৩.২
সত্য ও সত্যসন্ধানী মন

সত্য হলো ঠিক যা তা-ই। এখানে 'যা' হলো- সত্তার পূর্ণ পরিচয়। এই 'পূর্ণ পরিচয়' হলো একটি সত্তার কাছে অন্য সত্তার আবিষ্কৃত সর্বশেষ পরিচয়। সত্তার যথার্থ বা সত্য পরিচয় লাভের ভিতর দিয়ে বিশ্বাস জন্মে। আর বিশ্বাসের ভিতর দিয়ে  সত্যের নূতন দিক উন্মোচিত হয়।

যেভাবেই হোক, মানুষের মনে যখন কোনো অনুভূতির জন্ম হয় তখন, তা গ্রহণ করে তার 'আমি' নামক সত্ত্বা। এই অনুভূতি হলো একটি তথ্যের আদি স্তর। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা। ইন্দ্রিয়সমূহের কাজ হলো−তার আওতাধীন তথ্যাদি তার বিভাগের কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ ডিভাইসের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই ডিভাইসের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে 'আমি' উজ্জীবিত হয়। এই উজ্জীবনের সূত্রেই 'আমি'র 'উপলব্ধি' নামক অনুভূতির জন্ম নেয়। এই 'উপলব্ধি' মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়। উপলব্ধির দ্বারা প্রতিটি অনুভূতিকে জানা যায়, আর এই জানাটা স্মৃতিতে রক্ষিত হয়।

মানুষ তার ইন্দ্রিয় দ্বারা যখন কোনো কিছু অনুভব করে, তখন তার কাছে নতুন কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। এটাকে বলা যায় আদি বা প্রাথমিক অনুভব। এই অনুভবের ভিতর যে ক্ষুদ্র জ্ঞানের সৃষ্টি হয়, তাই হলো প্রাথমিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞা। অভিজ্ঞা মানুষের স্মৃতিভাণ্ডারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তথ্য হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। আর বহুবিধ অভিজ্ঞার সুসমন্বয়ে সৃষ্টি হয় জ্ঞান। তাই জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞা হলো ক্ষুদ্রতম মৌলিক উপাদান। আর জ্ঞানের উচ্চতর স্তর হলো প্রজ্ঞা।

মানুষ যখন জ্ঞানের চর্চা করে, তখন তার মস্তিষ্কে জন্ম নেয় অজস্র নতুন নতুন তথ্য । জ্ঞান চর্চার ভিতর দিয়ে মানুষের মনে অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। আবার এই তথ্য এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তৈরি হয় নতুন তথ্য। এই তথ্যটিই হলো- জ্ঞানতথ্য। মূলত কোনো বিদ্যমান বা ঘটিত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানতথ্যের খণ্ডিতরূপ। ঘটিততথ্যের মধ্য দিয়ে এমন একটি চূড়ান্ত জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে, যা হয়ে ওঠে সত্য। এক কথায়- 'ঠিক যা তাই'।

মূলত একটি সত্তার পূর্ণ পরিচয়ের ভিতরেই রয়েছে পরম সত্য। বাস্তবে মানুষের কাছে এই পরম সত্য অধরা থেকে যায়। মানুষের জানার সীমাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কোনো সত্তার পরম সত্যের অংশবিশেষ ধরা পড়ে মাত্র। তাই সত্তার প্রতি বিশ্বাসের মান দাঁড়ায় আংশিক। সত্তার সত্য উদ্‌ঘাটনে মধ্য দিয়ে সত্যের স্বরূপ পাল্টে যায়, সেই সাথে বিশ্বাসও পাল্টায়। তাই মানুষ যখন কোনো সত্য সম্পর্কে অবগত হ, তখন তা- একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে, সুনির্দিষ্ট পরিবেশে এবং সুনির্দিষ্ট অবস্থানের বিচারে 'আমি'র উপলব্ধি হিসাবে পায়। যেসকল তথ্য  কোনো সত্তাকে জানতে সহায়তা করে, তা সত্য জানার প্রক্রিয়া মাত্র। মূল সত্য এই সকল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোনো সত্তার বৈশিষ্ট্য বা ধর্মকে প্রকাশ করে। এই ধর্ম অবশ্যই সময়, পরিবেশ এবং 'আমি'র অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। সর্বদিকের বিবেচনায় যিনি সকল সত্যকে অনুভব করতে পারেন, তিনিই হয়ে ওঠেন পরম সত্যবান।

প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব সত্য। যেমন আগুনের রয়েছে আলো ও তাপ প্রদায়ী বৈশিষ্ট্য। এটি আগুনের জন্য সত্য, কিন্তু পানির জন্য নয়। একটি সত্তার সত্য অন্য সত্তার সত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়, বা অন্য সত্যের দ্বারা বিচ্যুতি ঘটে। যেমন আগুনের সত্য তাপপ্রদায়ী, পানির উপর সে সত্য কার্যকর হলে পানি বাষ্পীভূত হয়। অর্থাৎ পানি তার তরল ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়। আবার পানি থেকে তাপ সরিয়ে নিতে থাকলে পানি বরফ হয়। কিন্তু আগুনের তাপ কমানোর মধ্য দিয়ে আগুনের মৃত্যু হয়। কিন্তু অন্য সত্ত্বার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যখন একটি সত্তার রূপান্তর ঘটে, রূপান্তরিত সত্তর সত্যের মধ্যেই তা ঘটে। যেমন আগুনের প্রভাবে পানি যখন বাষ্পীভূত হয়, তখন পানির বাষ্পীভূত হওয়ার গুণের কারণেই ঘটে।

সত্তার সত্য স্থান, কাল ও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিন্নতর দশায় পৌঁছায়। এ সবের দ্বারা সত্তার ধর্ম পাল্টে যায় না, বরং সত্তার অপর একটি সত্য উন্মোচিত হয়। সত্তার এই বিবর্তন রূপান্তর ঘটে থাকে স্থান, কাল ও পরিবেশবিচারে

সত্য ও মিথ্যা

যদি আমরা মেনে নেই, 'সত্য হলো- ঠিক যা তাই', তা হলে মিথ্যা হবে 'ঠিক যা নয়, তাই'। এই মিথ্যার পথ ধরে যা কিছু চলে, তার সবই মিথ্যাচার। তা 'যদি যা যথার্থই মিথ্যা' তাও সত্য। অর্থাৎ মিথ্যা যেমন হওয়া উচিৎ, ঠিক তেমনটাই হয়েছে, এই অর্থে সকল মিথ্যাই সত্য। এখানে সত্যের বিচারে কোনো ঘটনা মিথ্যা হতে পারে। কিন্তু মিথ্যা রটনা করেছে, এটা সত্য।

 

যতক্ষণ না পরম সত্য পরম মানে পৌঁছায়, ততক্ষণ সত্য, মিথ্যার সাথে মিশে থাকে। এই সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ থেকে মিথ্যাকে পৃথক করার প্রক্রিয়ায় পরম সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক সময় অজ্ঞতার কারণে সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা যায় না। আবার অনেক সময় স্বার্থসিদ্ধির জন্য সত্যকেই বাদ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মিথ্যাকেই সত্যরূপে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মপ্রবঞ্চনা দশায় পৌঁছায় এবং নিজেই নিজের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। 
 

ভুল ও বিভ্রম

ভুল হলো- সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বা বিচ্যুত থাকা। অর্থাৎ ঠিক যা তাই, সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া। একজন গণিতের পণ্ডিতও ২+২=৫ লিখতে পারেন। এটাকে একটি  মনুষ্য ভ্রান্তি (human error) বলে ধরে নেওয়া যায়এক্ষেত্রে অসাবধনতার কারণে জানা বিষয়ে ভুল করা। এটার সাথে তাঁর বিশ্বাসের সম্পর্ক নেই। এটাকে আমরা বলতে পারি  সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া

 

আর এক ধরনের ভুল হলো- যা ভুল কিন্তু অজ্ঞানতার কারণে সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। একে বলা যায়  সত্য থেকে অজ্ঞানতাজনিত বিচ্যুতি যেমন মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এক সময় মানুষ মনে করতো পৃথিবীকে সূর্য আবর্তন করে, তখন সেটা ছিল এক ধরনের বিশ্বাসজনিত সত্য। এই বিশ্বাসটা মানুষ দীর্ঘদিন বহন করেছে। এক সময় মানুষ জানলো পৃথিবীই সূর্যকে আবর্তন করে। তখন আগের সত্য ভুল হয়ে গেলো, তার জায়গায় একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। এই জাতীয় ভুল যতদিন না নতুন কোনো সত্য দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, ততদিন তা সত্য হিসেবেই থেকে যায়।

বিভ্রম হলো
সত্য বলে ধরে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষভাবে ভুল করা। যেমন দড়িকে সাপ মনে করা। মূলত সাপকে সাপ হিসেবে চেনাটাই হলো সত্য। বিভ্রম হলো দড়িকে সাপ মনে করা। যখন কেউ সাপকে দড়ি মনে করে, তখন এই মনে করাটাই সত্য হিসেবে উপলব্ধিতে থাকে। বিভ্রম কেটে গেলে সত্যটা প্রকাশিত হয়। দেখা যায় বিভ্রমের সাথে জড়িত উপাদানগুলোর সাথে মানুষের আগে থেকেই পরিচয় থাকে। এই পরিচয় বিশ্বাস দ্বারা বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির দ্বারা হতে পারে। দড়িকে সাপ মনে করার মধ্যে আছে, দর্শকের দুটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধি। রাতের অস্পষ্ট আলোয় কলাপাতাকে ভুত মনে করার ভিতরে আছে, ভুতের বিশ্বাসজাত উপলব্ধি। এ সবের সাথে যে সত্য থাকে, তা শুধু তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়ে না বলেই বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। আবার মস্তিষ্কের অসুস্থতার জন্য অনেক সময় সত্য বিকৃত হয়। যেমন অসুস্থতার জন্য, কেউ একটি বস্তুকে দুটি অবস্থানে দেখতে পারে, ঝাপসা দেখতে পারে। এই জাতীয় উপলব্ধিগুলো আগের উদাহরণগুলোর বিচারে ভুলও নয়, বিভ্রমও নয়। একে বলা যায় শারীরীক অক্ষমতাজনিত দৃষ্টি-বিভ্রম। একইভাবে যুক্তিসঙ্গত বিচারের অভাবে বা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় সত্য ভিন্নপথে চালিত হতে পারে। এদের বলা যায় মনোবিকার।