ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


বিবিধ প্রসঙ্গ
 


আত্মময় আত্মবিস্মৃতি


    কিন্তু ইহা বলিয়া রাখি, ভাবুক লোকদিগের নিজের প্রতি মনোযোগ দিবার যেমন অল্প অবসর ও আবশ্যক আছে, এমন আর কাহারো নহে। যাহাদের পরের সহিত মিশিতে হয় তাহাদের যেমন চব্বিশ ঘন্টা নিজের চর্চ্চা করিতে হয়, এমন আর কাহাকেও না। তাহাদের দিনরাত্রি নিজেকে মাজিতে- ঘষিতে সাজাইতে-গোজাইতে হয়। পরের চোখের কাছে নিজেকে উপাদেয় করিয়া উপহার দিতে হয়। এইরূপে যাহারা পরের সহিত মেশে, নিজের সহিত তাহাদের অধিকতর মিশিতে হয়। ইহারাই যথার্থ আত্মম্ভরি। ভাবুকগণ কবিগণ সর্ব্বদাই নিজেকে ভুলিয়া থাকেন। কারণ তাঁহাদের নিজেকে মনে করাইয়া দিবার জন্য পর কেহ উপস্থিত থাকে না। নিজের সহিত ব্যতীত আর কাহারো সহিত ইহারা ভাল করিয়া মেশেন না বলিয়া ইহারা নিজের কথা ভাবেন না। ইঁহারাই যথার্থ আত্মময় আত্ম-বিস্মৃত।
 


ছোটো ভাব
 

    বর্ত্তমান সভ্যতার প্রাণপণ চেষ্টা এই যে, কিছুই ফেলা না যায়, সকলই কাজে লাগে। মনোবিজ্ঞান একটা ক্ষুদ্র বালকের, একটা বদ্ধ পাগলের, প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম চিন্তা খেয়াল মনোভাব সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া দেয় — কাজে লাগিবে। সমাজবিজ্ঞান, শিশু সমাজের, অসভ্য সমাজের, প্রত্যেক ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান, অর্থহীন প্রথা, পুঁথিতে জমা করিয়া রাখিতেছে — কাজে লাগিবে। এখনকার কবিরাও এমন সকল ক্ষুদ্র যৎসামান্য বিষয়গুলিকে কবিতায় পরিণত করেন, যাহা প্রাচীন লোকেরা গদ্যেরও অনুপযুক্ত মনে করিতেন।
    এখনকার শিল্পেও, যাহা সাধারণ লোকে অনাবশ্যক পুরাণ' গলিত বলিয়া ফেলিয়া দেয়, তাহাও একটা না একটা খাটিয়া যাইতেছে।
    আমরা যখন বেড়াইতেছি, শুইয়া আছি, আহার করিতেছি, সংসারে ছোটোখাটো খুঁটিনাটি কাজ সমাধা করিতেছি, তখন আমাদের মনের মধ্যে কত শত খুচরা বাজে ভাব আনাগোনা করিতে থাকে, সেগুলিকে আমরা নিতান্ত অনাবশ্যক বলিয়া আবর্জ্জনা মনে করিয়া ফেলিয়া দিই। খুব একটা দীর্ঘপ্রস্থ ভাব নহিলে আমরা তাহার উপরে হস্তক্ষেপ করি না। আমরা আমাদের মনের মধ্যে যে জাল পাতিয়া রাখি তাহা বড় মাছ ধরিবার জাল; ছোট ছোট মাছেরা তাহার ছিদ্রের মধ্য দিয়া গলিয়া পালাইয়া যায়। কিন্তু এমনতর অমনোযোগিতা একালের রীতি-বহির্ভূত। ঐ ছোট ভাব ধরিয়া জিয়াইয়া রাখিলে কত বড় হইত কে বলিতে পারে। একবার হাতছাড়া হইলে বড় হইয়া আবার যে তোমাকে ধরা দিবে তাহার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প। তাহা ছাড়া, আয়তন লইয়া আবশ্যক স্থির করে বালকেরা। সমাজের যতই বয়স বাড়িতেছে ততই এ বিষয় তাহার উন্নতি দেখা যাইতেছে। আমার একটি বন্ধু আছেন, তিনি অতি সাবধানে তাঁহার মনের দ্বার আগলাইয়া বসিয়া আছেন, যখনি ভাব আসে তখনি পাক্‌ড়া করেন, তাহাকে নাড়াচাড়া করিয়া দেখেন; ভাবিতে থাকেন, ইহাকে কোন প্রকারে মাজিয়া ঘষিয়া ছাঁটিয়া বাড়াইয়া কমাইয়া অক্ষরে লিখিবার উপযোগী করিতে পারি কি না। এই উপায়ে ইহার এমনি হাত পাকিয়া গিয়াছে যে, তুমি যে ভাব ব্যবহার করিয়া বা ব্যবহারের অযোগ্য বিবেচনা করিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দেও, তাহাই লইয়া দুই দণ্ডের মধ্যে ইনি ব্যবহারের জিনিষ বা ঘর সাজাইবার খেলনা গড়িয়া দিতে পারেন। লোকের অব্যবহার্য্য ভাঙ্গাকাঁচের টুকরো কুড়াইয়া কারিগরেরা ফানুষ গড়ে, ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া লইয়া কাগজ গড়ে। আমার বন্ধুর প্রবন্ধগুলি সেইরূপ। তাহাদের মূল উপকরণ অনুসন্ধান করিতে যাও, দেখিবে ভাবের আবর্জ্জনা, ছিন্ন টুকুরা,অব্যবহার্য্য চিন্তাখণ্ড লইয়া সমস্ত গড়িয়াছেন।
    সকলের প্রতি আমার পরামর্শ এই যে, কোনো ভাব বিবেচনা না করিয়া যেন ফেলা না যায়। অনবরত এইটে যেন মনে করেন, এ ভাবটাকে কোন প্রকারে লিখিয়া ফেলিতে পারি কি না! যাহা কিছু মনে আসে সমস্ত ভাব লিখিয়া রাখা তাঁহার কর্ত্তব্য কর্ম। অতএব অবিরত যেন হাতুড়ি, বাটালি, পালিশ করিবার যন্ত্রাদি হাতের কাছে মজুত থাকে। ইহা নিঃসন্দেহ যে, আমাদের মনে যত প্রকার ভাব উঠে সকলগুলিই লিখিবার উপযুক্ত। কিন্তু অতবড় লেখক হইবার উপযুক্ত প্রতিভা আমাদের নাই। বড় বড় কবিদিগের লেখা দেখিয়া আমরা অধিকাংশ সময়ে এই বলিয়া আশ্চর্য্য হই যে,"এ ভাবটা আমার মনে কত শতবার উদয় হইয়াছিল, কিন্তু আমি তো স্বপ্নেও মনে করি নাই এ ভাবটাও আবার এমন চমৎকার করিয়া লেখা যায়"। অনেকের মনে ভাব আছে, অথচ ভাব ধরা দেয় না, ভাব পোষ মানে না; ভাবের ভাব বুঝিতে পারা যায় না। আইস, আমরা অনবরত বুঝিতে চেষ্টা করি। মনোরাজ্যে এমন একটা বন্দোবস্ত করিয়া লই যে, বাজে খরচ না হয়। কাহারো কি আশ্চর্য্য মনে হয় না যে কেবল মাত্র বেবন্দোবস্তের দরুন প্রত্যহ কত হাজার হাজার ভাব নিস্ফল খরচ হইয়া যাইতেছে। তাহার হিসাব পর্য্যন্ত রাখা হইতেছে না। এক জন লেখক ও এক জন অলেখকের মধ্যে শুদ্ধ কেবল এই বন্দোবস্তের প্রভেদ লইয়া প্রভেদ। এক জন তাহার ভাব খাটাইয়া কারবার করেন, আর এক ব্যক্তির এই ভাবের টাকাকড়ির বিষয়ে এমনি গোলমেলে মাথা, যে কোন্ দিক্‌ দিয়া যে সমস্ত খরচ হইয়া যায়, উড়িয়া যায়, তাহার ঠিকানা করিতে পারেন না!


জগতের জন্ম-মৃত্যু
 

    কত অসংখ্য কত বিচিত্র জগৎ আছে, তাহা একবার মনোযোগপূর্ব্বক ভাবিয়া দেখা হউক দেখি ! আমার কথা হয়ত অনেকে ভূল বুঝিতেছেন। অনেকে হয়ত চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ নক্ষত্র একটি একটি গণনা করিয়া জগতের সংখ্যা নিরূপণ করিতেছেন। কিন্তু আমি আর এক দিক হইতে গণনা করিতেছি। জগৎ একটি বই নয়। কিন্তু প্রতি লোকের এক একটি যে পৃথক্ জগৎ আছে, তাহাই গণনা করিয়া দেখ দেখি! কত সহস্র জগৎ! আমি যখন রোগযন্ত্রণায় কাতর হইয়া ছট্‌ফট্‌ করিতেছি তখন কেন জ্যোৎস্নার মুখ ম্লান হইয়া যায়, উষার মুখেও শ্রান্তি প্রকাশ পায়, সন্ধ্যার হৃদয়েও অশান্তি বিরাজ করিতে থাকে? অথচ সেই মুহূর্ত্তে কত শত লোকের কত শত জগৎ আনন্দে হাসিতেছে! কত শত ভাবে তরঙ্গিত হইতেছে! না হইবে কেন? আমার জগৎ যতই প্রকাণ্ড, যতই মহান্ হউক না কেন, "আমি" বলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালুকণার উপর তাহার সমস্তটা গঠিত। আমার সহিত সে জন্মিয়াছে,আমার সহিত সে লয় পাইবে। সুতরাং আমি কাঁদিলেই সে কাঁদে, আমি হাসিলেই সে হাসে। তাহার আর কাহাকেও দেখিবার নাই, আর কাহারও জন্য ভাবিবার নাই। তাহার লক্ষ তারা আছে, কেবল আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিবার জন্য। এক জন লোক যখন মরিয়া গেল,তখন আমরা ভাবি না যে একটি জগৎ নিভিয়া গেল। একটি নীলাকাশ গেল, একটি সৌর-পরিবার গেল, একটি তরুলতাপশুপক্ষী-শোভিত পৃথিবী গেল।