নির্ঝর
কাব্যগ্রন্থ
কাজী নজরুল ইসলাম


বঙ্গনূর পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৭ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

    গরিবের ব্যথা
এই যে মায়ের অনাদরে ক্লিষ্ট শিশুগুলি,
পরনে নেই ছেঁড়া কানি, সারা গায়ে ধূলি, −
সারাদিনের অনাহারে শুষ্ক বদনখানি,
খিদের জ্বালায় ক্ষুণ্ণ, তাতে জ্বরের ধুকধুকানি,
অযতনে বাছাদের হায়, গা গিয়েছে ফেটে,
খুদ-ঘাঁটা তাও জোটে নাকো সারাটি দিন খেটে, −
এদের ফেলে ওগো ধনী, ওগো দেশের রাজা,
কেমন করে রোচে মুখে মণ্ডা-মিঠাই-খাজা?
ক্ষুধায় কাতর যখন এরা দেখে তোমায় খেতে,
সে কী নীরব যাচ্‌ঞা করুণ ফোটে নয়নেতে!
তা দেখে ছিঃ, অকাতরে কেমনে গেলো অন্ন?
দাঁড়িয়ে পাশে ভুখা শিশু ধূলিধূসর বর্ণ।
রাখছ যে চাল মরাই বেঁধে, চারটি তারই পেলে,
আ-লোনা মাড়-ভাত খেয়ে যে বাঁচে এসব ছেলে।
পোশাক তোমার তর-বেতরের, নেইকো এদের তেনা,
যে কাপড়ে মোছ জুতো, এদের তাও মেলে না।
প্যাঁটরা-ভরা কাপড় তোমার, এরা মরে শীতে,
সারাটি রাত মায়ে-পোয়ে শুয়ে ছাঁচ-গলিতে।
তোমরা ছেলের চুমো খেয়ে হাস কতই সুখে,
এদের মা-রা কাঁদেই শুধু ধরে এদের বুকে।
ছেলের শখের কাকাতুয়া, তারও সোনার দাঁড়,
এরা যে মা পায় না গো হায় একটি চুমুক মাড়।
তোমাদের সব খোকাখুকির খেলনার অন্ত নাই,
খেলনা তো মা ফেলনা – এদের মায়ের মুখে ছাই
তেলও দেয়নি একটু মাথায়, চুল হল তাই কটা;
এই বয়সে কচি শিশুর বাঁধল মাথায় জটা!
টোটো করে রোদে ঘুরে বর্ণ হল কালি,
অকারণে মারে ধরে লোকে দেয় আর গালি।
একটুকুতেই তোমাদের সব ছেলে কেঁদে খুন;
বুক ফাটলেও কষ্টে তারা মুখটি করে চুন,
এই অভাগা ছেলেরা মা দাঁড়িয়ে রয় একটেরে;
কে বোঝে ওই চাউনি সজল কী ব্যথা চাপছে রে!
তোমাদের মা খোকার একটু গাটি গরম হলে,
দশ ডাক্তার দেখে এসে; এরা জ্বরে মলে
দেয় না মা কেউ একটি চুমুক জলও এদের মুখে,
হাড়-চামড়া হয়ে মরে মায়ের বুকে ধুঁকে!
আনার আঙুর খায় না গো মা রুগ্‌ন তোমার ছেলে;
এরা ভাবে, রাজ্যি পেলুম মিছরি একটু পেলে।
তোমাদের মা খোকাখুকি ঘুমায় দোলায় দুলে,
এদের ছেলের ঘুম পেলে মা ঘুমায় তেঁতুল-তলে
একলাটি গে’ মাটির বুকে বাহুয় থুয়ে মাথা;
পাষাণ-বুকও ফাটবে তোমার দেখ যদি মা তা!
দুঃখ এদের দেউ বোঝে না, ঘেন্না সবাই করে,
ভাবে, এসব বালাই কেন পথেই ঘুরে মরে?
ওগো, বড়ো মুদ্দই যে পোড়া পেটের দায়,
দুশমনেরও শাস্তি যেন হয় না হেন, হায়!
এত দুখেও খোদার নাকি মঙ্গলেচ্ছা আছে,
এইটুকু যা সান্ত্বনা মা, এ গরিবদের কাছে।