অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী


                        লাঙল

যেখানে দিন দুপুরে ফেরিওয়ালি মাথায় করে মাটি বিক্রি করে, সেই আজব শহর কলিকাতায় 'লাঙল' চালাবার দুঃসাহস যারা করে, তাদের সকলেই নিশ্চিত পাগল মনে করছেন। কিন্তু সেই পাষাণ শহরেই আমরা 'লাঙল' নিয়ে বেরুলাম। এই পাষাণের বুক চিরে আমরা সোনা ফলাতে চাই। ব্রহ্মপুত্র-স্বোত হিমালয়ে আটকে গেলে হুলধর লাঙলের আঘাতে পাহাড় চিরে সেই স্রোতকে ধরায় নামিয়ে ছিলেন। সেই জল কত প্রান্তর শ্যামল করে কত তৃষিত কণ্ঠের পিপাসা মিটিয়ে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। "লাঙলবন্ধ" আজ বাংলার তীর্থ। মহাত্মাগণের আন্দোলন আজ নেতাদের পাষাণ পারিপার্শ্বিকে আট্‌কে গেছে তাই- আজ আবার হলধরের ডাক পড়ছে।

পাশ্চাত্য সত্যতার প্রয়োজনে শহরের সৃষ্টি হ'য়ে পল্লীমুখী বাংলার সভ্যতা ও সাধনা লোপ পেতে বসেছে। শাসন এবং শোষণের সহায়তার যন্ত্রস্বরূপে ভদ্র-সম্প্রদায় আত্মবিক্রয় করে শহরে উঠে এসেছেন। গ্রামের আনন্দ উৎসব রোগ-শোকের চাপে লুপ্ত হয়ে গেছে। শহরের বেকার বাঙালী আজ বুঝছে গ্রাম ছেড়ে এসে তার কি নিরুপায় অবস্থাই হয়েছে। জমিদার আর গ্রামের সকল কর্মের প্রাণস্বরূপে উপস্থিত নন- তিনি শহরে এসে বাস করে মদ-মাংস মেয়েমানুষ মোটর মামলা এই পঞ্চ-মকারের সাধনায় নিযুক্ত আছেন। নায়েব-গোমস্তার অত্যাচারে প্রজার প্রাণ ওষ্ঠাগত। মহাজনের হাতে জমির স্বত্ব চলে যাচ্ছে। গৃহহীন ভূমিহীন লক্ষ লোক সমাজের অভিশাপ নিয়ে শহরের দিকে ছুটছে-কলকারখানায় কতক ঢুকে নিজেদৈর সর্বনাশ করছে- আর কতক নানা হীন উপায়ে জীবিকা-নির্বাহের চেষ্টা করছে। দেশে চুরি, ডাকাতি ও বলাৎকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বেগুন তিন আনা সের এবং মাছ কেন দেড় টাকা সের হয় তাই লোকে জিজ্ঞাসা করে। যে ক্ষেতের মালিক বা মাছ ধরে তার অবস্থা দিন দিন খারাপই হচ্ছে- জমিদার, মহাজন, দালালের পেটেই লাভের বার আনা যাচ্ছো কাজেই ক্রেতাকে দাম এত বেশী দিতে হচ্ছে।

জমিতে চাষির স্বত্ব নাই। যত্নের অভাবে ভূমির উৎপাদিকা-শক্তি নষ্ট হয়েছে। উৎপন্নে প্রজার লাভের পূর্ণ অংশ নাই। আমরা গোড়া কেটে আগায় জল দিচ্ছি। কাউন্সিলে এবং খবরের কাগজে স্বরাজের জন্য চেঁচিয়ে আকাশ ফাটিয়ে দিচ্ছি। আবার বলছি স্বরাজ পেলে এই সমস্ত সমস্যা আপনিই দূর হবে।

এই "স্বরাজ"টা এখন হলে পাবে কে? যারা পাবে তারা নিজের হাতে যেটুকু দেওয়ার ক্ষমতা এখনই আছে, তা সকলকে, দিচ্ছে কি? আমরা স্বরাজের মামলা আর এটর্নি দিয়ে করতে চাই না- এবার নিজেদেরই বুঝতে হবে। মথুরার লীলা ঢের দেখেছি- আমাদের দেবতা যিনি তাঁকে বৃন্দদাবনের শ্যামল মাঠে ফিরিয়ে আনতে চলেছি, তিনি রাখাল-গণের সখা, তিনি গোধন চরাতে ভালবাসেন। তিনি বেণু বাজিয়ে সকলকে পাগল করেন। যদি সেই দেবতার আবাহনে কেউ বাধা দেন, তবে আমাদের হলধর ঠাকুর তাকে রাখবেন না- লাঙলের আঘাতে তাঁকে মরতেই হবে।

"লাঙল" চালিয়ে যিনি সীতাকে, লাভ করেছিলেন, সেই জনক আমাদের গুরু। যিনি producer (জনক) তিনিই ঝষি। তিনিই সমাজের শ্রেষ্ঠ। আজ নব-জনকের নৃতন-দর্শনে আমাদের জ্ঞান লাভ করতে হবে। Destibutor হিসাবে, জনকয়েক্ ভদ্রলোকের স্থান সমাজে আছে। ডাক্তারী, শিক্ষকতা প্রভৃতির দ্বারা সমাজের সেব৷ করার জন্যও লোকের প্রয়োজন। কবি, চিত্রকর, শিল্পী হিসাবেও স্রষ্টার স্থান আছে। কিন্তু পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার ব্যবসাটা লোপ পাওয়া দরকার। শরীরের মধ্যস্থল বেশী স্ফীত হয়ে গেলে শরীরটাই অচল হয়ে পড়বে। দুম্বার লেজ শরীর অপেক্ষা বড় হ'লে তখন লেজের মাংস খেলে দুম্বারই উপকার।

হিন্দুর বর্ণ-বিভাগ বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে শ্রমবিভাগ-নীতি মেনে পুরুযানুক্রমে একই চর্চা করে সমাজের ক্রমোন্নতি এই পদ্ধতির মূলে ছিল। এখন কিন্তু তালগাছহীন তালপুকুর হ'য়ে দাঁড়িয়েছে এই বর্ণ-বিভাগ।

ব্রাহ্মণ পাদরির রাজত্ব গিয়েছে। গুরু-পুরোহিত, খলিফা, পোপ নির্ব্বংশ-প্রায় ক্ষাত্র-সম্রাট ও সাম্রাজ্য সব ধ্বসে পড়েছে। রাজা আছেন নামে মাত্র। আমেরিকা, ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে এখন বৈশ্যের রাজত্ব। এবার শৃদ্রের পালা। এবার সমাজের প্রয়োজনে শূদ্র নয়- শুদ্রের প্রয়োজনে সমাজ চলবে। হিদু-মুসলমান সমস্যা, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সমস্যা সব লাঙলের ফালের মুখে লোপ পাবে। তাই আমরা লাঙলের জয়গান করলাম। লাঙল নবযুগের নব-দেবতা। জয় লাঙলের জয়- জয় লাঙলের দেবতার জয়।।

লাঙল
প্রথম খণ্ড, বিশেষ সংখ্যা
লা বৈশাখ ১৩৩২