চক্রবাক
কাজী নজরুল ইসলাম


বর্ষা বিদায়

                                      ওগো বাদলের পরি!
যাবে কোন দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরি!
ওগো ও ক্ষণিকা, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজি তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?
  
তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পাণ্ডুর কেয়া-রেণু,
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেণু।
কুমারীর ভীরু বেদনা-বিধুর প্রণয়-অশ্রুসম
ঝরিছে শিশির-সিক্ত শেফালি নিশি-ভোরে অনুপম।
                              ওগো ও কাজলের মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরির উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।
ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে
কাননে কাননে কদম-কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে।
তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে উঠিল যে বল্লরি
তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তারা কাঁদে দিবানিশি ভরি।
                              ‘বউ-কথা-কও’পাখি
উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা বউ করে ডাকাডাকি।
চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙিয়া, পিয়াসি মধুপ এসে
কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া কমল-কুমুদী-দেশে।
                                      তুমি চলে যাবে দূরে,
ভাদরের নদী দুকূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে!
  
যাবে যবে দূর হিমগিরিশিরে, ওগো বাদলের পরি,
ব্যথা করে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহারেও স্মরি?
সেথা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা, –
কে জানে কী ভালো বিধুর ব্যথা – না মধুর পবিত্রতা!
সেথা মহিমার ঊর্ধ্ব শিখরে নাই তরলতা হাসি,
সেথা রজনির রজনিগন্ধা প্রভাতে হয় না বাসি।
সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা-নূপুর খুলি,
চলিতে চকিতে চমকি উঠ না, কবরী উঠে না দুলি।
  
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্না তাপসিনী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’।