পঞ্চাঙ্গনা
গীতি-আলেখ্য

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে, ভারতের মুসলিম শাসনামলের প্রখ্যাত পাঁচজন মুসলিম নারীকে নিয়ে একটি গীতি আলেখ্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নজরুল এর নাম দিয়েছিলেন 'পঞ্চাঙ্গনা'। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত এই পাঁচটি গানের সমন্বয়ে এই গীতি-নক্‌শাটি কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে আগষ্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার,৭ ভাদ্র ১৩৪৮)। সময়সীমা ছিল রাত ৮টা থেকে ৮-৩৯ মিনিট পর্যন্ত।

বেতার জগৎ-এর ১২শ বর্ষ ১৬শ সংখ্যার [পৃষ্ঠা: ৯৫৮] অনুষ্ঠান সূচী থেকে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো-

সম্প্রচার কেন্দ্র: কলকাতা কেন্দ্র
সম্প্রচারের সময় ও তারিখ: শনিবার, ২৩ আগষ্ট ১৯৪১, ৬ ভাদ্র ১৩৪৮। তৃতীয় অধিবেশন। ৮.০০-৮.৩৯।
অনুষ্ঠানের নাম: পঞ্চাঙ্গনা (সঙ্গীতালেখ্য)
রচনা ও প্রযোজনা: কাজী নজরুল ইসলাম
সঙ্গীতানুষঙ্গ: যন্ত্রীসঙ্ঘ
বর্ণনা: অনিল দাস
রূপদান: চিত্তরঞ্জন দাস, শৈলদেবী ও ইলা ঘোষ

এই গীতি-আলেখ্যের নারীরা ছিলেন

১. মমতাজ পুরো নাম মমতাজ মহল। ভারতবর্ষের পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী। এঁর প্রকৃত নাম ছিল আরজুমান্দ বানু। তাঁকে মুমতাজ বা মমতাজ নামে  ডাকা হতো। এই নামের অর্থ  'প্রাসাদের অলঙ্কার'। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে-তে শাহজাহানের সাথে মমতাজ মহলের বিবাহ হয়। ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান বুরহানপুরের বালাপুর দুর্গ পরিদর্শন করেন। সে সময় গর্ভবতী মমতাজ তাঁর সাথে ছিলেন। ১৭ জুন তিনি কন্যা সন্তান গওহর বেগমের জন্মদানকালে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর সাময়িকভাবে বুরহানপুরে তাঁর কবর দেওয়া হয়। পরে শাহজাহান ডিসেম্বর মাসে তাঁর দেহাবশেষ, সোনায় মোড়া বাক্সে আগ্রাতে নিয়ে আসেন এবং সাময়িকভাবে একটি স্থানে কবর দেন। এরপর শাহজাহান তাঁর স্মরণে তাজমহল নামক বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন এবং মমতাজের পুনরায় কবর দেওয়া হয় তাজমহলের ভিতরে। শাহজাহানের মৃত্যুর পর, ওই সমাধির ভিতরেই মমতাজের পাশে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়।

২. নূরজাহানমোগল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর স্ত্রী। পিতার নাম মির্জা গিয়াসউদ্দিন বেগ। ইরানী বংশোদ্ভুত গিয়াসবেগ ভাগ্যানুসন্ধানে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে কান্দাহারে গিয়াসবেগের স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। পিতামাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন মেহেরুন্নেসা।

মেহেরুন্নেসার বিবাহ হয়েছিল আলীকুলি নামক সেনাপতির সাথে।
পরে তিনি বঙ্গদেশে আসেন স্বামী আলীকুলির সাথে। বাংলাদেশে থাকার সময়, নুরজাহান একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। শের আফগান বাংলাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, জাহাঙ্গীর বাংলার শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন কোকাকে নির্দেশ দেন, যেন অতি দ্রুত শের আফগানকে বন্দী করে দিল্লীতে পাঠানো হয়। কুতুবউদ্দিন কোকা তাঁকে গ্রেফতার করতে গেলে, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং শের আফগান নিহত হন। এরপর মেহেরুন্নেসা এবং তাঁর শিশু কন্যাকে বন্দী করে আগ্রায় আনা হয়। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মেহেরুন্নেসার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে, জাহাঙ্গীর তাঁকে বিবাহ করেন এবং নাম দেন নুরজাহান।

নুরজাহান অত্যন্ত বিদুষী এবং অসামান্যা রূপবতী ছিলেন। মোগল দরবারে জাঁকজমক বৃদ্ধিতে তাঁর প্রভাব ছিল অসামান্য।  দৈহিক শক্তিতেও তিনি সাধারণ নারীদের চেয়ে অগ্রগামিনী ছিলেন। এছাড়া তিনি অসীম সাহসীও ছিলেন। কথিত আছে, একবার জাহাঙ্গীরের সাথে মৃগয়ায় গিয়ে তিনি নিজে একটি বাঘ শিকার করেছিলেন। এই কারণে, জাহাঙ্গীর তাঁকে একটি মূল্যবান অলঙ্কার উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। দয়া-দাক্ষিণ্যের ক্ষেত্রেও তাঁর সুনাম ছিল।

৩. চাঁদ সুলতানা
ভারতবর্ষের একমাত্র সুলতানা। তিনি ষোড়শ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের আহমদনগর রাজ্যের স্বাধীন সুলতান হুসাইন নিজাম শাহের (১৫৫৩-৬৫ খ্রিঃ) কন্যা ছিলেন। ঐতিহাসিকদের অনেকে তাঁকে 'চাঁদরানী' , 'চাঁদবিবি' , ও 'মহীয়সী চাঁদ', বলে অভিহিত করেছেন। বৈবাহিক সূত্রে তিনি বিজাপুরের স্বাধীন শাসক প্রথম আলী আদিল শাহের(১৫৫৮-১৫৮০) পত্নী ছিলেন। ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আহমদনগর রাজ্যের নাবালক সুলতান ভ্রাতুষ্পুত্র বুরহান নিজাম শাহের অভিভাবিকা হন। মোগল সম্রাট আকবর আহমদনগর রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা করলে, চাঁদবিবি আহমদনগর রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি শাহজাদা মুরাদের নেতৃত্বে মোগল বাহিনী আহমদনগর আক্রমণ করে। দীর্ঘ ৩ মাস অবরোধের পরও মোগল বাহিনী আহমদনগর দখলে ব্যর্থ হয়। মোগল সেনাপতি শাহাজাদা মুরাদ সন্ধির প্রস্তাব পাঠালে, প্রথমে চাঁদবিবি তা প্রত্যাখান করলেও পরে সন্ধি করেন। আহমদনগরবাসী চাদবিবির অসামান্য সাহসিকতা, রণনৈপুণ্য এবং শৌর্য-বীর্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে 'চাঁদসুলতানা' উপাধিতে ভূষিত করেন।

আমীর-ওমরাহ্দের ষড়যন্ত্র আর সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে দাক্ষিণাত্যবাসীদের দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে চাঁদ সুলতানাকে সম্ভবত বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। এরপর আহমদনগর ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়।

৪. আনারকলি
মোগল সম্রাট আকবরের পুত্র শাহাজাদা সেলিমের প্রেমিকা হিসেবে পরিচিতা। প্রকৃতপক্ষে এই নামে কোনো চরিত্র ছিল কিনা সে বিষয়ে সংশয় আছে। ধারণা করা হয় যে, আনারকলি কোন এক বণিক বহরের সাথে ইরান থেকে পাঞ্জাবে এসেছিলেন। ঘটনাক্রমে আনারকলি মোগল হেরেমে নর্তকী হিসেবে স্থান পান। এই সময় শাহজাদা সেলিমের (পরবর্তিতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত হন) সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্রাট আকবর বিষয়টি জানতে পেরে, আনারকলিকে দুটি ইটের দালানের মধ্যখানে জীবন্ত কবরস্থ করেন। তবে এই কবরের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। ষোড়শ শতাব্দীর একটি উপাখ্যান অবলম্বনে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ইমতিয়াজ আলি তাজ সেলিম এবং আনারকলির প্রেমকে উপজীব্য করে একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এই সূত্রে এই কাহিনীটি প্রতিষ্ঠা পায়।

৫. জেবুন্নেসা:
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা। ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, সম্রাজ্ঞী দিলরাস বানু বেগমের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জেবুন্নেসা বিদুষী ছিলেন। তিনি চিরকুমারী ছিলেন। আরবি, ফারসি আর উর্দু ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি  পারশ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
পঞ্চাঙ্গনার 'গীতি-আলেখ্য' অনুসারে গানগুলো ছিলো-
১. মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল। [তথ্য] [পাণ্ডুলিপি নমুনা]
২. নূরজাহান! নূরজাহান! [তথ্য] [পাণ্ডুলিপি নমুনা]
৩. চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা [তথ্য]
৪. আনারকলি! আনারকলি! [তথ্য]
৫. লুকায়ে রহিলে চিরদিন [তথ্য]

সূত্র: