নারদীয় শিক্ষা
প্রথম প্রপাঠক
দ্বিতীয় কণ্ডিকা
সামবেদেতু বক্ষ্যামি স্বরাণাং চরিতং যথা।
অল্প গ্রন্থং প্রভূতার্থং শ্রব্যং বেদাঙ্গমুত্তমম্ ॥১॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: আমি সামবেদের প্রসঙ্গে স্বরসমূহের চরিত্র বা প্রকৃতি ব্যাখ্যা করব। এটি এমন একটি শ্রেষ্ঠ বেদাঙ্গ যা ছোট্ট একটি রচনা হলেও এর অর্থ বা ভাব অত্যন্ত গভীর, এবং যা শ্রবণের যোগ্য বা শুনতে সুমধুর।

ব্যাখ্যা:
১. প্রতিজ্ঞা: প্রথম চরণে বক্তা প্রতিজ্ঞা করছেন যে তিনি সামবেদ-এর সাপেক্ষে স্বর-এর অর্থাৎ সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য বা প্রয়োগপদ্ধতি আলোচনা করবেন। সামবেদ যেহেতু সঙ্গীতের বেদ নামে পরিচিত, তাই স্বরের আলোচনা তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
২. গুরুত্ব:
পরের চরণে তিনি তাঁর রচনার (যা নারদীয় শিক্ষা বা ঐ জাতীয় কোনো গ্রন্থ) বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছেন। তিনি বলছেন- এটি একটি বেদাঙ্গ (বেদের সহায়ক শাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম), এবং এটি উত্তম বা শ্রেষ্ঠ। এই গ্রন্থটি আয়তনে ছোট (অল্প গ্রন্থ) হলেও এর অর্থ বা বিষয়বস্তু অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক (প্রভূতার্থম্)। অর্থাৎ, কম কথায় অনেক তথ্য দেওয়া হয়েছে। এটি শ্রব্য—যার অর্থ এটি শুধু পাঠ্য নয়, এটি শুনতেও ভালো লাগে বা এর বিষয়বস্তু শ্রবণযোগ্য (যেমন মন্ত্রপাঠের স্বর বা সঙ্গীতের স্বর)।

এই শ্লোকটি স্বর বা সঙ্গীতের শিক্ষার উপর একটি শ্রেষ্ঠ, সংক্ষিপ্ত, ও গভীর অর্থবহ গ্রন্থ রচনার প্রারম্ভিক ঘোষণা হিসেবে কাজ করছে।
তান-রাগ-স্বর-গ্রাম-মুর্চ্ছনানাং তু লক্ষণম্।
পবিত্রং পাবনং পুণ্যং নারদেন প্রকীর্তিতম্ ॥২॥
শব্দার্থ:
ভাবার্থ:
তান, রাগ, স্বর, গ্রাম এবং মূর্ছনা-এর লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নারদ কর্তৃক পবিত্র, পাবন এবং পুণ্যদায়ক রূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে।

ব্যাখ্যা:
এই শ্লোকটি 'নারদীয় শিক্ষা' গ্রন্থের নিজস্ব গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। বলা হচ্ছে— সঙ্গীতের যে মৌলিক উপাদানগুলি, যেমন—তান (বিস্তার), রাগ (সুর-বিন্যাস), স্বর (সুর), গ্রাম (স্বরস্থান) এবং মূর্ছনা (আরোহণ-অবরোহণ), সেগুলির সঠিক সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নারদ মুনি এখানে বর্ণনা করেছেন। এই জ্ঞানকে কেবল জাগতিক জ্ঞান হিসেবে দেখা হচ্ছে না, বরং পবিত্রতা দানকারী, শুদ্ধকারী এবং ধর্মীয় ফলদায়ক (পুণ্য) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে সঙ্গীতের এই বিদ্যা সাধারণ নয়, এটি আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম।
শিক্ষামাহুর্দ্বিজাতীনাং ঋগ্যজুঃ সামলক্ষণম্।
নারদীয়মশেষেণ নিরুক্তং মনু পূর্বশৈঃ ॥৩॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: শিক্ষাকে দ্বিজাতিদের জন্য ঋক্, যজুঃ ও সাম এই তিন বেদের পরিচয় স্বরূপ বলা হয়। নারদীয় এই গ্রন্থটি সম্পূর্ণভাবে মনু এবং তাঁর পূর্ববর্তী ঋষিদের দ্বারা নিরুক্ত (ব্যাখ্যাত) হয়েছে। ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি 'শিক্ষা' নামক বেদাঙ্গের গুরুত্ব ও তার ঐতিহ্যের উপর আলোকপাত করছে।
১. শিক্ষার উদ্দেশ্য: শিক্ষা বেদাঙ্গটি (যে শাস্ত্রে বর্ণ ও স্বর-উচ্চারণের সঠিক নিয়ম শেখানো হয়) দ্বিজাতিদের (যারা বৈদিক পাঠের অধিকারী, দ্বিজ ব্রাহ্মণ) জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমন যে, শিক্ষা জানা থাকলে তবেই ঋক্, যজুঃ ও সামবেদের সঠিক লক্ষণ বা স্বরূপ বোঝা সম্ভব। অর্থাৎ, বিশুদ্ধ বৈদিক উচ্চারণের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য।
২. ঐতিহ্য:
নারদীয় এই শিক্ষা গ্রন্থটি কোনো নতুন রচনা নয়। বরং মনু (প্রথম মানব ও ধর্মশাস্ত্র প্রণেতা) এবং তাঁর পূর্ববর্তী মহান ঋষিদের দ্বারা এই জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যাত (নিরুক্ত) হয়েছে। এর মাধ্যমে নারদ মুনি এই রচনার প্রাচীনতা, প্রামাণিকতা এবং গভীর জ্ঞানমূলক ঐতিহ্যের উপর জোর দিচ্ছেন।
সপ্ত-স্বরাস্ত্রয়ো গ্রামা মূর্চ্ছনাস্ত্বেক-বিংশতিঃ।
তানা একোনপঞ্চাশদ্-দ্বিত্যেতৎস্বর মণ্ডলম্ ॥৪॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: সাতটি স্বর, তিনটি গ্রাম এবং একুশটি মূর্ছনা ও ঊনপঞ্চাশটি (৪৯) তানের সমবেত নাম স্বরমণ্ডল।
ষড়্জশ্চ ঋষভশ্চৈব গান্ধারো মধ্যমস্তথা।
পঞ্চমো ধৈবতশ্চৈব নিষাদঃ সপ্তমঃ স্বরঃ ॥৫॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ হলো সপ্তম স্বর।
ষড়্জ-মধ্যম-গান্ধারাঃ ত্রয়ো গ্রামাঃ প্রকীর্তিতাঃ।
ভূর্লোকাজ্জায়তে ষড়্‌জো ভূবর্লোকাচ্চ মধ্যমঃ ॥৬॥
ভাবার্থ: ভাবার্থ: ষড়্জ, মধ্যম এবং গান্ধার-এই তিনটি গ্রাম রূপে পরিচিত। ভূলোক থেকে ষড়্জ এবং ভূবর্লোক (অন্তরীক্ষা) থেকে মধ্যম উৎপন্ন হয়। ব্যাখ্যা:
স্বর্গান্নান্যত্র গান্ধারো নারদস্য মতং যথা।
স্বররাগবিশেষেণ গ্রামরাগা ইতি স্মৃতাঃ ॥৭॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: স্বর্গলোকে গান্ধার গ্রাম প্রচলিত আছে। ব্যাখ্যা: আগের শ্লোকে বলা হয়েছে ভূলোক থেকে ষড়্জ এবং ভূবর্লোক (অন্তরীক্ষা) থেকে মধ্যম উৎপন্ন হয়।
এরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এই শ্লোকে বলা হয়েছ- গান্ধার গ্রামের উৎস স্বর্গ এবং তা স্বর্গলোকে প্রচলিত আছে। 
রাগ প্রকারানবধার্যত্বাদ্বঃ
বিংশতিং মধ্যমগ্রামে ষড়্জগ্রামে চতুর্দশ ।
তানান্ পঞ্চদশোঁচ্ছন্তি গান্ধারগ্রামমাশ্রিতান্ ॥৮॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ। মধ্যম গ্রামে ২০টি, ষড়্জ গ্রামে ১৪টি এবং গান্ধার গ্রামে ১৫টি তান হয়।
নন্দী বিশালা সুমুখী চিত্রা চিত্রবতী সুখা।
বলা যা চাথ বিজ্ঞেয়া দেবানাং সপ্ত মূর্চ্ছনাঃ॥৯॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: নন্দী, বিশালা, সুমুখী, চিত্রা, চিত্রবতী, সুখা এবং বলা — এই সাতটি মূর্ছনা-কে দেবতাদের (বা স্বর্গীয়) বলে জানা উচিত।
আপ্যায়িনী বিশ্বভূতা চন্দ্রা হেমা কপর্দিনী।
মৈত্রী বার্হতী চৈব পিতৃণাং সপ্ত মূর্চ্ছনাঃ॥১০॥
ভাবার্থ। আপ্যায়িনী, বিশ্বভূতা, চন্দ্রা, হেমা, কপর্দিনী, মৈত্রী এবং বার্হতী — এই সাতটি মূর্ছনা হলো পিতৃপুরুষদের (বা প্রেতাত্মাদের)।
ষড়্জে তূত্তর মন্দ্রা স্যাদৃষভে চাভিরুদ্গতা।
অশ্বক্রান্তা তু গান্ধারে তৃতীয়া মূর্চ্ছনা স্মৃতা ॥১১॥ 
শব্দার্থ:  ভাবার্থ: ষড়্জ (স্বর বা গ্রাম)-এ উত্তর মন্দ্রা মূর্ছনা থাকে, এবং ঋষভ (স্বর)-এ অভিরুদ্গতা (মূর্ছনা থাকে)। আর গান্ধার (স্বর বা গ্রাম)-এ অশ্বক্রান্তা-কে তৃতীয় মূর্ছনা বলে বিবেচনা করা হয়।
মধ্যমে খলু সৌবীরা হৃষ্যকা পঞ্চমে স্বরে।
ধৈবতে চাপি বিজ্ঞেয়া মূর্চ্ছনা তূত্তরায়তা ॥১২॥ 
শব্দার্থ: ভাবার্থ: মধ্যম (মা) স্বরের ক্ষেত্রে সৌবীরা (মূর্ছনা) নিশ্চয়ই (থাকে), এবং পঞ্চম (পা) স্বরের ক্ষেত্রে হৃষ্যকা (মূর্ছনা থাকে)। এবং ধৈবত (ধা) স্বরের ক্ষেত্রে উত্তর আয়তা মূর্ছনাকেও জানা উচিত।
নিষাদাদর্জনো বিদ্যাদৃষিণাং সপ্ত মূর্চ্ছনাঃ।
উপজোহ্বান্ত গন্ধর্ব্বো দেবানাং সপ্ত মূর্চ্ছনা
  ॥১৩॥ 
শব্দার্থ: ভাবার্থ: নিষাদ (নি) স্বর থেকে উৎপন্ন অর্জনী (মূর্ছনা) পর্যন্ত ঋষিদের সাতটি মূর্ছনা জানা উচিত। (এবং) উপজোহ্বান্তী (মূর্ছনা) হলো গন্ধর্বদের বা দেবতাদের সাতটি মূর্ছনার মধ্যে (একটি)।
পিতৃণাং মূর্চ্ছনাঃ সপ্ত তথা যক্ষা ন সংশয়ঃ।
(মনুষ্যাণাং) ঋষীণাং মূর্চ্ছনাঃ সপ্ত যাস্ত্বাস্মা লৌকিকাঃ স্মৃতাঃ  ॥১৪॥ 
শব্দার্থ: ভাবার্থ: পিতৃপুরুষদের সাতটি মূর্ছনা, এবং যক্ষদেরও সাতটি মূর্ছনা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঋষিদের সাতটি মূর্ছনা, যা আমাদের দ্বারা লৌকিক বা জাগতিক বলে বিবেচিত হয়।
ষড়্জঃ প্রীণাতীহ দেবান্ ঋষীন্ প্রীণতি চর্ষভঃ।
পিতৄন্ প্রীণাতীহ গান্ধারো গন্ধর্বান্ মধ্যমঃ স্বরঃ  ॥১৫॥
শব্দার্থ: ভাবার্থ: ষড়্জ স্বর এখানে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে, এবং ঋষভ স্বর ঋষিদের সন্তুষ্ট করে। গান্ধার স্বর পিতৃপুরুষদের সন্তুষ্ট করে, এবং মধ্যম স্বর গন্ধর্বদের সন্তুষ্ট করে।
দেবান্ পিতৄনৃষীংশ্চৈব স্বরঃ প্রীণতি পঞ্চমঃ।
যক্ষান্ নিষাদঃ প্রীণাতি ভূতগ্রামং চ ধৈবতঃ ॥১৬
শব্দার্থ: ভাবার্থ: পঞ্চম স্বর দেবতা, পিতৃপুরুষ এবং ঋষি — এই তিন জনকেই সন্তুষ্ট করে। নিষাদ স্বর যক্ষদেরকে সন্তুষ্ট করে, এবং ধৈবত স্বর ভূতগ্রামকে (সমস্ত প্রাণীকুলকে) সন্তুষ্ট করে।
সূত্র: