বিষের বাঁশী
কাজী নজরুল ইসলাম

 

                'চরকার গান'
            ঘোর-
            ঘোর্‌ রে ঘোর্‌ রে আমার সাধের চর্‌কা ঘোর।
ঐ         স্বরাজ-রথের আগমনী শুনি চাকার শব্দে তোর॥
                            ১
            তোর ঘোরার শব্দে ভাই
            সদাই শুনতে যেন পাই,
ঐ         খুল্‌ল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই।
ঘু'রে      আস্‌ল ভারত-ভাগ্য-রবি, কাট্‌ল দুখের রাত্রি ঘোর॥

                              ২
            ঘর ঘর তুই ঘোর্‌ রে জোর
            ঘর্ঘর ঘর্‌ ঘূর্ণিতে তোর,
                        ঘুচুক ঘুমের ঘোর,
            তুই       ঘোর্‌ ঘোর্‌ ঘোর্‌।
তোর     ঘুর-চাকাতে বল-দর্পীর তোপ্‌ কামানের টুটুক জোর॥
                            ৩
            তুই ভারত-বিধির দান
            এই কাঙাল দেশের প্রাণ,
আবার   ঘরের লক্ষ্মী আস্‌বে ঘরে শুনে' তোর ঐ গান।
আর       লুট্‌তে না রবে সিন্ধু-ডাকাত বৎসরে পঁয়ষট্টি ক্রোড়॥
                            ৪
            হিন্দু-মুসলিম দুই সোদর,
            তাদের মিলন-সূত্র-ডোর রে
                     রচ্‌লি চক্রে তোর,
            তুই    ঘোর্‌ ঘোর্‌ ঘোর্‌ ঘোর্‌।
আবার    তোর মহিমায় বুঝ্‌ল দু’ভাই মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়!
                            ৫
            ভারত     বস্ত্রহীন যখন,
            কেঁদে     ডাকল- নারায়ণ!
তুমি      লজ্জা-হারী করলে এসে লজ্জা নিবারণ,
তাই      দেশ-দ্রৌপদীর বস্ত্র হরতে পার্‌ল না দুঃশাসন-চোর॥
                          ৬
                    এই     সুদর্শন চক্রে তোর
            অত্যাচারীর টুট্‌ল জোর রে, ছুটল সব গুমোর
                    তুই     ঘোর্‌ ঘোর্‌ ঘোর্‌॥
তুই       জোর জুলুমের দশমগ্রহ, বিষ্ণু-চক্র ভীম কঠোর ॥
                            ৭
            হয়ে     অন্ন বস্ত্রহীন
            আর     ধর্মে কর্মে ক্ষীণ
দেশ      ডুব্‌ছিল ঘোর পাপের ভারে যখন দিনকে দিন,
তখন     আন্‌লে অন্ন পুণ্য-সুধা, খুল্‌লে স্বর্গ মুক্তি-দোর॥
                            ৮
            শাস্‌তে জুলুম নাশতে জোর,
            খদ্দর-বাস বর্ম তোর রে অস্ত্র সত্য-ডোর,
            তুই     ঘোর্‌ ঘোর্‌ ঘোর্‌।
মোরা     ঘুমিয়েছিলাম, জেগে দেখি চল্‌ছে চরকা, রাত্রি ভোর॥
                            ৯
            তুই সাত রাজারই ধন,
            দেশ-মা'র পরশ-রতন,
তোর     স্পর্শে মেলে স্বর্গ অর্থ কাম্য মোক্ষ মন।
তুই        মায়ের আশিস্‌, মাথার মানিক, চোখ ছেপে বয় অশ্রু-লোর॥

 

রচনাকাল: এই গানটি রচনাকাল সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। ভারতী পত্রিকায় [৪৮ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ (এপ্রিল-মে ১৯২৪) গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম: চরকার গান। খাম্বাজ-কীর্তন-দাদরা। স্বরলিপি-সহ মুদ্রিত হয়েছিল। পৃষ্ঠা: ১২-১৫।] এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৪ বৎসর ১১ মাস।

উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধী চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিদেশ প্রেরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে এই আন্দোলনে সাফল্য লাভ করার পর, তিনি চরকায় সুতা কেটে সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরির পরিকল্পনা করেন। নজরুল গান্ধীজির চরকা আন্দোলনের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। এই অনুরাগ থেকেই তিনি গানটি রচনা করেছিলেন।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের ২-৩ তারিখে (শনিবার-রবিবার ১৯-২০ বৈশাখ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ) ফরিদপুরের অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কংগ্রেস অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলন মহাত্মা গান্ধী চিত্তরঞ্জন দাশ। সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। এই অধিবেশনেই নজরুলের সাথে প্রথম গান্ধীজির সাক্ষাৎ হয়। গান্ধীজির অনুরোধে এই গানটি পরিবেশন করেন।