বাসন্তিকা

কাজী নজরুল ইসলামের রচিত একাঙ্ক নাটক। নাটকটি বাসন্তিকা নামে প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল আজিজ সম্পাদিত 'অপ্রকাশিত নজরুল' নামে। পরে তা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির 'কাজী নজরুল ইসলাম রচনা সমগ্র'তে অন্তরভুক্ত হয়েছিল।

 

কুশীলব
(পুরুষ)

        ফাল্গুনী     হৃদয়-রাজ্যের রাজা
  দখিন হাওয়া     ওই মন্ত্রী
        কোকিল     ওই দূত
        পঞ্চশর      ওই সেনাপতি
ভ্রমর, মৌমাছি, প্রজাপতি দোয়েল শ্যামা… বৈতালিক দল।

                    (নারী)
        বাসন্তিকা   ফুলের দেশের রানি
          চৈতালি   রানির প্রিয় সহচরী

প্রথম দৃশ্য

    প্রেক্ষাগৃহের সম্মুখে ধোঁয়া রঙের যবনিকা। সেই যবনিকার এক পাশে অস্পষ্ট শ্বেতকরবীর গাছ আঁকা। গাছ থেকে কতক ফুল ঝরে পড়েছে, কতক ফুল ঝর-ঝর। আরেক পাশে আঁকা পল্লবহীন শিমুলতরু – তাতে দু-একটি কুঁড়ি দেখা দিয়েছে। যেন শীত ফুরিয়েছে, বসন্ত আসছে। … যবনিকা তোলার সঙ্গে সঙ্গে রাজাধিরাজ ফাল্গুনীর অগ্রদূত কোকিল মুহুর্মুহু কু্হুস্বরে রাজার আগমনবার্তা ঘোষণা করল। দূরে মৃদঙ্গ বীণা বেণুকা বেজে উঠল।
    ভ্রমর, মধু-মক্ষী, প্রজাপতি, দোয়েল, শ্যামা প্রভৃতি বৈতালিকদল সমস্বরে গেয়ে উঠল:

(গান)

            এলো ওই বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে
                        চঞ্চল তরুণ দুরন্ত॥
            বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর
            পরজ-বসন্তের সুর
পাণ্ডু কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে,
                রাঙা হল ধূসর দিগন্ত॥
            কিশলয়-পর্ণে অশান্ত
            ওড়ে তার অঞ্চলপ্রান্ত,
পলাশকলিতে তার         ফুলধনু লঘুভার
        ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত॥
        এলোমেলো দখিনা মলয় রে
        প্রলাপ বকিছে বনময় রে,
অকারণ মনোমাঝে         বিরহের বেণু বাজে
        জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত॥

চৈতালি:     ভয় কী সম্রাজ্ঞী! তব কণ্ঠের বিভব
                সীমাহীন মহীয়ান বৈচিত্রে সুরের!
                বহুরূপী কণ্ঠে তব বহু সুরে গান
                শুনিয়াছি বহুবার, মেনেছি বিস্ময়।
                গাহো গান আনন্দের। যদি সে পথিক
                সত্যই আসিয়া যায়, সে যেন জানিতে
                না পারে তোমার সখী মরমের কথা।
                সে যেন আসিয়া হেরে, তুমি মূর্তিমতী
                আনন্দ-প্রতিমা, তুমি সম্রাজ্ঞী বনের।
                রাজাই সে হয় যদি, এসে দেখে যাক
                রানির মহিমা তব, শির নত করি
                উদ্দেশে সে নিবেদন করুক প্রণাম।
বাসন্তিকা:   সেই ভালো, গাহি গান আমি আনমনে,
                এই অবসরে তুই বনরাজ্যে মোর
                বিশৃঙ্খল যাহা কিছু অসুন্দর যত
                সংযত সুন্দর করি রাখিবি সাজায়ে।
                অসুন্দর কোনো কিছু হেরি রাজ্যে মোর
                সুন্দরের আঁখি যেন ব্যথা নাহি পায়।

                            (গান)
                দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে।
                বাঁশরি বাজিল ছায়ানটে মনে মনে॥
                        চিত্তে চপল নৃত্যে কে
                        ছন্দে ছন্দে যায় ডেকে,
                যৌবনের বিহঙ্গ ওই ডেকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥

                বাজে বিজয়ডঙ্কা তারই এল তরুণ ফাল্গুনী।
                জাগো ঘুমন্ত দিকে দিকে ওই গান শুনি।
                        টুটিল সব অন্ধকার
                        খোলো খোলো বন্ধ দ্বার,
                বাইরে কে যাবি আয় সে শুধায় জনে জনে॥

চৈতালি:     রানি রানি। শোনো ওই দূরাগত গান,
                কে যেন পথিক বুঝি পরান-পসারি
                পরানের পসরা সে যায় হেঁকে গানে।
                প্রথম দিনের দেখা তব সে তরুণ
                এ যদি লো সেই হয় কী করিবে তবে?
                মুখপানে চেয়ে রবে নির্নিমেষ আঁখি?
বাসন্তিকা:  কী মধুর কণ্ঠ, শোনো, শোনো লো চৈতালি,
                শুনিতে দে প্রাণ ভরি, চল অন্তরালে।
                   
                (গান গাইতে গাইতে ফাল্গুনীর প্রবেশ)
            আমার গানের মালা আমি করব কারে দান।
            মালার ফুলে জড়িয়ে আছে করুণ অভিমান॥
                    চোখে মলিন কাজল লেখা
                        কণ্ঠে কাঁদে কুহুকেকা
                    কপোলে যার অশ্রু লেখা
                        একা যাহার প্রাণ।   
                                মালা করব তারে দান॥
            কথায় আমার কাঁটার বেদন
                        মালায় সূচির জ্বালা,
            কণ্ঠে দিতে সাহস না পাই
                        অভিশাপের মালা
                                এই অভিশাপের মালা।
            বিরহে যার প্রেম আরতি
            আঁধার লোকের অরুন্ধতী
            নাম-না জানা সেই তপতী
                        তার তরে এই গান।
                        মালা করব তারে দান॥

চৈতালি:     রহিতে পারি না আর-অন্তরালে,
                কণ্ঠে মম স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে গান।
                পত্রাবগুণ্ঠনে কুঁড়ি রহিতে কি পারে
                ভ্রমর আসিয়া সবে শোনায় গুঞ্জন।
বাসন্তিকা:   চৈতালি! চৈতালি! শোন, শোন মাথা খাস
                যাসনে উহার কাছে, ওরে ও চপলা
                কী জানি কী কহিবি যে বুঝি মোর নামে,
                সত্য-মিথ্যা কত কথা বিদেশির কাছে।

            (কুঞ্জান্তরাল হতে গান গাইতে গাইতে চৈতালির প্রবেশ)
বাসন্তিকা:     হৃদয় এমনই সখী, যাহারে সে চায়
                  তারে সে চিনিতে পারে আঁখির পলকে।
                  এমনই রহস্যময় পৃথিবীর প্রেম,
                  যখন সে আসে – আসে সহসা সহজে।
                  দেখিসনি তুই কি লো, এল সে যেমনই
                  রাজ্য মোর পূর্ণ হল রাজ-সমারোহে
                  রাজ্যের ঐশ্বর্য যত ছিল বনভূমে
                  লুটায়ে পড়িল সব তার পদতলে॥
চৈতালি:     মনের ঐশ্বর্য তব, বনের সে নহে
                লুটাইল যাহা সেই পথিকের পায়।
                আমি দেখি নাই তার রাজ-সমারোহ,
                হয়তো দেখেছ তুমি – এমনই নয়ন!
                একের নয়নে যার রূপ সীমাহীন,
                অন্যের নয়ন সখী তাহাতে বিরূপ।
বাসন্তিকা:   রাখ সখী, কখা আর ভালো নাহি লাগে।
                মনে হয়, চুপ করে বসে শুধু ভাবি।
চৈতালি:     ভাবনার অঙ্কুরেই এত, এ ভাবনা
                ক্রমে যবে হবে মহিরুহ সুবিশাল
                সহস্র শিকড় দিয়ে বাঁধিবে তোমায়
                তখন কী হবে হায়, তাই আমি ভাবি।
                ভালো, কথা নাহি কব, তুমিও কোয়ো না।
                তার চেয়ে গাহো গান, আমি বসে শুনি।

                            (বাসন্তিকার গান)
                কত জনম যাবে তোমার বিরহে
                        স্মৃতির জ্বালা পরান দহে॥
                শূন্য গেহ মোর শূন্য জীবনে
                        একা থাকারই ব্যথা কত সহে ওগো॥
                দিয়েছি যে জ্বালা জীবন ভরি হায়,
                        গলি নয়ন-ধারায় ব্যথা বহে॥

তৃতীয় দৃশ্য

পঞ্চশর:     শুনিতেছ, কি মধুর গান আসে ভেসে?
চৈতালি:     তোমাদের রাজার বন্দনা গাহিতেছে
                বনলক্ষ্মী। বলিতে কি পার বন্ধু তুমি
                কী করিছে রাজা-রানি কুঞ্জে নিরালায়?

দখিন হাওয়া:     আমি যদি চলে যাই এই স্থান ত্যজি
                       যা করিবে নিরালাতে তোমার দু-জন
                       তেমনই একটা কিছু। বেশি কিছু নহে।

চৈতালি:     বড়ো লঘু চিত্ত তুমি দক্ষিণের হাওয়া,
                ডেকে আনি পুষ্পলতা সখীরে আমার
                সমুচিত শাস্তি দেবে, হবে তব সাথি।
                শুনিতে হবে না আর তব হা-হুতাশ।

দখিন হাওয়া:     কাজ নাই, তার চেয়ে তুমি গাহো গান,
                       যে গান শুনিয়া কুঞ্জ-মাঝে রাজা-রানি–
                        বুঝিতে পারিবে মোরা বেশি দূরে নাই,
                        উৎসাহ দেবার তরে নিকটেই আছি।
                        বুঝিতেছি সব কিছু, দেখি না যদিও
                        উপভোগ করিতেছি মনশ্চক্ষু দিয়ে।

চৈতালি:     তা হলে আমিও গাই উৎসাহের গান।
                জ্বালাইলে কবে রানি! হায়, পরিচয়
                না হতেই মনে মনে মান অভিমান !
                পরিচয় ঘন হলে আরও কত হবে!
                প্রেমিকা তো নহি, তাই কিছু নাহি বুঝি।

বাসন্তিকা:     আঁখি-বিনিময়ে আঁখি চিনি লয় যারে
                  পলকে যে জিনি লয় সকল হৃদয়
                  সে বহু জনমের সাথি, বন্ধু, সখা।
                  চৈতালি! রহস্য এর তুই বুঝিবি না।
                  জন্মে জন্মে নব নব রূপে তার সাথে
                  বিরহ-মিলন, হয় নব জানাজানি।
                  ব্যথা দিয়ে চলে যায় জন্মান্তর পারে,
                  একজন চলে যায় – সাথি তার খোঁজে
                  আসে নব রূপ ধরি তারই পিছু পিছু।
                  আত্মার আত্মীয় যার সাথি প্রিয়তম
                  শুধু সেই জানে সখী রহস্য ইহার।
                  হৃদয় বরিয়া লয় হৃদি-দেবতারে।

                    (দূরে কোকিলের অবিরল কুহুধ্বনি)
চৈতালি:     ওই বুঝি এল তব হৃদিরাজদূত
                মুহুর্মুহু কুহুস্বরে কাঁপায়ে কান্তার।
                মর্মরিয়া লতাপাতা দখিনা পবন
                সহসা আসিল ওই, উতলা কানন।
                সহচর অনুচর দূত এল যবে
                রাজাও আসিছে পিছে মনে লাগে মোর।
                উষসীর আগমনে বুঝি লো যেমন
                তপনের উদয়ের আর নাহি দেরি।

বাসন্তিকা:     চৈতালি! কী হবে তবে? সত্যই সে যদি
                 এসে পড়ে, হেরে মোরে বিরহ-বিধুরা
                 কী হবে, এ মুখ সখী কেমনে লুকাই,
                 তুই বলে দে লো সখী, কী করিব আমি!
                 প্রণয় মধুর – যত রহে সে গোপন,
                 প্রকাশের লজ্জা তার অতি নিদারুণ।
                 লজ্জায় মরিয়া যাব, সে যদি লো বোঝে
                 ইঙ্গিতেও মোর পোড়া মরমের ব্যথা!
                        (পঞ্চশর ও চৈতালির গান)
পঞ্চশর:     বন-দেবী এসো গহন বনছায়ে।
চৈতালি:     এসো বসন্তের রাজা নূপুর-মুখর পায়ে॥
পঞ্চশর:     তুমি কুসুম-ফাঁদ
চৈতালি:     তুমি মাধবী চাঁদ
উভয়ে:       আমরা আবেশ ফাল্গুনের
                ভাসিয়া চলি স্বপন-নায়ে॥
পঞ্চশর:     কল্পলোকের তুমি রূপরানি লো প্রিয়া
                অপাঙ্গে ফোটাও জুঁই চম্পা টগর মোতিয়া।
চৈতালি:     নিঠুর পরশ তব (হায়) যাচিয়া জাগে বনভূমি,
                ফুলদল পড়ে ঝরি তব চারুপদ চুমি।
উভয়ে:     (মোরা) সুন্দরের পথ সাজাই
                    ঝরা কুসুম-দল বিছায়ে॥

দখিন হাওয়া:     তোমরা পরোক্ষে বুঝি এই ছল করি
                       কয়ে নিলে তোমাদেরও অন্তরের কথা।
চৈতালি:     তুমি বড়ো লঘু, বন্ধু! চলো আলাপন
                করি গিয়ে দূরে মোরা কুঞ্জের বাহিরে।
                        (সকলের প্রস্থান)

ফাল্গুনী:     ছল করি উহাদেরে লয়ে গেল দূরে
                চৈতালি তোমায় সখী। কেন নত চোখে
                চেয়ে আছ? কথা কও চাহো মুখপানে।

                    (বাসন্তিকার গান)
            অঞ্জলি লহো মোর সংগীতে
            প্রদীপ-শিখাসম কাঁপিছে প্রাণ মম
                    তোমায়, হে সুন্দর বন্দিতে।
                        সংগীতে সংগীতে॥
            তোমার দেবালয়ে কী সুখে কী জানি
            দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি
                    আরতি নৃত্যের ভঙ্গিতে।
                        সংগীতে সংগীতে॥
            পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
            গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।
            তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
            লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো
                        তোমার পদতল রঞ্জিতে।
                                সংগীতে সংগীতে॥

                            চতুর্থ দৃশ্য
বাসন্তিকা:     কেন ক্লান্ত আঁখি তব? কেন বার বার
                  চাহিতেছ মোর মুখে? এই তো তোমার
                  বাহুর বন্ধনে আমি আছি নাথ বাঁধা।
                  বিষাদিত ছলছল আঁখি হেরি তব
                  মনে বড়ো ভয় লাগে, আমি বড়ো ভীরু।
                  আছ মম বুকে, তবু কাঁদে কেন প্রাণ।

ফাল্গুনী:                 গান
                পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা!
                হেরো উষার বুকে কাঁদে প্রভাতি তারা
                তব বেণির মালা ম্লান, সুরভিহারা
                আজি ফুরাল ফাগুন এল যাবার বেলা,
                ভাঙে ভুলের মেলা, ভাঙে ফুলের খেলা।
                পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
                তব মৃণাল-ভুজে আর বেঁধো না মোরে
                ভীরু চাঁদের মতো আজও হাসি অধরে
                অনুরাগের কাজল আঁকি আঁখির তীরে
                চাহি মুখের পানে বোলো, ‘আসিয়ো ফিরে’।
                পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
                ফিরে আসিবে আবার নব চাঁদের তিথি,
                মালা তোমারই গলে দেবে নব অতিথি,
                রবে তারই বুকে মোর প্রথম প্রণয়
                আজি ফুরাল ফাগুন, এল যাবার সময়!
                পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥

বাসন্তিকা:     বসন্তের রাজা মোর! হৃদয়ের নাথ!
                 একী তব অরুন্তুদ অকরুণ গান?
                 অকারণ কেন মোরে দেখাও এ ভয়?
                 তুমি কি জান না নাথ, তুমি চলে গেলে
                 ফুরাইবে রাজ্যে মোর বসন্ত-উৎসব?

ফাল্গুনী:     আমি চিরচঞ্চল পথিক ঘরছাড়া,
                 বন্ধুহারা, উদাসীন, বিরাগী প্রেমিক।
                 সাথি মম পঞ্চশর দক্ষিণ সমীর,
                 ক্ষণিকের পথভোলা পথিক এরাও।
                 দুদিনের পিককুল মোর অগ্রদূত।
                 প্রজাপতি অলি – এরা মোর বৈতালিক।
                 ক্ষণিকের অতিথি যে আমরা সকলে,
                 কেন ভুলিতেছ প্রিয়া? নাই সাধ্য নাই,
                এর বেশি পৃথিবীতে থাকিবার আর।
                বসন্ত হয় অবসান, দিগন্তে বিদায়ের বেণু
                ওই শোনো বাজি ওঠে সকরুণ রবে।
                আমারে যে যেতে হবে। জনমে জনমে
                এমনই আসিব কাছে দু-দিনের লাগি,
                না মিটিতে সাধ শেষে চলে যেতে হবে!
                বিধির বিধান ইহা, যথা ভলোবাসা!
                মিলন ক্ষণিক সেথা, অনন্ত বিরহ।

বাসন্তিকা:     যেতে নাহি দিব আমি। তুমি রাজা, বীর,
                  আমারে বধিয়া যাও তব রাজ্যে ফিরে।
                  না, না, তব পায়ে পড়ি, থাকো ক্ষণকাল
                  পরুষ বচন আর কভু শোনাব না।

                                (গান)
                  মিনতি রাখো রাখো, পথিক থাকো থাকো
                  এখনই যেয়ো না গো না না না।
                  ক্ষণিক অতিথি বিদায়ের গীতি
                  এখনই গেয়ো না গো, না না না॥
                  চৈতি পূর্ণিমা চাঁদের তিথি
                  পুষ্প-পাগল এ বনবীথি
                            ধুলায় ছেয়ো না গো–না না না॥
                  বলি বলি করে হয়নি যা বলা,
                  যে কথা ভরিয়া ছিল বুকের তলা,
                  সে কথা না শুনে সুন্দর অতিথি হে
                            যেতে চেয়ো না গো, না না না॥

ফাল্গুনী:     তবু মোরে যেতে হবে! ছিঁড়িবে হৃদয়;
                করিতে হইবে তবু ছিন্ন এই ডোর।
                ভালোবেসে কাঁদি আমি কাঁদিয়া কাঁদাই
                এ মোর আত্মার ধর্ম! হে প্রিয়া বিদায়!

                            (গান)
                বল্লরি ভুজবন্ধন খোলো!
                অভিসার-নিশি অবসান হল॥
                পাণ্ডুর চাঁদ হেরো অস্তাচলে
                জাগিয়া শ্রান্ত তনু পড়েছে ঢলে
                মল্লিকা মালা ম্লান বক্ষতলে,
                অভিমান-অবনত আঁখি তোলো॥
                উতল সমীর আমি নিমিষের
                ভুল কুসুম ঝরাই কভু ফোটাই মুকুল।
                আলোকে শুকায় মোর প্রেমের শিশির
                দিনের বিরহ আমি, মিলন নিশির॥
                হে প্রিয় ভীরু এ স্বপন-বিলাসীর
                            অকরুণ প্রণয় ভোলো ভোলো॥ (প্রস্থান)

বাসন্তিকা:     কোথা তুমি প্রিয়তম ফাল্গুনী কিশোর?
                  নিশীথের ক্ষণিকের সুখ-স্বপ্নসম
                  আসিয়া গেলে কি চলি না মিটিতে সাধ?
                  দূরে ওই ওড়ে যেন বৈশাখী ঝড়ের
                  বিজয়-কেতন তার। বাসন্তী উৎসব
                  শেষ হোক আজি তবে। ঝরা ফুলদল,
                  বিরহের রৌদ্রদাহে মোর বনভূমি
                  পুড়ে যাক, উড়ে যাক, হোক ছারখার।
                  যোগিনীর গৈরিক নিশান নীলাম্বরে
                  এবার উড়ুক তবে। বিস্মৃতির ধূলি
                  ছেয়ে দিক রাজ্য মোর শস্য পুষ্পময়॥

                                (গান) [তথ্য]
                    ভোরে স্বপনে কে তুমি দিয়ে দেখা
                                    লুকালে সহসা।
                    মোর তপনের রাঙা কিরণ যেন
                                    ঘিরিল তমসা॥
                            না ফুটিতে মোর কথার কুঁড়ি
                            চপল বুলবুলি গেলে উড়ি
                    গেলে ভাসিয়া ভোরের সুর যেন
                                    বিষাদ-অলসা॥
                    জেগে দেখি হায় ঝরা ফুলে আছে ছেয়ে
                                    তোমার পথতল
                    ওগো অতিথি, কাঁদিছে বনভূমি
                                    ছড়ায়ে ফুলদল।
                           মুখর আমার গানের পাখি
                           নীরব হল হায় বারেক ডাকি
                           যেন ফাগুনের জোছনা-হসিত
                                    রাতে নামিল বরষা॥

[গানের মাঝে উঠল ধূলি-গৈরিক ঝড়, গানের শেষ দিকে ‘বাসন্তিকা’ ও রঙ্গমঞ্চ আর দেখা গেল না। সেই অন্ধকারেই গানের শেষ হল।]