বিষের বাঁশী
কাজী নজরুল ইসলাম


                     ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্
                                        [তিরোভাব]

                                    ১               
এ কী বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ!
বে-দরদ দিল্ কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর শোক।
        জান-মরা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ,
        কব্‌জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ , খাক চুমে নীলা তাজ ।
জিব্‌রাইলের আতশি পাখা সে ভেঙে যেন খান খান,
দুনিয়ার দেনা মিটে যায় আজ তবু জান আন্-চান!
                        মিকাইল অবিরল
            লোনা     দরিয়ার সবই জল
ঢালে     কুল মুল্লুকে , ভীম বাতে খায় অবিরল ঝাউ দোল।
এ কি     দ্বাদশীর চাঁদ আজ সেই? সেই রবিয়ল আউওল ?

                                   
ঈশানে কাঁপিছে কৃষ্ণ নিশান, ইস্‌রাফিলের ও প্রলয়-বিষাণ আজ
            কাতরায় শুধু! গুমরিয়া কাঁদে কলিজা-পিষানো বাজ!
রসুলের দ্বারে দাঁড়ায়ে কেন রে আজাজিল শয়তান?
তারও বুক বেয়ে আঁশু ঝরে, ভাসে মদিনার ময়দান!
            জমিন্-আশমান জোড়া শির পাঁও তুলি তাজি বোর্‌রাক্,
            চিখ্ মেরে কাঁদে 'আরশে' র পানে চেয়ে, মারে জোর হাঁক!
                            হুরপরি শোকে হায়
                জল-     ছলছল চোখে চায়।
আজ     জাহান্নমের বহ্নি-সিন্ধু নিবে গেছে ক্ষরি জল,
যত     ফিরদৌসের নার্গিস-লালা ফেলে আঁশু-পরিমল।

                               
মৃত্তিকা-মাতা কেঁদে মাটি হল বুকে চেপে মরা লাশ,
বেটার জানাজা কাঁদে যেন -তাই বহে ঘন নাভি-শ্বাস!
            পাতাল-গহ্বরে কাঁদে জিন, পুন মলো কি রে সোলেমান ?
            বাচ্চারে মৃগী দুধ নাহি দেয়, বিহগীরা ভোলে গান!
ফুল পাতা যত খসে পড়ে, বহে উত্তর-চিরা বায়ু,
ধরণর আজ শেষ যেন আয়ু, ছিঁড়ে গেছে শিরা স্নায়ু!
                        মক্কা ও মদিনায়
           আজ     শোকের অবধি নাই!
যেন     রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদসম ছুটে।
কাঁপে   ঘন ঘন কাবা, গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে।

                                    ৪
নকিবের তূরী ফুৎকারি আজ বারোয়াঁর সুরে কাঁদে,
কার তরবারি খান খান করে চোট মারে দূরে চাঁদে?
            আবু বকরের দর দর আঁশু দরিয়ার পারা ঝরে,
            মাতা আয়েষার কাঁদনে মুরছে আশমানে তারা ডরে!
            শোকে উন্মাদ ঘুরায় উমর ঘূর্ণির বেগে ছোরা,
বলে     'আল্লার আজ ছাল তুলে নেব মেরে তেগ্ , দেগে কোঁড়া।'
                        হাঁকে ঘন ঘন বীর-
            '
হবে,     জুদা তার তন শির,
আজ     যে বলিবে নাই বেঁচে হজরত 'যে নেবে রে তাঁরে গোরে।'
আজ     দারাজ দস্তে তেজ হাতিয়ার বোঁও বোঁও করে ঘোরে!

                                   
গুম্বজে কে রে গুমরিয়া কাঁদে মসজিদে মস্‌জিদে?
মুয়াজ্জিনের হোশ্ নাই, নাই জোশ চিতে, শোষ হৃদে!
                বেলালেরও আজ কণ্ঠে আজান ভেঙে যায় কেঁপে কেঁপে,
                নাড়ি-ছেঁড়া এ কী জানাজার ডাক হেঁকে চলে ব্যেপে ব্যেপে!
উস্‌মানের আর হুঁশ নাই কেঁদে কেঁদে ফেনা উঠে মুখে,
আলি হাইদর ঘায়েল আজি রে বেদনার চোটে ধুঁকে!
                আজ     ভোঁতা সে দুধারি ধার
                ঐ         আলির জুলফিকার !
আহা     রসুল-দুলালি আদরিণী মেয়ে মা ফাতেমা ওই কাঁদে,
'
কোথা   বাবাজান।' বলি মাথা কুটে কুটে এলোকেশ নাহি বাঁধে!

                               
হাসান-হুসেন তড়পায় যেন জবে-করা কবুতর,
'
নানাজান কই!' বলি খুঁজে ফেরে কভু বার কভু ঘর।
            নিবে গেছে আজ দিনের দীপালি, খসেছে চন্দ্র-তারা,
            আঁধিয়ারা হয়ে গেছে দশ দিশি, ঝরে মুখে খুন-ঝারা!
            সাগর-সলিল ফোঁপায়ে উঠে সে আকাশ ডুবাতে চায়,
শুধু         লোনা জল তার আঁশু ছাড়া কিছু রাখিবে না দুনিয়ায়।
                        খোদ     খোদা সে নির্বিকার,
                        আজ     টুটেছে আসনও তাঁর!
            আজ     সখা মহ্‍বুবে বুকে পেতে দুখে কেন যেন কাঁটা বেঁধে,
            তারে    ছিনিবে কেমনে যার তরে মরে নিখিল সৃষ্টি কেঁদে!

                                   
            বেহেশ্‌ত সব আরাস্তা আজ, সেথা মহা ধুম-ধাম,
গাহে     হুরপরি যত, 'সাল্লালাহু আলায়হি সাল্‌লাম।'
            কাতারে কাতারে করজোড়ে সবে দাঁড়ায়ে গাহিছে জয়,-
            ধরিতে না পেরে ধরা-মা-র চোখে দর দর ধারা বয়।
            এসেছে আমিনা আবদুল্লা কি, এসেছে খদিজা সতী?
আজ      জননীর মুখে হারামণি-পাওয়া-হাসা হাসে জগপতি!
                        '
খোদা,     একি তব অবিচার!'
                        বলে         কাঁদে সুত ধরা-মা-র।
আজ     অমরার আলো আরও ঝলমল, সেথা ফোটে আরও হাসি,
শুধু       মাটির মায়ের দীপ নিভে গেল, নেমে এল অমা-রাশি
                                * * * * *
আজ     স্বরগের হাসি ধরার অশ্রু ছাপায়ে অবিশ্রাম
ওঠে     কী ঘন রোল- 'সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম।'

শব্দার্থ:
আজরাইল-যমদূত
আজাজিল-শয়তানের নাম।
আতশি-অগ্নিময়

আবদু্লাহ্‌-হজরতের স্বর্গগত পিতা।
আমিনা-হজরত মোহাম্মদ (সা) জননীর নাম।
আরশ-খোদার সিংহাসন।
আসমান-আকাশ।
ইসরাফিল-প্রলয়-বিষাণধারী ফেরেশ্‌তা
ঈমান-বিশ্বাস।
ওয়ে-ওগো, বাছা।
কমি-অপূ্র্ণ।
কমি নাই-আজ কিছু অপূর্ণ নাই।
কুল মুল্‌লুকে-সর্বদেশে।
খাক-মাটি।
খোদার হাবিব-আল্লার বন্ধু (হজরতের খেতাব)।
গমি-দুঃখ।
গমি নাই-দুঃখ করো না।
জিবরাইল- প্রধান ফেরেশ্‌তা ও স্বগীয় বার্তাবহ।
তাজি- দ্রুতগামী অশ্ব।
তাজি বোর্‌রাক-বোররাক নামক স্বগীয় ঘোড়া।
 নার্গিস্‌ লালা-ফুলের নাম।
নীলা তাজ-আজরাইলের মাথার তাজ নীলবর্ণ।
পরওয়ান-পরোয়ানা।
বান্দা-হুজুরে- হাজির গোলাম, বন্দনাকারী।
বে-দরদ-নির্মম।
ফেরাউন, শাদ্দাদ, নমরুদ, মার্ওয়ান-বিখ্যাত ঈশ্বরদ্রোহী সব।
বিশ্ব-বয়তুল্লাহ_-বিশ্বরাপ 'কাবা' বা আল্লার ঘর।
বোর্‌রাক-উচ্চৈঃশ্রবার মতো স্বর্গের শ্রেষ্ট অশ্ব।
বোরহান-প্রমাণ।
ভরপুর-পূ্র্ণ।
ফিরেদৌস-বেহেশ্‌ত, স্বর্গবিশেষের নাম।
মারহাবা-সাবাস।
মিকাইল-একজন ফেরেশ্‌তার নাম।
রসুল-প্রেরিত পুরুষ।
রুহ- আত্মা।
রোয়ে-কাঁদে।
শর্ওয়ান-_নওশেরওয়ান নামক পারস্যের বিখ্যাত দানশীল বাদশাহ।
সরওয়ারে কায়েনাত-সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।
সাচ্চারই-সত্যেরই।
সুরাখ-বাঁঝরা।
 


প্রকাশ ও রচনাকাল:
মোসলেম ভারত 'অগ্রহায়ণ ১৩২৮' নভেম্বর ১৯২১ (কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৩২৮) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।