ভাষাংশ | কাজী নজরুল ইসলাম |
কাজী নজরুল ইসলামের রচনাসংগ্রহের সূচি


*৯০১. তাল: দ্রুত-দাদ্‌রা
যেতে নারি মদিনায় আমি হে প্রিয় নবী
আমারই ধ্যানে এসো প্রাণে এসো আল-আরবি॥
তপ্ত যে নিদারুণ আরবের সাহারা গো
শীতল হৃদে মম রাখিব তোমারই ছবি॥
ভালবাস যদি না মরুভূ ধূসর গো
জ্বালায়ে, হৃদি মম করিব সাহারা গোবি॥
হে প্রিয়তম, গোপনে তব তরে আমি কাঁদি
তোমারে দিয়াছি মোর, দুনিয়া আখের সবই॥
*৯০২. তাল:কাহার্‌বা
আমি গরবিনী মুসলিম বালা
সংসার সাহারাতে আমি গুলে লালা॥
জ্বালায়েছি বাতি (আমি) আঁধার কাবায়
এনেছি খুশির, ঈদে শিরনির থালা॥
আনিয়াছি ঈমান প্রথম আমি
আমি দিয়াছি সবার আগে মোহাম্মদে মালা॥
কত শত কারবালা বদরের রণে
বিলায়ে দিয়াছি স্বামী-পুত্র স্বজনে;
জানে গ্রহ-তারা জানে আল্লাহ তালা॥
*৯০৩. বৈতালিক
হায় হায় উঠিল মাতম আকাশ পবন ভুবন ভরি’।
আখেরি নবী দ্বীনের রবি বিদায় নিল বিশ্ব-নিখিল আঁধার করি’ ॥
অসীম তিমিরে পুণ্যের আলো
আনিল যে চাঁদ, সে কোথায় লুকালো
আকাশে ললাট হানি’ কাঁদিছে মরুভূমি
শোকে গ্রহ-তারকা পড়িছে ঝরি’॥
তৃণ নাহি খায় উট, মেষ নাহি মাঠে যায়;
বিহগ-শাবক কাঁদে জননীরে ভুলি হায়!
বন্ধুর বিরহ কি সহিল না আল্লার,
তাই তারে ডাকিয়া নিল কাছে আপনার;
হায় কাণ্ডারি গেল চ’লে রাখিয়া পারের তরী॥
*৯০৪. তাল: কাহার্‌বা
নিখিল ঘুমে অচেতন সহসা শুনিনু আজান
শুনি’ সে তকবিরের ধ্বনি আকুল হল মন-প্রাণ
বাহিরে হেরিনু আসি বেহেশতী রৌশনীতে রে
ছেয়েছে জমিন ও আসমান
আনন্দে গাহিয়া ফেরে ফেরেশ্‌তা হুর গেলেমান-
এলো কে, কে এলো ভুলোকে! দুনিয়া দুলিয়া উঠিল পুলকে॥
তাপীর বন্ধু, পাপীর ত্রাতা, ভয়-ভীত পীড়িতের শরণ-দাতা
মুকের ভাষা নিরাশার আশা, ব্যথার শান্তি, সান্ত্বনা শোকে
এলো কে ভোরের আলোকে॥
দরুদ পড় সবে: সাল্লে আলা, মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা।
কেহ বলে, এলো মোর কম্‌লিওয়ালা- খোদার হাবীব কেহ কয় নিরালা
মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা।
কেহ বলে, আহমদ নাম মধু ঢালা- মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা।
মজনুঁরও চেয়ে হল দীওয়ানা সবে, নাচে গায় নামের নেশায় ঝোঁকে॥
*৯০৫. নাটিকা: ‘পুতুলের বিয়ে’ তাল: দাদ্‌রা
মিলন-গোধূলি রাঙা হয়ে এলো ঐ সোনার গগনময়।
দাও আশিস অভয়, হে দেব জ্যোতির্ময়॥
মিলিল আবার দুইটি প্রাণ
কত যুগ পরে, হে ভগবান
সার্থক কর, হে মনোহর, এ মিলন অক্ষয়
যেন চির-সুখী হয়, হে দেব জ্যোতির্ময়॥
*৯০৬.নাটিকা: ‘পুতুলের বিয়ে’ তাল: দ্রুত-দাদ্‌রা
লাল টুক্‌টুক্ মুখে হাসি মুখখানি টুলটুল।
বিনি পানে রঙ দেখে যায় লাল-ঝুঁটি বুলবুল॥
দেখতে আমার, খুকুর বিয়ে
সূর্য্যি ওঠেন উদয় দিয়ে,
চাঁদ ওঠে ঐ প্রদীপ নিয়ে গায় নদী কুল্‌কুল্॥
*৯০৭. নাটিকা: ‘পুতুলের বিয়ে’, তাল: ফের্‌তা
সাবিত্রী সমান হও, লহ লহ এই আশিষ।
শ্বশুর শাশুড়ির মা বাপের, কুলের তারা হয়ে হাসিস॥
রামের মত স্বামী পাস, সতী হ’স সীতার সম
দশরথ কৌশল্যার মত শ্বশুর শাশুড়ি অনুপম।
লক্ষ্মণ সম দেবর পেয়ে সুখের সায়রে ভাসিস॥
গোয়ালে গরু, মরায়ে ধান সিঁথেয় সিঁদুর, মুখে পান
আল্‌তা পায়ে চির-এয়োতি যায় সুখে দিন এক সমান
অন্নপূর্ণা জগৎ জীবের মা হয়ে ফিরে আসিস॥
সভা-উজ্জ্বল জামাই পাস ভুবন-উজ্জ্বল দুঃখ পাস
ধরার মত সহ্য পাস জন্মায়স্তে কাল কাটাস।
পাকা চুলে পরিস্ সিঁদুর হয়ে থাকিস্ স্বামীর গো।
বেঁচে থাকিস্ যতকাল অক্ষয় থাক তোর হাতের নো।
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে গঙ্গাজলে দেহ রাখিস॥
*৯০৮. তাল: দ্রুত-দাদ্‌রা
আজ্‌কা হইবো মোর বিয়া কাল্‌কা আইমু বউ লইয়া,
থাইগ্‌বা তোমরা ফ্যাল-ফ্যালাইয়া বুঝ্‌ল্যা গোপ্‌লা মুকুন্দ্যা॥
তাইরে নাইরে নাইরে না, রইমু ঘরে বাইরে না
হকাল হইন্ধ্যা দুপইত্‌ত্যা চইল্যা যাইবো কোহান্ দ্যা॥
[আরে ও পরামানিকের পো, ক্ষুরবার লইয়া যাইতাছো কই?
আমারে বর কামান কামাইয়া দিয়া যাওছ্যান!
আইজগ্যা যে আমার বিয়া হইবো! [হ আরে আহো! আহো]
তাইরে নাইরে নাইরে না, রইমু ঘরে বাইরে না
হকাল হইন্ধ্যা দুপইত্‌ত্যা চইল্যা যাইবো কোহান্ দ্যা॥
[হউর হাউরী পাইমু কাল্, হুমুন্দী, আর হালার পাল
কইবো মোরে, হুনত্যাছ? ও-জামাই, কড়াকড়ির কী কাম আছে,
আর দুইডা দিন থাইক্যা যাও না ক্যা? অ্যা!]
আরে আমি উঠ্‌মু কি গাছ্‌ত গিয়া, উৎকা মাইর্যা ফাল দিয়া,
ভাইরে, হালার পরান ডা. (ভাইরে) নাইচ্যা উঠ্‌ছে এ্যাহন্ থ্যা।
তাইরে নাইরে নাইরে না, রইমু ঘরে বাইরে না
হকাল হইন্ধ্যা দুপইত্‌ত্যা চইল্যা যাইবো কোহান্ দ্যা॥
[আরে ও মুখুজ্যা ভাই, মুখুজ্যা ভাই, আরে যাও কই হুইনা যাও।
হুইনা যাই। হক্‌কল দিনই তো বলদ লইয়া মাঠে চরাইবার যাও।
আজকা আমারে লইয়া মাইয়ার বাড়ি যাওন লাগ্‌বো,
খাওন-দাওন আছে খাওন-দাওন আছে! ঠইগ্‌বা না, ঠইগ্‌বা না!]
তাইরে নাইরে নাইরে না, রইমু ঘরে বাইরে না
হকাল হইন্ধ্যা দুপইত্‌ত্যা চইল্যা যাইবো কোহান্ দ্যা॥
[খাইমু কি কি আরে হুনছ- গোপ্‌লা, ও মুকুন্দ্যা!
আরে, মুকুন্দ্যা ঐ খানে যাইয়া খারাইয়া আছ্‌ত কিল্ল্যাইগ্যা? আহো, হুনো!
মাংস খাইমু, লুচি খাইমু, পাত্‌ক্ষীর খাইমু, আর দইও খাইমু। আর তোমরা
অভাগ্যা, অভাগ্যার পাল! তোমরা তো খাইবা না, তোমরা চাইটবা! চুকা
কাসুন্দ্যা চাইটবা।]
ফুচ্‌কি দিয়া তোমরা চোর, দেখ্‌বার চাইবা বউরে মোর,
রাখুম তারে লুকাইয়া, হোগলার বস্তা চাপুনন্দ্যা॥
তাইরে নাইরে নাইরে তাই, বউরে ছাইর্যা যাইরে ভাই
থাক্‌তে পরান আসুম্ না, (ভাই) পইচ্যা হইমু ফাপুন্দ্যা॥
[আরে গোরা-চাঁদ যে, অকালের গাড়িতে আইল্যা বুঝি?
তোমরা দুই ভাইয়েই তো কোলকাতায় আষ্ট বছর কাল
ঘরজামাই হইয়া আছো। বউর লগে ভাব ক্যামুন। চালতাছে
ক্যামন? অ্যা?]
*৯০৯. তাল: কাহার্‌বা
(ওগো) আমার খোকার মাসি শ্রীঅমুকবালা দাসী,
মোরে দেখেই সর্বনাশী ফেলে ফিক্ করে সে হাসি॥
তার চোখ প্রায় পুটী মৎসই
তার চেহারাও নয় জুৎসই
আবার (তার) আছে তিনটি বৎসই কিন্তু সে স্বাস্থ্যে খোদার খাসি॥
সে খায় বটে পান-জর্দা
তার চেহারাও মর্দ্দা-মর্দা
তবু বুঝলে কি না বড়দা আমি তারেই ভালোবাসি॥
শালী অর্থাৎ কি না বউ সে পনর আনাই,
তারে দিয়ে একটা ‘আনি’ দাদা ঘরে যদি আনি
সে বউ হয় ষোল আনাই। কি বল দাদা এ্যা?
আমি তারই লাগি জেলে, মরবো ঘানি ঠেলে,
তারে নিয়ে ভাগ্‌বো রেলে, না হয় পর্‌বো গলায় ফাঁসি॥
*৯১০. রাগ: পিলু-খাম্বাজ, তাল: ঝাঁপতাল
আহ্‌মদের ঐ মিমের পর্দা উঠিয়ে দেখ্ মন।
(আহা) আহাদ সেথা বিরাজ করেন হেরে গুণীজন॥
যে চিন্‌তে পারে রয় না ঘরে হয় সে উদাসী,
সে সকল ত্যজে ভজে শুধু নবীজীর চরণ॥
ঐ রূপ দেখে পাগল হ’ল মনসুর হল্লাজ,
সে ‘আনল্ হক’ ‘আনল্ হক্’ ব’লে ত্যজিল জীবন॥
তুই খোদ্‌কে যদি চিন্‌তে পারিস্‌ চিন্‌বি খোদাকে,
তুই দেখ্‌রে তাই তোরই চোখে সেই নূরী রওশন॥
 

৯২৪
তাল : কাহারবা

ও ভাই     আমার এ না' যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী।
আমি       আপনারে ল'য়ে রে ভাই এপার ওপার করি॥
আমি       এই জলেরি আয়নাতে ভাই দেখেছিলাম তায়
এখন       আয়না আছে প'ড়ে রে ভাই আয়নার মানুষ নাই।
তাই        চোখের জলে নদীর জলে রে আমি তারেই খুঁজে মরি॥
আমি       তারির আশে তরী নিয়ে ঘাটে ব'সে থাকি,
আমার     তারির নাম ভাই জপমালা, তারেই কেঁদে ডাকি।
আমার     নয়ন-তারা লইয়া গেছে রে নয়ন নদীর জলে ভরি॥
ঐ          নদীর জলও শুকায় রে ভাই, সে জল আসে ফিরে
আর       মানুষ গেলে ফিরে নাকি দিলে মাথার কিরে।
আমি      ভালোবেসে গেলাম ভেসে গো আমি হলাম দেশান্তরী॥