মোতাহার হোসেন-কে

১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট
সওগাত অফিস
কলিকাতা
বিষ্যুতবার

প্রিয় মোতিহার!
    তোমার চিঠি রবিবার সকালে পেয়েছি কৃষ্ণনগরে – কলকাতা এসেছি তিন-চারদিন হল। এখন আবার দিলীপ ফিরে এসেছে – পরশু সকালে। এখন দিন-রাত গান আর গান। দুটো নতুন গান লিখেছি। গিয়ে শোনাব। কিন্তু পনেরোই তারিখ তো! যেতে পারছিনে, ভাই। বোধ হয় এপ্রিলের শেষ হপ্তায় যেতে পারব। এখন এত ব্যস্ত যে নিশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই।
    ওদিকে বুদ্ধদেবের দলও তাড়া দিচ্ছে যাবার জন্য এবং তাদের ওখানে ওঠার জন্য। একটা ঝগড়া বাধবে দেখছি। অবশ্য তোমারই জয় হবে – এটাও স্থির নিশ্চয়।
    চৈত্রের ‘প্রগতি’তে দুটো গজল বেরুবে আমার স্বরলিপি-সমেত। বেরুলে দেখো। বার্ষিক ‘সওগাত’ বেরুল। তোমার বোনকে পাঠালাম একখানা। তোমার খানা এঁরা পাঠাচ্ছেন বলে আর আমি পাঠালাম না। আমার দ্বিতীয় কবিতাটা যায়নি, আর জায়গা ছিল না বলে। সেটা বোধ হয় চৈত্রের ‘সওগাতে’ যাবে। চৈত্রের ‘সওগাত’ আর এক সপ্তাহের মধ্যে বেরুবে বলছেন। ‘রহস্যময়ী’ চৈত্রের সওগাতে যাবে না, বোধ হয় বৈশাখে যাবে।
    কতকগুলো লেখা জমেছিল, পাঠিয়ে দিলাম তোমার বোনকে। ভয়ে কিন্তু বুক দুরু দুরু করছে। না জানি কী শাস্তি ভোগ করতে হবে আবার। যাক, তেমন দেখি যদি, তাহলে আর পদ্মা পারই হব না। যদি খুব রাগেন, আমায় জানিয়ো।
    দিলীপ আবার আমায় কৃষ্ণনগর ধরে নিয়ে যাচ্ছে পরশু। কৃষ্ণনগরই ওর আসল বাড়ি। সেখানে তিন-চারদিন হবে হয়তো। তারপর কলকাতা ফিরে আসব। কৃষ্ণনগরের বাসা এবার তুলছি। কলকাতায় বাসা দেখছি – ওদের জন্য। ওরাও নাকি নিশ্চিন্ত হয় তাহলে এবং আমিও হই।
    আমার গ্রামোফোনে গান ১৪ই এবং ১৫ই এপ্রিল। চারখানা গান এবং দুটা আবৃত্তি দেব। দিলীপ, সাহানা, কে. মল্লিক প্রভৃতি আরও পাঁচ-সাতজন গাইয়ে আমার গান দেবেন এই সাথে।
    রেডিয়োতে সেদিন আবৃত্তি করিনি; কেন যেন ভালো লাগল না। তুমি ঠিক ধরেছ, তেওড়া তালে ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে গানটা গীত হবার আগেই আমার গান হয়েছিল। আবৃত্তি আমিই ইচ্ছা করে করিনি। রেডিয়োতে গান দেবার আর সময় হবে না এক সপ্তাহের মধ্যে।
    আজ খুব তাড়াতাড়ি লিখছি চিঠিটা – বড্ড সময়ের অভাব। যারা সব গ্রামোফোনে আমার গান দেবেন – তাঁদের সুর-শিক্ষা দিতে হচ্ছে।
    ...হ্যাঁ, ‘রহস্যময়ী’ কবিতাটা তুমি কোথায় পেলে সেদিন? যাক, যে রূপেই পাও, কেমন লেগেছে ওটা তোমার? এখানে সাহিত্যিক আসরে পড়েছিলাম ওটা, সকলেই ভয়ানক প্রশংসা করেছেন। বড়ো রথীরা বলেছেন, ওইটেই আমার লেখা শ্রেষ্ঠ
love poem, গিয়েই একদিন আবৃত্তি করে শোনাব।
    শফিক কি চলে গেছে? কোনদিন গেল? এখন তা হলে ওঁকে দেখাশোনা করছে কে? অবশ্য তুমি থাকতে ওঁর চিন্তা নেই। তবু রাত্রে তো ওঁকে হয়তো একা থাকতে হয়। যাক, সীমার অতিরিক্ত হয়তো চিন্তা ও প্রশ্ন করছি। ওঁর শরীর এখন কেমন? ওঁকে নিয়ে একি পাগলের মতো দুশ্চিন্তা আমার।...
    দিলীপ তোমাদের
Burdwan House-এ দু-দিন গেছিল বলল। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে খুব – বলল। তোমার এবং তোমার বোনের খুব প্রশংসা করল। আমায় যেতে বলেছে – তাও জানাতে ভোলেনি। ওঁর বাবা-মা কবে আসছেন? একটা কথা, কিছু মনে কোরো না, তুমি হঠাৎ আমাদের ভাই-বোন পাতিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়েছ কেন বলো তো। যদি ব্যবধানের নদী সৃষ্টি হয়েই যাবে আমাদের মধ্যে, আমি এপারেই থাকব, কাজ নেই আমার ওপারে গিয়ে মুখোশ পরে। আমি তোমাদের মতো হতে পারিনে, তা আর কী করবে বল। তাঁর ইঙ্গিতে যদি ও-কথা লিখে থাক, তা হলে তাঁকে বোলো, আমাকে ভয় করার তাঁর কিছুই নেই। আমি তাঁর বিনানুমতিতে গিয়ে বিরক্ত করব না – বা তাঁর শান্তির ব্যাঘাত করবনা। বন্ধু, তুমি, অনুগ্রহ করতে গিয়ে আর আমায় দুঃখ দিয়ো না। তুমি মনে করছ হয়তো, কত অসহায় আমি আজ! তাই বুঝি ওই মতলব ঠাউরিয়েছ, না? যাক, ওখানে গিয়ে এ নিয়ে দস্তুরমতো ঝগড়া করব তোমার সাথে। – হাঁ, কী নাটক লিখব বলো তো! ওদের ideal কী, তা তো জানা নেই। নাটকটা ওখানে গিয়েই লিখে দেব দু-দিনে।
    আমার ভালোবাসা নাও। খুব আনন্দে আছ, না? এখন নিজের বাড়িই শ্বশুরবাড়ি হয়ে গেছে বুঝি? তাড়াতাড়ি চিঠি দিয়ো। সতিন ভাবিকে সালাম। ছেলেমেয়েদের চুমু।

তোমার
নজরুল