সিন্ধু-হিন্দোল
কাজী নজরুল ইসলাম


                     মাধবী-প্রলাপ
আজ     লালসা-আলস-মদে বিবশা রতি
শুয়ে     অপরাজিতায় ধনি স্মরিছে পতি।
           তার     নিধুবন-উন্মন
                      ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন,
                     বুকে পীন যৌবন
                                উঠিছে ফুঁড়ি,
মুখে     কাম-কণ্টক ব্রণ মহুয়া-কুঁড়ি!

করে     বসন্ত বনভূমি সুরত কেলি,
পাশে    কাম-যাতনায় কাঁপে মালতী বেলি!
           ঝুরে     আলু-থালু কামিনী
                    জেগে সারা যামিনী,
                    মল্লিকা ভামিনী
                            অভিমানে ভার,
কলি     না ছুঁতেই ফেটে পড়ে কাঁটালি চাঁপার!

ছি ছি    বেহায়া কী সাঁওতালি মহুয়া ছুঁড়ি,
লাজে   আঁখি নিচু করে থাকে সোঁদাল-কুঁড়ি!
          পাশে     লাজ-বাস বিসরি
                      জামরুলি কিশোরী
                      শাখা-দোলে কি করি
                                খায় হিন্দোল।

হলো     ঘাম-ভাঙা লাজে কাম-রাঙার কপোল!

বাঁকা     পলাশ-মুকুলে কার আনত আঁখি?
ওগো     রাঙা-বউ বনবধূ রাগিল না কি?
            তার    আঁখে হানি কুঙ্কুম
                     ভাঙিল কি কাঁচা ঘুম?
                     চুমু খেয়ে বেমালুম
                                    পালাল কি চোর?
রাগে     অনুরাগে রাঙা হল আঁখি বন-বউর!

ওগো     নার্গিসফুলি বনবালা-নয়নায়
ও কে    সুরমা মাখায় নীল ভোমরা পাখায়!
            কালো     কোয়েলার রূপে ওকি
            উড়িয়া     বেড়ায় সখী
                         কামিনী-কাজল আঁখি
                                    কেঁদে বিষাদে?
কার     শীর্ণ কপোল কাঁদে অস্ত-চাঁদে!

সখী     মদনের বাণ-হানা শব্দ শুনিস
ওই     বিষ-মাখা মিশকালো দোয়েলের শিস!
         দেখ     দুই আঁখি ঝাঁপিয়া
                    কেঁদে ওঠে পাপিয়া—
        ‘চোখ গেল হা প্রিয়া’
                    চোখে খেয়ে শর।
কাঁদে     ঘুঘুর পাখায় বন বিরহ-কাতর!

ঝরে     ঝরঝর মরমর বিদায়-পাতা,
        কি বিরহিণী বনানীর ছিন্ন খাতা?
           ওকি     বসন্তে স্মরি স্মরি
                      সারাটি বছর ধরি
           শত অনুযোগ করি
                      লিখিয়া কত
আজ    লজ্জায় ছিঁড়ে ফেলে লিপি সে যত!


আসে   ঋতুরাজ, ওড়ে পাতা জয়ধ্বজা;
লো   অশোক শিমুলে বন-পুষ্প রজা।
          তার     পাংশু চীনাংশুক
                    হল রাঙা কিংশুক,
                    উৎসুক উন্মুখ
                            যৌবন তার
যাচে     লুণ্ঠন-নির্মম দস্যু তাতার!

ওড়ে     পিয়াল-কুসুম-ঝরা পরাগ কোমল
ওকি     বসন্ত বনভূমি-রতি-পরিমল?
           ওকি     কপোলে কপোল ঘষা
                            ওড়ে চন্দন খসা?
বনানী     কি করে গোসা
                        ছোঁড়ে ফুল-ধুল?
ওকি      এলায়েছে এলো-খোঁপা সোঁদা-মাখা চুল?

নাচে     দুলে দুলে তরুতলে ছায়া-শবরী,
দোলে   নিতম্ব-তটে লটপট কবরী!
           দেয়     করতালি তালীবন,
                     গাহে বায়ু শন শন,
                     বনবধূ উচাটন
                                মদন-পীড়ায়,
তার    কামনার হরষণে ডালিম ডাঁশায়!

নভ     অলিন্দে বালেন্দু উদিল কি সই?
ও যে   পলাশ-মুকুল, নব শশিকলা কই?
          ও যে   চির বালা ত্রয়োদশী
                    বিবস্ত্রা উর্বশী,
                    নখ-ক্ষত শশী
                            নভ-উরসে।
ওকি     তারকা না চুমো-চিন আছে মুরছে?

দূরে     সাদা মেঘ ভেসে যায়— শ্বেত সারসী,
ওকি    পরদের তরি অপ্সরি-আরশি?
          ওকি    পাইয়া পীড়ন-জ্বালা
                    তপ্ত উরসে বালা
                    শ্বেতচন্দন লালা
                            করিছে লেপন?
ওকি    পবন খসায় কার নীবি-বন্ধন?

হেথা   পুষ্পধনু লেখে লিপি রতিরে
হল     লেখনি তাহার লিচু-মুকুল চিরে!
         লেখে     চম্পা কলির পাতে,
                    ভোমরা আখর তাতে,
                    দখিনা হাওয়ার হাতে
                        দিল সে লেখা।
হেথা   ‘ইউসোফ’ কাঁদে, হোথা কাঁদে ‘জুলেখা’!  


রচনাকাল: কলকাতায় এই ঘটনা ঘটার সময়, সম্ভবত ১০ই এপ্রিলের (শনিবার ২৭ চৈত্র ১৩৩২) আগেই নজরুল মাদারীপুর থেকে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন। এই দিন কালিকলম পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠি থেকে শ্রীহট্ট যুব সম্মিলনীতে নজরুলের যোগদানের ইচ্ছার কথা জানা যায়।

প্রিয় শৈলজা!
কনফারেন্সের হিড়িকে মরবার অবসর নেই। কনফারেন্সের আর মাত্র একমাস বাকি। হেমন্তদা আর আমি সব করছি এ যজ্ঞের। কাজেই লেখাটা শেষ করতে পারিনি এতদিন। রেগো না লক্ষ্মীটি। আমি তোমাদের লেখা না দিতে পেরে বড়ো লজ্জিত আছি। 'মাধবী-প্রলাপ' পাঠালুম। বৈশাখেই দিয়ো। দরকার হলে অদল-বদল করে নিয়ো কথা- অবশ্য ছন্দ রক্ষা করে। আমি এবার কলকাতায় গিয়েছিলুম 'আল্লা... আর ভগবান'...এর মারামারির দরুন তোমাদের কাছে যেতে পারিনি। আমি ২/৩ দিন পরে শ্রীহট্ট যুবক সম্মিলনীতে যোগদান করতে যাচ্ছি। ওখান থেকে ফিরে তোমার সঙ্গে দেখা করব। আজ ডাকের সময় যায়, বেশি লিখবে না। ...মুরলিদা ও প্রেমেনকে ভালোবাসা দিয়ো। তোমরাও নিয়ো। -নজরুল
এই চিঠি থেকে জানা যায় 'মাধবী-প্রলাপ' নামে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন।

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে লেখা পত্র অনুসারে অনুমান করা যায়- কবিতাটি তিনি ১০ই এপ্রিলের (শনিবার ২৭ চৈত্র ১৩৩২) কিছু আগে বা ঐ দিনই রচনা করেছিলেন।  কবিতাটি 'কালি ও কলম' পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে কল্লোল পত্রিকা'র সাথে সম্পর্কিত কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠীর দীনেশরঞ্জন দাশ ও মুরলীধর বসুর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই সূত্রে অনেকেই কল্লোল গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসে 'কালিকলম' নূতন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ‌এপ্রিল মাসে। প্রথম বছরে সম্পাদক ছিলেন মুরলীধর বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখে (এপ্রিল ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ)।