নবীনচন্দ্র

অঞ্জলি পুরিয়া মম ভাগীরথী-নীরে
দাঁড়ায়েছি আসি তব কর্ণফুলি-তীরে।
বীর-কবি! লহ লহ এ মোর তর্পণ
অপরিচিতের এই পৃজা-নিবেদন !
আসিনি একাকী আমি এই তীর্থ-পথে
দানিতে তর্পণ আজি ! মম দেশ হতে
এসেছে ভারতচন্দ্, কবি চণ্ডিদাস,
জয়দেব, কাশীরাম, সাথে কৃত্তিবাস,
এসেছে কঙ্কণ কবি।। তাঁরা ঊর্ধে রহি
পাঠায়েছে অর্ঘ্যভার। আমি তাহা বহি
আসিয়াছি তব পুণ্য চট্টলায় একা,
তাহাদেরি অর্ঘ্য মম এই অশ্রুলেখা !

আজি বিচ্ছেদের এই স্মরণ-সন্ধ্যায়
তব কর্ণফুলি-তীরে সমুদ্রবেলায়
উঠিল মহান এক মিলন-মন্দির।
পশ্চিমের ভাগীরথী অজয়ের নীর
আসিল তোমার দেশে বন্দিতে তোমায়।
আসিল পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব বাঙ্গালায়
শ্রদ্ধার অঞ্জলি দিতে। দিতে অর্ঘ্য হবি
এ স্মরণ-তীর্থে এল কোরানের কবি।
ওঠে অভিনব মহা-মিলনের গীত
আজিকে শ্মশানে তব। আজি পুরোহিত
তোমার এ শ্রাদ্ধ-তীর্থে মুস্`লিম-তনয়।
প্রাণ আজি হল জয়ী, ভেদবুদ্ধি লয়
আজ হতে হলো, কবি! চিতা-ভস্মে তব
উঠিল মিলন-তাজ আজি অভিনব !

বিদায়-দিনের তব ভবিষ্যৎ-বাণী
'আজিকে বিজয় মোর !' দিল আজি আনি
সার্থক করিয়া বর হেথা অকম্মাৎ
হেথা ভায়ে ভায়ে আজ মিলাইল হাত।
এ গৌরবে ধন্য শুধু আমি নহি আজ-
এ গর্ব তাদের যারা সৃজিল এ তাজ।

হে কবি! জানিছ তুমি আর আমি জানি
যে-লোক বিহার করে বাণী বীণাপাণি
সেথা আছে আমাদের চির-পরিচয়।
তাই এই স্মৃতি-তীর্থে নাহি মোর ভয়
আনিতে অঞ্জলি মোর দানিতে তর্পণ।
এ-লোকে যাহারা তব আত্মীয়-স্বজন-
আমি জানি তাহাদের সকলের হতে
অধিক আত্মীয় আমি। না-জানার পথে
আমাদের জানাজানি। মোর অধিকার
হে কবি, নতুন নহে অর্ঘ্য দানিবার।
কবির ধেয়ান-লোকে স্বরগ-কাননে
পরম আত্মীয় বন্ধু মোরা দুইজনে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর হে নবীন ব্যাস!
'রৈবতক 'কুরুক্ষেত্র', তোমার 'প্রভাস'
নব-ভারতেরি বাণী- উচ্ছ্বাস এ নহে-
পরাধীন ভারতের ক্ষত মর্ম-দহে

যে-ব্যথা ভীষণ দাহে জ্বলে ধিকিধিকি
হৃদি-রক্তে তুমি ঋষি গেলে তাহা লিখি
তুমি রচি গেলে ঋষি গেলে তাহা গীতা,
ভগবানে করে গেলে মানুষের মিতা !
তুমি মহাভারতের মহাবেদনার
জ্বালা-কুণ্ড। তব অশ্রু নহে হতাশার।
উষ্ণ প্রস্রব্ণ সম তব আঁখিজল
যত বেগে বহে তত দহে অবিরল।
চট্টলার অগ্নিগিরি যবে তুমি রোষে
ফৌপাইয়া উঠিয়াছ ভীষণ আক্রোশে,
বাণবিদ্ধা ফণিনীর সম তব পায়ে
লুটায়ে পড়েছে সিন্ধু। দূর বনছায়ে
লুকায়েছে বনমৃগী হেন নদ-নদী।
বিশ্বের বিস্ময় তুমি প্রলয়-পয়োধি!

হে নবীনচন্দ্র! তুমি ত্যজিয়া গগন
নেমেছিলে এ ধরায়। না জানি কখন
শুনেছিলে বিরহিণী জলধির ডাক।
লুকায়ে তাহার তীরে আসিলে নির্বাক।
সিন্ধরে ধরিয়া বুকে তুমি উতরোল
জাগালে মৃতের দেশে নবীন কল্লোল।

নিমেষে ফুরায়ে যায় মিলনের দিন,-
আকাশের চন্দ্র তুমি আকাশে বিলীন
হইলে একদা কবে, সেই হতে, হায়!
তোমার শ্মশান-পাশে কিন্তু গরজায়।

তোমার প্রাণের ঐ প্লাবন-উচ্ছ্বাসে
যে পড়ে সে ভেসে যায়, আর নাহি আসে
ফিরে তার কূলে, কবি ! তোমার জোয়ার
এতই ভীষণ ওগো এতই দুর্বার,
দেখিতে দেয়নি কারে কোথা তার তল;
যতই ডুবিতে যাই, তত বন্যা-ঢল
কেবলি ভাসায়ে নেয় নিরুদ্দেশ-পানে ;
তল আছে- কুল নাই তোমার তুফানে।
যে নদী ডুবাই তরী সেই নহে বড়,

বেগবতী খরস্রোতা অপার দুস্তর-
মহানদী তারে কই। তুমি মহানদী
গভীর কূপের নাই তলের অবধি,
তা বলে সে তটিনীর চেয়ে বেশি নহে;
ক<ূল ভাঙে তারি স্রোতে যে-তটিনী বহে।
হে কৰি! ধরায় নাহি তার সমতুল,
যার স্রোতে ভেঙে যায় হৃদয়ের কূল!
হে সরল! হে উদার! হে বিরাট শিশু !
মুহম্মদ, কৃষ্ণ, বৃদ্ধ, অমৃতাভ যীশু
সকলে দিয়াছ তুমি সম অর্ঘ্য-প্রীতি
রচিয়াছ সকলের তরে তব গীতি।
উঠেছিলে চন্দ্র তুমি সকলের তরে,
প্রিয় হয়ে আছ তাই প্রতি ঘরে ঘরে।

হে নবীনচন্দ্র! শুধু তোমারি আশায়
এসেছিল মহাসিন্ধু তব চট্টলায়।
আজ তব সিন্ধু সাথে কাঁদি অবিশ্রাম
তোমারে স্মরণ করি, জানাই প্রণাম !