৩.২
সত্য ও সত্যসন্ধানী মন
সত্য হলো
−
ঠিক যা তা-ই। এখানে 'যা' হলো- সত্তার পূর্ণ পরিচয়। এই 'পূর্ণ পরিচয়' হলো একটি সত্তার কাছে অন্য সত্তার আবিষ্কৃত সর্বশেষ পরিচয়। সত্তার
যথার্থ বা সত্য পরিচয় লাভের ভিতর দিয়ে বিশ্বাস জন্মে। আর বিশ্বাসের ভিতর দিয়ে
সত্যের নূতন দিক উন্মোচিত
হয়।
যেভাবেই হোক, মানুষের মনে যখন কোনো অনুভূতির জন্ম হয় তখন, তা গ্রহণ করে তার 'আমি' নামক সত্ত্বা। এই অনুভূতি হলো একটি তথ্যের আদি স্তর।
এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা। ইন্দ্রিয়সমূহের কাজ হলো−তার আওতাধীন তথ্যাদি তার বিভাগের কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ ডিভাইসের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই ডিভাইসের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে 'আমি' উজ্জীবিত হয়। এই উজ্জীবনের সূত্রেই 'আমি'র 'উপলব্ধি' নামক অনুভূতির জন্ম নেয়। এই 'উপলব্ধি' মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়। উপলব্ধির দ্বারা প্রতিটি অনুভূতিকে জানা
যায়, আর এই জানাটা স্মৃতিতে রক্ষিত হয়।
মানুষ তার ইন্দ্রিয় দ্বারা যখন কোনো কিছু অনুভব করে, তখন তার কাছে নতুন কিছু তথ্য
প্রকাশিত হয়। এটাকে বলা যায় আদি বা প্রাথমিক অনুভব। এই অনুভবের ভিতর যে ক্ষুদ্র
জ্ঞানের সৃষ্টি হয়, তাই হলো প্রাথমিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞা। অভিজ্ঞা মানুষের
স্মৃতিভাণ্ডারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তথ্য হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। আর
বহুবিধ অভিজ্ঞার সুসমন্বয়ে সৃষ্টি হয় জ্ঞান। তাই জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞা
হলো ক্ষুদ্রতম মৌলিক উপাদান। আর জ্ঞানের উচ্চতর স্তর হলো
প্রজ্ঞা।
মানুষ যখন জ্ঞানের চর্চা করে, তখন তার মস্তিষ্কে জন্ম নেয় অজস্র নতুন নতুন তথ্য । জ্ঞান চর্চার ভিতর দিয়ে মানুষের মনে অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। আবার এই তথ্য এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তৈরি হয় নতুন তথ্য। এই তথ্যটিই হলো- জ্ঞানতথ্য। মূলত কোনো বিদ্যমান বা ঘটিত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানতথ্যের খণ্ডিতরূপ। ঘটিততথ্যের মধ্য দিয়ে এমন একটি চূড়ান্ত জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে, যা হয়ে ওঠে সত্য। এক কথায়- 'ঠিক যা তাই'।
মূলত একটি সত্তার পূর্ণ পরিচয়ের ভিতরেই রয়েছে পরম সত্য। বাস্তবে মানুষের কাছে এই পরম সত্য অধরা থেকে যায়। মানুষের জানার সীমাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কোনো সত্তার পরম সত্যের অংশবিশেষ ধরা পড়ে মাত্র। তাই সত্তার প্রতি বিশ্বাসের মান দাঁড়ায় আংশিক। সত্তার সত্য উদ্ঘাটনে মধ্য দিয়ে সত্যের স্বরূপ পাল্টে যায়, সেই সাথে বিশ্বাসও পাল্টায়। তাই মানুষ যখন কোনো সত্য সম্পর্কে অবগত হয়,
তখন তা- একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে, সুনির্দিষ্ট পরিবেশে এবং সুনির্দিষ্ট অবস্থানের
বিচারে 'আমি'র উপলব্ধি হিসাবে পায়। যেসকল তথ্য কোনো সত্তাকে জানতে সহায়তা করে, তা সত্য জানার প্রক্রিয়া মাত্র। মূল সত্য এই সকল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোনো সত্তার বৈশিষ্ট্য বা ধর্মকে প্রকাশ করে। এই ধর্ম অবশ্যই সময়, পরিবেশ এবং 'আমি'র অবস্থানের উপর নির্ভরশীল।
সর্বদিকের বিবেচনায় যিনি সকল সত্যকে অনুভব করতে পারেন, তিনিই
হয়ে ওঠেন পরম সত্যবান।
প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব সত্য। যেমন আগুনের রয়েছে আলো ও তাপ
প্রদায়ী বৈশিষ্ট্য। এটি আগুনের জন্য সত্য, কিন্তু পানির জন্য নয়। একটি সত্তার সত্য
অন্য সত্তার সত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়, বা অন্য সত্যের দ্বারা বিচ্যুতি ঘটে। যেমন আগুনের সত্য
তাপপ্রদায়ী, পানির উপর সে সত্য কার্যকর হলে পানি বাষ্পীভূত হয়। অর্থাৎ পানি তার তরল
ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়। আবার পানি থেকে তাপ সরিয়ে নিতে থাকলে পানি বরফ হয়। কিন্তু
আগুনের তাপ কমানোর মধ্য দিয়ে আগুনের মৃত্যু হয়। কিন্তু অন্য সত্ত্বার দ্বারা
প্রভাবিত হয়ে যখন একটি সত্তার রূপান্তর ঘটে, রূপান্তরিত সত্তার সত্যের মধ্যেই
তা ঘটে। যেমন আগুনের প্রভাবে পানি যখন বাষ্পীভূত হয়, তখন পানির বাষ্পীভূত হওয়ার
গুণের কারণেই ঘটে।
সত্তার
সত্য স্থান, কাল ও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিন্নতর দশায় পৌঁছায়।
এ সবের দ্বারা সত্তার ধর্ম পাল্টে যায় না, বরং সত্তার অপর একটি সত্য উন্মোচিত হয়।
সত্তার এই বিবর্তন রূপান্তর ঘটে থাকে স্থান, কাল ও পরিবেশর
বিচারে।
সুনির্দিষ্ট সময়: মহাকাল একটি অনন্ত
সময়মান। এর কোনো সুনির্দিষ্ট অংশ হলো সুনির্দিষ্ট সময়। এই সময়ের ভিতরে যে কোনো
বিষয়ের যথার্থ অনুভব বা উপলব্ধিই হবে ওই সময়সীমার মধ্যে সত্যের
খণ্ডিত মানদণ্ডে। ধরা যাক একটি টেবিলের উপরে
খানিকটা পানি পড়ে আছে। একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে কোনো এক 'আমি' তা দেখলো। আমি'র
কাছে টেবিলের উপরে পানি আছে এটাই সত্য। এই সত্য অবশ্যই সময়ের বিচারে হবে। কিছু
সময় পর দেখা যাবে স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে পানি কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও
সময়ের সাথে সাথে সত্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। এক ঘণ্টা আগে যতটুকু পানি 'আমি'
দেখেছিল, সেটা ছিল সেই সময়ের সত্য, এক ঘণ্টা পরে যতটুকু পানি থাকবে, তাই এক
ঘণ্টা পরের সত্য। সময়ের সাথে সাথে সত্যের এই বিবর্তনের ধারা হবে প্রপঞ্চ।
উল্লেখ্য প্রকৃষ্টরূপে যা প্রকটিত হয়, তাকে প্রপঞ্চ বলা
হচ্ছে। আক্ষরিকভাবে প্রকাশিত এই
অর্থের ভিতরে প্রপঞ্চের প্রকৃত রূপ পাওয়া যায় না। মূলত কোনো প্রক্রিয়াধীন দশায়
পরিবর্তনশীল কার্যক্রম হলো প্রপঞ্চ (phenomenon)।
ধরা যাক, কোনো এক সকালে দেখলেন, আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ। কিছুক্ষণ শুরু হলো
প্রবল বৃষ্টি। আরো কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে গেল। বৃষ্টির শুরু থেকে শেষ হওয়া
পর্যন্ত একটি প্রক্রিয়াধীন দশা আপনার সামনে ঘটে গেছে। এই ঘটমান কার্যক্রমটি
সত্য, কার্যক্রম শেষ হওয়াটাও সত্য। এর ভিতরে ঘটমান সকল
সত্যের সমন্বিত রূপে প্রপঞ্চ
উপস্থিপত হয়েছে।
প্রপঞ্চের প্রতিটি অংশ এক একটি সত্যকে ধারণ করবে, আবার একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের
ঘটে যাওয়া ঘটনা একটি অখণ্ড সত্যকে প্রকাশ করবে। একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের প্রপঞ্চ
আবার মহাকালের বিচারে খণ্ডাংশ। মহাকালের এই অসীম পরিসরে যা কিছু ঘটবে তার সবই
সত্য। কিন্তু মহাকালের একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের বিচারে অন্যান্য অংশের তুলনা
করলে, দেখা যাবে একটি সময়-খণ্ডাংশে যা সত্য, অন্য খণ্ডাংশে তা সত্য নয়।
জগৎ পরবর্তনশীল। স্বল্প সময়ের বিচারে প্রপঞ্চ স্থায়ী মনে হয়। প্রতিটি মানুষের
জীবনের
প্রতিমুহূর্তে যে পরিবর্তন ঘটছে, তা মানুষ
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শনাক্ত করতে পারে না। আজকের আমি, আর কালকের
আমির দৈহিক পরিবর্তন আমাদের অনুভূতিতে ধরা পরে না। কিন্তু ২০ বছর বা ৩০ বছরে
ব্যবধানে এই পরিবর্তন ধরা পড়ে। প্রকৃতির অন্যান্য উপকরণের মতোই, দেহধারী মানুষ
মাত্রেই প্রপঞ্চের অধীন। ভারতীয় ঋষিরা প্রপঞ্চের অর্থ করেছিলেন মায়াময়। যা ছিল,
তা নেই। তারপরেও আমাদের কাছে 'আছে বা নেই'-এর সত্য উপলব্ধিতে আসন গেড়ে বসে
আছে।
ভারতীয় মায়াদর্শনে, জগৎ পিতার মায়াময় বা যাদুর জগতের প্রতিটি উপদানের মতো
মানুষও একটি উপাদান। জগৎ প্রপঞ্চময়, সবকিছুকে নিয়েই প্রপঞ্চময়, তাই আমাদের
জীবন ও জীবনবোধও প্রপঞ্চময়। আমাদের দেহের পরিবর্তন যেমন ঘটে, মনেরও পরিবর্তন
ঘটে। মনের এই পরিবর্তনের প্রতিটি অংশও প্রপঞ্চ। দেহের পরিবর্তনশীল ঘটমান দশা
প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের তথা বিশ্ব জগতের প্রপঞ্চের অংশ, মনের প্রপঞ্চ
হলো সমগ্র মনোজগতের
অনুভবের প্রপঞ্চ।।
পরিবেশ: প্রবহমান ঘটনায় পরিবেশ
সত্যকে প্রভাবিত করে। ধরা যাক এমন একটি ঘরের কথা, যে ঘরের পরিবেশ অপরিবর্তনশীল।
তাহলে সত্যও চিরন্তন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ওই ঘরের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে,
সকল ধরনের উপাদানের প্রভাব স্থির হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ধরা যাক একটি ঘরে
কাগজের বই আছে। সময়ের সাথে সাথে ওই ঘরের তাপমাত্রা, জলীয়বাষ্প,
কাগজ ও কালির ক্ষয়িষ্ণু ইত্যাদি সবকিছু নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে বইটির লেখা এবং কাগজের মান অপরিবর্তিত
থাকবে। এই রকম পরিবেশকে পরমমানের পরিবেশ বলা যেতে পারে। পরিবেশের
বিচারে পরমমানের এই ধারণা হলো পরিবেশের পরমমানের দশা। বাস্তবে তা হয় না।
বস্তুজগতের পরিবেশভেদে নানাভাবে
সত্তা পরিবর্তিত হতে থাকে। এই পরিবর্তন প্রপঞ্চকে
বৈচিত্র্যময় করে তোলে এবং একটি সত্যকে অন্য একটি সত্যের দিকে ঠেলে দেয়। একটি নতুন
বই যেমন সত্য, তেমনি পরিবেশের কারণে জীর্ণ হয়ে যাওয়া বইটিও সত্য।
অবস্থান: এই অবস্থানটা হলো 'আমি'র
অবস্থান। অর্থাৎ 'আমি' কোন পরিবেশে কোন সময় কোথায় অবস্থান করছে। কোনো
সুনির্দিষ্ট সময়ে, সুনির্দিষ্ট পরিবেশে 'আমি' যে অবস্থান থেকে উপলব্ধি করছে,
তাই সত্য। সূর্য রাতের অন্ধকার সরিয়ে পূর্ব দিকে উঠে। পৃথিবী
থেকে 'আমি' যখন তা উপলব্ধি করবে, তখন তা সত্য। পৃথিবী ছেড়ে ১০০০
কিলোমিটার উপরে বসে 'আমি' যখন মহাকাশে
থেকে পৃথিবীকে দেখবে, তখন
সূর্যকে ওঠা হিসেবে বিবেচনা করবে না। সে উপলব্ধি করবে সূর্যকে কেন্দ্র করে
পৃথিবীর আবর্তন দশা। একইভাবে একজন মানুষ একটি হাতিকে সামনে থেকে এক রকম দেখবে, পিছন থেকে অন্যরকম
দেখবে। 'আমি'-র অবস্থান সাপেক্ষে সত্যের নতুন নতুন দিক
উন্মোচিত হবে এবং অবস্থান
সাপেক্ষে সকল সত্যই উপলব্ধিতে প্রকাশ পাবে। 'আমি' প্রশান্ত চিত্তে যা অনুভব
করবে, অস্থির চিত্তে তা করবে না। মানসিক অবস্থানের বিচারে সকল উপলব্ধিই সত্য
হবে। তাই 'ঠিক যা তাই'-এর অনুসন্ধান করতে হলে- অন্তত সকল
দিক থেকে দেখতে হবে।
আমি'র যথার্থ উপলব্ধি: 'আমি'র কাছে
বিভিন্ন সত্তা বিভিন্ন সত্যে প্রকাশিত হতে পারে। এই সত্যের স্বরূপ হবে,
সম্পূর্ণই তার উপলব্ধির বিষয়। সত্তা 'আমি'র কাছে প্রকাশিত হবে তার ধর্মের গুণে।
যে কোনো 'আমি' সত্তার যতগুলো ধর্ম উপলব্ধি করতে পারবে,
ওই 'আমি' ততটাই ওই সত্তাকে
চিনবে। ধরা যাক পানিকে কেউ জানে শুধু তরল পদার্থ হিসেবে, তার কাছে ওটাই সত্য।
পানিতে লবণ গলে যায়, এই উপলব্ধি যখন 'আমি' উপলব্ধি করবে, তখন তার কাছে পানি তরল
এবং লবণ গলে যাওয়ার ধর্ম সম্পর্কে জানবে। পানির এই দুটি ধর্ম অনুসারে 'আমি'র
উপলব্ধি হবে ভিন্নতর। এইভাবে পানি উত্তপ্ত করলে বাষ্পীভূত করলে, বাতাসে মিলিয়ে
যায়, অধিক ঠান্ডায় জমে বরফ হয়, পানি কাপড়কে ভিজিয়ে দেয় ইত্যাদি ধর্মসমূহদ্বারা
পানিকে যথাযথ উপলব্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। সময়ের বিচারে এই উপলব্ধির পরিবর্তন
ঘটতে পারে। প্রাত্যহিক জীবনের দৈনন্দিন কার্যক্রমের ভিতর
দিয়ে পানির যে সকল সত্য প্রকাশিত হবে, একজন রসায়ন বিজ্ঞানীর কাছে সে সকল সত্যই
পরমমানে ধরা দেবে না। বিজ্ঞানী দেখবেন পানি সৃষ্টি হয়েছে অক্সিজেন ও
হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে। এই সত্য একজন সাধারণ গৃহীর সত্যের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন
সত্যের জন্ম দেবে। আবার একজন গৃহী এবং রসায়ন বিজ্ঞানী পানির ক্ষেত্রে যে সত্য
ধারণ করবে, একজন কৃষকের জন্য তা যথেষ্ট নাও হতে পারে। যেমন একজন কৃষককে জানতে
হয়, কখন কৃষি ক্ষেত্রে জল দিতে হয়, জানে কোনো ফসলের জন্য পানি ক্ষতিকারক বা
লাভজনক। এসব জানার মত্য দিয়ে- ধীরে 'আমি' পরম সত্যের পথে অগ্রসর হবে।
এক সময় মানুষ জানতো সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেটা
ছিল সেই সময়ের সত্য। আবার মানুষ যখন জানলো পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত
হচ্ছে, তখন নতুন সত্য উপস্থাপিত হলো। মহাকালের অংশবিশেষে অনেক সত্য মিথ্যা আর
অনেক মিথ্যা সত্য হয়ে যায়। এই উপলব্ধি লাভ করে
'আমি'। এক্ষেত্রে 'আমি'র উপলব্ধিই মূখ্য হয়ে উঠে। তাই যা 'আমি'র কাছে সত্য, তাই
সত্য। বিশেষ কোনো 'আমি'র বিচারে অন্যসব মিথ্যা। এই জানা এবং
উপলব্ধির মধ্য দিয়ে যে 'আমি'র ভিতরে যে বিশ্বাসের জন্ম হয়, তা থেকে সত্য
প্রতিষ্ঠা পায়। জানার গভীরের প্রবেশের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে সত্যের অতলস্পর্শী
গভীরতায় প্রবেশের পথের উন্মুক্ত হয়।
যে কোনো সত্ত্বার সকল সত্যের সমাহার হলো পরম সত্য। কোনো সত্তার সকল সত্যের
সমন্বয়ে সৃষ্ট পরম সত্য 'আমি'র কাছে যখন ধরা দেয়, তখন তার কাছে পরম উপলব্ধিতে
পৌঁছায়। এরূপ সকল সত্তার পরম সত্য যদি কেউ ধারণ করতে পারেন, তাহলে তাঁর ভিতরে
পরম সত্তার উপলব্ধি ঘটবে। মানুষের জানার ক্ষমতার
সীমাবদ্ধতা এবং তার জ্ঞান ধারণের অক্ষমতার কারণে মানুষ পরম সত্যবান হয়ে উঠতে পারে না। পরম সত্যের মধ্য দিয়ে
যে মনে যে পরম
দশার সৃষ্টি হয়, সে দশায় থিতু হয়ে থাকতে পারেন যিনি, তিনিই পরম আরাধ্য পরমেশ্বের। পরমের
ঈশ্বর বা প্রভু বলেই সত্যের অন্বেষণকারী একমাত্র তিনিই।
পরম সত্যের ভিতরে নিহিত রয়েছে, সৃষ্টির পরম রহস্য। দুর্ভাগ্য ক্রমে কোনো বিশেষ
মানুষ পরম সত্যবান হয়ে উঠতে পারে না। এমন কি মনুষ্য সমাজের সকল সদস্যের
সম্মিলিত অনুভব যুক্ত করলেও তা সম্ভব কিনা, সন্দেহ থেকে যায়। তাই মানুষের পক্ষে
সৃষ্টি রহস্য ভেদ করা অসম্ভব। ধরা যাক অসাধারণ কম্পিউটারের মাধ্যমে সকল সত্যকে
ধারণ করা হলো, তাহলে তা হবে তথ্যের অসাধারণ একটি ভাণ্ডার। এবার এই তথ্য
ভাণ্ডারকে আত্মস্থ করে, কেউ যদি বিচারকের আসনে বসতে চায়, তাহলে তার পক্ষে পরম
সত্যবান হয়ে ওঠা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়।
সত্য ও মিথ্যা
যদি আমরা মেনে নেই, 'সত্য হলো- ঠিক যা তাই', তা হলে মিথ্যা হবে 'ঠিক যা নয়, তাই'। এই মিথ্যার পথ ধরে যা কিছু চলে, তার সবই মিথ্যাচার। তা 'যদি যা যথার্থই মিথ্যা' তাও সত্য। অর্থাৎ মিথ্যা যেমন হওয়া উচিৎ, ঠিক তেমনটাই হয়েছে, এই অর্থে সকল মিথ্যাই সত্য। এখানে সত্যের বিচারে কোনো ঘটনা মিথ্যা হতে পারে। কিন্তু মিথ্যা রটনা করেছে, এটা সত্য।
যতক্ষণ না পরম সত্য পরম মানে
পৌঁছায়, ততক্ষণ সত্য, মিথ্যার সাথে মিশে থাকে। এই সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ থেকে মিথ্যাকে
পৃথক করার প্রক্রিয়ায় পরম সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক সময় অজ্ঞতার কারণে সত্য-মিথ্যা
নিরূপণ করা যায় না। আবার অনেক সময় স্বার্থসিদ্ধির জন্য সত্যকেই বাদ দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে মিথ্যাকেই সত্যরূপে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষ
আত্মপ্রবঞ্চনা দশায় পৌঁছায় এবং নিজেই নিজের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
ভুল ও বিভ্রম
ভুল হলো- সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বা বিচ্যুত থাকা। অর্থাৎ ঠিক যা তাই, সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া। একজন গণিতের পণ্ডিতও ২+২=৫ লিখতে পারেন। এটাকে একটি মনুষ্য ভ্রান্তি (human error) বলে ধরে নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে অসাবধনতার কারণে জানা বিষয়ে ভুল করা। এটার সাথে তাঁর বিশ্বাসের সম্পর্ক নেই। এটাকে আমরা বলতে পারি সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া।
আর এক ধরনের ভুল হলো- যা ভুল কিন্তু অজ্ঞানতার কারণে সত্য বলে
মেনে নেওয়া হয়েছে। একে বলা যায় সত্য থেকে
অজ্ঞানতাজনিত বিচ্যুতি।
যেমন মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,
এক সময় মানুষ মনে করতো পৃথিবীকে সূর্য আবর্তন করে, তখন সেটা ছিল এক ধরনের
বিশ্বাসজনিত সত্য। এই বিশ্বাসটা মানুষ দীর্ঘদিন বহন করেছে। এক সময় মানুষ জানলো পৃথিবীই
সূর্যকে আবর্তন করে। তখন আগের সত্য ভুল হয়ে গেলো, তার জায়গায় একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত
হলো। এই জাতীয় ভুল যতদিন না নতুন কোনো সত্য দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, ততদিন তা সত্য
হিসেবেই থেকে যায়।
বিভ্রম হলো−
সত্য বলে ধরে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষভাবে ভুল করা। যেমন−
দড়িকে সাপ মনে করা। মূলত সাপকে সাপ হিসেবে চেনাটাই হলো সত্য। বিভ্রম হলো দড়িকে সাপ
মনে করা। যখন কেউ সাপকে দড়ি মনে করে, তখন এই মনে করাটাই সত্য হিসেবে উপলব্ধিতে
থাকে। বিভ্রম কেটে গেলে সত্যটা প্রকাশিত হয়। দেখা যায় বিভ্রমের সাথে জড়িত
উপাদানগুলোর সাথে মানুষের আগে থেকেই পরিচয় থাকে। এই পরিচয় বিশ্বাস
দ্বারা বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির দ্বারা হতে পারে। দড়িকে সাপ মনে করার মধ্যে
আছে, দর্শকের দুটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধি। রাতের অস্পষ্ট আলোয় কলাপাতাকে ভুত মনে
করার ভিতরে আছে, ভুতের বিশ্বাসজাত উপলব্ধি। এ সবের সাথে যে সত্য থাকে, তা
শুধু তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়ে না বলেই বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। আবার মস্তিষ্কের অসুস্থতার
জন্য অনেক সময় সত্য বিকৃত হয়। যেমন অসুস্থতার জন্য, কেউ একটি বস্তুকে দুটি অবস্থানে
দেখতে পারে, ঝাপসা দেখতে পারে। এই জাতীয় উপলব্ধিগুলো−
আগের উদাহরণগুলোর বিচারে ভুলও নয়, বিভ্রমও নয়। একে বলা যায় শারীরীক অক্ষমতাজনিত
দৃষ্টি-বিভ্রম। একইভাবে যুক্তিসঙ্গত বিচারের অভাবে বা
মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় সত্য ভিন্নপথে চালিত হতে পারে। এদের বলা যায় মনোবিকার।