অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী


       সত্যবাণী
ইসলাম জাগো ! মুসলিম জাগো। আল্লাহ তোমার একমাত্র উপাস্য, কোরআন তোমার সেই ধর্মের, সেই উপাসনার মহাবাণী,-সত্য তোমার ভূষণ, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা তোমার লক্ষ্য,- তুমি জাগো। মুক্ত বিশ্বের বন্যশিশু তুমি, তোমায় পোষ মানায় কে? দুরন্ত চঞ্চলতা, দুর্দমনীয় বেগ, ছায়ানটের নৃত্য-রাগ তোমার রক্তে, তোমাকে থামায় কে? উষ্ণ তোমার খুন, মস্ত তোমার জিগর, দারাজ তোমার দিল, তোমাকে রুখে কে? পাষাণ
কবাট তোমার বক্ষ, লৌহ তোমার পঞ্জর, অজেয় তোমার বাহু- তোমায় মারে কে? বিপুল বাণীর প্রথম উদ্বোধন 'কোহ-ই তুরের' নাঙ্গা শিখরে,- তুমি অমর, তুমি চির জাগ্রত। 'আল্লাহু আকবর' তোমার ওংকার, আলি তোমার হুংকার, তুমি অজেয় ! বীর তুমি, তোমার চিরন্তন মুক্তি, শাশ্বত বন্ধনহীনতা, 'আজাদির' কথা ভুলায় কে? তোমার অদম্য শক্তি, দুর্দমনীয় সাহস, তোমার বুকে খঞ্জর চালায় কে? ইসলাম ঘুমাইবার ধর্ম নয়, মুসলিম শির নত করিবার জাতি নয়। তোমার আদিম জন্মদিন হইতে তুমি বুক ফুলাইয়া, শির উচ্চ করিয়া দুর্লঙ্ঘ, মহাপর্ব্বতের মতো দাঁড়াইয়া আছ, তোমার গগনচুম্বী শিখরে আকাশ ভরা তারার আলো, অর্ধচন্দ্রের প্রদীপ প্রশান্তি জ্যোতি- তোমার যে মহাগৌরবের কথা বিশ্বে চির মহিমান্বিত। মনে পড়ে কি, তোমার সেই রক্ত-পতাকা যাহা বিশ্বের সিংহদ্বারে উড়িয়াছিল,- তোমার সেই শক্তি যাহা দুনিয়া মথিত আলোড়িত করিয়াছিল? বলো বীর, বলো আজ তোমার সে শক্তি কোথায়? বলো ভীরু, তোমার সে প্রচণ্ড উগ্র মহাশক্তিকে কে পদানত করিল? উত্তর দাও! তোমায় আমি আল্লার নামে আহ্বান করিতেছি, উত্তর দাও! তোমার অপমান কেহ কখনো করিতে পারে নাই, ইসলাম অবমাননা সহে নাই। তুমি সত্য, ইসলাম সত্য, তোমার-আমার বা ইসলামের অপমান যে সত্যের অপমান। তাহা যে সহ্য করে, সে ভীরু-সে ক্ষুদ্র! যেদিন তুমি তোমার উদারবাণী মহাশিক্ষা ভুলিয়া স্বাধীনতার বদলে অধীনতার ছায়া মাড়াইতে গিয়াছ সেই দিনই তোমার শিরে মিথ্যার, দুশমনের ভীমপ্রহরণ' বাজিয়াছে। ইসলাম এক মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারো নিকট শির নোয়ায় না। তোমার চির-উচ্চ চির-অটল খজু সেই শির আনত করিতে উদ্যত, তাই আজ তুমি আঘাত পাইয়াছ, তাই তোমার বক্ষে বজ্রবেদন, শক্তিশেল ! যদি আঘাতই খাইয়াছ, যদি আজ এমন করিয়া গভীর বেদনাই তোমার মর্মে বাজিয়াছে, যদি এই প্রথম অবমানিত হইয়াছ, তবে তোমার লাঞ্ছিত সত্য, ক্ষুব্ধ শক্তি আবার উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গের মতো উদ্বেলিত হইয়া উঠুক! বলো, ইসলাম ভিক্ষা করে না, যাচ্ঞা করে না। বল, দুর্বলিতা আমাদের ধর্মে নাই! বলো, আমাদের প্রাপ্য আমাদের মুক্তি আমরা নিজের শক্তিতে লাভ করিব!... তোমার বাঁধে ভাঙন ধরিয়াছে, তোমাকে ইহা হইতে রক্ষা পাইতে হইবে। তাই আজ আমরা আমাদের সারা বিশ্বের লাঞ্ছিত বিক্ষুব্ধ, শক্তি লইয়া এই মুক্ত মহা-গগন-তলে দাঁড়াইয়া বলিতে চাই_-মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। এই মুক্ত গগনতল তোমার মহাতীর্থস্থান-আরাফাতের ময়দান অপেক্ষাও পবিত্র। এইখানে গৃহহীন পথহারা নিপীড়িত মুসলিম সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব পাইয়াছে, ঈদের দিনের মতো পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করিয়াছে, বুকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়াইয়া মুসলিম, আবার বলো, 'মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন।" যদিও তুমি সর্বস্বহারা হও, কোথাও তোমার মাথা গুঁজিবার ঠাই না থাকে, কুছ পরোয়া নেই, তোমার মাথা নত করিও না। আবার সকলি পাইবে। মুসলিম হীন, এ ঘৃণার কথা শুনিবার পূর্বে কর্ণারন্ধ্রে সিসা ঢালিয়া বধির হইয়া যাও! তোমাদের এই 'ইখওয়াৎ'কে কেন্দ্র করিয়া আমাদের অন্তরের সত্য স্বাধীন শক্তিকে যেন কোনোদিন বিসর্জন না দিই। তোমার বীর ভাইগুলি এ যে তোমার দক্ষিণপার্শ্বে ইসলামের এই শাশ্বত সত্য রক্ষার জন্য হেলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেছে, সেই শহিদায়েন নব্য তুর্কি-তরুণদের দেখো, আর গৌরবে
তোমার বক্ষ ভরিয়া উঠুক। তাহাদের পানে তাকাও, তাহাদের অস্ত্র-ঝঞ্জনা শোনো- তাহাদের হুংকারে তোমার হিম-শীতল রক্ত উষ্ণ হইয়া বহিয়া যাক তোমার শিরায় শিরায়। মেঘ-মুক্ত প্রাবৃট-মধ্যাহ্নের রক্ত ভাস্কর তোমার বিপুল ললাটের ভাস্বর রাজটিকা হউক। তুমি অমর হও! তুমি স্বাধীন হও ! তোমার জয় হউক।


সাধনা  পত্রিকার 'ভাদ্র ১৩২৮; সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।