অগ্নি-বীণা
কাজীনজরুল ইসলাম

 

          বিদ্রোহী

                  বল        বীর
               বল উন্নত মম শির!
শির   নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
                  বল      বীর

বল    মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
 
      চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
        ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
                   খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া
                         উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!

মম    ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
                    বল     বীর

                    আমি চির-উন্নত শির!

               আমি      চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-   প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস
আমি   মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
                  আমি দুর্বার,

               আমি      ভেঙে করি সব চুরমার! 
               আমি      অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল
     আমি    দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
               আমি মানি নাকো কোনো আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
      আমি   ধূর্জটি, আনি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
      আমি   বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
                        বল     বীর

           চির    উন্নত মম শির!
    
         আমি      ঝন্‌ঝা, আমি ঘূর্ণি,
         আমি      পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি।
                     আমি    নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি               আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ!
        আমি       হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিল্লোল,
        আমি       চল চঞ্চল, ঠমকি ছমকি
                     পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি
                           ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
       আমি       চপলা-চপল হিল্লোল!

আমি   তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি    শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পঞ্জা,
              আমি উন্মাদ আমি ঝন্‌ঝা!
আমি   মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি   শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
                    বল    বীর

  
           আমি    চির-উন্নত শির।

              আমি    চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি   দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায়্ হর্দম্ ভর্‌পুর্ মদ।
             আমি    হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
             আমি    যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি   সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
             আমি    অবসান, নিশাবসান!
             আমি    ইন্দ্রাণি-সুত হাতে-চাঁদ ভালে সূর্য,
মম    এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তুর্য!
আমি  কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির!
আমি  ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
                    বল    বীর

     
      চির  উন্নত মম শির!

            আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গীস্,
আমি      আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।
            আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি      ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি      পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি      চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড!
আমি      খ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি      দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি      প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস,
আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি      মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি      কভু প্রশান্ত,
কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি      অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি      প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
                আমি     উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি      উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-উর্মির হিল্লোল্-দোল্!

আমি      বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী,তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি      ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেমউদ্দাম, আমি ধন্যি।
            আমি     উন্মন মন উদাসীর,
আমি      বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশির!
আমি      বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি      অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!
আমি      অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত       চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি      গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে-দেখা-অনুখন,
আমি      চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন-কন্।

                 আমি    চির-শিশু, চির কিশোর,
আমি      যৌবন-ভিতু পল্লীবালার আঁচল কাঁচলি নিচোর!
আমি      উত্তরী-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া!
আমি      পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি      আকুল নিদাঘ-তিয়াষা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি,
আমি      মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া ছবি

আমি      তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি      সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

আমি      উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি      বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
            ছুটি     ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গের
                           স্বর্গ-মর্ত-করতলে,

বোর্‌রাক পঙ্খীরাজ

তাজি     বোর্‌রাক আর উচ্চৈশ্রবা বাহন আমার
                          হিম্মৎ-হ্রেষা হেঁকে চলে!

আমি      বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালাহল!
আমি      পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি      তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আমি      ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চরি ভূমি-কম্প!
            ধরি    বাসুকির ফণা জাপটি,
ধরি       স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি!
            আমি     দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি      ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!

                আমি     অর্ফিয়াসের বাঁশরি,
                মহা-     সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
      ঘুম্‌      চুমু দিয়ে করে নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম
                মম বাঁশরির তানে পাশরি!
                আমি     শ্যামের হাতের বাঁশরি।

হাবিয় দোজখ সপ্তম নরক, এই নরকই ভীষণতম

আমি       রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে        সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি       বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া।
                   আমি     শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু        ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা

আমি      ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি      অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি      ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি      ছিন্নমস্তা চণ্ডি, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি      জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

               আমি   মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
               আমি   অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
               আমি    মানব দানব দেবতার ভয়,
                         বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
                  জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

আমি      তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাতাল মর্ত!
            আমি    উন্মাদ আমি উন্মাদ!!
আমি      চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!

                 আমি    পরশুরামের কঠোর কুঠার,
          নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
                 আমি    হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি    উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব-সৃষ্টির মহানন্দে।
                মহা
     বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
                আমি     সেই দিন হব শান্ত,
যবে   উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
        অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না

                    
      বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
              আমি      সেই দিন হব শান্ত!
আমি   বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি   স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি   বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
         আমি    খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

         আমি চির-বিদ্রোহী বীর
আমি   বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

রচনা ও প্রকাশকাল:
মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে এই কবিতা রচনা সম্পর্কে লিখেছেন-

'...তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পৃব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নীচেকার দক্ষিণ-পূব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার "বিদ্রোহী" কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে । পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। "বিদ্রোহী" কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।'
একটু বেলা বাড়ার পর, আফ্‌জালুল হক নজরুল তাঁকেও কবিতাটি শোনান। পরে কবিতাটির একটি কপি করে মোসলেম ভারতে প্রকাশের জন্য আফ্‌জালুল হককে দেন। এরপর অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য এলে, নজরুল তাঁকেও কবিতাটি শোনান। এরপর অবিনাশচন্দ্র জানান যে, মোসলেম ভারতের প্রকাশ অনিয়মিত। তার বদলে তিনি 'বিজলী' পত্রিকায় প্রকাশের পরামর্শ দেন। পরে নজরুল এই কবিতার একটি কপি অবিনাশচন্দ্রকেও দিয়েছিলেন।

'মোসলেম ভারতে প্রকাশিত 'বিদ্রোহী' কবিতাটির ৯১- ৯৪ সংখ্যক চরণগুলি ছিল নিম্নরূপ ছিল-
            ছুটি       ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
                        হাসি হা-হা হা-হা হি-হি হি-হি,
            তাজি    বোররাক আর উচ্চৈঃস্রবা বাহন আমার
                       হাকে চি-হি-হি-হি-চি-হি-হি-হি।

এছাড়া মোসলেম ভারতে প্রকাশিত 'বিদ্রোহী কবিতাতে 'আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার' পংক্তিটির পূর্বে ছিল এই পাচটি পঙক্তি। এই পঙক্তিগুলো হলো
                    আমি     উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল, মহাকাল,
                    আমি     বিবসন, আজ ধরাতল নভ ছেয়েছে আমারি জটাজাল।
                                    আমি ধন্য। আমি ধন্য !!
                    আমি     মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর, বিদ্রোহী সৈন্য!
                                    আমি ধন্য! আমি ধন্য!!

ধূমকেতু কবিতার প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় ( [১১ আগষ্ট ১৯২২ (শুক্রবার, ২৬ শ্রাবণ ১৩২৯)। সানাই-এর পোঁ- বিভাগে মুদ্রিত এই কবিতার শেষে বলা হয়, 'এই কবিতাটি প্রথমে 'মোস্‌লেম ভারতে' বের হয়। পরে এটা 'বিজলী' 'প্রবাসী' প্রভৃতি পত্রিকায় উদ্ধৃত হয়।...'। 

মোসলেম ভারতের 'কার্তিক ১৩২৮'  সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মোসলেম ভারত পত্রিকাটি অনেক সময় যথাযথ সময়ে প্রকাশিত হতো না। নজরুল যখন এই বিদ্রোহী কবিতাটি মোসলেম ভারতের জন্য আফ্‌জালুল হককে দেন, তখনও এর কার্তিক সংখ্যা প্রকাশিত হয় নি।  ফলে পৌষ মাসে রচিত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'কার্তিক ১৩২৮'  সংখ্যায়।

'বিজলী' পত্রিকার '২২ পৌষ ১৩২৮' (শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি ১৯২২) সংখ্যায়। কবিতাটি প্রকাশের পর, পত্রিকার প্রথম বারের সকল সংখ্যা বিক্রয় হয়ে যায়। ফলে বিজলী পত্রিকা এক সপ্তাহের ভিতরে দ্বিতীয়বার ছাপা হয়। কথিত আছে বিজলী'র ওই সংখ্যা দুই বারে মুদ্রিত হয়েছিল ঊনত্রিশ হাজার।

বিজলী ও মোসলেম ভারতের পরে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল প্রবাসী পত্রিকায়  'মাঘ ১৩২৮' সংখ্যায়। এর পর পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল, সাধনা পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৯ (‌এপ্রিল ১৯২২) সংখ্যায়।

১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে কলিকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস হইতে প্রকাশিত 'অগ্নিবীণা'র দ্বিতীয় সংস্করণেও এই পাচটি পঙক্তি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সংস্করণে এই পঙক্তিগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে। 'বিদ্রোহী' পাঠে কবি গোলাম মোস্তফা ১৩২৮ মাঘের 'সওগাত' পত্রিকায় লিখেছিলেন 'নিয়ন্ত্রিত'। সাধনা পত্রিকার 'বৈশাখ ১৩২৯' সংখ্যায় 'বিদ্রোহী' ও 'নিয়ন্ত্রিত পুনমুদ্রিত হইয়েছিল।