বিরজাসুন্দরী দেবী-কে

৩৯, সীতানাথ রোড
১৬.৮.৩৫

শ্রীচরণকমলেষু

মা। তোমার চিঠি পেয়েছি পরশু। ছোটো মাসিমার স্বর্গারোহণের দিন ছিল সেদিন, তোমার মন ছিল দুঃখের বর্ষাসিক্ত তাই বুঝি চিঠিতে অত কথার ফুল ফুটেছিল। প্রাচ্যের ঋষিরা মৃত্যুকে কখনও জীবনের শেষ বলে মানেননি, বড়ো করে দেখেননি। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আত্মীয়েরা পরমাত্মীয় হন, প্রিয়জন প্রিয়তর হন। জীবনে যে থাকে চোখের সামনে, মরণে সেই পায় অন্তরের অন্তরতম লোকে অক্ষয় আসন। উপরকার মৃত্যু জীবনের পরম পরিণতির এক একটা ধাপ মাত্র। মৃত্যুর সিঁড়ি বেয়ে আমরা অগ্রসর হই অমৃতলোকের পানে, ভগবানের সান্নিধ্যে। তবু মৃতজনের জন্যে আমরা কাঁদি, আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ বলে। ছোটো মাসিমার মৃত্যু যদি কয়েক বছর আগে হত, খুব কাঁদতাম। এখন কাঁদি না। এখন আমার জীবনের যেন এই জীবনেই নবজন্মের সূচনা অনুভব করছি, মায়াময় সৃষ্টির বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছি, তাই কান্না পেলে হাসি। তোমাদের – বিশেষ করে তোমার স্নেহামৃত আমার এই ভাবী পরিণতির যে সহায়তা করেছে, তা হয়তো তুমিও জান না। পূর্বজন্মে কী ছিলাম জানি না, এই জন্মে কোন কূলে কেন জন্মেছি জানি না, জানি আমার অনাগত জন্মকে, তাকেই আমি শ্রদ্ধা করি বিশ্বাস করি। সেই অনাগত জন্মে জগজ্জনীর চরণে আমার পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনের তপস্যার সিদ্ধি দিনে তোমাকে আরও বেশি করে স্মরণ করব – আমার প্রথম গুরু বলে, আদি মাতৃমূর্তি বলে। এখন রাঙাদা৩ আমার উপর এতটা নির্ভর করেন, এ আমার সৌভাগ্যের কথা, কিন্তু আমি জানি, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আমি এখন রাঙাদা কেন – কারোরই কোনো পার্থিব উপকার করতে পারিনে। যা করেন, ওঁর জেঠিমা৪ ও তোমাদের মেয়ে দুলি৫। স্নেহ-মায়ার দিক দিয়ে আমি প্রায় নির্লিপ্ত। সংসারের যেটুকু কাজ মহামায়া আমায় দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন, তা সে ইচ্ছাময়ীরই ইচ্ছা, আর আমার পাপের ভোগ ও প্রায়শ্চিত্ত। আমার বিচিত্র জীবনে সহস্রবার পড়েছি আবার উঠেছি – সেই ওঠাপড়ার দ্বন্দ্বে যখন ক্ষতবিক্ষত, তখন তুমি এসেছিলে আদি জননীর প্রতিভূ হয়ে। দ্বন্দ্বের আজও অবসান হয় নাই, কবে হবে মা-ই জানেন। কিন্তু এখন আর ভাবনা নাই মা আমার, পাপ-পুণ্য সকল কিছু নিবেদন করেছি ‘মা’ অম্বিকার শ্রীচরণে। এখন ‘যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি’ অবস্থা। তোমাদের সঙ্গে দেখা হল, তোমাদের বহু ক্ষতি করলাম, আবার দেখা হল, এসব তাঁরই লীলা। তোমাদের বহুজন্মের শত্রু – এবারেও বহু ক্ষতি করে গেলাম, কত লাঞ্ছনা গঞ্জনা তোমরা সয়েছ আমার জন্যে – সব স্মরণ করি অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে। শুধু এই প্রার্থনা করি, যেন আর কখনও তোমাদের কোনো ক্ষতি না করি, ব্যথা না দিই। আমার যারা ক্ষতি করছে, নিন্দা করেছে বা আজও করে তাদের কারোর উপরই আমার কোনো অনুযোগ অভিযোগ নেই আজ। আমার আনন্দ, আমি সর্বান্তঃকরণে সকলকে ক্ষমা করতে পেরেছি। যে নিন্দা করে তাকেও ভালোবাসতে পেরেছি। শ্রীমান শংকর বাবাজীবন মহাপুরুষ – কর্মযোগের জন্য জন্মেছে – এ আমার গুরুদেবের উক্তি। ওর যদি সংসারে আসক্তি জন্মে তবেই ও সংসারবলি হবে। ওকে, অনন্তকে মার চরণে নিবেদন করে দিয়েছিলাম। মা-ই রক্ষা করেছেন। ওর হাত দিয়ে মায়ের পূজা পাঠিয়ে দিয়ে ভালো হল। বউদিকে প্রণাম দিয়ো। ওঁকে বোলো, আর সকলে শ্রীমানকে দেখতে গেছিলেন, আমি শুধু প্রার্থনা করেছি ভগবানের চরণে। সকলের সব অধিকার থাকে না। ভগবান দেখার পূর্ণ অধিকার আমায় না দিলেও নীরবে দূরে প্রার্থনা করার অধিকারও কেড়ে নেননি। শ্রীমানকে এখন বাড়ি নিয়ে এসো এই কামনা করি। শ্রীমান অন্তত৬ এখন ভালোর দিকে। মাতৃভক্তের সন্তান, ওর ভয় নেই। তোমার শরীর কেমন তা এখান থেকেই বুঝতে পারছি। অন্যান্য খবর আর সকলের চিঠিতেই জানবে। প্রার্থনা করো যেন শীঘ্র সংসারে সকল ঋণ-মুক্ত হই। আমার কোটি প্রণাম নাও। মানসবাবুকে প্রীতি জীবনকে৭ স্নেহাশিস দিয়ো। মুক্তি সেবিকা দিদিকে প্রণাম। ইতি।

প্রণত
নুরু।