বিষের বাঁশী
প্রথম সংস্করণের কৈফিয়ৎ

অগ্নি-বীণা দ্বিতীয় খণ্ড নাম দিয়ে তাতে যেসব কবিতা ও গান দেবো বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেইসব কবিতা ও গান দিয়ে এই বিষের বাঁশী প্রকাশ করলাম। নানা কারণে অগ্নি-বীণা দ্বিতীয় খণ্ড নাম বদলে বিষের বাঁশী নামকরণ করলাম। বিশেষ কারণে কয়েকটি কবিতা ও গান বাদ দিতে বাধ্য হলাম। কারণ 'আইন'-রূপ 'আয়ান ঘোষ' যতক্ষণ তার বাঁশ উঁচিয়ে আছে, ততক্ষণ বাঁশিতে তথাকথিত 'বিদ্রোহ'- রাধার নাম না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এ ঘোষের পোচর বাঁশ বাঁশির চেয়ে অনেক শক্ত। বাঁশে ও বাঁশিতে বাঁশাবাঁশি লাগলে বাঁশিরই ভেঙে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কেননা, বাঁশি হচ্ছে সুরের, আর বাঁশ হচ্ছে অসুরের !

এই বাঁশি তৈরির জন্য আমার অনেক বন্ধু নিঃস্বার্থভাবে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁরা সাহায্য না করলে এ বাঁশির গান আমার মনের বেণু-বনেই গুমরে মরত। এরা সকলেই নিঃস্বার্থ নিষ্কলুষ প্রাণ-সুন্দর আনন্দ-পুরুষ। আমার নি-খরচা কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ পাবার লোভে এরা সাহায্য করেননি। এঁরা সকলেই জানেন, ওসব বিষয়ে আমি একেবারে অমানুষ বা পাষাণ। এঁরা যা করেছেন তা স্রেফ আনন্দের প্রেরণায় ও আমায় ভালোবেসে। সুতরাং আমি ভিক্ষাপ্রাপ্ত ভিক্ষুকের মতো তাঁদের কাছে চির-চলিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁদের আনন্দকে খর্ব ও ভালোবাসাকে অস্বীকার করব না। এঁরা যদি সাহায্য হিসাবে আমায় সাহায্য করতে আসতেন, তাহলে আমি এঁদের কারুর সাহায্য নিতাম না। যাঁরা সাহায্য করে মনে মনে প্রতিদানের দাবি পোষণ করে আমায় দায়ী করে রাখেন, তাঁদের সাহায্য নিয়ে আমি নিজেকে অবমানিত করতে নারাজ। এতটুকু শ্রদ্ধা আমার নিজের উপর আছে। স্রেফ তাঁদের নাম ও কে কোন মালমশলা জুগিয়েছেন তাই জানাচ্ছি- নিজেকে হালকা করার আত্মপ্রসাদের লোভে।

এ বিষের বাঁশীর বিষ জুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশ-মাতা, আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।

বাঁশ জুগিয়েছেন সুলেখক উপন্যাসিক-বন্ধু সনতকুমার সেন। এ বাঁশকে বাঁশি করে তুলেছেন-'বাণী' যন্ত্র দিয়ে ঐ যন্ত্রাধিকারী বিখ্যাত স্বদেশ-সেবক আমার অগ্রজ-প্রতিম পরম শ্রদ্ধাস্পদ ললিত-দা ও পাঁচুদা। তাঁদের যন্ত্রের সাহায্য না পেলে এ বাঁশি শুধু বাঁশই রয়ে যেত। এই বাঁশির গায়ের অদ্ভুত বিচিত্র নকশাটি কেটে দিয়েছেন প্রোথিত-যশা কবি-শিল্পী- আমার ঝড়ের রাতের বন্ধু -কল্লোল-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। এই সবের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছিলেন দেশের-কাজে-উৎসর্গ-প্রাণ আমার পরম শ্রদ্ধেয় বন্ধু মৌলবি মঈনউদ্দিন হুসয়ন সাহেব বি. এ. (নূর লাইব্রেরি)। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ডি. এম. লাইব্রেরির গোপাল-দা এই গান শোনাবার জন্য ঢোল-শোহরৎ দেবার ভার নিয়েছেন।

এত বন্ধুর এত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক দোষ-ত্রুটি রয়ে গেল আমার অবকাশ-হীনতা ও অভিমন্যুর মতো সপ্তরথী-পরিবেষ্টিত ক্ষতবিক্ষত অবস্থার জন্য। যাঁরা আমায় জানেন, তাঁরা জানেন, আমার বিনা কাজের হট্টমন্দিরে অবকাশের কিরকম অভাব এবং জীবনের কতখানি শক্তি ব্যয় করতে হয় দশ দিকের দশ আক্রমণ ব্যর্থ করবার জন্য। যদি অবকাশ ও শান্তি পাই, তাহলে দ্বিতীয় সংস্করণে এর দোষ-ক্রুটি নিরাকরণের চেষ্টা করব। ইতি-

হুগলি                                                                             নজরুল ইসলাম
১৬ই শ্রাবণ ১৩৩১