ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ি ও গান
 


 

          একাকিনী
         একটি মেয়ে একেলা,
               সাঁঝের বেলা,
          মাঠ দিয়ে চলেছে।
      চারি দিকে সোনার ধান ফলেছে।
ওর
 মুখেতে পড়েছে সাঁঝের আভা,
           চুলেতে করিছে ঝিকিমিকি।
      কে জানে কী ভাবে মনে মনে
           আনমনে চলে ধিকিধিকি।
      পশ্চিমে সোনায় সোনাময়,
           এত সোনা কে কোথা দেখেছে।
      তারি মাঝে মলিন মেয়েটি
           কে যেন রে এঁকে রেখেছে।
      মুখখানি কেন গো অমন ধারা,
     কোন্‌খানে হয়েছে পথহারা,
     কারে যেন কী কথা শুধাবে,
           শুধাইতে ভয়ে হয় সারা।
     চরণ চলিতে বাধে বাধে,
           শুধালে কথাটি নাহি কয়।
           বড়ো বড়ো আকুল নয়নে
           শুধু মুখপানে চেয়ে রয়।
           নয়ন করিছে ছলছল,
           এখনি পড়িবে যেন জল।

          সাঁঝেতে নিরালা সব ঠাঁই,
          মাঠে কোথাও জনপ্রাণী নাই —
          দূরে অতি দূরে দেখা যায়,
               মলিন সে সাঁঝের আলোতে
          ছায়া ছায়া গাছপালাগুলি
               মেশে মেশে মেঘের কোলেতে।
         বড়ো তোর বাজিতেছে পায়,
         আয় রে আমার কোলে আয়।
         আ মরি জননী তোর কে,
                বল্‌ রে কোথায় তোর ঘর।
         তরাসে চাহিস কেন রে,
                আমারে বাসিস কেন পর ?


               গ্রামে
নবীন প্রভাত-কনক-কিরণে
     নীরবে দাঁড়ায়ে গাছপালা —
কাঁপে মৃদু মৃদু কী যেন আরামে,
    বায়ু বহে যায় সুধা-ঢালা।
নীল আকাশেতে নারিকেল-তরু,
    ধীরে ধীরে তার পাতা নড়ে —
প্রভাত আলোতে কুঁড়েঘরগুলি,
    জলে ঢেউগুলি ওঠে পড়ে।
দুয়ারে বসিয়া তপনকিরণে
    ছেলেরা মিলিয়া করে খেলা,
মনে হয় সবি কী যেন কাহিনী
     শুনেছিনু কোন্‌ ছেলেবেলা।
প্রভাতে যেন রে ঘরের বাহিরে
     সে কালের পানে চেয়ে আছি,
পুরাতন দিন হোথা হতে এসে
     উড়িয়ে বেড়ায় কাছাকাছি।
ঘর-দ্বার সব মায়া-ছায়া-সম,
     কাহিনীতে গাঁথা খেলা-ধূলি —
মধুর তপন, মধুর পবন,
     ছবির মতন কুঁড়েগুলি।
কেহ বা দোলায় কেহ বা দোলে,
     গাছতলে মিলে করে মেলা,
বাঁশি হাতে নিয়ে রাখাল বালক
     কেহ নাচে-গায়, করে খেলা।
এমনি যেন রে কেটে যায় দিন,
     কারো যেন কোনো কাজ নাই,
অসম্ভব যেন সকলি সম্ভব —
     পেতেছে যেন রে যাহা চাই।
কেবলি যেন রে প্রভাততপনে,
প্রভাতপবনে প্রভাতস্বপনে
বিরামে কাটায়, আরামে ঘুমায়
     গাছপালা বন কুঁড়েগুলি।
কাহিনীতে ঘেরা ছোটো গ্রামখানি,
মায়াদেবীর মায়া-রাজধানী,
পৃথিবী-বাহিরে কলপনা-তীরে
     করিছে যেন রে খেলা-ধূলি।


             আদরিণী
একটুখানি সোনার বিন্দু, একটুখানি মুখ,
     একা একটি বনফুল ফোটে-ফোটে হয়েছে,
     কচি কচি পাতার মাঝে মাথা থুয়ে রয়েছে।
চার দিকে তার গাছের ছায়া, চার দিকে তার নিষুতি,
     চার দিকে তার ঝোপেঝাপে আঁধার দিয়ে ঢেকেছে—
বনের সে যে স্নেহের ধন আদরিণী মেয়ে,
     তারে বুকের কাছে লুকিয়ে যেন রেখেছে।

একটুখানি রূপের হাসি আঁধারেতে ঘুমিয়ে আলা,
     বনের স্নেহ শিয়রেতে জেগে আছে।
সুকুমার প্রাণটুকু তার কিছু যেন জানে না,
     চোখে শুধু সুখের স্বপন লেগে আছে।
একটি যেন রবির কিরণ ভোরের বেলা বনের মাঝে
     খেলাতেছিল নেচে নেচে,
নিরালাতে গাছের ছায়ে, আঁধারেতে শ্রান্তকায়ে
     সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
বনদেবী করুণ-হিয়ে তারে যেন কুড়িয়ে নিয়ে
     যতন করে আপন ঘরেতে।
থুয়ে কোমল পাতার'পরে মায়ের মতো স্নেহভরে
     ছোঁয় তারে কোমল করেতে।
ধীরি ধীরি বাতাস গিয়ে আসে তারে দোলা দিয়ে,
     চোখেতে চুমো খেয়ে যায়।
ঘুরে ফিরে আশেপাশে বার বার ফিরে আসে,
     হাতটি বুলিয়ে দেয় গায়।

একলা পাখি গাছের শাখে কাছে তোর বসে থাকে,
     সারা দুপুরবেলা শুধু ডাকে,
যেন তার আর কেহ নাই, সারা দিন একলাটি তাই
     স্নেহভরে তোরে নিয়েই থাকে।
ও পাখির নাম জানি নে, কোথায় ছিল কে তা জানে,
     রাতের বেলায় কোথায় চলে যায়,
দুপুরবেলা কাছে আসে- সারা দিন বসে পাশে
     একটি শুধু আদরের গান গায়।
রাতে কত তারা ওঠে, ভোরের বেলা চলে যায়
ে—
     তোরে তো কেউ দেখে না, জানে না।
এক কালে তুই ছিলি যেন ওদেরই ঘরের মেয়ে,
    আজকে রে তুই অজানা অচেনা।
নিত্যি দেখি রাতের বেলা একটি শুধু জোনাই আসে,
    আলো দিয়ে মুখপানে তোর চায়।
কে জানে সে কী যে করে! তারা-জন্মের কাহিনী তোর
    কানে বুঝি স্বপন দিয়ে যায়।
ভোরের বেলা আলো এল, ডাকছে রে তোর নামটি ধরে,
    আজকে তবে মুখখানি তোর তোল্‌,
    আজকে তবে আঁখিটি তোর খোল্‌,
লতা জাগে, পাখি জাগে গায়ের কাছে বাতাস লাগে,
    দেখি রে — ধীরে ধীরে দোল্‌ দোল্‌ দোল্‌।


            খেলা
    ছেলেতে মেয়েতে করে খেলা
    ঘাসের'পরে সাঁঝের বেলা।

ঘোর ঘোর গাছের তলে তলে,
     ফাঁকায় পড়েছে মলিন আলো,
কোথাও যেন সোনার ছায়া ছায়া
     কোথাও যেন আঁধার কালো কালো।
আকাশের ধারে ধারে ঘিরে,
    বসেছে রাঙা মেঘের মেলা— 
শ্যামল ঘাসের'পরে, সাঁঝে
আলো-আঁধারের মাঝে মাঝে,
     ছেলেতে মেয়েতে করে খেলা।
ওরা যে কেন হেসে সারা,
কেন যে করে অমনধারা,
     কেন যে লুটোপুটি,
    কেন যে ছুটোছুটি,
কেন যে আহ্লাদে কুটিকুটি।
     কেহ বা ঘাসে গড়ায়,
     কেহ বা নেচে বেড়ায়,
     সাঁঝের সোনা-আকাশে
     হাসির সোনা ছড়ায়।
     আঁখি দুটি নৃত্য করে,
     নাচে চুল পিঠের'পরে,
   হাসিগুলি চোখে মুখে লুকোচুরি খেলা করে।
যেন
     মেঘের কাছে ছুটি পেয়ে
           বিদ্যুতেরা এল ধেয়ে,
      আনন্দে হল রে আপন-হারা।
ওদের
     হাসি দেখে খেলা দেখে
             আকাশের এক ধারে থেকে
      মৃদু মৃদু হাসছে একটি তারা।
 

ঝাউগাছে পাতাটি নড়ে না,
কামিনীর পাপড়িটি পড়ে না।
     আঁধার কাকের দল
     সাঙ্গ করি কোলাহল
     কালো কালো গাছের ছায়,
     কে কোথায় মিশায়ে যায় —
আকাশেতে পাখিটি ওড়ে না।
     সাড়াশব্দ কোথায় গেল,
     নিঝুম হয়ে এল এল
গাছপালা বন গ্রামের আশেপাশে।
     শুধু খেলার কোলাহল,
     শিশুকন্ঠের কলকল,
হাসির ধ্বনি উঠেছে আকাশে।

     কত আর খেলবি ও রে,
     নেচে নেচে হাতে ধ'রে
যে যার ঘরে চলে আয় ঝাট্‌,
আঁধার হয়ে এল পথঘাট।
     সন্ধ্যাদীপ জ্বলল ঘরে,
    চেয়ে আছে তোদের তরে—
তোদের না হেরিলে মার কোলে
ঘরের প্রাণ কাঁদে সন্ধে হলে।


               ঘুম
     ঘুমিয়ে পড়েছে শিশুগুলি,
     খেলাধুলা সব গেছে ভুলি।

ধীরে নিশীথের বায় আসে খোলা জানালায়,
      ঘুম এনে দেয় আঁখিপাতে,
শয্যায় পায়ের কাছে খেলেনা ছড়ানো আছে,
     ঘুমিয়েছে খেলাতে-খেলাতে।
এলিয়ে গিয়েছে দেহ, মুখে দেবতার স্নেহ
    পড়েছে রে ছায়ার মতন,
কালো কালো চুল তার বাতাসেতে বার বার
    উড়ে উড়ে ঢাকিছে বদন।
তারার আলোর মতো হাসিগুলি আসে কত,
     আধো-খোলা অধরেতে তার
     চুমো খেয়ে যায় কত বার।
সারা রাত স্নেহসুখে তারাগুলি চায় মুখে,
     যেন তারা করে গলাগলি,
     কত কী যে করে বলাবলি!
যেন তারা আঁচলেতে আঁধারে আলোতে গেঁথে
     হাসিমাখা সুখের স্বপন,
ধীরে ধীরে স্নেহভরে শিশুর প্রাণের'পরে
     একে একে করে বরিষন।
কাল যবে রবিকরে কাননেতে থরে থরে
     ফুটে ফুটে উঠিবে কুসুম,
ওদেরো নয়নগুলি ফুটিয়া উঠিবে খুলি,
     কোথায় মিলায়ে যাবে ঘুম।
প্রভাতের আলো জাগি যেন খেলাবার লাগি
    ওদের জাগায়ে দিতে চায়,
আলোতে ছেলেতে ফুলে এক সাথে আঁখি খুলে
    প্রভাতে পাখিতে গান গায়।


                বিদায়
          সে যখন বিদায় নিয়ে গেল,
তখন
   নবমীর চাঁদ অস্তাচলে যায়।
          গভীর রাতি নিঝুম চারি দিক,
          আকাশেতে তারা অনিমিখ,
                ধরণী নীরবে ঘুমায়।
          হাত দুটি তার ধরে দুই হাতে
                মুখের পানে চেয়ে সে রহিল,
          কাননে বকুল তরুতলে
                একটিও সে কথা না কহিল।
         অধরে প্রাণের মলিন ছায়া,
               চোখের জলে মলিন চাঁদের আলো,
         যাবার বেলা দুটি কথা বলে
               বনপথ দিয়ে সে চলে গেল।
ঘন গাছের পাতার মাঝে
        আঁধার পাখি গুটিয়ে পাখা,
          তারি উপর চাঁদের আলো শুয়েছে,
ছায়াগুলি এলিয়ে দেহ
          আঁচলখানি পেতে যেন
          গাছের তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে।
গভীর রাতে বাতাসটি নেই —
  নিশীথে সরসীর জলে
         কাঁপে না বনের কালো ছায়া,
ঘুম যেন ঘোমটা-পরা
         বসে আছে ঝোপেঝাপে,
        পড়ছে বসে কী যেন এক মায়া।

       চুপ করে হেলে সে বকুল গাছে,
      রমণী একেলা দাঁড়ায়ে আছে।
এলোথেলো চুলের মাঝে
     বিষাদমাখা সে মুখখানি,
           চাঁদের আলো পড়েছে তার'পরে।
পথের পানে চেয়ে ছিল,
    পথের পানেই চেয়ে আছে,
          পলক নাহি তিলেক কালের তরে।
গেল রে কে চলে গেল,
     ধীরে ধীরে চলে গেল,
         কী কথা সে বলে গেল হায়,
অতি দূর অশথের ছায়ে       মিশায়ে কে গেল রে,
           রমণী দাঁড়ায়ে জোছনায়।
সীমাহীন জগতের মাঝে      আশা তার হারায়ে গেল,
          আজি এই গভীরে নিশীথে,
শূন্য অন্ধকারখানি             মলিন মুখশ্রী নিয়ে
          দাঁড়িয়ে রহিল এক
ভিতে।

         পশ্চিমের আকাশসীমায়
         চাঁদখানি অস্তে যায় যায়।
ছোটো ছোটো মেঘগুলি       সাদা সাদা পাখা তুলি
         চলে যায় চাঁদের চুমো নিয়ে,
আঁধার গাছের ছায়           ডুবু ডুবু জোছনায়
         ম্লানমুখী রমণী দাঁড়িয়ে।