বিষয়:
নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: কে
পাঠালে লিপির দূতী গোপন লোকের বন্ধু গোপন
কে পাঠালে লিপির দূতী গোপন লোকের বন্ধু গোপন।
চিন্তে নারি হাতের লেখা মনের লেখা চেনে গো মন॥
গান গেয়ে যাই আপন মনে
সুরের পাখি গহন বনে,
সে সুর বেঁধে কার নয়নে
─ জানে শুধু তা'রি নয়ন॥
কে গো তুমি গন্ধ-কুসুম
গান গেয়ে কি ভেঙেছি ঘুম,
তোমার ব্যথার নিশীথ নিঝুম
─ হেরে' কি মোর গানের স্বপন॥
নাই ঠিকানা নাই পরিচয়
কে জানে ও-মনে কি ভয়,
গানের কমল ও-চরণ ছোঁয়
─ তাইতে মানি ধন্য জীবন॥
সুরের গোপন বাসর-ঘরে
গানের মালা বদল করে,
সকল আঁখির অগোচরে
─ না দেখাতে মোদের মিলন॥
- ভাবসন্ধান: সুফিবাদী দর্শনে রচিত এই গানে একজন অচেনা বন্ধুর (পরমস্রষ্টা)
কাছ থেকে পাওয়া বার্তার কথা বলা হয়েছে। এই গানে পরমস্রষ্টা পরমাত্মারূপে
উপস্থাপিত হয়েছে রূপকতায় কবির কল্পবিহারে।
গানের শুরুতেই কবি স্রষ্টার রহস্যময় বার্তা বা দূতীর বার্তার উল্লেখ করেছেন। এই বার্তা
"গোপন লোকের" অর্থাৎ, এই বার্তা জাগতিক যাপিত জীবনের বাইরের বা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা পরমামাত্মার। যাঁর হাতের লেখা (তাঁর সৃষ্ট দৃশ্যমান পরিবেশে থাকা ঈঙ্গিত) থেকে
তাঁর কথা বুঝা না গেলেও তাঁর মনের কথা মন দিয়ে অনুভব করা যায়। এই গানে সেই গোপন
বন্ধুর (প্রম স্রষ্টা) প্রতি ভালোবাসা, আকুলতা এবং এক গভীর আত্মিক মিলনের কথা
প্রকাশ পেয়েছে। সুফি দর্শনে সত্যিকারের সংযোগ ঘটে ধ্যান-স্তরে। যিনি কবির
মনোলোকে আধ্যাত্মিক সত্তা, তিনই তাকে শিল্প রচনায় প্রেরণা জোগান।
কবি মনোলোকের গভীর বনে 'আপন মনে গান গাওয়া' এক সুরের পাখির সাথে
নিজেকে তুলনা করেছেন। এই "গহন বন" হলো শিল্পীর একান্ত নিজস্ব জগৎ। তিনি যে সুর সৃষ্টি করেন, তার উৎস বা অনুপ্রেরণা
'গোপন বন্ধু' নিজেই। তিনিই সে গানের সুর বাঁধেন, তিনিই তাঁর মর্ম উপলব্ধি
করতে পারেন। সাধারণ শ্রোতা বা দর্শক কেবল সুরটুকুই শোনে, কিন্তু তার পেছনের আবেগ ও উৎস থাকে গোপন।
কবি তার প্রেরণার উৎসকে "গন্ধ-কুসুম" বা সুগন্ধি ফুলের সাথে তুলনা করছেন, যা
দৃশ্যমান নয়, শুধু তার সৌরভ অনুভব করা যায়। কবি বিনীতভাবে নিজেকেই প্রশ্ন করছেন- তার গানের সুর কি সেই গোপন সত্তার নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করেছে,
বা সেই সত্তাকে ব্যথাতুর করে নিঝুম রাতের স্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে? এখানে শিল্পীর এক গভীর আত্মনিবেদন ফুটে ওঠে। তিনি মনে করেন তার সৃষ্টি হয়তো সেই অদৃশ্য প্রেরণারই অনুভূতির প্রতিচ্ছবি।
কবি জানেন না সেই গোপন বন্ধুর মনে কি নিজেকে প্রকাশ করার ভয় বা কোনো দ্বিধা কাজ করে
কি না। কবির কাছে এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। কবির কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, তার "গানের কমল"
দিয়ে সেই সত্তার চরণ স্পর্শ করতে
পারা। এই আত্মিক সংযোগকেই তিনি জীবনের সার্থকতা বলে মনে করছেন। জাগতিক প্রাপ্তির চেয়ে এই আধ্যাত্মিক মিলনই তার কাছে বড়।
গানের শেষে এসে কবি এক চূড়ান্ত মিলনের চিত্রকল্প এঁকেছেন। এই মিলন জাগতিক নয়, বরং "সুরের গোপন বাসর-ঘরে" সংঘটিত হয়। এখানে সুরই হলো তাদের মিলনের মাধ্যম ও স্থান। তারা "গানের মালা বদল করে" একে অপরকে বরণ করে নেয়।
এই মিলন ঘটে লোকচক্ষুর আড়ালে। কবি চান না, এই পবিত্র ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক পৃথিবীর মানুষ দেখুক বা জানুক। এটি একান্তই তাঁর এবং তাঁর সেই গোপন বন্ধুর মধ্যকার এক স্বর্গীয়
মিলন।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত 'সুর-সাকী' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের
এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৩ বৎসর ১ মাস।
-
গ্রন্থ:
-
সুর ও সাকী
- প্রথম সংস্করণ [আষাঢ় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ। জুলাই ১৯৩২)]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী,
ঢাকা। [জ্যৈষ্ঠ
১৪১৮, মে ২০১১। সুর-সাকী। ৮
। ঝিঁঝিট-খাম্বাজ-দাদরা। পৃষ্ঠা: ২২৬-২২৭]
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২) -এর
১৩৬৯ সংখ্যক গান।
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। ইসলাম ধর্ম। সুফিবাদ। মিলন।