ভগ্নস্তূপ

  ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চুরুলিয়ার লোকগাঁথা অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন 'রাজার গড়' নামক কবিতা। উল্লেখ্য পল্লীশ্রী নামক পত্রিকার 'আশ্বিন ১৩২৯ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯২২)' সংখ্যায় ভগ্নস্তূপ নামে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

 

(ঐ)        গাঁয়ের দখিনে দাঁড়ায়ে কে তুমি যুগ যুগ ধরি একা গো?
                         তোমার বুকে ও কিসের মলিন রেখা গো?
                        এ কোন্‌ দেশের ভগ্নাবশেষ?
                        কোন্‌ দিদিমার কাহিনীর দেশ?
            যায় অতীতের আবছায়াটুকু পাষাণেরি গায় দেখা গো
            তোমারি উরসে কোন্‌ চিতোরের চিতার 'ভস্মরেখা গো?

(ওগো)     কে তুমি আমার পল্লিমায়ের দুখেরি কাহিনি কহিছ?
                        নীরব নিঝুম গভীর ব্যথাটি বহিছ?
                        মাতা নাকি ছিল রাজাত দুলালি                       
                        আজ অনাধিনী পথের কাঙালি,
               স্মৃতির আগুন বুকে চাপি বুঝি ধিকিধিকি তাই দহিছ?
               শত বরষের পুঞ্জিত জ্বালা বুক পেতে নিজে সহিছ।

(বুঝি)     বক্ষে শোভিত 'নৌ-রতন' আর অগণিত শত 'বিহার'ই,
                ছিল বুঝি রাজ-কেয়ারিটি পাশে ইহারই-
                        আঁকড়ের ঝোপ এখন তথায়
                        ঘিরেছে 'বোয়ান' 'আলগ্‌ লতায়'-
             ফুটে ঝাড়খেত যথায় নিযুত, সুরভি ফুলের ঝিয়ারি,
             বুক বেয়ে তার বেয়ে বেয়ে যেত পতি সাথে রাজ-পিয়ারি।

(বুঝি)     তোমারে ঘিরিয়া করিত সোহাগ নহর, লহর নাচিত,
                        বাঁধা ঘাটে তার বধূর বাউটি বাজিত!
                        কোথা সে নহর? আধার গহর,
                        জানায় সে-কথা আটটি পহর,
            শাখে কাক ডাকে, গাগরটি কাঁখে চমকে বউটি আসিত
            সভয়ে কৃষক দেখায় আজিকে গড়ে আলেয়ার বাজিত।

(ওগো)    তোমারি শিয়রে এখনো জাগিয়া বিশাল শিমুল গাছটি,
                    সব গেছে শুধু সেই তো ছাড়েনি কাছটি।
                    এখনো নিশীথে কে তার শাখায়
                    আকুল কাঁদনে গ্রামটি কাঁপায়,
            স্বপনেরি ঘোরে চমকিয়া ওঠে মায়ের কোলের বাছটি,
            কেউ জানে না রে কত যুগ ধরে শিয়রে গাছটি !

(বুঝি)     একদিন ছিল লোক-মুখরিত বিরাট বিশাল নগরী,
(ছিল)            খোশ্‌বাগ-ভরা কত যূথি আর টগরই
                    মর্মর-বেদি তার মাঝে কত,
                    হর্মশোভিত রাজপথে শত,
            বিলাসবিতানে বেড়াত যুবতী এলায়ে অলস কবরী
            বধূ অজয়ের ঘাটে যেত ওগো নিয়ে কাঁখে তার গাগরি।

(ওগো)     যে বর্গির নামে আজো সাধ জাগে হতে মার কোলে ছেলে রে,
(তারা)            আঁধিয়ার রেতে ঘর-দোর দিল জ্বেলে রে!
                     হাঁটিয়া আসিল রাজার সেপাই,
                    যত আসে বর্গি ঘিরে গড়খাই,
                কচি শিশুটিরে মার কোল কেড়ে কাটে তায় অবহেলে রে,
                জীয়ন্‌ বাঁধিয়া পুরবাসী সব, চিতা জ্বেলে দেয় ফেলে রে।

(ওগো)     পোড়া ঝাউগুলি ছড়ানো রয়েছে আজ সারা গ্রাম ব্যাপিয়া,
                    উড়েছে কোথায় কপোত দোয়েল পাপিয়া !
                    ঝরে গেঁয়ো রাজারি চিতায়
                    শিশির-অশ্রু মাখানো কি তায়?
                আঁকড় শিমুল ভোরে জাগি দেয় ফুলে সমাধিটি ঝাঁপিয়া,
                ভেসে আসে কার মৃদু হাহাকার নৈশ সমীরে কাঁপিয়া।

(আজি)    পল্লির পথে রাজারি কুঙারী, চোখে আসে জল ভরি, মা!
                    তবু নত শিরে আজ পায় গড় করি, মা!
                    উদাসী পবন ধীরে বয়ে যায়,
                    অতীতের স্মৃতি পরানে জাগায়,
              তোরি শোকে পড়ে নিশির শিশির ঝর্ঝর্ঝর্‌ ঝরি, মা!
              চোখে আসে জল নেহারি মা তোর আজ পূত গত গরিমা।