নজরুলের নাটকের গান
সামগ্রিকভাবে নজরুলের রচিত নাটকের গানকে পৃথক করতে গেলে, নাট্যকারের বিচারে দুটি ধারার গান পাওয়া যায়। এই ধারা দুটি হলো-
নাট্যকার নজরুলের গান। অর্থাৎ যে সকল নাটক নজরুল রচনা করেছিলেন এবং ওই সকলে নাটকে ব্যবহৃত নজরুলের গান।
ভিন্ন নাট্যকারে রচিত নাটকে ব্যবহৃত নজরুলের গান।
নজরুলের
রচিত নাটকে নজরুলের গান
সাধারণভাবে মঞ্চে পরিবেশনযোগ্য
সংলাপ-প্রধান উপাখ্যান হলো নাটক। এর সংলাপ উপস্থাপিত হতে পারে গদ্যধর্মী, কাব্যধর্মী,
সঙ্গীতধর্মী বা মিশ্রধর্মী। এ সকল বিচারে নজরুলের রচিত নাটকগুলোকে বিভিন্ন
ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন-
গীতিনাট্য। নজরুলের নাটকের সূচনা হয়েছিল গীতিনাট্যের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।
তাঁর ১১-১৩ বৎসরের মধ্যে এই জাতীয় নাটকের সন্ধান পাওয়া যায় 'লেটোগান' হিসেবে।
লেটোগান
মূলত বর্ধমান অঞ্চলের যাত্রাগানের মতো এক ধরনের
পালাধর্মী লোকগান। গীত, বাদ্য, নৃত্য এবং অভিনয়ের
সমন্বয়ে এই পালা অভিনীত হয়ে থাকে। কোনো কোনো সময়ে
কোনো কোনো লেটো দল কবির লড়াই-য়ের মতো করে আসরে অবতীর্ণ হতেন। ধারণা করা হয়,
খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী এই গানের উদ্ভব হয়েছিল।
এই গানের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হতো কোনো কাহিনি। সাধারণত বাংলার
লোকগাঁথা, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি, ঐতিহাসিক কাহিনি, সামাজিক রঙ্গরস ও আটপৌরে
গ্রামীণ জীবন ইত্যাদিকে যাত্রার আঙ্গিকে তৈরি করা হতো।
সাধারণত শীতের ফসল ওঠার পর, অগ্রহায়ণ থেকে কার্তিক মাসের ভিতরে লেটোর আসর বসতো।
এই গান ছিল মূলত বর্ধমান অঞ্চলের
কৃষিজীবীদের মনোরঞ্জনের
জন্য।
লেটোগানের সামাজিক
প্রেক্ষাপট
সম্ভবত শুরু দিকে লেটো গানের কাহিনি নেওয়া হতো পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত
থেকে। কালক্রমে এতে যুক্ত হয় সমসাময়িক সামাজিক ঘটনাও। বর্ধমানে মুসলমানদের
আগমনের প্রথম পর্যয়ে লেটো গান, অভিজাত মুসলমান স্থানীয় শাসকদের ভিতরে এ গানের
প্রভাব পড়েনি। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে সাধারণ মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়
ধর্ম প্রচারের জন্য আসা মুসলমান পীরদের দ্বারা। গোড়ার দিকে মুসলমি শাসকরা এসব
ধর্মপ্রচারকদের নিষ্কর জমি প্রদান করতেন। এঁদের দ্বারা স্থানীয় প্রান্তিক
হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল বিহার
ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী সাধারণ মুসলমান। এসব
মুসলমানরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটো ছোটো মুসলমান পাড়া, মহল্লা বা গ্রাম তৈরি
করেছিল। তবে এই সময় রাজায় রাজায় যুদ্ধ ছিল রাজত্ব রক্ষায়। ভারতবর্ষে প্রায় সকল
প্রান্তেই এ যুদ্ধ ছিল মুসলমান ও অ-হিন্দু শাসকদের মধ্যে রাজত্বের লড়াই।
রাজত্ব রক্ষার জন্য স্থানীয় অ-হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজারা নিজেদের মধ্য বহু
যুদ্ধ করেছে। আর এরই মধ্যে বহিরগাত রাজ্যলোভী মুসলমানরা আধিপত্য বিস্তার করেছে।
রাজায় রাজায় যুদ্ধ চললেও সাধারণ হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ছিল।
শুরুর দিকে বর্ধমানের কৃষি এবং বিভিন্ন পেশার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিনোদনের জন্য
পালাধর্মী লেটো গানের সূচনা করেছিল। পরে স্থানীয় মুসলমান কৃষকদের
মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বর্ধমানের
মুসলমান কবিদের মধ্যে তা লেটো গান রচনা এবং চর্চা
ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময়ে এরা ছোটো ছোটো লেটো দল তৈরি করেছিল। মুসলমান
কবিরা ইসলামী কাহিনির পাশাপাশি, সনাতন হিন্দু
ধর্মের পৌরাণিক কাহিনি নিয়েও লেটো পালা তৈরি করতো।
ফলে গানের আবেদনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই
লেটো গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
গোড়ার দিকে হয়তো লেটোগান ছিল একক গানের দল। এরা কোনো পৌরাণিক কাহিনিকে গানে
গানে উপস্থাপন করতো। কে কত বড় কবিয়াল তার পরীক্ষার জন্য কবিয়ালরা নিজেদের মধ্যে
গানের যুদ্ধ শুরু করেছিল। কালাক্রমে লেটো গান কবিয়ালদের যুদ্ধই প্রাধ্যান্য লাভ
করেছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে লেটো গান হয়ে উঠেছিল কবি গানের লড়াই।
গোড়ার দিকে লেটো গান ছিল লোকশিক্ষামূলক গান। এ সময়ে আধ্যাত্মিকত্ত্বমূলক গানের
প্রাধান্য ছিল। এর অনুষঙ্গ হিসেবে ছিল ধর্মকথা ও দেহতত্ত্ব। এ সবের মধ্য দিয়ে
প্রচার করা হতো সততা ও কর্মনিষ্ঠার কথা।
পেশাদার লেটোর লড়াই
পালাধর্মী গান হিসেবে লেটো দলের আবির্ভাব হলেও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে
লেটো গান কবিদের লড়াই' গানে পরিণত হয়েছিল। এই সময় আসরে দু্জন কবিয়াল আসরে
নামতেন নিজ নিজ দলবল নিয়ে। এঁরা একটি কাহিনি সংক্ষেপে গানে গানে উপস্থাপন
করতেন। এরপর তিনি প্রতিপক্ষের কবিয়ালের প্রতি একটি প্রশ্ন রেখে আসর থেকে অবসর
নিতেন। এরপর আসরে অবতীর্ণ হতেন প্রতিপক্ষ কবিয়াল। তিনি প্রথম কবিয়ালের রেখে
যাওয়া প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং আসর ত্যাগ করার সময় প্রতিপক্ষের প্রতি একটি
প্রশ্ন রেখে যেতেন। এই ভাবে প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে লেটোর লড়াই চলতো।
লেটো
দলের বিন্যাস
পালাধর্মী গান হিসেবে লেটো দল তৈরি হতো একাধিক
কণ্ঠশিল্পী ও বাজনদার নিয়ে। এই দলটি পরিচালনা করতেন একজন প্রধান কবিয়াল। যিনি
গোদা কবি নামে পরিচিত ছিলেন। দলে অংশগ্রহণকারীরা বিষয় অনুসারে নানা নামে
অভিহিত হয়ে থাকে। যেমন-
লেটোর লড়াই
পালাধর্মী গান হিসেবে লেটো দলের আবির্ভাব হলেও
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে লেটো গান কবিদের লড়াই' গানে পরিণত হয়েছিল। এই সময় আসরে
দু্জন কবিয়াল আসরে নামতেন নিজ নিজ দলবল নিয়ে। এঁরা একটি কাহিনি সংক্ষেপে গানে
গানে উপস্থাপন করতেন। এরপর তিনি প্রতিপক্ষের কবিয়ালের প্রতি একটি প্রশ্ন রেখে
আসর থেকে অবসর নিতেন। এরপর আসরে অবতীর্ণ হতেন প্রতিপক্ষ কবিয়াল। তিনি প্রথম
কবিয়ালের রেখে যাওয়া প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং আসর ত্যাগ করার সময় প্রতিপক্ষের
প্রতি একটি প্রশ্ন রেখে যেতেন। এই ভাবে প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে লেটোর লড়াই চলতো।
সাধারণত
লেটোর আসর বসতো স্থানীয় কোনো ফাঁকা জায়গায়। লড়াইয়ে জেতা কবিয়াল খ্যাতির সূত্রের
দূরের দূরের গ্রামগুলোতে আমন্ত্রণ পেতেন। আর এসবই আমন্ত্রণের সূত্রে এঁদের
জীবিকা নির্বাহ হতো।
কাজী নজরুল ইসলাম
ও লেটো গান
কাজী নজরুল ইসলাম
১৯১০
বঙ্গাব্দে সংসারে অর্থাভাব দূর করার জন্য, ১১ বৎসর বয়সে
যখন
লেটো দলে যোগদান করেছিলেন,
সে সময়ে লেটো গান ছিল পুরোপুরি গানের লড়াইয়ের যুগ।
প্রথম দিকে তিনি লেটোর জন্য কাহিনি এবং গান রচনা করতেন। পরে লেটো দলে অভিনয়ও
করেছেন।
নজরুল ইসলামের লেটো গানের ওস্তাদ ছিলেন কাজী বজলে করীম। এই দলের তিনি গোদা কবি
ছিলেন। এই ওস্তাদের সংস্পর্শে এসে তিনি লেটো গান এবং নাচ শেখেন। এছাড়া লেটো দলে
ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন এই সময়। বিশেষ করে গান রচনা করা এবং তাতের
সুর-প্রয়োগের তালিমও পেয়েছিলেন গোদাকবি কাজী বজলে করীম-এর
কাছ থেকে। এরপর তিনি এই ওস্তাদের সূত্রে পালা পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠেন। ধীরে
ধীরে তিনি লেটো গানে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন যে, লোকে তাঁকে 'ভ্রমর কবি' নাম
দিয়েছিল।
গোদাকবি কাজী বজলে
করীম- বয়সের কারণে দল চালানো অসম্ভব হয়ে পড়লে, নজরুল ইসলাম এই দলের ওস্তাদ পদ
অধিকার করেন। এই সময়ে তাঁর রচিত বিখ্যাত নাটক ছিল 'মেঘনাদ বধ' বেশ সুনাম
কুড়িয়েছিল। এছাড়া তিনি রচনা করেছিলেন- চাষার সঙ, শকুনি বধ, দাতা কর্ণ, রাজপুত্র
কবি কালিদাস, আকবর বাদশা ইত্যাদি।
এই সময় গোদা কবি
কাজী বজলে করীমের
দলের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন শেখ চাকর গোদা। ফলে এই দুই গোদা কবির দলের মধ্যে
মাঝে মাঝে লেটোর লড়াই হতো।
প্রথম দিকে
শেখ
চাকরের দলের প্রাধান্য
ছিল। পরে নজরুল এই দলে যোগদানের পর, শেখ চাকরের আধিপত্য কমতে
থাকে।
শেখ
চাকর
নজরুলকে স্নেহ
করতেন এবং বয়সে অনেক ছোটো হলেও কবিয়াল হিসেবে নজরুলে সম্মান করতেন। তিনি
স্নেহ করে
নজরুলকে
'ব্যাঙাচি' নামে অভিহিত
করেছিল এবং বলেছিলেন এই ব্যাঙ্গাচি বড় হয়ে সাপ হবে।
তিনি নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে মুখে মুখে গান রচনার কৌশল শিখিয়েছিলেন। এই সূত্রে
শেখ
চাকরের
সাথে গভীর সম্পর্ক গড়র ওঠে এবং এক সময় তিনি
শেখ চাকরের
দলে যোগদান করেন।
মূলত
কাজী বজলে করীম
ও শেখ
চাকর
ছিলেন নজরুলের
গানের আদি গুরু। এঁদের
কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন হারমোনিয়াম
বাজানোর কৌশল, গান রচনার কৌশল এবং ছন্দ ও সুরের খেলা।
আরও শিখেছিলেন বিস্তারিতভাবে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি।
নজরুলের রচিত সকল লেটোগান উদ্ধার করা যায় নি। যেগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু গানের সাথে লেটো-পালার নাম পাওয়া যায়। এর বাইরে আবার কিছু গানের সাথে পালার নাম পাওয়া যায় না।
দেখুন: পূর্ণাঙ্গ তালিকা [১১-১৩]
নজরুলের লেটোগানের পর্ব
শেষ হয়েছিল ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের দিকে।
যতদূর জানা যায়, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের
ডিসেম্বরের দিকের (পৌষ-মাঘ ১৩১৯) এক শীতের রাতে এক বাঙালি ক্রিশ্চান গার্ড
সাহেব কিশোর নজরুলের গান শুনে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি তাঁকে
বাবুর্চির কাজের কথা বলে তাঁর প্রসাদপুরের বাংলোয় নিয়ে আসেন।
তারপর নানা জায়গা ঘুরে, সিয়ারসোল হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে
(১৩২৪ বঙ্গাব্দ), তাঁর ১৮ বৎসর বয়স নজরুল ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষার
পূর্বেই অর্থাৎ প্রিটেষ্ট পরীক্ষা ফেলে সেনাদলে নাম
লেখান। যুদ্ধ শেষে
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে (ফাল্গুন-চৈত্র
১৩২৬ বঙ্গাব্দ) করাচি থেকে কলকাতায় এসেছিলেন 'বাঙালি
পল্টন'-এর চূড়ান্ত অবলুপ্তির আগেই।
নজরুল করাচি থেকে সোজা চলে আসেন বন্ধু শৈলজানন্দের রামাকান্ত বোস
স্ট্রিটের পলিটেকনিক বোর্ডিং-এ। এখানে এক চাকর নজরুলের এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার
করায় এবং নজরুলের অবস্থানে মেসের অন্যান্য বাসিন্দার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হওয়ায় তিনি
নীরবে সে স্থান ত্যাগ করে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র
অফিসে এসে ওঠেন। এরপর তিনি সাত-আট দিনের জন্য চুরুলিয়া গ্রামের বাড়িতে যান। এখান
থেকে ফিরে তিনি রাজস্ব বিভাগে প্রাক্তন সৈনিক হিসেবে চাকরির আবেদন করেছিলেন। এই
সূত্রে তাঁর চাকরির সুযোগও হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি আর ওই চাকরিতে যোগদান করেন নি।
এপ্রিল মাসের পুরো সময়ে তিনি প্রায় কর্মহীন অবস্থায় কাটান। তবে ধারণা করা হয়,
এই সময় তিনি রচনা করেছিলেন একটি গান। লেটো গান রচনার দীর্ঘদিন পর
এটাই ছিল তাঁর রচিত প্রথম গান-'বাজাও
প্রভু বাজাও ঘন বাজাও'।
এই গানটির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল নজরুল-সঙ্গীতের দ্বিতীয় অধ্যায়।
এরপর থেকে তিনি মেতে উঠেন কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক রচনায়। প্রথম দিকে এসকল
রচনার অধিকাংশই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নাট্যধর্মী দুটি কবিতা রচনা
করেছিলেন। কবিতা দুটি হলো-
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের
৮ই নভেম্বর (মঙ্গলবার
২২ কার্তিক ১৩২৯ ) রাজদ্রোহিতার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায়, পত্রিকার
সম্পাদক নজরুল ইসলাম এবং মুদ্রাকর প্রকাশক আফজাল-উল হকের বিরুদ্ধে গ্রফতারি পরোয়ানা
জারি করা হয়। এই সময় ৩২ কলেজ স্ট্রিট থেকে আফজাল-উল হককে গ্রেফতার করা হয়। নজরুল
গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সমস্তিপুরে চলে যান। ২৩শে নভেম্বর (বৃ্হস্পতিবার, ৭ অগ্রহায়ণ
১৩২৯) বেলা ১২টার সময় নজরুলকে পুলিশ গ্রেফ্তার করে। এই উৎসুক জনতা তাঁকে দেখার জন্য
জড় হতে থাকলে, প্রশাসন নজরুলকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ২৪শ নভেম্বর (শুক্রবার,
৮ অগ্রহায়ণ ১৩২৯) পুলিশ প্রহরায় চট্টগ্রাম মেলে নজরুলকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ট্রেনটি
কলকাতায় পৌঁছায় সন্ধ্যাবেলায়। তাঁকে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে কলকাতা প্রেসিডেন্সি
জেলে রাখা হয়। ২৫শে নভেম্বর (শনিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৩২৯) তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়।
২৯শে নভেম্বর (বুধবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩২৯) ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের পুলিশ কোর্টের চিফ
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাশে হাজির করা হয়। এই দিন রাজাদ্রোহিতার মামলা শুরু
হয়। এই মামলায় বিনা পারিশ্রমিকে কবির পক্ষে মামলা চালান আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায়।
এই মামলায় পত্রিকার প্রকাশক আফজাল-উল হককে সরকার পক্ষের সাক্ষী করা হয়েছিল। শুনানি
শেষে নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়। '...টি-পট্টা
তুলতেই দেখতে পেলাম যে একখানা পত্র চাপা আছে, -নজরুলের পত্র। লিখেছে, আমার কথা
সে সব শুনেছে। আমি বহরমপুর বদলী হতে পারি না? তার পরে লিখেছে তার সময় ভালোই
কাটছে। শ্রীপূর্ণ দাস (মাদারীপুরের) একখানা নাটক লিখে দেওয়ার জন্যে তাকে
অনুরোধ করেছেন। তাই লিখছে সে তখন। শ্রীপূর্ণ দাস বাইরে গিয়ে একটি চারণ দল গঠন
করবেন। সেই চারণ দলের অভিনয়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন নাটকখানার। নজরুলের এই নাটক
লিখিত হয়েছিল, তার পাণ্ডুলিপি জেল হতে বাইরে নিরাপদে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়- বহরমপুর জেলে থাকার সময় নজরুল দুর্গাপূজা উপলক্ষে
একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এবং জেলের ভিতরে তা মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই নাটকটিও শেষ
পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। অন্যের রচিত নাটকে নজরুলের রচিত প্রথম গান
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই
জানুয়ারি (মঙ্গলবার ২রা মাঘ ১৩২৯) নজরলকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৭ই জানুয়ারি (বুধবার ৩রা মাঘ ১৩২৯) নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ১৩ই এপ্রিল (শুক্রবার ৩০ চৈত্র ১৩২৯), আলীপুর সেন্ট্রাল জেল নজরুলেক থেকে হুগলী জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময় কারা-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যে, তাঁকে বহরমপুর জেলে পাঠানো হবে। ১৪ই এপ্রিল তাঁকে নৈহাটি রেলস্টেশনে নামানো হয় সাধারণ কয়েদির পোশাকে এবং তাঁকে হুগলি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় রাজবন্দী হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন শামসুদ্দীন, পূর্ণচন্দ্র দাস, নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, সতীন্দ্রনাথ সেন, কবি খান মুহাম্মাদ মঈনুদ্দীন, সিরাজউদ্দীন, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়. গোপালচন্দ্র সেন প্রমুখ।
বহরমপুর জেলে থাকার সময় পূর্ণচন্দ্র দাসের সাথে নজরুলের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
পূর্ণচন্দ্র দাসের অনুরোধে তিনি একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'
গ্রন্থে এই বিষয়ে লিখেছেন-
উল্লিখিত পত্রের সূত্রে
জানা যায়,পূর্ণ দাস জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, 'মাদারীপুর শান্তিসেনা চারণদল' গঠন করেছিলেন।
নজরুলের যখন এই নাটকটি রচনা করেছিলেন, তখন হয়তো পূর্ণ দাস নজরুলকে এই চারণদল সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু তখনো এই নামে কোনো চারণ দল গড়ে উঠে নি। এই নাটকটি পূর্ণ দাস হারিয়ে ফেলেছিলেন।
কিন্তু এই নাটকের জন্য লিখিত একটি গান দুইজনের পরমার্শে এবং উৎসাহে নজরুল মাদারীপুর শান্তিসেনা চারণদলের জন্য একটি নাটক রচনা করেন।
বিজলী পত্রিকার '৪ শ্রাবণ ১৩৩০ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। এ
র পাদটীকায় লিখা ছিল 'মাদারীপুর শান্তি-সেনা চারণ দল'-এর জন্য লিখিত অপ্রকাশিত নাটক থেকে'।
ব্রহ্মমোহন ঠাকুর তাঁর 'নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা গ্রন্থে' গানটির 'রচনার স্থান ও কাল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন-'বহরমপুর জেলে
১৯২৩ সালের ১৮ই জুন থেকে ২০ জুলাই-এর মধ্যে লেখা'। পল্টন-ফেরত যথার্থ নাটকের জন্য লিখিত এটাই ছিল প্রথম গান। গানটি হলো-
পৌঁছেও গিয়েছিল, কিন্তু তার পরে নাকি পণ্ডুলিপিখানা হারিয়ে যায়...'।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই
ডিসেম্বর (শনিবার ২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩০ বঙ্গাব্দ) নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন ।
এর কিছুদিন পর 'ধুমকেতু'র কর্মসচিব শান্তিপদ সিংহ
শরৎচন্দ্রের 'চরিত্রহীন' উপন্যাসটির নাট্যরূপ
দিয়েছিলেন। এই
নাটকে দৃশ্য পরিবর্তনের সময়টুকু আনন্দদায়ক করার জন্যে নায়ক সতীশের বেসে
এক ভিখারীকে উপস্থিত করেছিলেন নাট্যকার। তার জন্যে গান দরকার। শ্রী
শান্তিপদ সিংহ নজরুলকে অনুরোধ জানায়য় পাত্র, পরিবেশ এবং পরিস্থিতি
অনুযায়ী তিনি লিখে দিয়েছিলেন বাউল সুরের একটি গান। এটাই ছিল অন্যের
রচিত নাটকে নজরুলের প্রথম গান। গানটি হলো-
[সূত্র: সম্পাদনাঃ আবদুল আজীজ আল আমান, স্বরলিপি:
নিতাই ঘটক, শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, অখণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭]
পেশাদারী নাটকের সাথে নজরুলের যোগাযোগ
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নজরুল বেশ অর্থসঙ্কটে পড়েন। নাট্যাচার্য শিশির
ভাদুরী নজরুলের সাহায্যার্থে কলকাতারা আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের
'বসন্তলীলা' নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেন। শিশির ভাদুরী ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র ১৩০০) মাসে এই নাটকের প্রিমিয়াম শো-এর আয়জন করেন।
এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। এই অনুষ্ঠানে নজরুল তাঁর 'বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করেন।
এছাড়া বসন্তদূতের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। এরপর এপ্রিল মাসের ৯ (বুধবার
২৭ চৈত্র ১৩০০) তারিখে শিশির ভাদুরী এই মঞ্চে নজরুলকে
সংবর্ধনা দেন। এই দুটি অনুষ্ঠানের সূত্রে নজরুলের সাথে বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছিল। এই
দুটি অনুষ্ঠানের সূত্রে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুরী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নাটকার মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়,
বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রমুখের সাথে বিশেষ সখ্য গড়ে উঠে।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের (১৩৩২ বঙ্গাব্দ) মাঝামঝি সময়ে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের সঙ্গে নজরুলের সাথে
পরিচয় ঘটেছিল। এই সময় মুকুন্দ দাস 'পল্লীসেবা' নামক একটি যাত্রাপালা রচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
তিনি নজরুলের অনুমতি নিয়ে এই নাটকে তাঁর দুটি গান ব্যবহার করেছিলেন। গান দুটি হলো-
পরে মুকুন্দ দাস কেয়া বাজারের বারোয়ারি তলায় যাত্রামঞ্চে নজরুলকে বিপ্লবী গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। নজরুল গেরুয়া রঙের জামা ও পাগড়ি পড়ে, মঞ্চে গান পরিবেশন করেছিলেন।
ঝিলিমিল নাটক ও নাট্যসঙ্কলন
মাসিক 'নওরোজ' পত্রিকার আষাঢ় ১৩৩৪ (জুন-জুলাই ১৯২৭) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল
নজরুলের রচিত 'ঝিলিমিলি' নামক নাটিকা। এটাই ছিল নজরুলের প্রথম প্রকাশিত নাটিক। কাজী
নজরুল ইসলামের রচিত একটি নাটিকাটি 'ঝলিমিলি' নামক নাট্য সংকলন হিসেবে প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ [নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৩০] মাসে।
এই নাটিকাতে ব্যবহৃত হয়েছিল ৪টি গান। এই গানগুলো হলো-
ঝলিমিলি' নামক নাট্য সংকলনের দ্বিতীয় নাটিকার প্রথম ও দ্বিতীয় দৃশ্য প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নওরোজ পত্রিকার 'শ্রাবণ ১৩৩৪' সংখ্যায়। পত্রিকায় প্রকাশের সময় এর নাম ছিল 'সারা ব্রিজ'। এই নাটিকার গানগুলো ছিল-
ঝিলিমিলি নাট্য-সঙ্কলনের অপর দুটি নাটিকা শিল্পী ও ভুতের নাটক প্রকাশিত হয়েছিল আরও পরে।