হেনা (গল্প)
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬ সংখ্যায় এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পের লেখক পরিচিতি হিসেবে উল্লেখ ছিল- 'হাবিলদার, বঙ্গবাহিনী, করাচি'। গল্পটি পরে 'ব্যথার দান গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল।

ভার্দুন টেঞ্চ, ফ্রান্স

ওঃ! কী আগুন-বৃষ্টি! আর কী তার ভয়ানক শব্দ! 'গুড়ুম' 'দ্রুম' ' দ্রুম! ' আকাশের একটুও নীল দেখা যাচ্ছে না, যেন সমস্ত আশমান জুড়ে আগুন লেগে গেছে! গোলা আর বোমা ফেটে ফেটে আগুনের ফিনকি এত ঘন বৃষ্টি হচ্ছে যে, অত ঘন যদি জল ঝরত আসমানের নীলচক্ষু বেয়ে, তা হলে এক দিনেই সারা দুনিয়া পানিতে সয়লাব হয়ে যেত! আর এমনই অনবরত যদি এই বাজের চেয়েও কড়া 'দ্রুম দ্রুম' শব্দ হত, তাহলে লোকের কানগুলো একেবারে অকেজো হয়ে যেত। আজ শুধু আমাদের সিপাইদের সেই 'হোলি' খেলার গানটা, মনে পড়ছে,-
 

'আজু তলওয়ার সে খেলেঙ্গে হোরি
জমা হো গয়ে দুনিয়া কা সিপাই।r> ঢালোঁও কি ডঙ্কা বাদন লাগি, তোপঁও কে পিচকারী,
গোলা বারুদকা রঙ্গ বনি হ্যায়, লাগি হ্যায় ভারী লড়ান্!'

    বাস্তবিক এ গোলা-বারুদের রঙে আশমান-জমিন লালে-লাল হয়ে গেছে! সব চেয়ে বেশি লাল ওই বুকে; বেয়নেট'-পোরা হতভাগাদের বুকের রক্ত! লালে লাল! শুধু লাল আর লাল! এক একটা সিপাই 'শহীদ' হয়েছে, আর যেন বিয়ের নওশার মতো লাল হয়ে শুয়ে আছে!
    ওঃ! সবচেয়ে বিশ্রী ওই ধোঁয়ার গন্ধটা। বাপ রে বাপ! ওর গন্ধে যেন বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে ওঠে। – মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, তাদের মারবার জন্যে এ-সব কী কুৎসিত নিষ্ঠুর উপায়। রাইফেলের গুলির প্রাণহীন সিসাগুলো যখন হাড়ে এসে ঠেকে, তখন সেটা কী বিশ্রী রকম ফেটে চৌচির হয়ে দেহের ভিতরের মাংসগুলোকে ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়।
    এত বুদ্ধি মানুষ অন্য কাজে লাগালে তারা ফেরেশতার কাছাকাছি একটা খুব বড়ো জাত হয়ে দাঁড়াত!
    ওঃ! কী বুক-ফাটা পিয়াস! এই যে পাশের বন্ধু রাইফেলটা কাত করে ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, একে আর হাজার কামান এক সঙ্গে গর্জে উঠলেও জাগাতে পারবে না। কোনো সেনাপতি আর তার হুকুম মানাতে পারবে না একে। এই সাত দিন ধরে একরোখা ট্রেঞ্চে কাদায় শুয়ে শুয়ে অনবরত গুলি ছোড়ার ক্লান্তির পর সে কী নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে এর প্রাণে! তৃপ্তির কী স্নিগ্ধ স্পর্শ এখনও লেগে রয়েছে এর শুষ্ক শীতল ওষ্ঠপুটে!
    যাক, যে ভয়ানক পিয়াস লেগেছে এখন আমার! এখন ওর কোমর থেকে জলের বোতলটা খুলে একটু জল খেয়ে জানটা ঠান্ডা করি তো! কাল থেকে আমার জল ফুরিয়ে গিয়েছে, কেউ এক ফোঁটা জল দেয়নি। 'আঃ! আঃ!! গভীর তৃষ্ণার পর এই এক চুমুক জল, সে কত মিষ্টি। অনবরত চালিয়ে চালিয়ে আমার লুইস গানটাও আর চলছে না। এখন আমার মৃত বন্ধুর লুইস গানটা দিয়ে দিব্যি কাজ চলবে!' এর যদি মা কিংবা বোন কিংবা স্ত্রী থাকত আজ এখানে, তা হলে এর এই গোলার আঘাতে ভাঙা মাথার খুলিটা কোলে করে খুব এক চোট কেঁদে নিত! যাক, খানিক পরে একটা বিশ-পঁচিশ মনের মস্ত ভারী গোলা হয়তো ট্রেঞ্চের সামনেটায় পড়ে আমাদের দুজনাকেই গোর দিয়ে দেবে! সে মন্দ হবে না!
    হাঁ, আমার এত হাসি পাচ্ছে ওই কান্নার কথা মনে হয়ে! আরে ধ্যেত, সবাই মরব; আমি মরব, তুইও মরবি! এত বড়ো একটা নিছক সত্যি একটা স্বাভাবিক জিনিস নিয়ে কান্না কীসের?
    এই যে এত কষ্ট, এত মেহনত করছি, এত জখম হচ্ছি, তবুও সে কী একটা পৈশাচিক আনন্দ আমার বুক ছেয়ে ফেলেছে! সে আনন্দটা এই কাঠ-পেনসিলটার সিসা দিয়ে এঁকে দেখাতে পারছিনে! মস্ত ঘন ব্যথার বুকেও একটা বেশ আনন্দ ঘুমপাড়ানো থাকে, যেটা আমরা ভালো করে অনুভব করতে পারিনে। এই লেখা অভ্যেসটা কী খারাপ! এত আগুনের মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছি, 'পায়ের নীচে দশ-বিশটা মড়া , মাথার উপর উড়োজাহাজ থেকে বোমা ফাটছে 'দুম' 'দুম ' দুম, সামনে বিশ হাত দূরে বড়ো বড়ো গোলা ফাটছে, গুড়ুম গুড়ুম, পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে 'রাইফ্‌ল' আর 'মেশিনগানে'র গুলি 'শোঁ শোঁ শোঁ, -তবুও এই সাতটা দিন মনের কথাগুলি খাতার কাগজগুলিকে না জানাতে পেরে জানটাকে কী ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল! আজ এই কটা কথা লিখে বুকটা হালকা বোধ হচ্ছে!
    আঃ পাশের মরা বন্ধুর গায়ে ঠেস দিয়ে দিব্যি একটু আরাম করে নেওয়া যাক!  ওঃ কী আরাম! ...
    এই সিন্ধুপারের একটা অজানা বিদেশিনি ছোট্ট মেম আমায় খানিকটা আচার আর দুটো মাখন-মাখা রুটি দিয়েছিল। সেটা আর খাওয়াই হয়নি। এদেশের মেয়েরা আমাদের এত স্নেহের আর করুণার চক্ষে দেখে -হা-হা-হা-হাঃ, রুটি দুটো দেখছি শুকিয়ে দিব্যি 'রোস্ট' হয়ে আছে! দেখা যাক রুটি শক্ত না আমার দাঁত শক্ত! ওই খেতে হবে কিন্তু, পেটে যে আগুন জ্বলছে! -আচারটা কিন্তু বেড়ে তাজা আছে, দেখছি!
    ওই তেরো চৌদ্দ বছরের কচি মেয়েটা (আমাদের দেশে ও-রকম মেয়ে নিশ্চয়ই সন্তানের জননী নতুবা যুবতি গিন্নি!) যখন আমার গলা ধরে চুমো খেয়ে বললে, দাদা, এ-লড়াইতে কিন্তু শত্তুরকে খুব জোর তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে', তখন আমার মুখে সে কী একটা পবিত্র বেদনা-মাখা হাসি ফুটে উঠেছিল!
    আঃ! এতক্ষণ আকাশটা বেরোবার একটু ফাঁক পেয়েছে। রাশি রাশি জল-ভরা মেঘের ফাঁকে একটু একটু নীল আশমান দেখা যাচ্ছে। সে কত সুন্দর! ঠিক যেন অশ্রুভরা চোখের ঈষৎ একটু সুনীল রেখা!         থাক গে, এখন অন্য সময় বাকি কথাগুলো লেখা যাবে। মরা বন্ধুর আত্মা হয়তো আমার উপর চটে উঠেছে এতক্ষণ। কি বন্ধু, একটু জল দেব নাকি মুখে? -ইস, হাঁ করে তাকাচ্ছেন দেখ! না বন্ধু -না, তোমার পরপারের প্রিয়তমা হয়তো তোমার জন্যে শরবতের গেলাস-হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে! আহা, সে -বেচারিকে বঞ্চিত করব না তার সেবার আনন্দ হতে!
    আজ কত কথাই মনে হচ্ছে, -না -না, কিছু মনে হচ্ছে না, সব ঝুটা! ফের লুইস গানটায় গুলি চালানো যাক! -আমার সাহায্যকারী কয়জন বেশ তোয়াজ করে ঘুমিয়ে নিলে তো দেখছি!
    ওই-ওই, পাশে কাদের তালে তালে পা মিলিয়ে চলার শব্দ পাচ্ছি! ঝপ ঝপ ঝপ -লেফট রাইট লেফট! ওই মিলিয়ে চলার শব্দটা কী মধুর! ও বুঝি আমাদের 'রিলিভ' করতে আসছে অন্য পল্টন।
    উঃ! এতটুকু অসাবধানতার জন্যে হাতের এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেল দেখছি একটি গুলিতে! ব্যান্ডেজটা বেঁধে নিই নিজের। নার্সগুলোকে আমি দুচোখে দেখতে পারিনে। নারী যদি ভালো না বেসে সেবা করে আমার, তবে সে সেবা আমি নেব কেন?
    আঃ যুদ্ধের এই খুনোখুনির কী মাদকতা-শক্তি! মানুষ মারার কেমন একটা গাঢ় নেশা! পাশে আমার চেয়ে অত বড়ো জোয়ানটা এলিয়ে পড়েছে দেখছি!
    আমি দেখছি শরীরের বলের চেয়ে মনের বলের শক্তি অনেক বেশি। লুইস গানে এক মিনিটে প্রায় ছয়-সাতশো করে গুলি ছাড়ছি। যদি জানতে পারতুম, ওতে কত মানুষ মরছে! -তা হোক এই দু-কোণের দুটো লুইস গানই শত্রুদের জোর আটকিয়ে রেখেছে কিন্তু। কী চিৎকার করে মরছে শত্রুগুলো দলে দলে! কী ভীষণ সুন্দর এই তরুণের মৃত্যুমাধুরী!
                     পরবর্তী অংশ