ফণিমনসা
কাজী নজরুল ইসলাম


                            সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ
আজ     আষাঢ়-মেঘের কালো কাফনের আড়ালে মু'খানি ঢাকি
আহা     কে তুমি জননি কার নাম ধরে বারে বারে যাও ডাকি?
                                        মাগো কর হানি দ্বারে দ্বারে
তুমি     কোন হারামণি খুঁজিতে আসিলে ঘুম-সাগরের পারে?
           ‘কই রে সত্য, সত্যেন কই’ কাতর কান্না শুধু
           গগন-মরুর প্রাঙ্গণে হানে সাহারার হা হা ধু ধু!
           সত্য অমর, কেঁদো না জননি, আসিবে আবার রবি,
           গিয়াছে বাণীর কমল-বনে মা, কমল তুলিতে কবি!

ও কে    ক্রন্দসী হায় মুরছিয়া পড়ে অশ্রু-সিন্ধু তীরে
গেল     সহসা নিশীথে বাণীর হাতের বেয়ালার তার ছিঁড়ে।
                                       আহা, কোন ভিখারিনি এ রে
           কাহারে হারায়ে নিখিলের দ্বারে ফরিয়াদ করে ফেরে?
           সতীর কাঁদনে চোখ খুলে চায় ঊর্ধ্বে অরুন্ধতী,
           নিবিড় বেদনা ম্লান করে আনে রবির কনক-জ্যোতি।
           সত্য অমর, কাঁদিয়ো না সতী, আসিবে আবার রবি,
           গিয়াছে বাণীর কমল-কাননে কমল তুলিতে কবি!

আজ     সারথি হারায়ে বিষাদে অন্ধ ছন্দ-সরস্বতী,
ওগো    পুরোহিত-হারা ভারতী-দেউলে বন্ধ পূজা-আরতি।
                                            ওরে মৃত্যু-নিষাদ ক্রূর
           বিষাদ-শায়ক বিঁধিয়া করেছে বাংলার বুক চুর!
           নিভে গেল মঙ্গল-দীপশিখা, বঙ্গবাণীর আলো,
           দুলে দশদিকে শুধু দিশেহারা অশ্রু অতল কালো!
           ‘সত্য’ অমর! কাঁদিয়া না কবি, আসিবে আবার রবি,
            গিয়াছে বাণীর কমল-কাননে কমল তুলিতে কবি।

শ্বেত     বৈজয়ন্তী উড়ে চলে যায় মৃত্যুরও আগে আগে,
ওরে     সে চির-অমর, মৃত্যু আপনি তারই পায়ে প্রাণ মাগে।
                                        তাই ওই বাজে জয়-ভের
            স্বর্গ-দুয়ারে, ওঠে জয়ধ্বনি, ‘জয় সুত অমৃতেরি!’
            কাঁদিসনে মাগো, ওই তোর ছেলে মাতা সারদার কোলে
            শিশু হয়ে পুনঃ দুধ-হাসি হেসে তোরে ডেকে ডেকে দোলে!
            ‘সত্য’ অমর, কাঁদিয়ো না কেহ, আসিবে আবার রবি,
            মা বীণাপাণির সোহাগ আনিতে স্বর্গে গিয়াছে কবি।

কলিকাতা
শ্রাবণ, ১৩২৯