মিস ফজিলতুন্নেসা-কে

১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট
সওগাত অফিস
কলিকাতা
শনিবার, রাত্রি ১২টা
    আজ ঈদ। ঈদ মোবারক। অসহায় হইয়া আপনার এই পত্র লিখিতেছি। যদি বিরক্ত করিয়া থাকি, মার্জনা করিবেন। আজ ১৪দিন হইল মোতাহার সাহেবের২ কোনো চিঠি পাই নাই। তাহার শেষ চিঠি পাইয়াছি ১০ই মার্চ। তাহার পর আমি তাহাকে দুইখানা পত্র দিয়াছি ১০ই ও ১৮ই মার্চ। আজও কোনো উত্তর না পাইয়া ছটফট করিতেছি। জানি না তিনি ঢাকায় আছেন কিনা, না অসুখ করিয়াছে – কত কী মনে হইতেছে। আপনার শারীরিক সংবাদটুকুও তাহার মারফতই পাইতাম। বড়ো উদ্‌বিগ্নে দিন কাটাইতেছি।
    আপনি যদি দয়া করিয়া – জানা থাকিলে আজ দু-লাইন লিখিয়া তাঁহার খবর জানান, তাহা হইলে সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকিব।
    তিনি আমার ওই চিঠি দুইখানা পাইয়াছেন কিনা জানেন কি? তিনি কি আমার উপর রাগ করিয়াছেন? না অন্য কারণ? জানা না থাকিলে জানাইবার দরকার নাই।
    আমি সওগাতের লেখা লইয়া বড়ো ব্যস্ত আছি। কলিকাতায় আরও দুই চারদিন আছি। পত্র সওগাতের অফিসের ঠিকানাতেই দিবেন।
    আপনার শরীর খুবই অসুস্থ দেখিয়া আসিয়াছিলাম। কেবলই মনে হয়, যেন আপনার শরীর ভালো নাই। দু-দিনের পরিচয়ের এত বড়ো আস্পর্ধাকে আপনি হয়তো ক্ষমা করিবেন না, তবু সত্য কথাই বলিলাম।
     – আপনাকে দিয়া বাংলার অন্তত মুসলিম নারী-সমাজের বহু কল্যাণ সাধন হইবে – ইহা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই আপনার অন্তত কুশল সংবাদটুকু মাঝে মাঝে জানিতে বড্ড ইচ্ছা করে। যদি দয়া করিয়া দুটি কথায় শুধু কেমন আছেন লিখিয়া জানান – তাহা হইলে আমি আপনার নিকট চির-ঋণী থাকিব। আমার ইহা বিনা অধিকারের দাবি।
    আমি এখন বেশ ভালোই আছি। আর একটা কথা। আপনি বার্ষিক সওগাতের জন্য একটি গল্প দিয়াছেন ‘শুধু দু-দিনের দেখা’ শীর্ষক।৩ সওগাত সম্পাদক আমায় তাহা দেখিয়া দিতে দিয়াছেন। কিন্তু আপনার অনুমতি ব্যতীত তাহার একটি অক্ষর বদলাইবারও সাহস নাই আমার, আমি লেখাটি পড়িয়াছি। যদি ধৃষ্টতা মার্জনা করেন – তাহা হইলে আমি উহার এক-আধটু অদল-বদল করিয়া ঠিক গল্প করিয়া তুলিবার চেষ্টা করি। সামান্য এক-আধটু বাড়াইয়া দিলেই উহা একটা ভালো গল্প হইবে। অবশ্য এ স্পর্ধা আমার নাই যে আপনার লেখার তাহাতে কিছুমাত্র সৌন্দর্য বা গৌরব বাড়িবে। মনে হয় গল্পটা বড্ড তাড়াতাড়ি লিখিয়াছেন। উহা যেন আপনার অযত্ন-লালিতা।
    অবশ্য আপনার অসম্মতি থাকিলে যেমন আছে তেমনটা ছাপিবেন সম্পাদক সাহেব। আপনার অমত থাকিলে স্পষ্ট করিয়া লিখিবেন, কিছু মাত্র দুঃখিত হইব না তাহাতে।
    আর আমার লিখিবার কিছু নাই। আপনার খবরটুকু পাইলেই আমি নিশ্চিত হইতে পারিব।
    হাঁ আর একটা কথা। আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভালো যেগুলি সেগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি ‘সঞ্চিতা’ নাম দিয়া।৪ খুব সম্ভব আর এক মাসের মধ্যেই উহা বাহির হইয়া যাইবে।
    আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানি। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই।৫ আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনে সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কী সম্মান করিব?
    সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পীড়া দিবেন না – এই আমার আকুল প্রার্থনা।
    দুই একদিনের মধ্যেই আমার লেখা সব বইগুলি পাঠাইয়া দিব আপনায়। আপনার মতো বিদূষী মহিলার পড়ার তাহা উপযুক্ত নয়, তবু দিব। আপনার আঙিনায় season flower-এর গাছ দেখিয়াছিলাম যেন। তাহারও তো যত্ন নেন দেখিয়াছি। সুতরাং আমার লেখাও ফেলিবেন না, ভরসা করি।
    একটু কষ্ট করিয়া আজই পত্র দিবেন। আপনার ভগ্নীদের ও ভাইকে স্নেহাশিস দিবেন।

ইতি–
নজরুল ইসলাম