অধিকতর প্রযোজ্য। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে নিজের ক্ষেত্রকেই আগে চেনা দরকার।

আবার মানুষের প্রত্যাহিক জীবনে নানারকম বিষয়ের সাথে জড়িত থাকে। নিজের ক্ষেত্রের চর্চার ভিতর দিয়ে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করবে, কিন্তু জীবনের অন্যান্য উপাদানকে তুচ্ছ করে বা অগ্রাহ্য করে নয়। তা যদি করে তবে সে বড় মানুষ হতে পারবে কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে না। অন্যান্য উপাদানের প্রতি শ্রদ্ধার ভিতরে থাকবে তার মহত্বের পরিচয়। একথা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়, মানুষ সামাজিক জীব। এককভাবে প্রতিটি মানুষ দুর্বল, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে প্রবল। প্রবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অন্যের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিতে হবে। প্রতিটি মানুষ হবে নিজের রাজত্বের রাজা, আর অন্যান্য রাজার সাথে মিলে তৈরি করবে একটি অখণ্ড রাজত্ব। সমাজের অন্যান্য রাজার সাথে মিলে যে রাজত্ব গড়ে উঠবে, তার ক্ষমতা হবে অনেক অনেক বেশি।

যে মানুষটি নিজের আনন্দে সৌন্দর্য তৈরি করেন তিনিও শিল্পী, যিনি সবার জন্য করেন তিনিও শিল্পী। প্রকৃতির এই যে এত রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শ্রবণ-এর লীলা, প্রকৃতি এসব কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করে না। যা হওয়ার তা হয়, তা অনুভব করে কোনো এক 'আমি' বা 'আমিসমূহ' আনন্দ বা দুঃখ পায়। কিন্তু শিল্পীর উদ্দেশ্য থাকতেই হয়। এই শিল্পীর শিল্পবোধের সাথে শিল্পের রসগ্রহণকারীর শিল্পবোধের যোগাযোগ যথাযথভাবে হলে, শিল্পকর্ম সার্থক হয়ে উঠে।

নান্দনিকতা অনেকক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয় বা রসাস্বাদনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাগসঙ্গীতের স্বরবিন্যাস যে বিশেষ ধ্বনিশৈলী তৈরি হয়, তার কোনো একটি শৈলী যদি কারো আগে থেকেই শ্রোতার জানা থাকে, তাহলে সহজেই কোনো শিল্পীর পরিবেশনা দ্বারা সে আনন্দ লাভ করতে পারে বা বিরক্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ তার পূর্ব-অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে। সে আগের অভিজ্ঞাতার সাথে নতুন শোনার অভিজ্ঞতার তুলনা করে। ফলে শ্রোতার অভিব্যক্তি হয়, 'যা শুনলাম এমনটা আর শুনি নি, কিম্বা এত মন্দ পরিবেশনা আর কখনো শুনি নি। এরূপ তুলনা হতে পারে, কবিতার ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে।  সকল নান্দনিক উপস্থাপন সবার জন্য নয়, আবার সকল উপস্থাপনও নান্দনিক নয়। কিছু লোক যা দেখে আনন্দ লাভ করে, তা খুব খারাপ হতে পারে বা খুব ভালো হতে পারে। কিন্তু কিছু লোক তো ভালো বলেছে এ আত্মতৃপ্তি শিল্পীর থাকতেই পারে। উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পী ভাবতেই পারেন, তিনি যে স্থানে আছেন, সেখানে দর্শক-শ্রোতা পৌঁছাতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে বিনয়ের সাথে শিল্পীকেই ভাবতে হবে, তার কোনো ত্রুটি আছে কিনা। বিনয়টা শিল্প এবং শিল্পীর জন্য জরুরী। সত্যিকারের মানুষ হবে বিনয়ী। কারণ মানুষ পরম সত্যের সাধনা করতে পারে, কিন্তু লাভ করতে পারে না। যদি কেউ পারে তবে সে হয়ে উঠবে ঈশ্বর। সে আর যাই হোক অন্তত মানুষ থাকবে না। অন্য কোনো বিশেষ মানুষের তুলনায় সে হয়তো কোনো কিছু খুব ভালো পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে পরমমানে পৌঁছাতে পারে নি বা পারবে না, এই অপারগতার কারণে তাঁর বিনয়ী হতে হবে। বিনয় মানুষকে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে যায় এবং সত্যিকারের মানুষ হওয়ার পথে চালিত করে। অহঙ্কার বড় মানুষ করে, কিন্তু সত্যিকারের মানুষের পথ থেকে বিচ্যুত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সে ভালো গান করে সে সুগায়ক, আর যে ভালো গান করে কিন্তু বিনয়ী, সে সঙ্গীতশিল্পী। আমাদের সুগায়কের চেয়ে অনেক বেশি  দরকার শিল্পীর। সকল ক্ষেত্রেই শিল্পীর দরকার। যিনি নিজেকে সাজাতে পারেন, অন্যকে সজ্জিত করতে পারেন।

শিল্পীর প্রতিযোগিতা হবে নিজের সাথে নিজের। অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা শিল্পীকে হীনমন্য করে, নিজের সাথের প্রতিযোগিতা করে সমৃদ্ধ। শিল্পী তাঁর আত্ম-অতৃপ্তির মধ্য দিয়ে অনুভব করবে, অপার সৌন্দর্যের ভুবনে সে কত ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্রত্বকে অসীমে উত্তরণের সাধনায় শিল্পীর সাধনা। প্রতিবার নিজেকে অতিক্রম করে একসময় শিল্পী অসীম সৌন্দর্যের পরম মানে পৌঁছাতে পারে না। আর যদি সে পারে, তা হলে পরম সৌন্দর্য হবে পরম সত্য, আর পরম সত্যই তাকে ঈশ্বরত্বে পৌঁছে দেবে। একজন শিল্পী সারা জীবন সে পরম সত্যের কাছে পৌঁছার সাধনা করেন, তা এক সময় শেষ হয়ে যায় অতৃপ্ততার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ করে হয়তো বলতে হয় 'আমার সকল কাজই রইলো বাকি, সকল শিক্ষা দিলেম ফাকি।' স্রষ্টার কাছে এই আক্ষেপ বোধ করি সকল শিল্পীর থাকে।

সত্যিকারের মানুষ হবে আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বমানব সভায় সে অনাহুতও নয়, রবাহুতও নয়। জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণে তার আবির্ভাব। এ আমন্ত্রণে সে ধন্য, কিন্তু যজ্ঞসভাকে ধন্য করতে হবে তাকেই। যে ক্ষমতা তার আছে তা দিয়েই সম্ভব। অলৌকিক কোনো প্রপঞ্চে আসক্ত বা বিশ্বাসী হওয়ার দরকার নেই। কর্মের ভিতর দিয়েই সে সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠবে। তবেই সে প্রবহমান অনন্ত আনন্দধারায় স্নাতক হতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় তোলা জলে স্নান করার দরকার পড়বে না।

মানুষের উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয় অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা দেয় ধারণা আর বহুবিধ ধারণা থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান। জ্ঞানের ব্যবহারিক কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে পাওয়া যায় বুদ্ধিমত্তা। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে বুদ্ধিমত্তার সাথে দরকার বোধ। বুদ্ধিমত্তার দ্বান্দ্বিক দশা থেকেই জন্ম নেয় বোধ। বোধই ধারণ করে ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বোধের রূপ পাল্টায় বটে, কিন্তু কিছু বোধ থাকে যা চিরায়ত, যা সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। যেমন সততার বোধ, অহিংসার বোধ, পরশ্রীকাতরতা-মুক্ত বোধ ইত্যাদি।

এসবের ভিতর দিয়েই একজন মানুষ হয়ে উঠবে সত্যিকারের মানুষ। এই মানুষ সাদাকে সাদা বলার সাহসিকতা দেখাবে, পক্ষপাতদুষ্টতার দ্বারা নিজেকে কলুষিত করবে না। আত্মসমালোচনা এবং আত্ম-সংশোধনের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠবে সত্যিকারে মানুষ। তা যেদিন হবে, সেদিনই আমরা গাইতে পারবো মানুষের জয় গান।

জীবনানন্দের অমিয় ধারা
শৈশবের কোনো এক বৈশাখী মেলায়, কোনো এক লোকশিল্পীর কণ্ঠে শুনেছিলাম
'নিরিখ বান্ধ রে দুই নয়ানে (নয়নের আঞ্চলিক শব্দরূপ)'। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। শৈশবের অজস্র স্বপ্নের ভিতরে ভাসতে ভাসতে কোনো স্বপ্নকেই নিরিখে বাঁধা হলো না। তাই দিক্‌ভ্রান্তের মতো দিক্‌চক্রবালের দিকে শুধুই চেয়ে থাকা। মুক্তি-আস্বাদনের স্বপ্ন সুদূরে রয়ে গেছে, জীবনে তার স্নিগ্ধ পরশ মেলে নি। পরীক্ষায় পাশের জন্য 'আমার জীবনের লক্ষ্য' কতবার পড়তে হয়েছে। তাতে, পরীক্ষায় পাশের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বটে, কিন্তু জীবনের লক্ষ্যে ফেলমারা ছাত্রই রয়ে গেছি। নিরখি বাঁধা হলো না, তাই মুক্ত জীবনের আনন্দও জুটলো না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনটা এমনই। নয়ান নিরিখে বাঁধতে বাঁধতে জীবন ফুরিয়ে যায়। জীবনের চলার পথে, যে সকল সহযাত্রী নিরিখ বাঁধতে পেরেছেন, তাঁরাই নমস্য হয়েছেন। মূলত, সাধারণ আর অসাধারণ মানুষের মধ্যে যে পার্থক্যটা গড়ে উঠে, বোধ করি তার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে এই বন্ধন।

এই মহাবিশ্বের বিপুল কর্মযজ্ঞশালা যে নিগড়ের বাঁধা, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন শৃঙ্খলা। জগতের প্রবহমান এই শৃঙ্খলাকে প্রাচীন ভারতের ঋষিরা নাম দিয়েছিলেন প্রপঞ্চ। তাঁদের কাছে প্রপঞ্চ হলো মায়া। তাঁরা এই মায়ার বাঁধনকে উপেক্ষা করার ভিতরে মুক্তির সন্ধান করেছেন। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছেন 'কা তব কান্তা'।
ধুনিক মানুষ মনে করেন, 'জগৎ প্রপঞ্চময়' বলে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে আছে পলায়নপর মনোবৃত্তি। মূলত মানুষের লক্ষ্য পূরণের ভিতর দিয়ে ঘটে মুক্তি। আর সে লক্ষ্যকে স্থির করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা হলো 'মুক্তি সংগ্রাম'। প্রপঞ্চময় বলে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে, এগিয়ে যাওয়ার বা জয় করার আস্বাদন পাওয়া সম্ভব নয়। সত্যের বন্ধনে যে শ্বাশত জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়, সে পথ ধরে চলতে গেলে, শুধু সত্য নয় লোভ, ঈর্ষা, ক্রোধ ইত্যাদি ত্যাগ করতে হয়। যিনি পারেন, তিনি প্রকৃত মুক্ত- জীবনের আনন্দধারায় স্নাতক হন। বৌদ্ধ দর্শনে একেই বলে  নির্বাণ লাভ। 'ত্যাগেই মুক্তি' একথা তখনই যথার্থ হয়ে উঠে, যদি তা হয় জগতের কল্যাণের জন্য হয়। 'জগতে কে কাহার' বলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্য নিজের কল্যাণও নেই, জগতের কল্যাণও নেই। এর ভিতরে আছে হয় আত্মপ্রবঞ্চনা নয়তো স্বার্থপরতা।

যে ধর্মবিশ্বাস আমাদেরকে শেখায় আত্মা দেহের কারাগারে বাঁধা, এ কারাগার ভেঙে আত্মা মুক্তির পথ খুঁজে পায়। সেই ধর্মই বলে, আত্মার মুক্তির জন্য আত্মহত্যা পাপ। কারণ, ঈশ্বরে বিচারে আত্মহত্যার ভিতরে রয়েছে অবৈধভাবে বাঁধ-ভাঙাজনীত অপরাধ। ঈশ্বর যে বিধির অধীনে মানুষকে জীবিত রাখেন, তার পূর্ণতা না দেওয়াটাই হলো বিধি-লঙ্ঘন। আত্মহত্যা কতটা পাপ, তার পরিমাপ ধর্মানুশাসনে যাই থাক, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বলা যায় আত্মহত্যা, জীবনযুদ্ধে পলায়নপর মনোবৃত্তিরই প্রকাশ। দেহের বন্ধনে মানুষ বন্দী হয়, আর বোধের বন্ধনে আমিত্ব মুক্তি পায়। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষদেরকে দীর্ঘদিন দৈহিকভাবে বন্দী করে রাখা যায়, কিন্তু বোধের দিক থেকে একটি মুহূর্তও রাখা যায় না। কারাগারে থেকেও তিনি মুক্ত। বোধ থেকে জন্ম নেয় আদর্শ। প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে বহুজনকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না। আদর্শের বন্ধনের ভিতরে মানুষের মুক্তির স্বাদ পায়। বোধের মৃত্যু হলেই মানুষের প্রকৃত মৃত্যু ঘটে। বিষপানে সক্রেটিস মৃত্যু ঘটেছিল বহুদিন আগে, কিন্তু বোধের রাজ্যে তিনি অমর। দৈহিকভাবে টিকে থাকার মধ্যে আছে প্রাণে বেঁচে থাকার কসরৎ, আর বোধের অধিকার নিয়ে নিজেকে মেলে ধরার মধ্যে আছে জীবনের সার্থকতা। 

একথা ঠিক, শিল্প এক ধরনের মোহ তৈরি করে। যা মনে হয় কোনো মায়াময় জগৎ। বাস্তবে শিল্পী, জগতের সৌন্দর্যের এক একটি অধ্যায়কে তুলে ধরেন। জীবনের অন্যান্য অনুভুতির সাথে এই অধ্যায়কে মেলাতে না পারলে তা মায়াই মনে হবে। শিল্প জীবনের প্রপঞ্চকে ধারণ করে। তাই কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ের নিরিখে বাধা উপলব্ধিও প্রপঞ্চময় হয়ে ওঠে। মহাকালের বিচারে জগৎ প্রপঞ্চময়, কিন্তু মহাকালের ক্ষুদ্র অংশে তা কঠোর বাস্তব। তাকে মায়া বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ এই ক্ষুদ্র অংশে লক্ষ্যবস্তু, শিল্পী এবং শিল্প উপভোগকারী সবাই বাস্তব। তাকে নিজের মতো করে বাঁধতে হয়। সুসমন্বিত বন্ধনে শিল্পের মুক্তি ঘটে।

সবার লক্ষ্য এক নাও হতে পারে, কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই নিরিখ বাঁধতে হয়। জীবনের লক্ষ্য যদি একমুখী হয়, তাহলে তার মুক্তি ঘটে একদিকে। বহুমুখী মানুষের মুক্তির পথ বহুদিকে প্রসারিত। জগতের সকল ক্ষেত্রে যদি কারো মুক্তি ঘটে, তবে তিনি হয়ে উঠবেন ঈশ্বর। সেটা সম্ভব হয় না বলেই মানুষ অনেক চেষ্টায় অসাধারণ হয়েও ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারেন না।

লক্ষ্য পুরণের জন্য শুধু বন্ধন নয়, সমন্বয়টাও দরকার। এই কারণেই, ছন্দোবন্ধে বাণী হয়ে উঠে কবিতা, সুরের বন্ধনে সাধারণ কথা হয়ে উঠে গান, আর দেহের ছন্দোবদ্ধ দোলায় সৃষ্টি হয় নৃত্য। এসবেরই মূলে থাকে সুসমন্বয়। যে অসীম আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনের শুরু, তার অনেক কিছুই পাওয়া হয়ে ওঠে না, লক্ষ্যের যাত্রাপথকে ঠিক মতো না বাঁধার কারণে। বিশ্বচরাচরের বন্ধনে ছন্দ আছে বলেই তা আনন্দময়। এই আনন্দ আবার বহুবিধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের সমন্বয়ে সৃষ্ট। যেখানে সকল আনন্দ মিলে মিশ্র আনন্দের রূপ ফুটে ওঠে, সেখানেই বিশ্ব-প্রকৃতির সৌন্দর্য। ছন্দের বিকাশ ঘটে সুসমন্বয়ে। সমন্বয়হীনতার কারণে যে কর্মকাণ্ড ছন্দবিহীন অবাধ, উপস্থাপনের বিচারে তাই উচ্ছৃঙ্খলতা। তানপুরায় যে সুরের খেলা চলে, তা ঘটে তার বাঁধার সুসমন্বিত বিধিতে। নইলে এমন সুরের যন্ত্রও যন্ত্রণায় পরিণত হয়। 

মানুষ সামাজিক প্রাণী। বহুজনের ভিতরে একাকী থাকার ভিতরে যে যন্ত্রণা আছে, বোধ করি মনোবিকারগ্রস্থ কিছু মানুষ ছাড়া আর সবাই তা অনুভব করেন। এক্ষেত্রে অন্তর্মুখী মানুষের যন্ত্রণা আরও বেশি। কারণ, তিনি অন্যের সাথে বন্ধন গড়ে তুলতে পারেন না। বহুজনের সাথে বন্ধন গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন অন্যান্যদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। যাঁরা অন্যের ত্রুটি ধরে বেড়ান, সেটা যে তাঁর নিজেরেই একটি বড় ত্রুটি সেটা ভাবেন না। যিনি অন্যের কথা শুনতে চান না, তাঁর কথাও অন্যেরা শুনবে কোন দায়ে। একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হলে, অন্যান্যদের সাথে অন্তত সুসম্পর্কটা রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। সুসম্পর্ক রয়েছে এমন মানুষদের সবাই বন্ধু হয়ে উঠে না। মনের বন্ধনে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। এর জন্য মনের সাথে মনের সেঁতুবন্ধ তৈরি করতে হয়। এ কারণেই বন্ধনের শৈথিল্যে নিজের পরিবারের লোকও বন্ধু হয়ে উঠে না। দীর্ঘদিনে এক সাথে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কাটাবার পরও তাঁদের ভিতর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে না।

মানবশিশুর বোধের বিকাশ ঘটে বাইরের জগত চেনার ভিতর দিয়ে। এর ভিতর দিয়ে নিজেকে জানার প্রাথমিক কাজটুকু ঘটে যায় পরিবেশগত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়ায় সে নিজেকে লিঙ্গের বিচারে চেনে, পরিবারের বিচারে চেনে, গোষ্ঠীর বিচারে চেনে। তারপর সে বাইরের জগতের নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে জানতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ বাইরের জগৎ নিয়ে এতটাই মেতে ওঠে, কখনো যে নিজেকে চেনার চর্চাটা হারিয়ে ফেলে, সে বুঝতে পারে না। ফলে ক্রমে ক্রমে সে নিজগৃহে পরাবাসী হয়ে যায়।

নিজেকে জানার ভিতর দিয়ে ঘটে আত্ম-উপলব্ধি। এজন্য নিজের মনের তারকে আগে বাঁধতে হয়। নইলে জীবনসঙ্গীত হয়ে যাবে হট্টগোলের মেলা। সামাজিক হতে গেলে সমাজের সাথে নিজেকে বাঁধতে হয়। বহুজনের ভিতরে নিজেকে চিনতে গেলে এর বিকল্প নেই। একইভাবে জাতি সত্ত্বার সাথে গড়ে উঠা বন্ধনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে জাতীয়তা বোধ। যিনি এই বন্ধনকে অগ্রাহ্য করেন, তিনি নিজ দেশেই বিদেশী। স্বজাতির সাথে নিজেকে বাঁধতে গেলে, প্রয়োজন নিজ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।  মানুষের বৃহত্তর গোষ্ঠীগত যত ধরনের বন্ধন আছে, তার ভিতরে সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন হলো, সাংস্কৃতিক বন্ধন। এর ভিতরেই রয়েছে যে কোনো জাতির মুক্তির মূলমন্ত্র। এই মন্ত্রের জোরেই ভাষা-আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটে এবং বিজয়ের ইতিহাস তৈরি হয়।

বন্ধকে মুক্ত করার জন্য বন্ধন। কারণ, বন্ধনে আছে মুক্তির অঙ্গীকার, আর মুক্তিতে আছে জীবনানন্দ। আসুন সে জীবনানন্দের প্রবহমান অমিয় ধারায় আমরা সবাই স্নাতক হই।