গীতবিতান

  বিচিত্র
 

 

১০১

তিমিরময় নিবিড় নিশা    নাহি রে নাহি দিশা—

একেলা ঘনঘোর পথে,   পান্থ, কোথা যাও

বিপদ দুখ নাহি জানো,   বাধা কিছু না মানো,

অন্ধকার হতেছ পার— কাহার সাড়া পাও

দীপ হৃদয়ে জ্বলে,  নিবে না সে বায়ুবলে—

মহানন্দে নিরন্তর একি গান গাও।

সমুখে অভয় তব, পশ্চাতে অভয়রব—

অন্তরে বাহিরে কাহার মুখ চাও

 

১০২

হায় হায় রে, হায় পরবাসী,

হায় গৃহছাড়া উদাসী

অন্ধ অদৃষ্টের আহবানে

কোথা অজানা অকূলে চলেছিস ভাসি

শুনিতে কি পাস দূর আকাশে  কোন্ বাতাসে

সর্বনাশার বাঁশি—

ওরে, নির্মম ব্যাধ যে গাঁথে মরণের ফাঁসি।

রঙিন মেঘের তলে গোপন অশ্রুজলে

বিধাতার দারুণ বিদ্রপবজ্রে

সঞ্চিত নীরব অট্টহাসি

১০৩

সুন্দরের বন্ধন নিষ্ঠুরের হাতে   ঘুচাবে কে।

নিঃসহায়ের অশ্রুবারি পীড়িতের চক্ষে  মুছাবে কে

আর্তের ক্রন্দনে হেরো ব্যথিত বসুন্ধরা,

অন্যায়ের আক্রমণে বিষবাণে জর্জরা—

প্রবলের উত্পীড়নে

কে বাঁচাবে দুর্বলেরে।

অপমানিতেরে কার দয়া বক্ষে  লবে ডেকে

 

১০৪

আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি,

অলস যেন না রয় ডানা দুটি

ওরে পাখি, ঘন বনের তলে

বাসা তোরে ভুলিয়ে রাখে ছলে,

রাত্রি তোরে মিথ্যে করে বলে—

শিথিল কভু হবে না তার মুঠি

জানিস নে কি কিসের আশা চেয়ে

ঘুমের ঘোরে উঠিস গেয়ে গেয়ে।

জানিস নে কি ভোরের আধার-মাঝে

আলোর আশা গভীর সুরে বাঁধে,

আলোর আশা গোপন রহে না যে—

রুদ্ধ কুঁড়ির বাঁধন ফেলে টুটি

 

১০৫

কোথায় ফিরিস পরম শেষের অন্বেষণে।

অশেষ হয়ে সেই তো আছে এই ভুবনে

তারি বাণী দু হাত বাড়ায় শিশুর বেশে,

আধো ভাষায় ডাকে তোমার বুকে এসে,

তারি ছোঁওয়া লেগেছে ওই কুসুম বনে

কোথায় ফিরিস ঘরের লোকের অন্বেষণে—

পর হয়ে সে দেয় যে দেখা ক্ষণে ক্ষণে।

তার বাসা-যে সকল ঘরের বাহির-দ্বারে,

তার আলো যে সকল পথের ধারে ধারে,

তাহারি রূপ গোপন রূপে জনে জনে

 

১০৬

চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।

চেয়ো না চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি

রাখিতে চাহ, বাঁধিতে চাহ যারে,

আঁধারে তাহা মিলায়   মিলায় বারে বারে

বাজিল যাহা প্রাণের বীণা-তারে

সে তো কেবলই গান কেবলই বাণী

পরশ তার নাহি রে মেলে, নাহি রে পরিমাণ—

দেবসভায় যে সুধা করে পান।

নদীর স্রোতে, ফুলের বনে বনে,

মাধুরী-মাখা হাসিতে আঁখিকোণে,

সে সুধাটুকু পিয়ো আপন-মনে—

মুক্তরূপে নিয়ো তাহারে জানি

 

১০৭

রয় যে কাঙাল শূন্য হাতে, দিনের শেষে

দেয় সে দেখা নিশীথরাতে স্বপনবেশে

আলোয় যারে মলিনমুখে মৌন দেখি

আঁধার হলে আঁখিতে তার দীপ্তি একি—

বরণমালা কে যে দোলায় তাহার কেশে

দিনের বীণায় যে ক্ষীণ তারে ছিল হেলা

ঝঙ্কারিয়া ওঠে যে তাই রাতের বেলা।

তন্দ্রাহারা অন্ধকারের বিপুল গানে

মন্দ্রি ওঠে সারা আকাশ কী আহবানে—

তারার আলোয় কে চেয়ে রয় নির্নিমেষে

 

১০৮

সে কোন্ পাগল যায়  যায় পথে তোর,  যায় চলে ওই একলা রাতে—

তারে ডাকিস নে  ডাকিস নে তোর আঙিনাতে

সুদূর দেশের বাণী ও যে যায়   যায় বলে, হায়, কে তা বোঝে—

কী সুর বাজায় একতারাতে

কাল সকালে রইবে না   রইবে না তো,

বৃথাই কেন আসন পাতো।

বাঁধন-ছেঁড়ার মহোত্সবে

গান যে ওরে গাইতে হবে

নবীন আলোর বন্দনাতে

 

১০৯

পরবাসী, চলে এসো ঘরে

অনুকূল সমীরণ-ভরে

ওই দেখ কতবার হল খেয়া-পারাবার,

সারিগান উঠিল অম্বরে

আকাশে আকাশে আয়োজন,

বাতাসে বাতাসে আমন্ত্রণ।

মন যে দিল সাড়া, তাই তুমি গৃহছাড়া

নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে

 

১১০

ছিল যে পরানের   অন্ধকারে

এল সে ভুবনের    আলোক-পারে

স্বপনবাধা টুটি   বাহিরে এল ছুটি,

অবাক্ আঁখি দুটি  হেরিল তারে

মালটি গেঁথেছিনু  অশ্রুধারে,

তারে যে বেঁধেছিনু  সে মায়াহারে।

নীরব বেদনায় পূজিনু  যারে হায়

নিখিল তারি গায়  বন্দনা রে

 

১১১

যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে     সে কাঁদনে সেও কাঁদিল।

যে বাঁধনে মোরে বাঁধিছে    সে বাঁধনে তারে বাঁধিল

পথে পথে তারে খুঁজিনু     মনে মনে তারে পূজিনু,

সে পূজার মাঝে লুকায়ে     আমারেও সে যে সাধিল

এসেছিল মন হরিতে         মহাপারাবার পারায়ে।

ফিরিল না আর তরীতে,      আপনারে গেল হারায়ে।

তারি আপনারই মাধুরী       আপনারে করে চাতুরী,

ধরিবে কি ধারা দিবে সে    কী ভাবিয়া ফাঁদ ফাঁদিল

 

১১২

আমরা  লক্ষ্মীছাড়ার দল   ভবের  পদ্মপত্রে জল

সদা করছি টলোমল।

মোদের আসা-যাওয়া শূন্য হাওয়া, নাইকো ফলাফল

নাহি জানি করণ-কারণ, নাহি জানি ধরণ-ধারণ,

নাহি মানি শাসন-বারণ গো—

আমরা আপন রোখে মনের ঝোঁকে ছিড়েছি শিকল

লক্ষ্মী, তোমার বাহনগুলি ধনে পুত্রে উঠুন ফুলি,

লুঠুন তোমার চরণধূলি গো—

আমরা  স্কন্ধে লয়ে কাঁথা ঝুলি ফিরব ধরাতল।

তোমার  বন্দরেতে বাঁধা ঘাটে  বোঝাই-করা সোনার পাটে

অনেক রত্ন অনেক হাটে গো—

আমরা নোঙর-ছেঁড়া ভাঙা তরী ভেসেছি কেবল

আমরা এবার খুঁজে দেখি  অকূলেতে কূল মেলে কি,

দ্বীপ আছে কি ভবসাগরে।

যদি  সুখ না জোটে দেখব ডুবে কোথায় রসাতল।

আমরা জুটে সারা বেলা   করব হতভাগার মেলা,

গাব গান খেলব খেলা গো—

কণ্ঠে যদি গান না আসে করব কোলাহল

 

১১৩

ওগো, তোমরা সবাই ভালো—

যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে, সেই আমাদের ভালো—

আমাদের এই আঁধার ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো

কেউ বা অতি জ্বলো-জ্বলো, কেউ বা ম্লান’ ছলো-ছলো,

কেউ বা কিছু দহন করে, কেউ বা স্নিগ্ধ আলো

নূতন প্রেমে নূতন বধূ  আগাগোড়া কেবল মধু,

পুরাতনে অম্ল-মধুর   একটুকু ঝাঁঝালো।

বাক্য যখন বিদায় করে  চক্ষু এসে পায়ে ধরে,

রাগের সঙ্গে অনুরাগে সমান ভাগে ঢালো

আমার তৃষ্ণা, তোমার সুধা— তোমার তৃপ্তি, আমরা ক্ষুধা—

তোমার কথা বলতে কবির কথা ফুরালো।

যে মূর্তি নয়নে জাগে  সবই আমার ভালো লাগে—

কেউ বা দিব্যি গৌরবরন, কেউ বা দিব্যি কালো

 

১১৪

ভালো মানুষ নই রে মোরা ভালো মানুষ নই—

গুণের মধ্যে ওই আমাদের, গুণের মধ্যে ওই

দেশে দেশে নিন্দে রটে,   পদে পদে বিপদ ঘটে—

পুঁথির কথা কই নে মোরা, উল্টো কথা কই

জন্ম মোদের ত্র্যহস্পর্শে, সকল অনাসৃষ্টি।

ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি।

অযাত্রাতে নৌকো ভাসা, রাখি নে, ভাই, ফলের আশা—

আমাদের আর নাই যে গতি ভেসেই চলা বই

 

১১৫

আমাদের ভয় কাহারে।

বুড়ো বুড়ো চোর ডাকাতে   কী আমাদের করতে পারে।

                                      আমাদের  রাস্তা সোজা, নাইকো গলি— নাইকো ঝুলি, নাইকো থলি—

ওরা  আর যা কাড়ে কাড়ুক, মোদের  পাগলামি কেউ কাড়বে না রে

আমরা চাই নে আরাম, চাই নে বিরাম,

    চাই নে ফল, চাই নে রে নাম—

মোরা ওঠায় পড়ায় সমান নাচি,

সমান খেলি জিতে হারে

 

১১৬

আমাদের   পাকবে না চুল গো— মোদের পাকবে না চুল।

আমাদের  ঝরবে না ফুল গো— মোদের ঝরবে না ফুল

আমরা  ঠেকব না তো কোনো শেষে, ফুরোয় না পথ কোনো দেশে রে,

আমাদের  ঘুচবে ভুল গো— মোদের ঘুচবে না ভুল

আমার  নয়ন মুদে করব না ধ্যান  করব না ধ্যান।

নিজের  মনের কোণে খুঁজব না জ্ঞান খুঁজব না জ্ঞান।

আমরা ভেসে চলি স্রোতে স্রোতে   সাগর-পানে শিখর হতে রে,

আমাদের  মিলবে না কূল গো— মোদের মিলবে না কূল

 

১১৭

পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে,

মোদের  পাড়ার থোড়া  দূর দিয়ে যাইয়ে

                                     হেথা   সা রে গা মা -গুলি  সদাই করে চুলোচুলি,

কড়ি কোমল কোথা   গেছে তলাইয়ে

হেথা আছে তাল-কাটা বাজিয়ে—

বাধাবে সে কাজিয়ে।

চৌতালে ধামারে

      কে কোথায় ঘা মারে—

তোরে-কেটে মেরে-কেটে ধাঁ-ধাঁ-ধাঁইয়ে

 

১১৮

ও ভাই কানাই, কারে জানাই  দুঃসহ মোর দুঃখ।

তিনটে-চারটে পাস করেছি, নই নিতান্ত মুক্‌খ

তুচ্ছ সা-রে-গা-মা’য়  আমায় গলদ্‌ঘর্ম ঘামায়।

বুদ্ধি আমার যেমনি হোক কান দুটো নয় সূক্ষ্ম—

এই বড়ো মোর দুঃখ কানাই রে,

এই বড়ো মোর দুঃখ

বান্ধবীকে গান শোনাতে ডাকতে হয় সতীশকে,

হৃদয়খানা ঘুরে মরে গ্রামোফোনের ডিস্কে।

কণ্ঠখানার জোর আছে তাই  লুকিয়ে গাইতে ভরসা না পাই—

স্বয়ং প্রিয়া বলেন, ‘তোমার গলা বড়োই রুক্ষ’

এই বড়ো মোর দুঃখ কানাই রে,

এই বড়ো মোর দুঃখ

 

১১৯

কাঁটাবনবিহারিণী সুর-কানা দেবী

তাঁরি পদ সেবি, করি তাঁহারই ভজনা

বদ্‌কণ্ঠলোকবাসী আমরা কজনা

                                     আমাদের বৈঠক বৈরাগীপুরে   রাগ-রাগিণীর বহু দূরে,

গত জনমের সাধনেই   বিদ্যা এনেছি সাথে এই গো

নিঃসুর-রসাতল-তলায় মজনা

সতেরো পুরুষ গেছে, ভাঙা তম্বুরা

রয়েছে মর্চে ধরি বেসুর-বিধুরা।

বেতার সেতার দুটো, তবলাটা ফাটা-ফুটো,

সুরদলনীর করি এ নিয়ে যজনা—

আমরা কজনা

 

১২০

                                      আমরা      না-গান-গাওয়ার দল রে, আমরা না-গলা-সাধার।

মোদের  ভৈঁরোরাগে  প্রভাতরবি রাগে  মুখ-আঁধার

আমাদের এই অমিল-কণ্ঠ-সমবায়ের চোটে

পাড়ার কুকুর সমস্বরে,  ও ভাই,  ভয়ে ফুক্‌রে ওঠে—

আমরা কেবল ভয়ে মরি ধূর্জটিদাদার

মেঘমল্লার ধরি যদি ঘাটে অনাবৃষ্টি,

ছাতিওয়ালার দোকান জুড়ে লাগে শনির দৃষ্টি।

আধখানা সুর যেমনি লাগাই বসন্তবাহারে

মলয়বায়ুর ধাত ফিরে যায়, তত্ক্ষণাৎ আহা রে

সেই হাওয়াতে বিচ্ছেদতাপ পালায় শ্রীরাধার

অমাবস্যার রাত্রে যেমনি বেহাগ গাইতে বসা

কোকিলগুলোর লাগে দশম-দশা।

শুক্লকোজাগরী নিশায় জয়জয়ন্তী ধরি,

অমনি মরি মরি

রাহু-লাগার বেদন লাগে পূর্ণিমা-চাঁদার

 

১২১

মোদের কিছু নাই রে নাই, আমরা ঘরে বাইরে গাই—

তাইরে নাইরে নাইরে না।   না না না।

যতই দিবস যায় রে যায়  গাই রে সুখে হায় রে হায়—

তাইরে নাইরে নাইরে না।     না না না

যারা  সোনার চোরাবালির ’পরে পাকা ঘরের-ভিত্তি গড়ে

                                     তাদের  সামনে মোরা গান গোয় যাই— তাইরে নাইরে নাইরে না।

না না না

 যখন          থেকে থেকে গাঁঠের পানে   গাঁঠকাটারা দৃষ্টি হানে

 তখন          শূন্যঝুলি দেখায়ে গাই— তাইরে নাইরে নাইরে না।  না না না

যখন  দ্বারে আসে মরণবুড়ি মুখে তাহার বাজাই তুড়ি,

                                তখন           তান দিয়ে গান জুড়ি রে ভাই— তাইরে নাইরে নাইরে না।  না না না

এ যে বসন্তরাজ এসেছে আজ, বাইরে তাহার উজ্জ্বল সাজ,

ওরে            অন্তরে তার বৈরাগী গায়— তাইরে নাইরে নাইরে না।  না না না

সে যে উত্সবদিন চুকিয়ে দিয়ে, ঝরিয়ে দিয়ে, শুকিয়ে দিয়ে,

                            দুই              রিক্ত হাতে তাল দিয়ে গায়— তাইরে নাইরে নাইরে না।

না না না

 

১২২

এবার   যমের দুয়োর খোলা পেয়ে   ছুটছে সব ছেলে মেয়ে।

হরিবোল হরি বোল হরিবোল।

রাজ্য জুড়ে মস্ত খেলা,  মরণ-বাঁচন-অবহেলা—

ও ভাই, সবাই মিলে প্রাণটা দিলে সুখ আছে কি মরার চেয়ে।

হরিবোল হরি বোল হরিবোল

বেজেছে ঢোল, বেজেছে ঢাক, ঘরে ঘরে পড়েছে ডাক,

এমন    কাজকর্ম চুলোতে যাক— কেজো লোক সব আয় রে ধেয়ে।

হরিবোল হরি বোল হরিবোল

রাজা প্রজা হবে জড়ো থাকবে না আর ছোটো বড়ো—

একই   স্রোতের মুখে ভাসবে সুখে বৈতরণীর নদী বেয়ে।

হরিবোল হরি বোল হরিবোল

 

১২৩

হায় হায় হায়   দিন চলে যায়।

   চা-স্পৃহ চঞ্চল  চাতকদল’ চল’ চল’ চল’ হে

                             টগ’বগ’-উচ্ছল কাথলিতল-জল কল’কল’ হে।

এল      চীনগগন হতে  পূর্বপবনস্রোতে  শ্যামলরসধরপুঞ্জ

শ্রাবণবাসরে রন ঝর’ঝর’ ঝরে,  ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।

এস’ পুঁথিপরিচারক  তদ্ধিতকারক  তারক তুমি কাণ্ডারী।

এস’ গণিতধুরন্ধর কাব্যপুরন্দর ভূবিবরণভাণ্ডারী।

এস’ বিশ্বভারনত শুষ্করুটিনপথ- মরু-পরিচারণক্লান্ত।

এস’ হিসাবপত্তরত্রস্ত  তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত  লোচনপ্রান্ত- ছল’ছল’ হে।

এস’ গীতিবীথিচর  তম্বুরকরধর তানতালতলমগ্ন।

এস’ চিত্রী চট’পট’ ফেলি তুলিকপট রেখাবর্ণবিলগ্ন।

এস’ কনস্‌টিট্যুশন- নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত।

এস কমিটিপলাতক  বিধানঘাতক  এস’ দিগভ্রান্ত টল’মল’ হে

 

১২৪

ওগো  ভাগ্যদেবী পিতামহী, মিটল আমার আশ—

    এখন তবে আজ্ঞা করো, বিদায় হবে দাস

জীবনের এই বাসররাতি  পোহায় বুঝি, নেবে বাতি—

বধূর দেখা নাইকো, শুধু প্রচুর পরিহাস

     এখন থেমে গেল বাঁশি, শুকিয়ে এল পুষ্পরাশি,

উঠল তোমার অট্টহাসি কাঁপায়ে আকাশ।

   ছিলেন যাঁরা আমায় ঘিরে  গেছেন যে যার ঘরে ফিরে,

আছ বৃদ্ধা ঠাকুরানী মুখে টানি বাস

 

১২৫

ওর ভাব দেখে যে পায় হাসি, হায় হায় রে।

মরণ-আয়োজনের মাঝে বসে আছেন কিসের কাজে

প্রবীণ প্রাচীন প্রবাসী। হায় হায় রে

এবার দেশে যাবার দিনে  আপনাকে ও নিক-না চিনে,

সবাই মিলে সাজাও ওকে নবীন রূপে সন্ন্যাসী। হায় হায় রে।

এবার ওকে মজিয়ে দে রে  হিসাব-ভুলের বিষম ফেরে।

কেড়ে নে ওর থলি থালি, আয় রে নিয়ে ফুলের ডালি,

গোপন প্রাণের পাগ্‌লাকে ওর বাইরে দে আজ প্রকাশি। হায় হায় রে

 

১২৬

আমরা খুঁজি খেলার সাথি—

ভোর না হতেই জাগাই তাদের ঘুমায় যারা সারা রাতি

আমরা ডাকি পাখির গলায়, আমরা নাচি বকুলতলায়,

মন ভোলাবার মন্ত্র জানি,    হাওয়াতে ফাঁদ আমরা পাতি।

মরণকে তো মানি নে রে,

কালের ফাঁসি ফাঁসিয়ে দিয়ে লুঠ-করা ধন নিই যে কেড়ে।

আমরা তোমার মনোচোরা,   ছাড়ব না গো তোমায় মোরা—

চলছে কোন্ আঁধার পানে   সেথাও জ্বলে মোদের বাতি

 

১২৭

                                   মোদের   যেমন খেলা তেমনি যে কাজ             জানিস নে কি ভাই।

তাই       কাজকে কভু আমরা না ডরাই

খেলা মোদের লড়াই করা,              খেলা মোদের বাঁচা মরা,

খেলা ছাড়া কিছুই কোথাও নাই

খেলতে খেলতে ফুটেছে ফুল,           খেলতে খেলতে ফল যে ফলে—

খেলারই ঢেউ জলে স্থলে।

ভয়ের ভীষণ রক্তরাগে       খেলার আগুন যখন লাগে

ভাঙাচোরা জ্ব’লে যে হয় ছাই

 

১২৮

সব কাজে হাত লাগাই মোরা     সব কাজেই।

বাধা বাঁধন নেই গো নেই

দেখি খুঁজি বুঝি,  কেবল   ভাঙি গড়ি যুঝি,

 মোরা  সব দেশেতেই বেড়াই ঘুরে  সব সাজেই

পারি নাইবা পারি,  নাহয়   জিতি কিম্বা হারি—

যদি   অমনিতে হাল ছাড়ি   মরি সেই লাজেই।

আপন হাতের জোরে   আমরা তুলি সৃজন ক’রে,

আমরা  প্রাণ দিয়ে ঘর বাঁধি, থাকি তার মাঝেই

 

১২৯

কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন,  ও তার  ঘুম ভাঙাইনু রে।

লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপনে, ওগো,  তায় জাগাইনু রে

    পোষ মেনেছে হাতের তলে    যা বলাই সে তেমনি বলে—

দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে

অচল ছিল, সচল হয়ে    ছুটছে ওই জগৎ-জয়ে—

          নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে

 

১৩০

        আমরা   চাষ করি আনন্দে।

    মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে

রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,

    বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে

সবুজ প্রাণের গানের লেখা     রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,

     মাতে রে কোন্ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।

ধানের শিষে পুলক ছোটে— সকল ধরা হেসে ওঠে

অঘ্রানেরই সোনার রোদে, পূর্ণিমারই চন্দ্রে

 

        ১৩১

তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও   কুলুকুলুকল নদীর স্রোতের মতো।

আমরা তীরেতে দাঁড়ায়ে চাহিয়া থাকি,   মরমে গুমরি মরিছে কামনা কত।

আপনা-আপনি কানাকানি কর সুখে,  কৌতুকছটা উছলিছে চোখে মুখে,

কমলচরণ পড়িছে ধরণী-মাঝে,   কনকনূপুর রিনিকি ঝিনিকি বাজে

 

অঙ্গে অঙ্গে বাঁধিছ রঙ্গপাশে,,  বাহুতে বাহুতে জড়িত ললিত লতা।

ইঙ্গিতরসে ধ্বনিয়া উঠিছে হাসি,  নয়নে নয়নে বহিছে গোপন কথা।

আঁখি নত করি একেলা গাঁথিছ ফুল,   মুকুর লইয়া যতনে বাঁধিছ চুল।

গোপন হৃদয়ে আপনি করিছ খেলা—

কী কথা ভাবিছ, কেমন কাটিছে বেলা

 

আমরা বৃহৎ অবোধ ঝড়ের মতো    আপন আবেগে  ছুটিয়া চলিয়া আসি,

বিপুল আঁধারে অসীম আকাশ ছেয়ে   টুটিবারে চাহি আপন হৃদয়রাশি।

তোমরা বিজুলি হাসিতে হাসিতে চাও, আঁধার ছেদিয়া মরম বিঁধিয়া দাও—

গগনের গায়ে আগুনের রেখা আঁখি   চকিত চরণে চলে যাও দিয়ে ফাঁকি

 

অযতনে বিধি গড়েছে মোদের দেহ,   নয়ন অধর দেয় নি ভাষার ভরে—

মোহনমধুর মন্ত্র জানি নে মোরা, আপনা প্রকাশ করিব কেমন ক’রে।

তোমরা কোথায় আমরা কোথায় আছি,

কোনো সুলগনে হব না কি কাছাকাছি—

তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাবে, আমরা দাঁড়ায়ে রহিব এমনি ভাবে

 

                                                                   ১৩২

ওগো পুরবাসী,

          আমি  দ্বারে দাঁড়িয়ে আছি উপবাসী

হেরিতেছি সুখমেলা,    ঘরে ঘরে কত খেলা,

শুনিতেছি সারা বেলা সুমধুর বাঁশি

চাহি না অনেক ধন,          রব না অধিক ক্ষণ,

যেথা হতে আসিয়াছি সেথা যাব ভাসি।

তোমরা আনন্দে রবে         নব নব উত্সবে,

কিছু ম্লান নাহি হবে গৃহভরা হাসি

 

১৩৩

আমার যাবার সময় হল,   আমায় কেন রাখিস ধরে।

চোখের জলের বাঁধন দিয়ে  বাঁধিস নে আর মায়াডোরে

ফুরিয়েছে জীবনের ছুটি,   ফিরিয়ে নে তোর নয়ন দুটি—

নাম ধরে আর ডাকিস নে ভাই,  যেতে হবে ত্বরা করে

 

১৩৪

যেতে হবে, আর দেরি নাই।

পিছিয়ে পড়ে রবি কত, সঙ্গীরা যে গেল সবাই

আয় রে ভবের খেলা সেরে, আঁধার করে এসেছে রে,

পিছন ফিরে বারে বারে কাহার পানে চাহিস রে ভাই

খেলতে এল ভবের নাটে নতুন লোক নতুন খেলা।

হেথা হতে আয় রেঢ সরে,   নইলে তোরে মারবে ঢেলা।

   নামিয়ে দে রে প্রাণের বোঝা, আরেক দেশে চল্ রে সোজা—

সেথা নতুন করে বাঁধবি বাসা,

নতুন খেলা খেলবি সে ঠাঁই

 

১৩৫

আমি শুধু রইনু বাকি।

যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি

আমার ব’লে ছিল যারা  আর তো তারা দেয় না সাড়া—

কোথায় তারা, কোথায় তারা, কেঁদে কেঁদে কারে ডাকি

বল্ দেখি মা, শুধাই তোরে— আমার কিছু রাখলি নে রে,

আমি কেবল আমায় নিয়ে কোন্ প্রাণেতে বেঁচে আছি

 

১৩৬

সারা বরষ দেখি নে, মা, মা, তুই আমার কেমন ধারা।

নয়নতারা হারিয়ে আমার অন্ধ হল নয়নতারা

এলি কি পাষাণী ওরে। দেখব তোরে আঁখি ভ’রে—

কিছুতেই থামে না যে, মা,  পোড়া এ নয়নের ধারা

 

১৩৭

যাহা পাও তাই লও,  হাসিমুখে ফিরে যাও।

কারে চাও, কেন চাও— আশা কে পূরাতে পারে

সবে চায়, কেবা পায়         সংসার চ’লে যায়—

যে বা হাসে, যে বা কাঁদে, যে বা প’ড়ে থাকে দ্বারে

 

১৩৮

মেঘেরা চলে চলে যায়,  চাঁদের ডাকে ‘আয়, আয়’।

ঘুমঘোরে বলে চাঁদ ‘কোথায় কোথায়’

না জানি কোথা চলিয়াছে,  কী জানি কী যে সেথা আছে,

আকাশের মাঝে চাঁদ চারি দিকে চায়

সুদূরে, অতি অতিদূরে  বুঝি রে কোন্ সুরপুরে

তারাগুলি ঘিরে ব’সে বাঁশরি বাজায়।

মেঘেরা তাই হেসে হেসে  আকাশে চলে ভেসে ভেসে,

লুকিয়ে চাঁদের হাসি চুরি করে যায়

 

১৩৯

(আমি)              শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি

 মম                 জল-ছলোছলো আঁখি মেঘে মেঘে

(আমরা             বেদনা ব্যাপিয়া যায় গো বেণুবনমর্মরে মর্মরে)

বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি

অনিমেষে আছে জেগে মেঘে মেঘে

(বিরহের পরপারে খুঁজিছে আকুল আঁখি

মিলনপ্রতিমাখনি— খুঁজিছে।)

 যে                  গিয়েছে দেখার বাহিরে

আছে                তারি উদ্দেশে চাহি রে।

(সে যে              চোখে মোর জল রেখে গেছে চোখের সীমানা পারায়ে।)

স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি

পুরব-পবন-বেগে মেঘে মেঘে

(কেশের পরশ তার পাই রে

পুরব-পবন-বেগে মেঘে মেঘে।)

শ্যামল তমালবনে

যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলিখনে

বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে—

(তার                না বলা কথার বেদনা বাজে গো—

চলার পথে পথে বাজে গো।)

কাঁপে নিশ্বাসে—

সেই                 বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া

ছায়ার রয়েছে লেগে মেঘে মেঘে

 

১৪০

সন্ন্যাসী যে জাগিল ওই, জাগিল ওই, জাগিল।

হাস্য-ভরা দখিন-বায়ে   অঙ্গ হতে দিল উড়ায়ে

শ্মশানচিতাভষ্মরাশি— ভাগিল কোথা ভাগিল।

মানসলোঢক শুভ্র আলো   চূর্ণ হয়ে রঙ জাগালো,

মদির রাগ লাগিল তারে— হৃদয়ে তার লাগিল

আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে—

রঙের ধারা ওই-যে বহে যায় রে

 

রঙের ঝড় উচ্ছ্বসিল গগনে,

রঙের ঢেউ রসের স্রোতে মাতিয়া ওঠে সঘনে—

ডাকিল বান আজি সে কোন্ কোটালে।

নাকাড়া বাজে কানাড়া বাজে বাঁশিতে—

কান্নাধারা মিলিয়া গেছে হাসিতে—

প্রাণের মাঝে গেছে ফোয়ারা তার ছোটালে।

 

এসেছে হাওয়া বাণীতে দোল-দোলানো, এসেছে পথ-ভোলানো—

এসেছে ডাক ঘরের-দ্বার-খোলানো।

আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে—

রঙের ধারা ওই-যে বহে যায় রে

 

উদয়রবি যে রাঙা রঙ রাঙায়ে  পূর্বাচলের দিয়েছে ঘুম ভাঙায়ে

অন্তরবি সে রাঙা রসে রসিল—

চিরপ্রাণের বিজয়বাণী ঘোষিল।

অরুণবীণা যে সুর দিল রণিয়া  সন্ধ্যাকাশে সে সুর উঠে ঘনিয়া

নীরব নিশীথিনীর বুকে নিখিল ধ্বনি ধ্বনিয়া।

আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে—

বাঁধন-হারা রঙের ধারা ওই-যে বহে যায় রে