নারদীয় শিক্ষা
প্রথম প্রপাঠক
প্রথম কণ্ডিকা
অথাতঃ স্বরশাস্ত্রাণাং সর্ব্বং বৈদিকনিশ্চয়ম্।
উচ্চনিচবিভাগাশ্চ স্বরমাত্রম্ চ প্রবর্ততে ১॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: এখন স্বরশাস্ত্র সম্পর্কিত সমস্ত বৈদিক সিদ্ধান্ত আলোচনা করা হবে। এখানে উচ্চ ও নিচ স্বরের বিভাগ এবং স্বরমাত্রার নিয়ম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোক মূলত গ্রন্থের সূচনা। এখানে বলা হচ্ছে- বৈদিক পাঠে স্বরের শুদ্ধতা (উচ্চ-নিচ, দীর্ঘ-হ্রস্ব) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া হলো- এই গ্রন্থে স্বরশাস্ত্র (স্বরের ব্যবহার, নিয়ম, দৈর্ঘ্য-সংক্ষিপ্ততা) সম্পর্কে পরিষ্কার আলোচনা করা হবে।
প্রণম্য পরমানন্দমূর্ত্তি-সামবেদবিগ্রহম্।
মুনিনা নারদেনৈব শিক্ষা ব্যাখ্যাতুমীষ্যতে ১॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: চিরআনন্দময়, সামবেদরূপ পরমেশ্বরকে প্রণাম জানিয়ে, মুনি নারদ নিজেই শিক্ষা-শাস্ত্র (স্বরশিক্ষা) ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছা করছেন।

ব্যাখ্যা:  প্রত্যেক বৈদিক শাস্ত্র বা শিক্ষা সাধারণত মঙ্গলাচরণ দিয়ে শুরু হয়। এখানে নারদ মুনি ঈশ্বরকে সামবেদের রূপে বন্দনা করেছেন, কারণ এই শিক্ষা মূলত সামবেদীয় সঙ্গীত ও স্বরসংক্রান্ত নিয়ম বোঝা নোর জন্য রচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ভগবানই সামবেদের আদি উৎস, তাই তাঁকে প্রণাম জানিয়ে নারদ মুনি গ্রন্থ রচনা শুরু করছেন।
আর্চিকং গাথিকং চৈব সামিকং চ স্বরাত্তরম্।
কৃতান্তে স্বরশাস্ত্রাণাং প্রয়োক্তব্যং বিশেষতঃ ২॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: আর্চিক, গাথিক এবং সামিকএই তিনটি শ্রেষ্ঠ স্বরকে (স্বরাত্তম্) স্বরশাস্ত্রের (উচ্চারণ বিজ্ঞানের) সিদ্ধান্ত বা নিয়ম অনুসারে বিশেষভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
একান্তরঃ স্বরো হ্যৃক্ষু গাথাসুদ্বন্তরঃ স্বরঃ।
সামসুত্র্যন্তরং বিদ্যাদেতাবৎ স্বরতোহন্তরস্ ॥৩॥
শব্দার্থ:
ভাবার্থ: ঋগ্বেদের মন্ত্রে (আর্চিক) একটি স্বর ব্যবহৃত হয়। গাথাগুলিতে (গাথিক) দুটি স্বর ব্যবহৃত হয়। সামবেদের মন্ত্রে (সামিক) তিনটি স্বর ব্যবহৃত হয়। স্বর-পদ্ধতির এই পার্থক্যগুলি জানা অত্যন্ত জরুরি।
ঋক্ সাময়জুরজ্ঞানি যে যজ্ঞেষু প্রযুঞ্জতে।
অবিজ্ঞাতাদি শাস্ত্রাণাং তেষাং ভবতি বিস্বরঃ ॥৪॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: যে সকল ব্যক্তি ঋক্, সাম এবং যজুঃ বেদ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং (উচ্চারণ) শাস্ত্রের আদি নিয়মাবলী না জেনেই যজ্ঞসমূহে (বৈদিক মন্ত্র) প্রয়োগ করেন, তাদের (উচ্চারণে) ভুল স্বর বা বিচ্যুতি ঘটে।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি বৈদিক মন্ত্র এবং যজ্ঞ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সঠিক উচ্চারণ (স্বর) এবং জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি বলছে যে, যারা বেদের বা স্বরশাস্ত্রের মৌলিক নিয়ম না মেনেই মন্ত্র পাঠ করেন, তাদের উচ্চারণ ভুল হয়, যার ফলে যজ্ঞের ফল বিঘ্নিত হতে পারে।
মন্ত্রো হীনঃ স্বরতো বর্ণতো বা মিথ্যা প্রযুক্তো ন তমর্থমাহ।
স বাগ্‌বজ্রো যজমানং হিনস্তি যথেন্দ্র শত্রুঃ স্বরতোপরাধাৎ॥ ৫॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: মন্ত্র যদি স্বর (সুর) অথবা বর্ণ (অক্ষর)-এর দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ হয়, এবং ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে তা সেই অভিপ্রেত অর্থ প্রকাশ করে না।" "বরং, সেই (অশুদ্ধ) মন্ত্র বাক্যরূপ বজ্র হয়ে যজমানকে বিনাশ করে, ঠিক যেমন স্বরের ত্রুটির কারণে (ত্বষ্টা কর্তৃক উচ্চারিত) 'ইন্দ্রশত্রু' শব্দে বৃত্রাসুর নিহত হয়েছিল।" ব্যাখ্যা:
১. ত্রুটির গুরুত্ব: শ্লোকটি জোর দিয়ে বলছে যে, একটি মন্ত্রের শক্তি বা কার্যকারিতা নির্ভর করে তার শুদ্ধ উচ্চারণের উপর। মন্ত্র যদি স্বর (উচ্চারণের উচ্চতা, যেমন উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত) অথবা বর্ণ (অক্ষর বা শব্দ)-এর দিক থেকে সামান্যতম ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে তা তার আসল ফল বা অর্থ দিতে পারে না।
২. বিপজ্জনক ফল: শুদ্ধ ফল না দেওয়ার পাশাপাশি, অশুদ্ধভাবে উচ্চারিত সেই মন্ত্র বাগ্‌বজ্র (বাক্যরূপ বজ্র) হয়ে যজ্ঞকারী বা যজমানের ক্ষতি করে, এমনকি তাঁকে বিনাশও করতে পারে। এটি মন্ত্রের ধ্বনি-শক্তির মারাত্মক দিকটি তুলে ধরে।
৩. ঐতিহাসিক উদাহরণ (ইন্দ্রশত্রু): এই বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে একটি বিখ্যাত পৌরাণিক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্দ্রের হাতে পুত্র নিহত হওয়ার পর, তাঁর পিতা ত্বষ্টা একটি যজ্ঞ করেন এবং একটি মন্ত্র উচ্চারণ করেন: "ইন্দ্রশত্রু বর্ধস্ব" (ইন্দ্রের শত্রু বৃদ্ধি হোক)। * ত্বষ্টা চেয়েছিলেন মন্ত্রটি এমন হোক: 'ইন্দ্রস্য শত্রুঃ' (যিনি ইন্দ্রের বিনাশক হবেন, অর্থাৎ বৃত্রাসুর)। এই ক্ষেত্রে, 'ইন্দ্রশত্রু' শব্দের প্রথম অক্ষরটি উদাত্ত (উঁচু স্বর) হওয়া উচিত ছিল। * কিন্তু ত্বষ্টা অসাবধানতাবশত ভুল স্বর (স্বরিত বা অনুদাত্ত) প্রয়োগ করেন, যার ফলে শব্দটির অর্থ দাঁড়ালো: 'ইন্দ্রঃ শত্রুঃ যস্য সঃ' (ইন্দ্র যার শত্রু)। * স্বরের এই সামান্য ভুলের কারণে সৃষ্ট বৃত্রাসুর শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রের দ্বারাই নিহত হয়।
প্রহীনঃ স্বরবর্ণাভ্যাং যোবিমস্ত্রঃ প্রযুক্ত্যে।
যজ্ঞেষু যজমানস্য রুষত্যায়ুঃ প্রজাং পশূন্॥৬॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: যে মন্ত্র স্বর এবং বর্ণ- উভয় দিক থেকেই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যজ্ঞের সময় প্রয়োগ করা হয়, সেটি যজমানের আয়ু, সন্তান-সন্ততি এবং পশুকে বিনাশ করে।
 
স্বররূপং ত্রিষু স্থানেষ্বভিব্যজ্যত ইত্যুচ্যতে।
উরাঃ কণ্ঠঃ শিরশ্চৈব স্থানানি ত্রীণি বাঙ্‌ময়ে।
সবনান্যাহুরেতানি সাম বাণ্যর্থতোঽন্তরম্॥ ৭॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: স্বর (স্বরধ্বনি) তিনটি স্থানে প্রকাশিত হয় বলা হয়েছে। বাক্-সৃষ্টিতে উর (বক্ষ), কণ্ঠ এবং মস্তক (শির)-ই হলো সেই তিনটি স্থান। এই স্থানগুলিকেই 'সবন' (যজ্ঞের সময়কাল বা আহুতি) বলা হয়, এবং অর্থের দিক থেকে সাম-বাণী (সামবেদের মন্ত্র) এই সবনগুলির চেয়ে ভিন্ন। ব্যাখ্যা:
উরাঃ সপ্তবিচারং স্যাত্তথা কণ্ঠস্থশিরাঃ।
ন চ সপ্তেষ্বেষি ব্যক্তাস্তথা প্রাবচনোবিধিঃ॥ ৮॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: ব্যাখ্যা:
কঠ কালাপ বৃত্তেষু তৈত্তিরীয়া হরকেষু চ।
ঋগ্‌বেদে সামবেদে চ বক্তব্যঃ প্রথমঃ স্বরঃ॥ ৯॥
শব্দার্থ:

ভাবার্থ: কঠ এবং কালাপ পাঠগুলিতে, এবং তৈত্তিরীয় ও হরেক শাখাতে, এবং ঋগ্বেদ ও সামবেদেও প্রথম স্বরটিই (প্রাধান্যসহকারে) পাঠ করা উচিত।

ব্যাখ্যা:
ঋগ্বেদস্তু দ্বিতীয়েন তৃতীয়েন চ বৰ্ত্ততে।
উচ্চ মধ্যম সংঘাত স্বরো ভবতি পার্থিবঃ॥ ১০॥

শব্দার্থ: ভাবার্থ: কিন্তু ঋগ্বেদ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্বরের দ্বারা কার্যক্ত হয়। অর্থাৎ এই দুই স্বরের মাধ্যমে প্রধানত ঋগ্বেদ পাঠ করা হয়। উচ্চ এবং মধ্যম স্বরের সংমিশ্রণ থেকেই সেই পার্থিব স্বরটি উৎপন্ন হয়।

ব্যাখ্যা:
তৃতীয়-প্রথম-ক্রুষ্টান্ কুৰ্বন্ত্যাহরকাঃ স্বরাণ।
দ্বিতীয়াঘাংস্তু মন্দান্তান্ তৈত্তিরীয়াশ্চতুরঃ স্বরাণ॥ ১১॥

শব্দার্থ: ভাবার্থ: আহরক শাখা তৃতীয়, প্রথম ও ক্রুষ্ট স্বরগুলিকে প্রয়োগ করে। কিন্তু তৈত্তিরীয়েরা দ্বিতীয় থেকে মন্দ (নিম্ন) স্বর পর্যন্ত চারটি স্বর ব্যবহার করে।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি বৈদিক পাঠের বিভিন্ন ধারার মধ্যে স্বর প্রয়োগের পার্থক্য তুলে ধরে।
প্রথমশ্চ দ্বিতীয়শ্চ তৃতীয়োঽথ চতুৰ্থকঃ।
মন্ত্রঃ ক্রুষ্টো হ্যতিস্বারাঃ এতাং কুৰ্বন্তি সামগাঃ॥ ১২॥

শব্দার্থ:

ভাবার্থ: প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ; মন্ত্র, ক্রুষ্ট এবং হ্যতিস্বার (অতিশ্বার্য)—এইগুলি সামবেদের গায়কেরা প্রয়োগ করে।

দ্বিতীয় প্রথমাবৃতৌ তাণ্ডিমাল্লবিনাং স্বরৌ।
তথা শাতপথাবৃতৌ স্বরৌ বাজসনেয়িনাম্॥ ১৩॥

শব্দার্থ: ভাবার্থ: তাণ্ডি এবং মাল্লব শাখাগুলির পাঠে দ্বিতীয় এবং প্রথম—এই দুটি স্বর (প্রাধান্য পায়); তেমনই শতপথ (ব্রাহ্মণ) অনুসরণকারী বাজসনেয়ী (শুক্ল যজুর্বেদ) শাখারও এই দুটি স্বরই (প্রচলিত)।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি বৈদিক শাখার মধ্যে স্বর প্রয়োগের নিয়মাবলীর তুলনা করছে।
এতে বিশেষবতঃ প্রোক্তাঃ স্বরা বৈ সাৰ্ব্ববৈদিকাঃ।
ইত্যেতদচ্চরিতং সৰ্ব্বং স্বরাণাং সাৰ্ব্ববৈদিকমিতি॥ ১৪॥

শব্দার্থ: ভাবার্থ: এই স্বরগুলিই বিশেষভাবে সকল বেদে প্রযোজ্য বা সার্বজনীন বৈদিক স্বররূপে বর্ণিত হয়েছে। এইভাবে স্বরসমূহের সমস্ত সার্ববৈদিক নিয়মাবলী ব্যাখ্যা করা হলো।

ব্যাখ্যা:
এই শ্লোকটি পুরো আলোচনাটির উপসংহার।
সূত্র: