বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: কেন মরিতে আসিলাম যমুনায়, ললিতা কেন বিপরীত হেরিলাম
কেন মরিতে আসিলাম যমুনায়, ললিতা কেন বিপরীত হেরিলাম।
কৃষ্ণ-যমুনা-জলে কারে ল'য়ে কুতুহলে জল-খেলা করে ঘনশ্যাম॥
কালো মেঘের যেন খেলে বিজলি
সোনার-প্রতিমার প্রতিবিম্ব কালো জলে
কালো মেঘে যেন খেলে বিজলি।
হিরন্ময়ী জ্যোতিমর্য়ী সতিনীর রূপ আমি যত দেখি গো তত মজি সখি গো!
অতি জ্যোতি গবির্তা যেন পতি সোহাগিনী সতীসম কে এ সতিনী, ললিতে,
মোর শ্যাম অঙ্গে অপরূপ ভঙ্গে আমারই সমুখে করে খেলা,
মোরে ছলিতে।
ও কি কায়া না ছায়া!
ও কি কৃষ্ণ রূপের চঞ্চল জল-তরঙ্গ মায়া?
সখি মান ভাঙাতে মোর এসেছিল গোপনে শ্যাম আজি প্রভাতে (সখি),
শ্যাম-তনুমুকুরে হেরিলাম বিরাজে গৌর-বর্ণা নারী অপরূপ শোভাতে।
এলো অভিমান মনে, তাই
মনে হলে যমুনায় ডুবিয়া ললিতা শান্তি যদি পাই।
এখানেও দেখি সেই গৌরী কিশোরী আছে শ্যামে
জড়ায়ে।
(ও কি কায়া না মায়া ও কি কৃষ্ণেরই রঙ্গ না আমারই
ছায়া কায়া না মায়া।)
কোন্ দেশে যাব সখি কোন্ খানে পাব শ্যামে একাকী।
আন-নারীরে ছেড়ে কেবল রাধার হয়ে দেবে না দেখা কি (সখি গো)॥
-
ভাবসন্ধান: আদিকাল থেকে রাধা গভীরভাবে মিশে আছেন কৃষ্ণের প্রেমসত্তার
সাথে। তাই তৃতীয় পক্ষ হয়ে রাধা যখন কৃষ্ণকে কাছে পেতে যান, তখন তিনি নিজেকে
দেখেন কৃষ্ণের সাথে প্রেমলীলায়। তাই তিনি কৃষ্ণকে কখনো একাকী পান না। তাই
পার্থিব রাধা আত্মিক রাধাকে সতীন ভেবে বিচলিত হন।
কৃষ্ণের প্রেমে অধীর রাধা যমুনায় এসেছিলেন, শ্যামের সাথে প্রেমলীলার অংশভাগিনী
হয়ে জলক্রীড়ায় মত্ত হতে। কিন্তু এসে তিনি দেখেন রাধাময় কৃষ্ণ কালোযমুনা-জলে
কুতুহলে জলক্রীড়ায় মত্ত। তিনি নিজেকে চিনতে পারেন না বলেই বিভ্রান্ত হন। তাই তিনি তাঁর সখি ললিতাকে ডেকে আক্ষেপের সুরে বলেন-
কেন তিনি মরতে এলেন যমুনায়।
কৃষ্ণকে রাধা কালো মেঘের সঙ্গে এবং তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী নারীকে বিদ্যুৎ (বিজলি) বা সোনার প্রতিমার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কৃষ্ণের শ্যামল রূপের পাশে সেই গৌরবর্ণা নারীর
ঔজ্জ্বল্য, আকর্ষণীয় ও দ্যুতিময় রূপের বর্ণনার মধ্য দিয়ে নিজেকেই প্রকাশ করেছেন।
তিনি স্বর্ণময়ী (হিরন্ময়ী)
ও জ্যোতির্ময়ী এই নারীকে তাঁর সতীন হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজের রূপকেই প্রকাশ
করেছেন।
তাই এই নারীর রূপযীবনের সৌন্দর্যের মুগ্ধতা রাধা উপেক্ষাও করতে পারেন না।
এই লীলা দেখ তিনি ভাবেন- যেন কৃষ্ণ ও সেই নারী
ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে কষ্ট দিতে তাঁর চোখের সামনেই প্রেমলীলায় মত্ত হয়েছেন।
পরক্ষণেই রাধা ভাবেন- যা দেখছেন তা কি দেহ (কায়া) নাকি কেবলই ছায়া? নাকি শুধু
চঞ্চল জলতরঙ্গের সৃষ্ট রূপমহিমা মায়া। এই বিভ্রমে তিনি কৃষ্ণের দেহরূপ দর্পণে
(শ্যাম-তনুমুকুরে) দেখেন সেই গৌরবর্ণার গভীর আলিঙ্গনাবদ্ধ দশার
প্রতিবিম্ব।
এই অবুঝ রাধা অভিমানে যমুনার জলে ডুবে মরে শান্তি পেতে চেয়েছেন। কৃষ্ণের আধারে
রাধা নিজেকে চিনতে পারেন না বলেই- তিনি যেখানেই যান, সেখানেই সেই গৌরী কিশোরীকে
(নিজেক) দেখেন শ্যামের সাথে অালিঙ্গনাবস্থায়। রাধা ভেবে পান না কোথায় গেলে শ্যামকে তিনি
একাকী পাবেন, অন্য নারীকে ছেড়ে কেবল তাঁর সাথেই থাকবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা
কখনো সম্ভব হয়ে ওঠে না, কারণ যেখানে কৃষ্ণ, সেখানে রাধা। কৃষ্ণ যেমন বিরাজ করেন
রাধাময় হয়ে, তেমনি রাধায় বিরাজ করেন কৃষ্ণময় হয়ে।
-
রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই নভেম্বর (শনিবার, ২৩ কার্তিক ১৩৪৭), কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে অভিমানিনী প্রথম প্রচারিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪১ বৎসর ৫ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ১২২১। গীতিচিত্র: 'অভিমানিনী'। পৃষ্ঠা: ৩৭১-৩৭২]
- বেতার:
- অভিমানিনী
(গীতিচিত্র)।
- প্রথম প্রচার: কলকাতা বেতারকেন্দ্র-ক, তৃতীয় অধিবেশন।
৯ নভেম্বর ১৯৪০ (শনিবার, ২৩ কার্তিক ১৩৪৭)। রাত্রি: ৮.০০-৮.৪০ মিনিট]
- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ, ২১ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ১১৬২
- The
Indian-listener 1940, Vol V, No 21. page 1665
- দ্বিতীয় প্রচার: কলকাতা বেতারকেন্দ্র-ক, তৃতীয় অধিবেশন। ২৮ জুন ১৯৪১ (শনিবার
১৩ আষাঢ়। ১৩৪৮)। রাত ৮.০০-৮.৩৯ মিনিট
- সূত্র: বেতার জগৎ। ১২শ বর্ষ, ১২ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৭১৪
- পর্যায়
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম। বৈষ্ণব। রাধাকৃষ্ণ-লীলা