মেহের-নেগার
করাচী সেনানিবাসে থাকার সময় নজরুল 'মেহের-নেগার ' নামক গল্প রচনা করেন। এই গল্পটি তিনি ডাকযোগে সওগাত পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। গল্পটি 'নূর' পত্রিকার 'মাঘ ১৩২৬' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এই  গল্পটি ' রিক্তের বেদন' গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

[ ক ]

ঝিলম্

বাঁশি বাজছে, আর এক বুক কান্না আমার গুমরে উঠছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হল তখন, যখন বৈশাখের গুমোটভরা উদাস-মদির সন্ধ্যায় বেদনাতুর পিলু-বারোঁয়া রাগিণীর ক্লান্ত কান্না হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরুচ্ছিল। আমাদের দুজনারই যে এক-বুক করে ব্যথা, তার অনেকটা প্রকাশ পাচ্ছিল ওই সরল-বাঁশের বাঁশির সুরে। উপুড়-হয়ে-পড়ে-থাকা সমস্ত স্তব্ধ ময়দানটার আশে-পাশে পথ হারিয়ে গিয়ে তারই উদাস প্রতিধ্বনি ঘুরে মরছিল! দুষ্ট দয়িতকে খুঁজে খুঁজে বেচারা কোকিল যখন হয়রান পেরেশান হয়ে গিয়েছে, আর অশান্ত অশ্রুগুলো আটকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় বারংবার চোখ দুটোকে ঘষে ঘষে কলিজার মতো রক্ত-লোহিত করে ফেলেছে, তখন তরুণী কোয়েলিটা তার প্রণয়ীকে এই ব্যথা দেওয়ায় বোধ হয় বাস্তবিকই ব্যথিত হয়ে উঠেছিল, – কেননা, তখনই কলামোচার আমগাছটার আগডালে কচি আমের থোকার আড়ালে থেকে মুখ বাড়িয়ে সকৌতুকে সে কুক দিয়ে উঠল ‘কু-কু-কু’। বেচারা শ্রান্ত কোকিল তখন রুদ্ধকণ্ঠে তার এই পাওয়ার আনন্দটা জানাতে আকুলি বিকুলি করে চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তু ডেকে ডেকে তখন তার গলা বসে গিয়েছে, তবু অশোক গাছ থেকে ওই ভাঙা গলাতেই তার যে চাপা বেদনা আটকে যাচ্ছিল, তারই আঘাত খেয়ে সাঁঝের বাতাস ঝিলমতীরের কাশের বনে মুহুর্মুহু কাঁপন দিয়ে গেল।

আমি ডাক দিলুম, ‘মেহের-নেগার’! কাশের বনটা তার হাজার শুভ্রশিষ দুলিয়ে বিদ্রুপ করলে, ‘…আ…র’! ঝিলমের ওপারের উঁচু চরে আহত হয়ে আমারই আহ্বান কেঁদে ফেললে, আর সে রুদ্ধশ্বাসে ফিরে এসে এইটুকু বলতে পারলে, ‘মেহের-নেই-আর’!

পশ্চিমে সূর্যের চিতা জ্বলল এবং নিবে এল। বাঁশির কাঁদন থামল। মলয়-মারুত পারুল বনে নামল বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে। পারুল বললে, ‘উ-হু’ –মলয় বললে, ‘আ-হা–আঃ’।

আমি বুক ফুলিয়ে চুল দুলিয়ে মনটাকে খুব একচোট বকুনি দিয়ে আনন্দভৈরবী আলাপ করতে করতে ফিরলুম – আমার মতো অনেক হতভাগারই ওই ব্যথাবিজড়িত চলার পথ ধরে। এমন সাধা গলাতেও আমার সুরটার কলতান শুধু হোঁচট খেয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। আমার কিন্তু লজ্জা হচ্ছিল না। আমার বন্ধু তানপুরাটা কোলে করে তখন শ্রীরাগ ভাঁজছেন দেখলুম। তিনি হেসে বললেন, ‘কি য়ুসোফ! এ-আসন্ন সন্ধ্যা বুঝি তোমার আনন্দ-ভৈরবী আলাপের সময়? তুমি যে দেখছি অপরূপ বিপরীত!’ আমার তখন কান্না আসছিল। হেসে বললুম, ‘ভাই তোমার শ্রীরাগেরও তো সময় পেরিয়ে গেছে। সে বললে তাই তো! কিন্তু তোমার হাসি আজ এত করুণ কেন, –ঠিক পাথর-খোদা মূর্তির হাসির মতো হিম-শীতল আর জমাট? আমি উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলুম।

আদরিনী অভিমানী বধূর মতো সন্ধ্যা তার মুখটাকে ক্রমশই কালিপানা আঁধার করে তুলছিল। এমন সময় কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির এক-আকাশ তারা তাকে ঘিরে বললে, ‘সন্ধ্যারানি! বলি এত মুখভার কীসের? এত ব্যস্ত হসনে লো, ওই চন্দ্রদেব এল বলে!’ অপ্রতিভ বেচারি সন্ধ্যার মুখে জোর করে হাসার সলজ্জ-মলিন ঈষৎ আলো ফুটে উঠল। চাঁদ এল মদখোর মাতালের মতো টলতে টলতে, চোখ মুখ লাল করে। এসেই সে জোর করে সন্ধ্যা বধূর আবরু ঘোমটা খুলে দিলে। সন্ধ্যা হেসে ফেললে। লুকিয়ে-দেখা বউ-ঝির মতো একটা পাখি বকুল গাছের থেকে লজ্জারাঙা হয়ে টিটকারি দিয়ে উঠল, ‘ছি-ছি’। তারপর চাঁদে আর সন্ধ্যায় অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়ে সন্ধ্যার চিবুক আর গাল বেয়ে খুব খানিক শিশির ঝরবার পর সে বেশ খুশি মনেই আবার হাসি-খেলা করতে লাগল। কতকগুলো বেহায়া তারা ছাড়া অধিকাংশকেই আর দেখা গেল না।

আমার বিজন কুটিরে ফিরে এলুম। চাঁদ উঠেছে, তাই আর প্রদীপ জ্বাললুম না। আর, জ্বালালেও দীপশিখার ওই ম্লান ধোঁয়ার রাশটা আমার ঘরের বুকভরা অন্ধকারকে একেবারে তাড়াতে পারবে না। সে থাকবে লুকিয়ে পাতার আড়ালে, ঘরের কোণে, সব জিনিসেরই আড়ালে; ছায়া হয়ে আমাকে মধ্যে রেখে ঘুরবে আমারই চারপাশে! চোখের পাতা পড়তে না পড়তে হড়পা বানের মতো হুপ করে আবার সে এসে পড়বে – যেই একটু সরে যাবে এই দীপশিখাটি! – ওগো আমার অন্ধকার! আর তোমায় তাড়াব না। – আজ হতে তুমি আমার সাথি, আমার বন্ধু, আমার ভাই!– বুঝলে ভাই আঁধার, এই আলোটার পেছনে খামখা এতগুলো বছর ঘুরে মরলুম!

আমি বললুম, ‘ওগো মেহের-নেগার! আমার তোমাকে চাই-ই। নইলে যে আমি বাঁচব না! তুমি আমার। নইলে এত লোকের মাঝে তোমাকে আমি নিতান্ত আপনার বলে চিনলুম কী করে? – তুমিই তো আমার স্বপ্নে পাওয়া সাথি! – তুমি আমার, নিশ্চয়ই আমার!’ – চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে সে আমার পানে চাইলে, পলাশ ফুলের মতো ডাগর টানাটানা কাজল-কালো চোখ দুটির গভীর দৃষ্টি দিয়ে আমার পানে চাইলে! কলসিটি-কাঁখে ওই পথের বাঁকেই অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সে। তারপর বললে, ‘আচ্ছা,– তুমি পাগল?’ – আমি ঢোক গিলে, একরাশ অশ্রু ভিতর দিকে ঠেলে দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললুম, ‘হুঁ’! তার আঁখির ঘনকৃষ্ণ পল্লবগুলোতে আঁশু উথলে এল! তারপর সে তাড়াতাড়ি চলে যেতে যেতে বললে, ‘আচ্ছা, আমি তোমারই!’

একটা অসম্ভব আনন্দের জোর ধাক্কায় আমি অনেকক্ষণ মুষড়ে পড়েছিলুম। চমকে উঠে চেয়ে দেখলুম, সে পথের বাঁক ফিরে অনেক দূর চলে যাচ্ছে।

আমি দৌড়ুতে দৌড়ুতে ডাকলুম, ‘মেহের-নেগার’! সে উত্তর দিল না। কলসিটাকে কাঁখে জড়িয়ে ধরে ডান হাতটাকে তেমনি ঘন ঘন দুলিয়ে সে যাচ্ছিল। তারপর তাদের বাড়ির সিঁড়িতে একটা পা থুয়ে দিয়ে আমার দিকে তিরস্কার-ভরা মলিন চাওয়া চেয়ে গেল। আর বলে গেল, ‘ছি! পথে-ঘাটে এমন করে নাম ধরে ডেকো না! – কী মনে করবে লোকে!’ পথ না দেখে দৌড়ুতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে একবার পড়ে গেছিলুম, তাতে আমার নাক দিয়ে তখনও ঝরঝর করে খুন ঝরছিল! আমি সেটা বাঁ-হাত দিয়ে লুকিয়ে বললুম, ‘আঃ, তাইতো। – আর অমন করে ডাকব না।’

বুঝলে সখা আঁধার! যে জন্মান্ধ, তার তত বেশি যাতনা নেই, যত বেশি যাতনা আর দুঃখ হয় – একটা আঘাত পেয়ে যার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে যায়। কেননা, জন্মান্ধ তো কখনও আলোক দেখেনি। কাজেই এ জিনিসটা সে বুঝতে পারে না,আর যে জিনিস সে বুঝতে পারে না তা নিয়ে তার তত মর্মাহত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। আর, এই একবার আলো দেখে তারপর তা হতে বঞ্চিত হওয়া, – ওঃ কত বেশি নির্মম নিদারুণ!

তোমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার যে প্রতিশোধ নিলে তুমি, তাতে ভাই আঁধার, আর যেন তোমায় ছেড়ে না যাই। তোমায় ছোটো ভেবে এই যে দাগা পেলাম বুকে ওঃ তা, –

সেদিন ভোরে ঝিলম নদীর কূলে তার সঙ্গে আবার দেখা হল। সে আসছিল একা নদীতে স্নান করে। কালো কশকশে ভেজা চুলগুলো আর ফিরোজা রঙের পাতলা উড়ানিটা ব্যাকুল আবেগে তার দেহ-লতাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আকুল কেশের মাঝে সদ্যস্নাত সুন্দর মুখটি তার দিঘির কালোজলে টাটকা ফোটা পদ্মফুলের মতো দেখাচ্ছিল। দূরে একটা জলপাই গাছের তলায় বসে সরল রাখাল বালক গাচ্ছিল, –

গৌরী ধীরে চলো, গাগরি ছলক নাহি যায় –
শিরোপরি গাগরি, কমর মে ঘড়া,
পাতরি মকরিয়া তেরি বলখ না যায়, আহা টুট না যায়; –
গৌরী ধীরে চলো।

আমিও সেই গানের প্রতিধ্বনি তুলে বললুম, ‘ওগো গৌরবর্ণা কিশোরী, একটু ধীরে চলো, – ধীরে। – তোমার ভরা কুম্ভ হতে জল ছলকে পড়বে যে। অত সূক্ষ্ম তোমার কটিদেশ ভরা গাগরি আর ঘড়ার ভারে মুচকে ভেঙে যাবে যে! ওগো তন্বী গৌরী, ধীরে একটু ধীরে চলো!’ আমায় দেখে তার কানের গোড়াটা সিঁদুরের মতো লাল হয়ে উঠল। আমার দিকে শরম-অনুযোগভরা কটাক্ষ হেনে সে বললে, ছি, ছি, সরে যাও। একী পাগলামি করছ?’ – আমি ব্যথিত-কণ্ঠে ডাকলুম, ‘মেহের-নেগার!’ সে একবার আমার রুক্ষ কেশ, ব্যথাতুর মুখ ধুলিলিপ্ত দেহ আর ছিন্ন মলিন বসন দেখে কী মনে করে চুপটি করে দাঁড়াল। তারপর ম্লান হেসে বললে ‘ও হল! আমার নাম “মেহের-নেগার” কে বললে? – আচ্ছা, তুমি আমায় ও নামে ডাক কেন? সে তোমার কে?’ আমি দেখলুম, কী একটা ভীতি আর বিস্ময় তার স্বরটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল। তার শঙ্কাকুল বুকে ঘন স্পন্দন মূর্ত হয়ে ফুটল। আমারও মনে অমনি বিস্ময় ঘনিয়ে এল। দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছিল। তাই তার গায়ে হেলান দিয়ে বললুম, ‘আহ! তুমি তবে সে নও? না-না, তুমি তো সেই আমার – আমার মেহের-নেগার! অমনই হুবহু মুখ, চোখ, – অমনই ভুরু, অমনই চাউনি, অমনই কথা! – না গো-না, আর আমায় প্রতারণা কোরো না। তুমি সেই! তুমি –‘! সে বললে, আচ্ছা, মেহের-নেগারকে কোথায় দেখেছিলে?’ আমি বললুম, ‘কেন, খোওয়াবে!’ তার মুখটা এক নিমিষে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তার সাদা মুখে আবার রক্ত দেখা গেল। সে ঝরনার মতো ঝরঝর করে হাসির ঝরা ঝরিয়ে বললে, ‘আচ্ছা, তুমি কবি, না চিত্রকর?’ আমি অপ্রতিভ হয়ে বললুম, ‘চিত্র ভালোবাসি, তবে চিত্রকর নই। আমি কবিতাও লিখি, কিন্তু কবি নই।’ সে এবার হেসে যেন লুটোপুটি খেতে লাগল।

আমি বললুম, ‘দেখ, তুমি বড্ড দুষ্টু!’ সে বললে, ‘আচ্ছা, আমি আর হাসব না! তুমি কীসের কবিতা লেখ?’ আমি বললুম, ‘ভালোবাসার!’

সে ভিজা কাপড়ের একটা কোণ নিংড়াতে নিংড়াতে বললে, ‘ও তাই, – তা কাকে উদ্দেশ করে?’

আমি সেইখানেই সবুজ ঘাসে বসে পড়ে বললুম, ‘তোমাকে – মেহের-নেগার! তোমাকে উদ্দেশ করে।’ আবার তার মুখে যেন কে এক থাবা আবির ছড়িয়ে দিলে। সে কলসিটা কাঁখে আর একবার সামলে নিয়ে বললে, ‘তুমি কদ্দিন হতে এরকম কবিতা লিখছ?’ আমি বললুম, ‘যেদিন হতে তোমায় খোওয়াবে দেখেছি।’ সে বিস্ময়-পুলকিত নেত্রে আমার দিকে একবার চাইলে, তার পর বললে, ‘তুমি এখানে কী কর?’ আমি বললুম, ‘গান-বাজনা শিখি।’ সে বললে, ‘কোথায়?’ আমি বললুম, ‘খাঁ সাহেবের কাছে।’ সে খুব উৎসাহের সঙ্গে বললে, ‘একদিন তোমার গান শুনবখন। – শুনাবে?’ তারপর চলে যেতে যেতে পিছন ফিরে বললে, ‘আচ্ছা, তোমার ঘর কোন্খানে?’ আমি বললুম, ‘ওয়াজিরিস্তানের পাহাড়।’ সে অবাক বিস্ময়ে ডাগর চক্ষু দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চাইলে; তারপর স্নিগ্ধকণ্ঠে বললে, ‘তুমি তাহলে এদেশের নও? এখানে নূতন এসেছ?’ – আমি তার চোখে রেখে বললুম, ‘হুঁ,– আমি পরদেশি।’ … সে চুপি চুপি চলে গেল আর একটিও কথা কইলে না। … আমার গলার তখন বড্ড বেদনা, কে যেন টুঁটি চেপে ধরেছিল। পেছন হতে ঘাসের শ্যামল বুকে লুটিয়ে পড়ে, আবার ডাকলুম তাকে। কাঁখের কলসি তার ঢিপ করে পড়ে ভেঙ্গে গেল। সে আমার দিকে একটা আর্তদৃষ্টি হেনে বললে, ‘আর ডেকো না অমন করে।’ দেখলুম তার দুই কপোল দিয়ে বেয়ে চলেছে দুইটি দীর্ঘ অশ্রু-রেখা।

 

[ খ ]

প্রাণপণে চেষ্টা করেও সেদিন সুর-বাহারটার সুর বাঁধতে পারলুম না। আদুরে মেয়ের জেদ-নেওয়ার মতো তার ঝংকারে শুধু একরোখা বেখাপ্পা কান্না ডুকরে উঠছিল। আমার হাতে আমার এই প্রিয় যন্ত্রটি আর কখনও এমন অশান্ত অবাধ্য হয়নি, এমন একজিদে কান্নাও কাঁদেনি। আদর-আবদার দিয়ে অনেক করেও মেয়ের কান্না থামাতে না পারলে মা যেমন সেই কাঁদুনে মেয়ের গালে আরও দু-তিন থাপ্পড় বসিয়ে দেয়, আমিও তেমনই করে সুর-বাহারের তারগুলোতে অত্যাচারের মতো হাত চালাতে লাগলুম। সে নানান রকমের মিশ্রসুরে গোঙানি আরম্ভ করে দিলে!

ওস্তাদজী আঙ্গুর-গালা মদিরার প্রসাদে খুব খোশ-মেজাজে ঘোর দৃষ্টিতে আমার কাণ্ড দেখছিলেন। শেষে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি বাচ্চা, তোর তবিয়ত আজ ঠিক নেই, – না? মনের তার ঠিক না থাকলে বীণার তারও ঠিক থাকে না। মন যদি তোর বেসুরা বাজে, তবে যন্ত্রও বেসুরা বাজবে, এ হচ্ছে খুব সাচ্চা আর সহজ কথা। – দে আমি সুর বেঁধে দিই!’ ওস্তাদজি বেয়াদব সুর-বাহারটার কান ধরে বার কতক মোলায়েম ধরনের কানুটি দিতেই সে শান্তশিষ্ট ছেলের মতো দিব্যি সুরে এল। সেটা আমার হাতে দিয়ে, সামনের প্লেট হতে দুটো গরম গরম শিক কাবাব ছুরি দিয়ে ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, একবার বাগেশ্রী রাগিণীটা আলাপ কর তো বাচ্চা! হাঁ, – আর ও সুরটা ভাঁজবারও সময় হয়ে এসেছে। এখন কত রাত হবে? হাঁ, আর দেখ বাচ্চা, তুই গলায় আর একটু গমক খেলাতে চেষ্টা কর তাহলেই সুন্দর হবে।’ কিন্তু সেদিন যেন কণ্ঠভরা বেদনা! সুরকে আমার গোর দিয়ে এসেছিলুম ওই ঝিলম দরিয়ার তীরের বালুকার তলে। তাই কষ্টে যখন অতি-তারের কোমল গান্ধারে উঠলুম তখন আমার কণ্ঠ যেন দীর্ণ হয়ে গেল, আর তা ফেটে বেরুল শুধু কণ্ঠভরা কান্না! ওস্তাদজি দ্রাক্ষারসের নেশায় ‘চড় বাচ্চা আর দু-পরদা পঞ্চমে–‘ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে সান্ত্বনাভরা স্বরে কইলেন, ‘কী হয়েছে আজ তোর বাচ্চা? দে আমায় ওটা।’ বাগেশ্রীর ফোঁপিয়ে-ফোঁপিয়ে-কান্না ওস্তাদজির গভীর কণ্ঠ সঞ্চরণ করতে লাগল অনুলোমে বিলোমে – সাধা গলার গমকে মিড়ে! তিনি গাইলেন, ‘বীণা-বাদিনীর বীণ আজ আর রোয়ে রোয়ে বনের বুকে মুহুর্মুহু স্পন্দন জাগিয়ে তুলছে না। আঁশু এসে তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। তাই সুর পূর্ণ হয়ে বেরোচ্ছে না। ওগো, তার যে খাদের আর অতি-তারের দুইটি তারই ছিন্ন হয়ে গেছে!’ আমার তখন ওদিকে মন ছিল না। আমার মন পড়েছিল সেই আমার স্বপ্নে-পাওয়া তরুণিটির কাছে।

ওঃ, সে স্বপ্নের চিন্তাটা এত বেশি তীব্র মধুর, তাতে এত বেশি মিঠা উন্মাদনা যে দিনে হাজার বার মনে করেও আমার আর তৃপ্তি হচ্ছে না। সে কী অতৃপ্তির কন্টকে বিঁধে গেল আমার মর্মতলে, ওগো আমার স্বপ্ন-দেবী! ওই কাঁটা যে হৃদয়ে বিঁধেছে, সেইটেই এখন পেকে সারা বুক বেদনায় টনটন করছে! ওগো আমার স্বপ্নলোকের ঘুমের দেশের রানি! তোমার সে আকাশ-ঘেঁষা ফুল, আর পরাগ-পরিমলে-ভরা দেশ কোথায়? সে জ্যোৎস্না-দীপ্ত কুটির যেখানে পায়ের আলতা তোমার রক্তরাগে পাতার বুকে ছোপ দিয়ে যায়, সে কুটির কোন্ নিকুঞ্জের আড়ালে, কোন্ তড়াগের তরঙ্গ-মর্মরিত তীরে?

সে স্বপ্নচিত্রটা কী সুন্দর!–

সেদিন সাঁঝে অনেকক্ষণ কুস্তি করে খুব ক্লান্ত হয়ে যেমনি বিছানায় গা দিয়েছি, অমনি যেন রাজ্যের ঘুম এসে, আমার সারা দেহটাকে নিষ্কম্প অলস করে ফেললে, আমার চোখের পাতায় পাতায় তার সোহাগ-ভরা ছোঁয়ার আবেশ দিয়ে। শীঘ্রই আমার চেতনা লুপ্ত করে দিলে সে যেন কার শিউরে-উঠা কোমল অধরের উন্মাদনা-ভরা চুম্বন-মদিরা! …. হঠাৎ আমি চমকে উঠলুম! …. কে এসে আমার দুইটি চোখেই স্নিগ্ধ কাজল বুলিয়ে দিলে! দেখলুম, যেখানে আশমান আর দরিয়া চুমোচুমি করছে, সেইখানে একটি কিশোরী বীণা বাজাচ্ছে; বরফের ওপর পূর্ণ-চাঁদের চাঁদনি পড়লে যেমন সুন্দর দেখায়, তাকে তেমনি দেখাচ্ছিল, সূক্ষ্ম রেশমি নীল পেশোয়াজের শাসন টুটে বীণাবাদিনীর কৈশোর-মাধুর্য ফুটে বেরুচ্ছিল – আশমানের গোলাবি নীলিমায় জড়িত প্রভাত অরুণশ্রীর মতো মহিমশ্রী হয়ে! সে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকলে। আমার চোখের ঘুমের রঙিন কুয়াশা মসলিনের মতো একটা ফিনফিনে পরদা টেনে দিলে। বীণার চেয়েও মধুর বীণাবাদিনীর মঞ্জু গুঞ্জন প্রেয়সীর কানে-কানে-কওয়া গোপন কথার মতো আমায় কয়ে গেল, ‘ওই যে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে দরিয়ার কিনার, ওইখানেই আমার ঘর। ওইখানেই আমি বীণ বাজাই। তোমার ওই সরল বাঁশির সহজ সুর আমার বুকে বেদনার মতো বেজেছে, তাই এসেছি! আবার আমাদের দেখা হবে সূর্যাস্তের বিদায়-ম্লান শেষ-আলোকতলে। আর মিলন হবে এই উদার আকাশের কোলে এমনই এক অরুণ-অরুণিমা-রক্ত নিশিভোরে – যখন বিদায় বাঁশির ললিত বিভাসের কান্না তরল হয়ে ঝরে পড়বে।’ আমি আবিষ্টের মতো তার আঁচল ধরে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কে তুমি, স্বপ্নরানি?’ সে বললে, ‘আমায় চিনতে পারলে না য়ুসোফ? আমি তোমারই মেহের-নেগার।’ অচিন্ত্য অপূর্ব অনেক কিছু পাওয়ার আনন্দে আমার বুক ভরে উঠেছিল। আমি রুদ্ধ কণ্ঠে কইলুম, ‘আমায় কী করে চিনলে? – হাঁ, আমি তোমাকেই চাইছিলুম – তবে তোমার নাম জানতুম না। আর তোমায় নাকি অনেকেই জীবনের এমনি ফাগুন-দিনে ডাকে? তবে শুধু কি আমায়ই দেখা দিলে, আর কাউকে না?’ সে তার তাম্বূলরাগ-রক্ত পাপড়ির মতো পাতলা ঠোঁট উলটিয়ে বললে, ‘না – আমি তোমায় কী করে চিনব? – এই হালকা হাওয়ায় ভেসে আমি সব জায়গাতেই বেড়াই; কাল সাঁঝে তাই এদিক দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলুম তুমি আমায় বাঁশির সুরে কামনা করছ! তাই তোমায় দেখা দিলুম। …. আর, হাঁ – যারা তোমার মতো এমনি বয়সে এমনি করে তাদের অজানা অচেনা প্রেয়সীর জন্য কেঁদে মরে, কেবল তাকেই দেখা দিয়ে যাই। … তবু আমি তোমারই!’ … মেঘের কোলে সে কিশোরীর কম-মূর্তি ঝাপসা হয়ে এল।

আমার ঘুম ভাঙল। কোকিল ডাকলে, ‘উ-হু-উ!’ পাপিয়া শুধালে ‘পিউ কাহাঁ?’ বুলবুল ঝুঁটি দুলিয়ে গলা ফুলিয়ে বললে, ‘জা–নি–নে।’ ঝরে-হেনার শেষ সুবাস আর পীত-পরাগলিপ্ত ভোরের বাতাস আমার কানের কাছে শ্বাস ফেলে গেল, ‘হু–হু–হু!’

 

[ গ ]

আমার স্নেহের বাঁধনগুলো জোর বাতাসে পালের দীর্ণ দড়ির মতো পট পট করে ছিঁড়ে গেল। তারপর ঢেউ-এর মুখে ভাসতে ভাসতে, খাপছাড়া – ঘরছাড়া আমি এই ঝিলমে এলুম! – প্রথম দেখলুম এই হিন্দুস্থানের বীরের দেশ পাঁচটা দরিয়ার তরঙ্গ-সংকুল পাঞ্জাব, যেখানের প্রতি বালুকণা বীরের বুকের রক্ত জড়ানো – যেখানের লোকের তৃষ্ণা মিটাত দেশদ্রোহী – আর দেশ-শত্রু ‘জিগরের খুন।’

*  *  *  *

যে ডাল ধরতে গেলুম, তাই ভেঙে আমার মাথায় পড়ল! তাই নিরাশ্রয়ের কুটো ধরার মতো অকেজোর কাজ এই সংগীতকেই আশ্রয় করলুম আমার কাজ আর সান্ত্বনা স্বরূপে।

ওঃ, আমার এই বলিষ্ঠ মাংসপেশী-বহুল শরীর, মায়া-মমতাহীন – লৌহ কবাটের মতো শক্ত বক্ষ, তাকে আমি চেষ্টা করেও উপযুক্ত ভালো কাজে লাগাতে পারলুম না, খোদা! দেশের মঙ্গলের জন্য এর ক্ষয় হল না! ¬– প্রিয় ওয়াজিরিস্তানের পাহাড় আমার! তোমার দেহটাকে অক্ষত রাখতে গিয়ে যদি আমার এই বুকের উপর তোমারই অনেকগুলো পাথর পড়ে পাঁজরগুলো গুঁড়ো করে দিত, তাহলে সে কত সুখের মরণ হত আমার! ওই তো হত আমার হতভাগ্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা! – আমার জন্যে কেউ কাঁদবার নেই বলে হয়তো তাতে মানুষ কেউ কাঁদত না, কিন্তু তোমার পাথরে – মরুতে – উষ্ণ মারুতে শুকনো শাখায় একটা আকুল অব্যক্ত কম্পন উঠত! সেই তো দিত আত্মায় আমার পূর্ণ তৃপ্তি! আহা, এমন দিন কি আসবে না জীবনে!

আচ্ছা, – ওগো অলক্ষ্যের মহান স্রষ্টা! তোমার সৃষ্ট পদার্থের এত মধুর জটিলতা কেন? পাহাড়ের পাথরবুকে নির্ঝরের স্রোত বইয়েছ, আর আমাদের মতো পাষাণের বুকেও প্রেমের ফল্গুধারা লুকিয়ে রেখেছ!…আর তুমি যদি ভালোবাসাই সৃষ্টি করলে, তবে আলোর নীচে ছায়ার মতো তার আড়ালে নিরাশাকে সঙ্গোপন রাখলে কেন?

আমাকে সবচেয়ে ব্যথিয়ে তুলছে গত সন্ধ্যার কথাটা! –

আবার সহসা তার সঙ্গে দেখা হল সন্ধেবেলার খানিক আগে। তখন ঝিলমের তীরে তীরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁঝিট রাগিণীর ঝমঝমানি ভরে উঠছিল। সে ঠিক সেই স্বপ্নে-দেখা কিশোরীর মতোই হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকলে, ‘এখানে এসো!’ … আমি শুধোলুম, ‘মেহের-নেগার, স্বপ্নের কথা কি সত্যি হয়?’ সে বললে, ‘কেন?’ আমি তাকে আমার সেই স্বপ্নের কথা জানিয়ে বললুম, ‘তুমিই তো সেদিন নিশি-ভোরে আমায় অমন করে দেখা দিয়ে এসেছিলে আর তোমার নামও বলে এসেছিলে!… তুমি যে আমার!’ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল তার বুকের বসনে দোল দিয়ে! সে বললে, ‘য়ুসোফ, আমি তো মেহের-নেগার নই, আমি – গুলশন!’ সে কেঁদে ফেললে। … আমি বললুম, ‘তা হোক, তুমিই সেই। … আমি তোমাকে মেহের-নেগার বলেই ডাকব।’ সে বললে, ‘এসো, সেদিন গান শুনাবে বলেছিলে না?’ আমি বললুম, ‘তুমিই গাও, আমি শুনি।’ সে গাইলে,

ফারাকে জানাঁ মে হাম্‌নে সাকি লোহু পিয়া হেয় শারাব করকে।
তপে আলম নে জিগর কো ভূনা উয়ো হামনে খায়া কবাব কর্‌কে॥

আহ‌! এ কোন্ দগ্ধহৃদয়ের ছটফটানি? – প্রিয়তমের বিচ্ছেদে আমার নিজের খুনকেই শারাবের মতো করে পান করেছি, আর ব্যথার তাপে আমার হৃৎপিণ্ডটাকে পুড়িয়ে কাবার করে খেয়েছি! – ওগো সাকি, আর কেন? এসরাজের ঝংকার থামাতে অনেক সময় লাগল।

আমি গাইলুম, ‘ওগো, সে যদি আমার কথা শুধায়, তবে বোলো যে, সারা জনম অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে সে আজ বেহেশতের বাইরে তোমারই প্রতীক্ষায় বসে আছে!’ সে কেঁদে আমার মুখটা চেপে ধরে বললে, ‘না – না, এমন গান গাইতে নেই!’ তারপর বললে, ‘আচ্ছা, এই গান-বাজনায় তোমার খুব আনন্দ হয়, – না?’ আবার সে কোন্ অজানা-নিষ্ঠুরের প্রতি অভিমানে আমার বক্ষে ক্রন্দন গুমরে উঠল! আমি গাইলুম –

শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন মাঝে?
অশান্তি যে আঘাত করে তাইতে বীণা বাজে।
নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা–-
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের গন্ধ-ঢালা।

বিদায়ের ক্ষণে সে হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলে বললে, ‘আচ্ছা, তুমি আমায় ভালোবাসা, তাই আমি একটা ভিক্ষা চাইছি। … বলো, আর আমায় ভালোবাসবে না, আমায় চাইবে না।’ সে উপুড় হয়ে আমার পায়ে পড়ল! …চাঁদের সমস্ত আলো এক লহমায় নিবে গেল বিরাট একট জলোমেঘের কালো ছায়ার আড়ালে পড়ে! … আমি কষ্টে উচ্চারণ করতে পারলুম, ‘কেন’? সে একটু থেমে, চোখ দুটো আঁচল দিয়ে চেপে বললে, ‘দেখো, পবিত্র জিনিসের পূজা পবিত্র জিনিস দিয়েই হয়। কলুষ যা, তা দিয়ে পূতকে পেতে গেলে পূজারির পাপের মাত্রা চরমে গিয়ে পৌঁছে। …এই যে তোমার ভালোবাসা, – হোক না তা মাদকতা আর উন্মাদনার তীব্রতায় ভরা, – তা অকৃত্রিম আর প্রগাঢ় পবিত্র! তাকে অবমাননা করতে আমার যে একবিন্দু সামর্থ্য নেই। …আমাকে চেন না? এই শহরে যে খুরশেদজান বাইজির নাম শুন, আমি তারই মেয়ে।’ বলেই সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার সারা অঙ্গ কাঁপতে লাগল! সে বললে, ‘রূপজীবিনীর কন্যা আমি, ঘৃণ্য, অপবিত্র! ওগো আমার শিরায়-শিরায় যে অপবিত্র পঙ্কিল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে! কেটে দেখো, সে লোহু রক্তবর্ণ নয়, বিষ-জর্জরিত মুমূর্ষুর মতো তা নীল-শিয়াহ।’ দেখলুম, তার চোখ দিয়ে আগুন ফিনকির মতো জ্বালাময়ী অশ্রু নির্গত হচ্ছে। বুঝলুম, এ তো স্নিগ্ধ গৈরিক নির্ঝর নয়, এ যে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত দ্রবময়ী স্রোতের নিঃস্রাব!

বিছার কামড়ের মতো কেমন একটা দংশন-জ্বালা বুকের অন্তরতম কোণে অনুভব করলুম। ভাবলুম স্বভাব-দুর্গন্ধ যে ফুল, সে দোষ তো সে ফুলের নয়। সে দোষ যদি দোষ হয়, তবে তা স্রষ্টার। অথচ তার বুকেও যে সুবাস আছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে অসাধারণ যে সে-ই; সাধারণে কিন্তু তার নিকটে গেলেই মুখে কাপড় দেয়, নাক সিঁটকায়। …আমি ছিন্নকণ্ঠ বিহগের মতো আহত স্বরে বললুম, ‘তা – তা হোক মেহের-নেগার! সে দোষ তো তোমার নয়। তুমি ইচ্ছা করলে কি পবিত্র পথে চলতে পার না? স্রষ্টার সৃষ্টিতে তো তেমন অবিচার নেই। আর বোধ হয় এমনই ভাগ্যহত যারা তাদের প্রতিই তাঁর করুণা, অন্তত সহানুভূতি একটু বেশি পরিমাণেই পড়ে, এ যে, আমরা না ভেবেই পারি নে!… আর তুমি তো আমায় সত্য করে ভালোবেসেছ! এ ভালোবাসায় যে কৃত্রিমতা নেই, তা আমি যে আমার হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারছি। আর এ প্রেমের আসল নকল দুটি হৃদয় ছাড়া সারা বিশ্বের কেউ বুঝতে পারবে না।…হাঁ, আর ভালোবাসায় জীব যখন কাঁদতে পারে, তখন সে অনেক উঁচুতে উঠে যায়। নীচের লোকেরা ভাবে, ‘এ লোকটার অধঃপতন নিশ্চিত’। অবশ্য একটু পা পিছলে গেলেই যে সে অত উঁচু হতে একেবারে পাতালে এসে পড়বে, তা সেও বোঝে। তাই সে কারুর কথা না শুনে সাবধানে অমনি উঁচুতে উঠতে থাকে। …না মেহের-নেগার, তোমাকে আমার হতেই হবে।’ … সে স্থির হয়ে বসল, তারপর মূর্ছাতুরের মতো অস্পষ্ট কণ্ঠে কইলে, ‘ঠিক বলেছ য়ুসোফ, আমার সামনে অনেকেই এল, অনেকেই ডাকল; কিন্তু আমি কোনোদিন তো এমন করে কাঁদিনি। যে আমার সামনে এসে তার ভরা অর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছে, মনে হত আহা, একেই ভালোবাসি। এখন দেখছি, তা ভুল। সময় সময় যে অমন হয়, আজ বুঝেছি তা ক্ষণিকের মোহ আর প্রবৃত্তির বাইরের উত্তেজনা। কিন্তু যেদিন তুমি এসে বললে, তুমি আমারই, সে দিন আমার প্রাণমন সব কেন একযোগে সাড়া দিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁগো হ্যাঁ, আমার সব তোমারই। ওঃ, সে কি অনাবিল গভীর প্রশান্ত প্রীতির জোয়ার ছুটে গেল ধমনীর প্রতি রক্ত-কণিকায়! সে এমন একটা মধুর সুন্দর ভাব, যা মানুষে জীবনে একবার মাত্র পেয়ে থাকে, – সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে! আমাদের এই ভালোবাসায় আর দরবেশের প্রেমের সমান গভীরতা, এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, যদি সেই ভালোবাসা চিরন্তন হয়!’ …ক্লান্ত কান্তার মতো সে আমার স্কন্ধে মাথাটা ভর করে আস্তে আস্তে কইলে, ‘তোমাকে পেয়েও যে এই আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি, এ তোমাকে ভালোবাসতে, – প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছি বলেই! … আমার – আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে য়ুসোফ, তবে তোমাকে পাওয়ার আশা আমাকে জোর করে ত্যাগ করতেই হবে। যাকে ভালোবাসি তারই অপমান তো করতে পারি নে আমি! এইটুকু ত্যাগ, এ আমি খুব সইতে পারব। অভাগিনী নারী জাতি, আমাদের এর চেয়েও যে অনেক বড়ো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তোমরা যাই-ই ভাব, আমাদের কাছে এ কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়, আর কঠিনও নয়।… ওঃ, কেন তুমি আমার পথে এলে? কেন তোমার শুভ্র শুচি প্রেমের সোনার পরশ দিয়ে আমার অ-জাগন্ত ভালোবাসা জাগিয়ে দিলে? – না তোমাকে না পেলেও তুমি থাকবে আমারই। তবু আমাদের দুজনকে দুদিকে সরে যেতে হবে। – যে বুকে প্রেম আছে, সেই বুকেই কামনা ওত পেতে বসে আছে। আমাদের নারীর মনকে বিশ্বাস নেই য়ুসোফ, সে যে বড়োই কোমল, সময়ে একটু তাপেই গলে পড়ে। কে জানে এমন করে থাকলে কোনো দিন আমাদের এই উঁচু জায়গা হতে অধঃপতন হবে। … না, না প্রিয়তম, আর এই কলুষবাষ্পে তোমার স্বচ্ছ দর্পণ ঝাপসা করে তুলব না। … আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না। যদি হয়, তবে আমাদের মিলন হবে ওই – ওইখানে যেখানে আকাশ আর দরিয়া দুই উদার অসীমে কোলাকুলি করছে! … বিদায় প্রিয়তম! বিদায়!!’ বলেই সে আমার হস্ত চুম্বন করে উন্মাদিনীর মতো ছুটে বেরিয়ে গেল।

ঝড় বইছিল শন – শন – শন। আর অদূরের বেণুবনে আহত হয়ে তারই কান্না শোনা যাচ্ছিল আহ্ – উহ্ – আহ্! স্নায়ুছিন্ন হওয়ার মতো কট কট করে বেদনার্ত বাঁশগুলোর গিঁটে গিঁটে শব্দ হচ্ছিল।

এক বুক ব্যথা নিয়ে ফিরে এলুম! ফিরতে ফিরতে চোখের জলে আমার মনে পড়ল – সেই আমার স্বপ্নরানির শেষ কথা! সেও তো এর মতোই বলেছিল, ‘আমাদের মিলন হবে এই উদার আকাশের কোলে এমনই এক তরুণ অরুণিমা-রক্ত-নিশিভোরে যখন বিদায় বাঁশির সুরে সুরে ললিত বিভাসের কান্না তরল হয়ে ক্ষরবে।’

 

[ ঘ ]

সেদিন যখন আমায় একেবারে বিস্ময়-পুলকিত আর চকিত করে সহসা আমার জন্মভূমি-জননী আমার বুকের রক্ত চাইলে, তখন আমার প্রাণ যে কেমন ছটফট করে উঠল তা কইতে পারব না! … শুনলুম আমাদের স্বাধীন পাহাড়িয়া জাতিটার উপর ইংরেজ আর কাবুলের আমির দুজনারই লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। আর কয়েকজন দেশদ্রোহী শয়তান দুভাগে বিভক্ত হয়ে দেশটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে যে, আমাদের এই ঘরবাড়িহীন পাঠানদের বশে আনতে কেউ কখনও পারবে না। আমরা স্বাধীন – মুক্ত। সে যেই হোক না কেন, আমরা কেন তার অধীনতা স্বীকার করতে যাব? শিকল সোনার হলেও তা শিকল। – না, না, যতক্ষণ এই য়ুসোফ খাঁর এক বিন্দু রক্ত থাকবে গায়ে আর মাথাটা ধড়ের সঙ্গে লাগা থাকবে, ততক্ষণ কেউ, কোনো অত্যাচারী সম্রাট আমার জন্মভূমির এক কণা বালুকাও স্পর্শ করতে পারবে না! ওঃ একি দুনিয়াভরা অবিচার আর অত্যাচার, খোদা তোমার এই মুক্ত সাম্রাজ্যে? এই সব ছোটো মনের লোকই আবার নিজেদের ‘উচ্চ’ ‘মহান’ ‘বড়ো’বলে নিজেদের ঢাক পিটায়। – ওঃ যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে, যেমন আকাশের অনেকগুলো পাখিকে ধরে এনে চারিদিকে লোহার শিক দেওয়া একটা খাঁচার ভিতর পুরে দিলে হয়। ওঃ আমার সমস্ত স্নায়ু আর মাংসপেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে! আরও শুনছি দুইপক্ষেই আমাদিগকে রীতিমত ভয় দেখান হচ্ছে। – হাঃ হাঃ হাঃ! গাছের পাখিগুলোকে বন্দুক দেখিয়ে শিকারি যদি বলে, ‘সব এসে আমার হাতে ধরা দেও, নইলে গুলি ছাড়লুম!’ তাহলে পাখিরা এসে তার হাতে ধরা দেবে? কখনই না, তারা মরবে, তবুও ধরা দেবে না – দেবে না! শিকারিদের বুকে যে ছুরি লুকানো আছে, তা পাখিরা আপনিই বোঝে। এ তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না। হাঁ, আর যদিই যোগ দিতে হয়, তবে নিজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে যেখানে অন্যায় দেখব সেইখানেই আমাদর বজ্রমুষ্টির ভীম তরবারির আঘাত পড়বে! আমার জন্মভূমি কোনো বিজয়ীর চরণ স্পর্শে কখনও কলঙ্কিত হয়নি, আর হবেও না। ‘শির দিব, তবু স্বাধীনতা দিব না’।

তোমার পবিত্র নামের শপথ করে এই যে তরবারি ধরলুম খোদা, এ আর আমার হাত হতে খসবে না! তুমি বাহুতে শক্তি দাও! – এই তরবারির তৃষ্ণা মিটাব – প্রথমে দেশদ্রোহী শয়তানদের জিগরের খুনে, তারপর দেশ-শত্রুর কলুষরক্তে। – আমিন!!!

*  *  *

হাঁ, আমার মনে হচ্ছে হয়তো আমার দেশের ভাই-ই আমায় হত্যা করবে জল্লাদ হয়ে! … তা হোক, তবু তো সুখে মরতে পারব, কেননা আমার এ ক্ষুদ্র প্রাণ দেশের পায়েই উৎসর্গীকৃত হবে! – ‘খোদা! আমার এ দান যেন তুমি কবুল করো।’

*  *  *

বেশ হয়েছে! খুব হয়েছে!! আচ্ছা হয়েছে!!!

আমার এই চিরবিদায়ের সময় কেন কাল মনে হল, সে অভাগিকে একবার দেখে যাই। কেন সে ইচ্ছাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। … গিয়ে দেখলুম তার ত্যক্ত বাড়িটা ধূলি আর জঙ্গলময় হয়ে সদ্যবিধবা নারীর মতো হাহাকার করছে! … আর – আর ও কি? … ঘরের আঙিনায় ও কার কবর? যেন কার এক বুক বেদনা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। কার পাহাড়পারা ব্যথা জমাট হয়ে যেন মূর্ছিত হয়ে মাটি আঁকড়ে রয়েছে!… কবরের শিরানে কার বুকের রক্ত দিয়ে মর্মর ফলকে লেখা, ‘অপবিত্র জঠরে জন্ম নিলেও ওগো পথিক, আমায় ঘৃণা করো না! একবিন্দু অশ্রু ফেলো, আমার কল্যাণ কামনা করে – আমি অপবিত্র কি-না জানি না, কিন্তু পবিত্র ভালোবাসা আমার এই বুকে তার পরশ দিয়েছিল! … আর ওগো স্বামিন্! তুমি যদি কখনও এখানে আস, – আঃ, তা আসবেই – তবে আমায় মনে করে কেঁদো না। যেখানেই থাকি প্রিয়তম, আমাদের মিলন হবেই। এমন আকুল প্রতীক্ষার শেষ অবসান এই দুনিয়াতেই হতে পারে না। খোদা নিজে যে প্রেমময়! – অভাগিনি – গুলশন!’

আমার এক বুক অশ্রু ঝরে মর্মর-ফলকের মলিন রক্ত লেখাগুলিকে আরও অরুণোজ্জ্বল করে দিলে!…

ঝিলমের ওপার হতে কার আর্ত আর্দ্র সুর এপারে এসে আছাড় খাচ্ছিল,

আগর মেয় বাগবাঁ হোতে তো গুলশন কো
লুটা দেতে।
পাকড় কর দস্তে বুলবুল কো চমন সে জাঁ
মেলা দেতে॥

হায়রে অবোধ গায়ক! তুই যদি মালি হতিস, তা হলে বুলবুলের হাত ধরে ফুলের সঙ্গে মিলন করিয়ে দিতিস – অসম্ভব রে, তা অসম্ভব। খোদা হয়তো তোকে সে শক্তি দেননি, কিন্তু যাদের সে শক্তি আছে ভাই, তাঁরা তো কই এমন করা তো দূরের কথা, একবার তোর এই কথা মুখেও আনতে পারে না! তোরই এই ক্ষমতা থাকলে হয়তো তুই এ গান গাইতে পারতি নে!….

*  *  *

তবু আমার চিরবিদায়ের দিনে ওই গানটা বড্ড মর্মস্পর্শী মধুর লেগেছিল।