সিন্ধু-হিন্দোল
কাজী নজরুল ইসলাম


                   গোপন-প্রিয়া

পাইনি বলে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রানি,
মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি!
                  আমি এ-পার, তুমি ও-পার,
                  মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার
ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্‌ছানি,
আমি মরু, পাইনে তোমারছায়ার ছোঁওয়াখানি।

নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়!
আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়!
                এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে
                আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে,
আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়,
কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়!

চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর।
গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিনশাখার’ পর।
                গান ফুরালো যাব যবে        
               
গানের কথাই মনে রবে,
পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর স্বর,
উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর!

তোমার পায়ে বাজ্‌ল কখন আমার পারের ঢেউ,
অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ।
                উড়তে গিয়ে পাখা হতে
                একটি পালক পড়লে পথে,
ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও!
ভয় কি সখি? আপনি তুমিফেলবে খুলে এ-ও!

বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি
ঝুরবে তুমিএক্‌লা মনে, বনের কেতকী?
                মনের মনে নিশীথ্‌-রাতে
                চুম্‌ দেবে কি কল্পনাতে?
স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি!
মেঘের সাথে কাঁদবেতুমি, আমার চাতকী!

দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই একাঁদন-রোল!
কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল!
                তোমায় পেলে থাম্‌ত বাঁশী,
                আস্‌ত মরণ সর্বনাশী।
পাইনিক তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল।
বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।

বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও,
দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও।
                থাকবে তুমি ছায়ার সাথে
                মায়ার মত চাঁদনী রাতে!
যত গোপন ততমধুর-নাই বা কথা কও!
শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও!

ওগো আমারআড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর!
তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর।
                কোথায় আছ কেম্‌নে রানি
                কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি!
ভালোবাসি এই আনন্দে আপনিআছি ভোর!
চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!

রাত্রে যখন এক্‌লা শোব-চাইবে তোমার বুক,
নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ,
                দুখের সুরায় মস্ত্‌ হয়ে
                থাকবে এ-প্রাণ তোমায় লয়ে,
কল্পনাতে আঁক্‌ব তোমারচাঁদ-চুয়ানো মুখ!
ঘুমে জাগায় জড়িয়ে রবে, সেই তো চরম সুখ!

গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান।
থাম্‌বে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান!
                শিল্পী আমি, আমি কবি,
                তুমি আমার আঁকা ছবি,
আমার লেখাকাব্য তুমি, আমার রচা গান।
চাইব নাক, পরান ভরে করে যাব দান।

তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর,
কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির।
                গোপন তুমি আস্‌লে নেমে
                কাব্যে আমার, আমার প্রেমে,
এই-সে সুখে থাক্‌বে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর?
দূরের পাখী-গানগেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়!

বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান,
মনে আমায় করবে নাক-সেই তোমনে স্থান!
                যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে
                কর্‌বে মনে, সে-দিন প্রিয়ে
ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ!
নাই বা পেলাম, চেয়েগেলাম, গেলে গেলাম গান!

চট্টগ্রাম ২৮.৭.২৬