বিষের বাঁশী
কাজী নজরুল ইসলাম

                বিদ্রোহের বাণী
                
                            ১
দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল্‌।
ঢের দেখাবি ঢাক ঢাক গুড় গুড় ঢের মিথ্যা ছল॥
                            এবার তোরা সত্য বল্‌।

পেটে এক আর মুখে আরেক- এই যে তোদের ভণ্ডামি,
এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম্‌-দামি।
নিজেরে কাছেও ক্ষুদ্র হলি আপন ফাঁকির আফসোসে,
বাইরে ফাঁকা পাঁয়তারা তাই, নাই তলোয়ার খাপ-কোষে।
                        তাই হলি সব সেরেফ আজ
                        কাপুরুষ আর ফেরের-বাজ
সত্য কতা বলতে ডরাস তোরাই আবার করবি কাজ-
                        ফোঁপরা ঢেঁকির নেইক লাজ।

ইলশেগুড়ি বৃষ্টি দেখেই ঘর ছুটিস্‌ সব রাম-ছাগল!
যুক্তি তোদের খুব বুঝেছি, দুধকে দুধ আর জলকে জল॥
                            এবার তোরা সত্য বল্‌।

                        ২
বুকের ভিতর ছ-পাই ন-পাই, মুখে বলিস্‌ স্বরাজ চাই,
স্বরাজ কথার মানে তোদের ক্রমেই হচ্ছে দরাজ তাই!
'ভারত হবে ভারতবাসীর'- এই কথাঁটাও বলতে ভয়।
এদের তোরা বলিস নেতা, এদের কথায় চলতে হয়।

                    বল রে তোরা বল নবীন-
                   
 চাই নে এসব জ্ঞান প্রবীণ।
চোখের সামনে দেশকে এরা করছে ক্লীব দিনকে দিন,
                    চায় না এরা- হই স্বাধীন।
কর্তা হবার সখ সবারই, স্বরাজ-ফরাজ ছল্‌ কেবল।
ফাঁকা প্রেমের ফুস্‌-মন্তর, মুখ সরল আর মন গরল।
                            এবার তোরা সত্য বল্‌।

                            ৩
মহান-চেতা নেতার দলে তোল রে তরুণ তোদের নায়,
ওঁরা মোদের দেবতা, সবাই করব প্রণাম ওঁদের পায়।
জানিস তো ভাই শেষ বয়সে স্বতই সবার মরতে ভয়,
ঝড়-তুফানে তাঁদের দিয়ে নয় তরি পার করতে নয়।
                    জোয়ানরা হাল ধরবে তার
                    করবে তরি তুফান পার!
আল্লা বলে মাল্লা তরুণ ওই তুফানে লাখ হাজার
                    প্রাণ দিয়ে ত্রাণ করবে মার!
সেদিন করিস এই নেতাদের ধ্বংস-শেষের সৃষ্টি কল।
ভয়-ভীরুতা থাকতে দেশের প্রেম ফলাবে ঘণ্টা ফল!
                        এবার তোরা সত্য বল॥

                            ৪
            ধর্ম-কথা প্রেমের বাণী জানি মহান উচ্চ খুব,
            কিন্তু সাপের দাঁত না ভেঙে মন্ত্র ঝাড়ে যে বেকুব!
'ব্যাঘ্র সাহেব, হিংসে ছাড়ো, পড়বে এসো বেদান্ত!'
কয় যদি ছাগ, লাফ দিয়ে বাঘ অমনি হবে কৃতান্ত!
                        থাকতে বাঘের দন্ত-নখ
                        বিফল ভাই ওই প্রেম-সেবক!
চোখের জলে ডুবলে গর্ব শার্দুলও হয় বেদ-পাঠক,
                                    প্রেম মানে না খুন-খাদক।
ধর্মগুরু ধর্ম শোনান, পুরুষ ছেলে যুদ্ধে চল।
সেও ভি আচ্ছা, মরব পিয়ে মৃত্যু-শোণিত-অ্যালকোহল!
                    এবার তোরা সত্য বল॥

                        ৫
প্রেমিক ঠাকুর মন্দিরে যান, গাড়ুন সেথায় আস্তানা!
শবে শিবায় শিব কেশবের -তৌবা- তাঁদের রাস্তা না!
মৃতের সামিল এখন ওঁরা, পূজা ওঁদের জোরসে হোক,
ধর্মগুরু গোর-সমাধি পূজে যেমন নিত্য লোক!
                তরুণ চাহে যুদ্ধ-ভূম!
                মুক্তি-সেনা চায় হুকুম!
চাই না 'নেতা', চাই 'জেনারেল', প্রাণ-মাতনের ছুটুক ধূম!
                মানব-মেধের যজ্ঞধূম।
প্রাণ-আঙুরের নিঙরানো রস- সেই আমাদের শান্তি-জল।
সোনা-মানিক ভাইরা আমার ! আয় যাবি কে তরতে চল।
            এবার তোরা সত্য বল॥

                        ৬
যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ!
ধামা-ধরা! জামা-ধরা! মরণ-ভীতু! চুপ রহো!
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!
এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি- মরব শেষ!
নরম গরম পচে গেছে, আমরা নবীন চরম দল!
ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিংবা পাতাল-তল!
 

রচনাকাল: এই গানটি রচনাকাল সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। ভারতী পত্রিকার বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ (এপ্রিল-মে ১৯২৪) সংখ্যায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।