মোতাহার হোসেন-কে

১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট
কলিকাতা
১০.৩.২৮,
রাত্রি ২টা

প্রিয় মোতিহার!
    কাল সকালে তোমার চিঠি পেয়েছি। সুন্দরের ছোঁয়া-লাগা চিঠি। তারই আনন্দে অভিভূত হয়ে কেটেছে আমার দুটো দিন। দুটি কথা তাতেই এত মধু!
    কাল ঘুমুতে পারিনি। আজও কিছুতেই ঘুম এল না। তাই তোমায় চিঠি লিখতে বসে গেলাম।
    কাল থেকে মনে হচ্ছে, আমার সব অসুখ সেরে গেছে। সত্যি ভাই, আজ অনেকটা ভালো আছি।
    আজ ‘দেবদাস’ দেখতে গেছিলাম ছায়াচিত্রে – সে কথা পরে লিখছি। রোসো আগে দরকারি কথা কয়টা লিখে নিই।
    কাল আমার চিঠি পোস্ট করার একটু পরেই তোমার চিঠি এসে পঁহুচল।
    আমার চিঠি বোধ হয়, আজ সন্ধ্যয় পেয়েছ। না? আচ্ছা, তোমরা কলকাতার চিঠি কখন পাও, সকালে না সন্ধ্যায়? মনে করে লিখো কিন্তু।
    তাহলে আমি চিঠি দিয়ে তার পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় বসে বসে ভাবব যে, এতক্ষণ তুমি আমার চিঠি পড়ছ।
    আচ্ছা ভাই, আমার সব চিঠিই কি তোমার বোনকে২ দেখাও? বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে। চিঠিগুলো আবার ফিরিয়ে নাও তো?
    উনি যদি দেখেন সব চিঠি, তা হলে একটু সাবধানে লিখব, বন্ধু। বাপরে। ওঁর একটা চিঠি পেয়েই তার তাল আজও সামলাতে পারছিনে। ওঁকে রাগাবার দুঃসাহস আর আমার নেই।
    লিখি আর ভয়ে বুক দুরু দুরু করে কাঁপে, এই রে! বুঝি বা কোথায় কী বেফাঁস লিখে তাঁকে ‘খেলো’ করে ফেললাম। এই বুঝি ‘কবির খেয়াল’ হয়ে গেল লেখাটি!– এমনইতর এ ভয় সব।
    আচ্ছা, তোমাদের গণিতজ্ঞদের মতো দুটি লাইনে দু-হাজার কথার উত্তর লেখার কায়দাটা আমায় শিখিয়ে দেবে?
    গণিতের প্রতি আমার ভয় কি কোনো দিনই যাবে না? গণিতজ্ঞ লোকেরা বড্ড কঠোর নিষ্ঠুর হয় –এ অভিযোগের সদুত্তর তুমি ছাড়া বুঝি আরেকটা নেই জগতে। ওদের কেবল
intellect, heart নেই।
গণিতের প্রতি আমার ভয় কি কোনো দিনই যাবে না? গণিতজ্ঞ লোকেরা বড্ড কঠোর নিষ্ঠুর হয় –এ অভিযোগের সদুত্তর তুমি ছাড়া বুঝি আরেকটা নেই জগতে। ওদের কেবল
intellect, heart নেই।
    আমাদের যেমন
intellect, heart নেই। একেবারে যাকে বলে 'সিলি ফুল'।
    কিন্তু, একটা সত্যি কথা বলব? হেসো না কিন্তু। আমার এতদিনে ভারী ইচ্ছে করছে অঙ্ক শিখতে। হয়তো চেষ্টা করলে বুঝতে পারি এখনও জিনিসটে। আমি আমার এক চেনা অঙ্কের অধ্যাপকের কাছে পরশু অনেকক্ষণ ধরে আলাপ-আলোচনা করলাম অঙ্ক নিয়ে। এম.এ. ক্লাসে কী অঙ্ক কষতে হয় – সব শুনলাম সুবোধ বালকের মতো রীতিমতো মন দিয়ে। শুনে তুমি অবাক হবে যে, আমার এতে উৎসাহ বাড়ল বই কমল না। কেন যেন এখন আর অত কঠিন বোধ হচ্ছে না ও জিনিসটে। আমি যদি বি.এ.-টা পাস করে রাখতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম যে, এম.এ.-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কবিও হতে পারে ইচ্ছে করলে।
    যদি ঢাকায় থাকতাম, তাহলে তোমার কাছে আবার একবার যাদব চক্রবর্তীর
Algebra নিয়ে বসে যেতাম – একেবারে (a+b)2 থেকে শুরু করে। সত্যি ভাই মোতিহার, আমায় অঙ্ক শেখাবে? তাহলে ঢাকায় যেতে রাজি আছি। এমন অঙ্ক শিখিয়ে দিতে পারে না কেউ, যাতে করে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এম.এ.-কে হারিয়ে দিতে পারি?
    এখন কেবলই মনে হচ্ছে, কী ছাই করলাম কবিতা লিখে! তার চেয়ে অঙ্কর প্রফেসর হলে ঢের বেশি লাভবান হতে পারতাম।
    যাক। তোমার বোনকে বোলো, এত দূরে থেকেও তাঁর ভয় আর আমার গেল না। বেশি চা ও পান খেতে তিনি এমনই কথায় কথায় নিষেধ করেছিলেন, সেই অবধি ওই দুটো জিনিস মুখের কাছে তুলেই এতটুকু হয়ে যাই ভয়ে। হাত কাঁপতে থাকে। আমার স্কুলের অঙ্কের মাস্টার ভোলানাথ বাবুকে মনে পড়েও অত ভয় হয় না।
    ওকে বোলো, ‘অবুঝের মতো অত্যাচার’ করতে হয়তো এখন থেকে ভয়ই হবে।
    অঙ্কের মহিমা আছে বলতে হবে।
    কিন্তু মন কেন এমন করে অবুঝের মতো কেঁদে ওঠে? ওখানে যে আমি নাচার।
    ওঁকে একটা অনুরোধ করবে বন্ধু আমার হয়ে? বোলো – ‘যাকে ভাসিয়ে দিয়েছ স্রোতে, তাকে দড়ি বেঁধে ভাসিয়ো না! ওকে তরঙ্গের সাথে ভেসে যেতে দাও, পাহাড় কি চোরাবালি কি সমুদ্দুর এক জায়গায় গিয়ে সে ঠেকবেই।’ যেই সে স্রোতে ভাসতে যাবে, অমনি দড়ি ধরে টানবে – এ হয়তো তাঁর খেলা, আমার কিন্তু এ যে মৃত্যু।
    একটি ছোট্ট আদেশের বেড়া এমন অলঙ্ঘ্য হয়ে ওঠে, তা কে জানত!
    তোমার চিঠির কতকগুলো দরকারি কথার উত্তর দিতে হবে। কালকের চিঠিতে যা সব লিখেছি, তা তো তোমার চিঠির উত্তর নয়। তা হয়তো ‘কবির খেয়াল।’
    তবে ও রোগে তোমাকেও ধরেছে বলে তোমায় লিখতে ভয় নেই।
    এই চিঠি পড়ে যদি কেউ রাগ করেন, তাহলে তাঁকে বোলো – পাথরের রাগ করতে নেই। তাহলে পাথর নড়তে হয়?
    তোমার ব বেচারির বয়স কত হল! নিশ্চয়ই এখন ছেলেমানুষ। তার ওপর, তোমার মতো ছেলেমানুষ নিয়ে ঘর করা। ও ব্যাচারিরই বা দোষ কী?– দাঁড়াও বন্ধু, আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিই – তোমার বউ-ও কি আমার চিঠি পড়েন? দোহাই ভাই, ও কর্মটি কোরো না। এ চিঠি কেবল তোমার জন্য। আরেকজনকে তোমার বউ বেচারির বয়স কত হল! নিশ্চয়ই এখন ছেলেমানুষ। তার ওপর, তোমার মতো ছেলেমানুষ নিয়ে ঘর করা। ও ব্যাচারিরই বা দোষ কী?– দাঁড়াও বন্ধু, আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিই – তোমার বউ-ও কি আমার চিঠি পড়েন? দোহাই ভাই, ও কর্মটি কোরো না। এ চিঠি কেবল তোমার জন্য। আরেকজনকে
    আমি হাত গুনতে পারি। আমি জানি, তুমি যেদিন শিশির ভাদুড়ির ‘ভ্রমর’৪ দেখে এসেছিলে, সেদিন সারারাত বউ-এর রসনা-সিক্ত মধু-বিষের আস্বাদ পেয়েছিলে। অন্তত তাঁর মাথার কাঁটাগুলোর চেয়ে বেশি বিঁধেছিল তাঁর কথাগুলো সেদিন তোমার বুকে। তারপর সেদিন চাঁদনি-রাতে কোনো অপরাধের জন্য সারারাত ‘দেহি পদ-পল্লবমুদারম’ গাইতে হয়েছিল শ্রীমতীর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে! তোমার বউ-এর ভাগ্য ভালো ভাই, হিংসে হয় একবার! দেখো, তোমার বউ-ও এই চিঠি লেখার আর প্রিয় সম্ভাষণের ঘটা দেখে আমায় সতিন না ঠাওরান!
    যাক উড়ের লড়াই-এর মতো দাম্পত্য কলহ বলতে বহ্বারম্ভে লঘু-ক্রিয়া। এতদিনে তোমার চিরদিনের ‘ওগো’ সম্ভাষণের ফাটলে সিমেন্ট পড়েছে বোধ হয়। রোজকার মতো বাহুতে চুড়ির এবং বুকে নাকছাবির চাপে পুলক অনুভব করছ! আমি এইখানে থেকেই শান্তিমন্ত্র পাঠ করছি। তোমার শিগ্‌গির আর একটি খোকা হোক! বাঢ়ম!
    ভাগ্যিস এবার ‘সওগাতে’ কিচ্ছু লিখিনি, তাই ‘কারুর’ চোখে পড়ার সৌভাগ্য হয়ে গেছে আমার। সেই ‘কারুর’কে বোলো, লিখলে যে লেখা চোখে পড়ত – তাতে হয়তো চোখ করকর করত! চোখের জল চাই বলে কি ‘চোখের বালি’ হয়ে সেই জল দেখব?
    এতদিন লিখেছি বলেই হয়তো চোখে পড়িনি, আজ না লিখে যদি চোখে পড়ে থাকি, তাহলে আমার না-লেখা অক্ষয় হোক! ওর পরমায়ু বেড়ে যাক!– আমি কিন্তু ফাল্গুনের ‘সওগাত’ আজও চোখে দেখিনি। কাজেই ওতে কি আছে না আছে – জানিনে। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে হয়তো কিছু না কিছু লেখা দিতে পারতাম। ইচ্ছে করেই দিইনি। কিছু ভালো লাগছে না ছাই। কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করছে – নিরুদ্দেশভাবে। অনেক দূর-দূরান্তরে।
    আমার শাদা পাতার জয়জয়কার হোক। ওই পাতাটাই আজ অন্তত ভুল করেও এক-জনকে আমার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
    তোমার বোন ঢাকা থাকতে আমি ওখানকার কাজ নেব না– একথাও শুনেছ?
    যাক শুনেইছ যখন, তখন সব কথা খুলেই বলি। তার আগে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে নিই, তিনি আমার সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলেন? তিনি কি তাঁর এবং আমার সব কথাই তোমাকে বলেছেন? না তুমি আন্দাজি আঁচ করে নিয়েছ সব? তুমি কিন্তু খলিফা ছেলে! ভয়ানক দুষ্ট! কিউপিডের মতো।
    তোমার কাছে অন্তত আমার দিকটা তো আর লুকোছাপা নেই। আমার জীবনে এত বড়ো পরিবর্তন এত বড়ো সৌভাগ্য আর আসেনি, বন্ধু। যে বেদনার সাথিকে কবিতায় কল্পনায় স্বপ্নে খুঁজে ফিরেছি – রূপে রূপে যার স্ফুলিঙ্গ দেখেছি, তাকে দেখেছি – পেয়েওছি, বুকের বেদনায় চোখের জলে। কয় মুহূর্তের দেখা, তারই মাঝে তাঁর কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়তো বা কত অপরাধও করে ফেলেছি। পাওয়ার বেভুল আনন্দে যে আত্মবিস্মৃতি আমার ঘটেছে, তা তাঁর ঘটেনি। কাজেই আমি কী করেছি, না করেছি, কী লিখেছি, না লিখেছি তা আমার মনেও নেই, কোনোদিন মনে পড়বেও না। কেবল মনে আছে তাঁকে – তাঁর প্রতিটি গতি-ভঙ্গি, হাসি কথা চলাফেরা সব। ওই তিনদিনের দেখা তাঁকে – আজও তেমনই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার চোখের সামনে। তেমনি হাসি, তেমনি কথা – সব! ফিরে ফিরে মনে আসছে ওই তিনদিনের মানুষটি। একবার নয়, দু-বার নয়, দিনে হাজার বার করে। আমার সকল চিন্তা কল্পনা হাসি গান ঘুম জাগরণ – সব কিছুতে দিবারাত্তির জড়িয়ে আছে ওই কয়েক মুহূর্তের স্মৃতি। ওই তিনটি দিন আমার কাছে অন্তত কালের মতো অক্ষয় হয়ে রইল। তার আঘাত, বেদনা, অশ্রু আমার শাশ্বত লোকের শূন্য-ভাণ্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে। এর চেয়ে বেশি পেতে গেলে যে আঘাত পাব, তা সইতে পারব না, বন্ধু! যে পূজারি দেবতা প্রকাশের আরাধনা করে, তার মতো দুঃসাহসী বোধ হয় কেউ নেই। সুন্দর দেবতাও প্রথমে হয়তো দেখা দেন রূদ্ররূপে। সে আঘাত কি সকলে সইতে পারে?
    দূর থেকে অঞ্জলি নিবেদন করব – সকলের আড়ালে সরে গিয়ে আমার হৃদয়রক্ত দিয়ে তাঁকে সৃষ্টি করব, রাঙিয়ে তুলব– শুধু এইটুকু অহংকার থাকুক আমার। তাঁর পায়ের তলার পদ্মটিতেই আমার ধ্রুবকে পাই যেন, তার ঊর্ধ্বে তাকালে স্থির থাকতে পারব না।
    আমার পূজার উপচারের আড়ালে লুকাতে পারি যেন নিজেকে – দেবতা যেন পূজাই দেখতে পায় এবার – পূজারিকে নয়। আশীর্বাদ করো – ধ্রুবলোকে অক্ষয় হোক এবার।
    যাবার দিনে পরিপূর্ণ চিত্তে যেন বলে যেতে পারি, আমি ধন্য হয়ে গেলাম– আমি ভালোবেসে মরলাম। তাঁকে বোলো, আমার ধ্যান-লোকে তার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। আমার আর তাঁকে হারাবার ভয় নেই।
    দশই তারিখের লেখা চিঠিটা পোস্ট করিনি; রোজ মনে করছি – হয় তো তোমার চিঠি চলে আসবে আজ। তার পরই এটা দেব।
    আজ ১৮ই মার্চ। আমি চিঠি পোস্ট করছি ১০ই তারিখে, অন্তত ১২ই তারিখে তা পেয়েছ। পাওনি কি?
    আজও তার উত্তর দিলে না কেন? না, এরই মধ্যে পুরোনো হয়ে গেলাম, বন্ধু? যা হোক একটা লিখো – শান্তি পাব। সব কথার উত্তর না-ই দিলে, এমনি চিঠি দিয়ো।
    আমি এখন ভালো আছি। এ কয়দিন বিনা-কাজের ভিড়ে এক চিন্তা ছাড়া– লিখতে পারিনি কিছু।
    এর মধ্যে একটা মজা হয়ে গেছে। তেমন কিছু নয়, তবু তোমায় লিখছি। দৈনিক ‘বসুমতী’তে দিনকতক আগে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল যে, কোনো ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক মৃত্যুশয্যায় শায়িত – কোনো সুস্থকায় যুবকের কিছু রক্ত পেলে তিনি বাঁচতে পারেন। তিনি কলকাতাতেই থাকেন। আমি রাজি হয়েছি রক্ত দিতে। আজ ডাক্তার পরীক্ষা করবে আমায়। আমার দেহ থেকে রক্ত নিয়ে ওঁর দেহে দেবে। ভয়ের কিছু নেই এতে, তবে দু-চারদিন শুয়ে থাকতে হবে মাত্র। কী হয়, পরে জানাব – কাজেই দু চারদিন চিঠি দিতে দেরি হলে কিছু মনে কোরো না, লক্ষ্মীটি।
    তবে দু-চারদিন শুয়ে থাকতে হবে মাত্র। কী হয়, পরে জানাব – কাজেই দু চারদিন চিঠি দিতে দেরি হলে কিছু মনে কোরো না, লক্ষ্মীটি।
    আজ আর সময় নেই। এখুনি বেরুব ডাক্তারের কাছে। আমার বুক-ভরা ভালোবাসা নাও। তোমার ছেলেমেয়েদের চুমু খেয়ো আমার হয়ে।
    তাঁর খবর একটু দিস ভাই। এ-কয়দিন তো শুয়েই থাকব, ও-টুকু পেলেও বেঁচে যাব।

তোমার
নজরুল