গীতবিতান

   প্রেম (২০১-৩০০)


 

                 ২০১

আমার    নিখিল ভুবন হারালেম আমি যে।

        বিশ্ববীণায় রাগিণী যায় থামি যে॥

            গৃহহারা হৃদয় হায়   আলোহারা পথে ধায়,

                গহন তিমিরগুহাতলে যাই নামি যে॥

       তোমারি নয়নে সন্ধ্যাতারার আলো।

আমার পথের অন্ধকারে জ্বালো জ্বালো।

মরীচিকার পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে,

        দিন-অবসানে

তোমারি হৃদয়ে শ্রান্ত-পান্থ  অমৃততীর্থগামী যে॥

    তোমারি নয়নে সন্ধ্যাতারার আলো।

আমার পথের অন্ধকারে জ্বালো।

মরীচিকার পিছে পিছে   তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে,

        দিন-অবসানে

তোমারি হৃদয়ে শান্ত-পান্থ  অমৃততীর্থগামী যে

 

                        ২০২

না না,  ভুল কোরো না গো, ভুল কোরো না,

            ভুল কোরো না, ভালোবাসায়।

   ভুলায়ো না, ভুলায়ো না, ভুলায়ো না নিষ্ফল আশায়

বিচ্ছেদদুঃখ নিয়ে আমি থাকি,     দেয় না সে ফাঁকি,

            পরিচিত আমি তারি ভাষায়

    দয়ার ছলে তুমি হোয়ো না নিদয়।

    হৃদয় দিতে চেয়ে ভেঙো না হৃদয়।

    রেখো না লুব্ধ করে,         মরণের বাঁশিতে মুগ্ধ করে

            টেনে নিয়ে যেয়ো না সর্বনাশা

 

                  ২০৩

      ভুল করেছিনু, ভুল ভেঙেছে।

জেগেছি, জেনেছি-আর ভুল নয়, ভুল নয়

মায়ার পিছে-পিছে ফিরেছি, জেনেছি স্বপনসম সব মিছে-

    বিঁধেছে কাঁটা প্রাণে-এ তো ফুল নয়, ফুল নয়

        ভালোবাসা হেলা করিব না,

খেলা করিব না নিয়ে মন-হেলা করিব না।

    তব হৃদয়ে সখী, আশ্রয় মাগি।

            অতল সাগর সংসারে এ তো, কূল নয়, কূল নয়

 

                ২০৪

ডেকো না আমারে,  ডেকো না, ডেকো না।

    চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না

আমার বেদনা আমি নিয়ে এসেছি,

    মূল্য নাহি চাই যে ভালোবেসেছি,

        কৃপাকণা দিয়ে  আঁখিকোণে ফিরে দেখো না

আমার দুঃখজোয়ারের জলস্রোতে

    নিয়ে যাবে মোরে সব লাঞ্ছনা হতে।

        দূরে যাব যবে সরে  তখন চিনিবে মোরে-

            আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না

 

               ২০৫

যে ছিল আমার স্বপনচারিণী

    তারে    বুঝিতে পারি নি।

        দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে

শুভখনে কাছে ডাকিলে,

    লজ্জা আমায় ঢাকিলে গো,

        তোমারে    সহজে পেরেছি বুঝিতে

 

কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,

    কে মোরে ডাকিবে কাছে,

        কাহার প্রেমের বেদনায়    আমার মূল্য আছে,

            এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি নে যুঝিতে-

                আমি    তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে

 

                ২০৬

     হায় হতভাগিনী,

স্রোতে বৃথা গেল ভেসে-

            কূলে তরী লাগে নি, লাগে নি

কাটালি বেলা বীণাতে সুর বেঁধে, কঠিন টানে উঠল কেঁদে,

            ছিন্ন তারে থেমে গেল যে রাগিণী

    এই পথের ধারে এসে

ডেকে গেছে তোরে সে।

    ফিরায়ে দিলি তারে রুদ্ধদ্বারে-

বুক জ্বলে গেল গো, ক্ষমা তবুও কেন মাগি নি


                   ২০৭

       কোন্ সে ঝড়ের ভুল

            ঝরিয়ে দিল ফুল,

প্রথম যেমনি তরুণ মাধুরী মেলেছিল এ মুকুল,     হায় রে

                        নব প্রভাতের তারা

            সন্ধ্যাবেলায় হয়েছে পথহারা।

অমরবতীর  সুরযুবতীর   এ ছিল কানের দুল, হায় রে

    এ যে   মুকুটশোভার ধন।

হায় গো দরদী  কেহ থাক যদি  শিরে করো পরশন।

    এ কি স্রোতে যাবে ভেসে-দূর দয়াহীন দেশে

        কোন্‌খানে পাবে কূল,  হায় রে

 

               ২০৮

      ছি ছি, মরি লাজে, মরি লাজে-

কে সাজালো মোরে মিছে সাজে। হায়

    বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রুপে নিয়ে এল চুপে চুপে

        মোরে    তোমাদের দুজনের মাঝে

আমি নাই, আমি নাই-    আদরিণী লহো তব ঠাঁই

    যেথা তব আসন বিরাজে। হায়

 

                   ২০৯

শুভ মিলনলগনে বাজুক বাঁশি

    মেঘমুক্ত গগনে জাগুক হাসি

        কত দুখে কত দূরে দূরে    আঁধারসাগর ঘুরে ঘুরে

            সোনার তরী তীরে এল ভাসি।

                পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি

ওগো পুরবালা,

    আনো সাজিয়ে বরণডালা,

        যুগলমিলনমহোৎসবে    শুভ শঙ্খরবে

            বসন্তের আনন্দ দাও উচ্ছ্বাসি।

                পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি

 

                  ২১০

আর নহে, আর নহে-

    বসন্তবাতাস কেন আর শুষ্ক ফুলে বহে

        লগ্ন গেল বয়ে    সকল আশা লয়ে,

    এ কোন্‌ প্রদীপ জ্বালো    এ যে বক্ষ আমার দহে

    কানন মরু হল,

আজ এই সন্ধ্যা-অন্ধকারে সেথায় কী ফুল তোলো

        কাহার ভাগ্য হতে বরণমালা হরণ করো,

            ভাঙা ডালি ভরো-

মিলনমালার কণ্টকভার কণ্ঠে কি আর সহে

 

                ২১১

ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি,

    যা উড়ে, যা উড়ে, যা রে একাকী

বাজবে তোর পায়ে সেই বন্ধ, পাখাতে পাবি আনন্দ,

        দিশাহারা মেঘ যে গেল ডাকি

নির্মল দুঃখ যে সেই তো মুক্তি    নির্মল শূন্যের প্রেমে-

    আত্মবিড়ম্বনা দারুণ লজ্জা, নিঃশেষে যাক সে থেমে।

        দুরাশায় যে মরাবাঁচায়    এত দিন ছিলি তোর খাঁচায়,

                ধূলিতলে তারে যাবি রাখি

 

                     ২১২

যাক ছিঁড়ে, যাক ছিঁড়ে যাক    মিথ্যার জাল।

    দুঃখের প্রসাদে এল আজি  মুক্তির কাল॥

        এই ভালো ওগো ভালো    বিচ্ছেদবহ্নিশিখার আলো,

            নিষ্ঠুর সত্য করুক বরদান-

                ঘুচে যাক ছলনার অন্তরাল॥

যাও প্রিয়, যাও তুমি    যাও জয়রথে-

    বাধা দিব না পথে,

বিদায় নেবার আগে    মন তব স্বপ্ন হতে যেন জাগে-

    নির্মল হোক হোক সব জঞ্জাল॥

 

                    ২১৩

দুঃখের যজ্ঞ-অনল-জ্বলনে জন্মে যে প্রেম

        দীপ্ত সে হেম,

    নিত্য সে নিঃসংশয়,

        গৌরব তার অক্ষয়॥

            দুরাকাঙ্ক্ষার পরপারে    বিরহতীর্থে করে বাস

                যেথা জ্বলে ক্ষুব্ধ হোমাগ্নিশিখায়  চিরনৈরাশ-

                    তৃষ্ণাদাহনমুক্ত অনুদিন অমলিন রয়।

        গৌরব তার অক্ষয়॥

    অশ্রু-উৎস-জল-স্নানে তাপস জ্যোতির্ময়

আপনারে আহুতি-দানে    হল সে মৃত্যুঞ্জয়।

        গৌরব তার অক্ষয়॥

 

                ২১৪

    আমার     মন কেমন করে-

কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে॥

    অলখ পথের পাখি গেল ডাকি,

        গেল ডাকি সুদূর দিগন্তরে

    ভাবনাকে মোর ধাওয়ায়

সাগরপারের হাওয়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়।

                স্বপনবলাকা    মেলেছে ওই পাখা,

    আমার    বেঁধেছে কে সোনার পিঞ্জর    ঘরে॥

 

                  ২১৫

গোপন কথাটি রবে না গোপনে,

    উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।

        না না না, রবে না গোপনে॥

                    বিভল হাসিতে

                        বাজিল বাঁশিতে,

        স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে।

            না না না, রবে না গোপনে॥

    মধুপ গুঞ্জরিল,

মধুর বেদনায় আলোকপিয়াসি

    আশোক মুঞ্জরিল।

                        হৃদয়শতদল

                           করিছে টলমল

                 অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে।

                    না না না, রবে না গোপনে॥

 

                  ২১৬

বলো সখী, বলো তারি নাম

    আমার কানে কানে

যে নাম বাজে তোমার প্রাণের বীণার

    তানে তানে॥

                বসন্তবাতাসে বনবীথিকায়

                    সে নাম মিলে যাবে

                বিরহবিহঙ্গকলগীতিকায়।

                    সে নাম মদির হবে যে বকুলঘ্রাণে॥

    নাহয় সখীদের মুখে মুখে

সে নাম দোলা খাবে সকৌতুকে।

    পূর্ণিমারাত একা যবে

        অকারণে মন উতলা হবে

            সে নাম শুনাইব গানে গানে॥

 

                    ২১৭

অজানা সুর কে দিয়ে যায় কানে কানে।

ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে

      বিস্মৃত জন্মের ছায়ালোকে হারিয়ে-যাওয়া বীণার শোকে

      ফাগুন-হাওয়ায় কেঁদে ফিরে পথহারা রাগিণী।

               কোন বসন্তের মিলনরাতে তারার পানে

               ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে

 

           ২১৮

ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই,

    যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই।

        কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে

            প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে।

                এসো মম সার্থক স্বপ্ন

                    করো মম যৌবন সুন্দর,

                        দক্ষিণবায়ু আনো পুষ্পবনে।

ঘুচাও বিষাদের কুহেলিকা,

    নব প্রাণমন্ত্রের আনো বাণী।

        পিপাসিত জীবনের ক্ষুব্ধ আশা

            আঁধারে আঁধারে খোঁজে ভাষা

                শূন্যে পথহারা পবনের ছন্দে,

                    ঝরে-পড়া বকুলের গন্ধে॥

 

                   ২১৯

কোন্ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে

        এ কী সংশয়েরই অন্ধকারে।

দিশেহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায়

        মিলনতরণীখানি ধায় রে

            কোন বিচ্ছেদের পারে॥

 

                     ২২০

ওগো    কিশোর, আজি তোমার দ্বারে    পরান মম জাগে।

          নবীন করে করিবে তারে রঙিন তব রাগে॥

ভাবনাগুলি বাঁধনখোলা রচিয়া দিবে তোমার দোলা,

    দাঁড়িয়ো আসি হে ভাবে-ভোলা, আমার আঁখি-আগে॥

    দোলের নাচে বুঝি গো আছ অমরাবতীপুরে-

       বাজাও বেণু বুকের কাছে, বাজাও বেণু দূরে।

          শরম ভয় সকলি ত্যেজে মাধবী তাই আসিল সেজে-

            শুধায় শুধু, 'বাজায় কে যে মধুর মধুসুরে!'

        গগনে শুনি একি এ কথা, কাননে কী যে দেখি।

            একি মিলনচঞ্চলতা, বিরহব্যথা একি।

আঁচল কাঁপে ধরার বুকে, কী জানি তাহা সুখে না দুখে-

    ধরিতে যারে না পারে তারে স্বপনে দেখিছে কি।

            লাগিল দোল জলে স্থলে,  জাগিল দোল বনে বনে-

    সোহাগিনির হৃদয়তলে বিরহিণীর মনে মনে।

            মধুর মোরে বিধুর করে সুদূর তার বেণুর স্বরে,

                নিখিল হিয়া কিসের তরে দুলিছে অকারণে।

আনো গো আনো ভরিয়া ডালি করবীমালা লয়ে,

    আনো গো আনো সাজায়ে থালি কোমল কিশলয়ে।

        এসো গো পীত বসনে সাজি, কোলেতে বীণা উঠুক বাজি,

            ধ্যানেতে আর গানেতে আজি যামিনী যাক বয়ে।

 

        এসো গো এসো দোলবিলাসী বাণীতে মোর দোলা,

            ছন্দে মোর চকিতে আসি মাতিয়ে তারে তোলো।

                অনেক দিন বুকের কাছে রসের স্রোত থমকি আছে,

                    নাচিবে আজি তোমার নাচে সময় তারি হল 

 

                     ২২১

     তুমি    কোন্‌ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।

মার ভাঙন যা তা ধন্য হল চরণপাতে

     আমি    রাখব গেঁথে তারে    রক্তমণির হারে,

        বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে

ুমি    কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে-

    ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি-'পরে।

        নীরবে তাহারি গান আমি তাই জানি তোমারি দান-

            ফেরে সে ফাল্গুন-হাওয়ায়-হাওয়ায় সুরহারা মূর্ছনাতে

 

                     ২২২
মি    তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ    সুরের বাঁধনে-

         তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে

            সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ,

                সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ-

                    তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম

                        রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে

     তোমার অরূপ মূর্তিখানি

াল্গুনের আলোতে বসাই আনি।

                বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদুর দিগন্তে

                    সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী

                        গানের তানের সে উন্মাদনে

 

                       ২২৩

      এই    উদাসী হাওয়ার পথে পথে    মুকুলগুলি ঝরে;

মি    কুড়িয়ে নিয়েছি    তোমার          চরণে দিয়েছি-

                    লহো লহো করুণ করে

            যখন যাব চলে    ওরা    ফুটবে তোমার কোলে,

    তোমার  মালা গাঁথার আঙুলগুলি  মধুর বেদনভরে

                যেন আমায় স্মরণ করে

বউকথাকও তন্দ্রাহারা বিফল ব্যথায় ডাক দিয়ে হয় সারা

                আজি বিভোর রাতে।

ুজনের কানাকানি কথা দুজনের মিলনবিহ্বলতা,

    জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে।

    এই    আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা কালকে দিনের তরে

                তোমার  অলস দ্বিপ্রহরে

 

                  ২২৪

সন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে

েষ কুসুমের পরশ রাখে বনের ভালে

    তেমনি তুমি যাবে জানি,  সঙ্গে যাবে হাসিখানি-

        অলক হতে পড়বে অশোক বিদায়-থালে

রইব একা ভাসান-খেলার নদীর তটে,

    বেদনাহীন মুখের ছবি স্মৃতির পটে-

        অবসানের অস্ত-আলো তোমার সাথি, সেই তো ভালো-

            ছায়া সে থাক্ মিলনশেষের অন্তরালে


                      ২২৫

ম     দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন  তব চরণতলে

        শুভলগন গেল চলে,

            প্রেমের অভিষেক কেন হল না   তব নয়নজলে

সের ধারা নামিল না,   বিরহে তাপের দিনে  ফুল গেল শুকায়ে-

            মালা পরানো হল না তব গলে

নে হয়েছিল দেখেছিনু করুণা তব আঁখিনিমেষে,

                গেল সে ভেসে।

    যদি দিতে বেদনার দান, আপনি পেতে তারে ফিরে

                অমৃতফলে

 

                  ২২৬

াণী মোর নাহি,

    স্তব্ধ হৃদয় বিছায়ে চাহিতে শুধু জানি

        আমি অমাবিভাবরী আলোহারা

            মেলিয়া অগণ্য তারা

                নিষ্ফল আশায় নিঃশেষ পথ চাহি

ুমি যবে বাজাও বাঁশি সুর আসে ভাসি

    নীরবতার গভীরে বিহ্বল বায়ে

        নিদ্রাসমুদ্র পরায়ে।

            তোমারি সুরের প্রতিধ্বনি তোমারে দিই ফিরায়ে,

                কে জানে সে কি পশে তব স্বপ্নের তীরে

                    বিপুল অন্ধকার বাহি

 

                       ২২৭

জি দক্ষিণপবনে

    দোলা লাগিল বনে বনে

        দিক্‌ললনার নৃত্যচঞ্চল মঞ্জীরধ্বনি অন্তরে ওঠে রনরনি

            বিরহবিহ্বল হৃৎস্পন্দনে

াধবীলতায় ভাষাহারা ব্যাকুলতা

    পল্লবে পল্লবে প্রলপিত কলরবে।

        প্রজাপতির পাখায় দিকে দিকে লিপি নিয়ে যায়

            উৎসব-আমন্ত্রণে

 

                     ২২৮

দি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম তব অকৃপণ করে,

        মন তবু জানে জানে-

    চকিত ক্ষণিক আলোছায়া তব আলিপন আঁকিয়া যায়

        ভাবনারে প্রাঙ্গণে

            বৈশাখের শীর্ণ নদী ভরা স্রোতের দান না পায় যদি

                তবু সঙ্কুচিত তীরে তীরে

            ক্ষীণ ধারায় পলাতক পরশখানি দিয়ে যায়,

                 পিয়াসি লয় তাহা ভাগ্য মানি

ম   ভীরু বাসনার অঞ্জলিতে

    যতটুকু পাই রয় উচ্ছলিতে।

                 দিবসের দৈন্যের সঞ্চয় যত

                    যত্নে ধরে রাখি,

                 সে যে রজনীর স্বপ্নের আয়োজন

 

                      ২২৯

মার আপন গান আমার অগোচরে  আমার মন হরণ করে,

    নিয়ে সে যায় ভাসায়ে সকল সীমারই পারে

        ওই-যে দূরে কূলে কূলে  ফাল্গুন উচ্ছ্বসিত ফুলে ফুলে-

            সেথা হতে আসে দুরন্ত হাওয়া, লাগে আমার পালে

কোথায় তুমি মম অজানা সাথি,

    কাটাও বিজনে বিরহরাতি,

        এসো এসো উধাও পথের যাত্রী-

            তরী আমার টলোমলো ভরা জোয়ারে

 

                      ২৩০

অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে।

    ও যে সুদূর রাতের পাখি

        গাহে সুদূর রাতের গান

            বিগত বসন্তের অশোকরক্তরাগে ওর রঙিন পাখা,

                তারি ঝরা ফুলের গন্ধ ওর অন্তরে ঢাকা

ওগো বিদেশিনী,

    তুমি ডাকো ওরে নাম ধরে,

        ও যে তোমারি চেনা।

    তোমারি দেশের আকাশ ও যে জানে, তোমার রাতের তারা,

        তোমারি বকুলবনের গানে ও দেয় সাড়া-

            নাচে তোমারি কঙ্কণেরই তালে

 

                          ২৩১

আমি যে গান গাই জানি নে সে     কার উদ্দেশে

    যবে জাগে মনে  অকারণে চঞ্চল হাওয়ায়, প্রবাসী পাখি উড়ে যায়-

        সুর যায় ভেসে   কার উদ্দেশে

            ওই মুখপানে চেয়ে দেখি-

                তুমি সে কি  অতীত কালের স্বপ্ন এলে

                    নূতন কালের বেশে।

    কভু জাগে মনে  আজও যে জাগে নি এ জীবনে

   গানের খেয়া সে মাগে আমার তীরে এসে

 

                  ২৩২

ওগো পড়োশিনি,

    শুনি বনপথে সুর মেলে যায় তব কিঙ্কিণী

        ক্লান্তকূজন দিনশেষে, আম্রশাখে,

            আকাশ বাজে তব নীরব রিনিরিনি

    এই নিকটে থাকা

        অতিদূর আবরণে রয়েছে ঢাকা।

            যেমন দূরে বাণী আপনহারা গানের সুরে,

    মাধুরীরহস্যমায়ায় চেনা তোমারে না চিনি

 

                    ২৩৩

ওগো স্বপ্নস্বরূপিণ, তবী অভিসারের পথে পথে

    স্মৃতির দীপ জ্বালা

        সেদিনেরই মাধবীবনে আজও তেমনি ফুল ফুটেছে

            তেমনি গন্ধ ঢালা

                আজি তন্দ্রাবিহীন রাতে ঝিল্লিঝঙ্কার স্পন্দিত পবনে

                    তব অঞ্চলের কম্পন সঞ্চার।

    আজি  পরজে বাজে বাঁশি

যেন হৃদয়ে বহুদূরে আবেশবিহ্বল সুরে।

    বিকচ মল্লিমাল্যে তোমারে স্মরিয়া রেখেছি ভরিয়া ডালা

 

                        ২৩৪

ওরে জাগায়ো না,    ও যে বিরাম মাগে    নির্মম ভাগ্যের পায়ে।

    ও যে সব চাওয়া দিতে চাহে অতলে জলাঞ্জলি

        দুরাশার দুঃসহ ভার দিক নামায়ে,

            যাক ভুলে অকিঞ্চন জীবনের বঞ্চনা

                আসুক নিবিড় নিদ্রা,

    তামসী তুলিকায় অতীতের বিদ্রূপবাণী দিক মুছায়ে

            স্মরণের পত্র হতে।

    স্তব্ধ হোক বেদনগুঞ্জন

        সুপ্ত বিহঙ্গের নীড়ের মতো-

আনো তমস্বিনী,

    শ্রান্ত দুঃখের মৌনতিমিরে শান্তির দান

 

                     ২৩৫

দিনান্তবেলায় শেষের ফসল নিলেম তরী-'পরে,

    এ পারে কৃষি হল সারা,

            যাব ও পারের ঘাটে

        হংসবলাকা উড়ে যায়

            দূরের তীরে, তারার আলোয়,

        তারি ডানার ধ্বনি বাজে মোর অন্তরে

    ভাঁটার নদী ধায় সাগর-পানে কলতানে,

            ভাবনা মোর ভেসে যায় তারি টানে।

যা-কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়

    সুখ নয় সে, দুঃখ সে নয় নয় সে কামনা-

        শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে

 

                     ২৩৬

ধূসর জীবনের গোধুলিতে ক্লান্ত আলোয় ম্লানস্মৃতি।

    সেই  সুরের কায়া মোর সাথের সাথি, স্বপ্নের সঙ্গিনী,

          তারি আবেশ লাগে মনে বসন্তবিহ্বল বনে

দেখি তার বিরহী মূর্তি বেহাগের তানে

        সকরুণ নত নয়ানে।

                            পূর্ণিমা জ্যোৎস্নালোকে মিলে যায়

                        জাগ্রত কোকিল-কাকলিতে মোর বাঁশির গীতে

 

                    ২৩৭

দোষী করিব না, করিব না তোমারে

    আমি নিজের নিজে করি ছলনা।

    মনে মনে ভাবি ভালোবাসো,

        মনে মনে বুঝি তুমি হাসো,

      জান এ আমার খেলা-

        এ আমার মোহের রচনা

সন্ধ্যামেঘের রাগে    অকারণে ছবি জাগে,

    সেইমতো মায়ার আভাসে    মনের আকাশে

        হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে

    শূন্যে শূন্যে ছিন্নলিপি মোর

            বিরহমিলনকল্পনা

 

                  ২৩৮

       দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে

আপন মনে যাও তুমি গান গেয়ে গেয়ে।

        যে আকাশে সুরের লেখা লেখো

            তার পানে রই চেয়ে চেয়ে॥

হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে,  চেনা দিনের ঠিক-ঠিকানা ভোলে,

        মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন  গন্ধের পথ বেয়ে বেয়ে॥

                গানের টানা জালে

       নিমেষ-ঘেরা গহন থেকে তোলে অসীমকালে।

মাটির আড়াল করি ভেদন সুরলোকের আনে বেদন,

                মর্তলোকের বীণার তারে  রাগিণী দেয় ছেয়ে॥

 

                   ২৩৯

ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।

মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি॥

বিষাদের অশ্রুজলে নীরবের মর্মতলে

গোপনে উঠুক ফলে  হৃদয়ের নূতন বাণী॥

যে পথে যেতে হবে  সে পথে তুমি একা-

নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।

সারা দিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে

পরানের পদ্মবনে  বিরহের বীণাপাণি॥

  

                     ২৪০

ওকে    ধরিলে তো ধরা দেবে না-

            ওকে  দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে।

মন      নাই যদি দিল নাই দিল,

                মন নেয় যদি নিক্ কেড়ে॥

একি খেলা মোরা খেলেছি,  শুধু   নয়নের জল ফেলেছি-

ওরই     জয় যদি হয় জয় হোক, মোরা হারি যদি যাই হেরে॥

          এক দিন মিছে আসরে  মনে গরব সোহাগ না ধরে,

শেষে     দিন না ফুরাতে ফুরাতে  সব গরব দিয়েছে সেরে।

            ভেবেছিনু ওকে চিনেছি,  বুঝি  বিনা পণে ওকে কিনেছি-

ও যে      আমাদেরই কিনে নিয়েছি ও যে তাই আসে, তাই ফেরে॥

 

                      ২৪১

        কেন ধরে রাখা, ও যাবে চলে

                মিলনযামিনী গত হলে॥

স্বপনশেষে নয়ন মেলো,  নিব-নিব দীপ নিবায়ে ফেলো-

                কী হবে শুকানো ফুলদলে॥

        জাগে শুকতারা, ডাকিছে পাখি,

                    উষা সকরুণ অরুণ-আঁখি।

এসো প্রাণপণ হাসিমুখে   বলো 'যাও সখা ! থাকো সুখে'-

        ডেকো না, রেখো না আঁখিজলে॥

  

                            ২৪২

ও চাঁদ      চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে,

হল          কনায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে॥

আমার       তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেল খুলে;

তারে         হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্‌ অচেনার ধারে॥

              পথিক সবাই পেরিয়ে গেল ঘাটের কিনারাতে,

               আমি সে কোন্‌ আকুল আলোয় দিশাহারা রাতে।

সেই          পথ-হারানোর অধীর টানে  অকূলে পথ আপনি টানে,

               দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে॥

  

                        ২৪৩

হায় গো,    ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়, যায় গো-

                    সুর হারালেম অশ্রুধারে॥

                তরী তোমার সাগরনীরে,  আমি ফিরি তীরে তীরে,

                    পথ কোথা পাই অন্ধকারে॥

হায় গো,     নয়ন আমার মরে দুরাশায় গো,

                    চেয়ে থাকি দাঁড়িয়ে দ্বারে।

        যে ঘরে ওই প্রদীপ জ্বলে তার ঠিকানা কেউ না বলে,

               বসে থাকি পথের নিরালায় গো

                  চির-রাতের পাথার-পারে॥

 

                     ২৪৪

তোমার বীণায় গান ছিল আর আমার ডালায় ফুল ছিল গো।

একই দখিন হাওয়ায় সে দিন দোঁহায় মোদের দুল দিল গো॥

    সে দিন সে তো জানে না কেউ আকাশ ভরে কিসের সে ঢেউ,

    তোমার সুরের তরী আমার রঙিন ফুলে কূল নিল গো॥

সে দিন আমার মনে হল, তোমার গানের তাল ধ'রে।

আমার প্রাণে ফুল-ফোটানো রইবে চিরকাল ধ'রে।

    গান তবু তো গেল ভেসে, ফুল ফুরালো দিনের শেষে,

    ফাল্গুনবেলার মধুর খেলায় কোন্‌খানে হায় ভুল ছিল গো॥

 

                        ২৪৫

তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার    কত রঙে রঙ-করা।

মোর সাথে ছিল দুখের ফলের ভার    অশ্রুর রসে ভরা॥

    সহসা আসিল, কহিল সে সুন্দরী    'এসো না বদল করি'।

    মুখপানে তার চাহিলাম, মরি মরি, নিদয়া সে মনোহরা॥

সে লইল মোর ভরা বাদলের ডালা,    চাহিল সকৌতুকে।

আমি লয়ে তার নবফাল্গুনের মালা      তুলিয়া ধরিনু বুকে।

    'মোর হল জয়' যেতে যেতে কয় হেসে, দূরে চলে গেল ত্বরা।

    সন্ধ্যায় দেখি তপ্ত দিনের শেষে    ফুলগুলি সব ঝরা॥

  

                      ২৪৬

কেন    নয়ন আপনি ভেসে যায়    জলে।

কেন    মন কেন এমন করে॥

যেন    সহসা কী কথা মনে পড়ে-

মনে    পড়ে না গো তবু মনে পড়ে॥

            চারি দিকে সব মধুর নীরব,

            কেন আমারি পরাম কেঁদে মরে।

            কেন মন কেন এমন কেন রে॥

যেন    কাহার বচন দিয়েছে বেদন,

যেন    কে ফিরে গিয়েছে অনাদরে-

বাজে    তারি অযতন প্রাণের 'পরে।

            যেন  সহসা কী কথা মনে পড়ে-

            মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে॥

  

                       ২৪৭

আজি        যে রজনী যায়    ফিরাইব তায় কেমনে।

কেন        নয়নের জল        ঝরিছে বিফল নয়নে॥

             এ  বেশভূষণ লহো সখী, লহো, এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ-

                    এমন যামিনী কাটিল বিরহশয়নে॥

আমি        বৃথা অভিসারে  এ যমুনাপারে এসেছি,

বহি         বৃথা মনো-আশা  এত ভালোবাসা বেসেছি। 

শেষে        নিশিশেষে বদন মলিন,   ক্লান্তচরণ, মন উদাসীন,

                        ফিরিয়া চলেছি কোন্‌ সুখহীন ভবনে

ওগো        ভোলা ভালো তবে,   কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর।

যদি         যেতে হল হায়   প্রাণ কেন চায় পিছে আর।

             কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো  রজনীপ্রভাতে বসে রব কত-

                        এবারের মতো  বসন্ত গত জীবনে

 

                      ২৪৮

       এমন দিনে তারে বলা যায়

       এমন ঘনঘোর বরিষায়।

       এমন দিনে মন খোলা যায়-

এমন মেঘস্বরে    বাদল-ঝরোঝরে

        তপনহীন ঘন তমসায়

        সে কথা শুনিবে না কেহ আর,

        নিভৃত নির্জন চারি ধার।

দুজনে মুখোমুখি    গভীর দুখে দুখি,

        আকাশে জল ঝরে অনিবার-

        জগতে কেহ যেন নাহি আর

 

        সমাজ সংসার মিছে সব,

        মিছে এ জীবনের কলরব।

কেবল আঁখি দিয়ে   আঁখির সুধা পিয়ে

        হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব-

        আঁধারে মিশে গেছে আর সব

 

        তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার

        নামাতে পারি যদি মনোভার।

শ্রাবণবরিষণে    একদা গৃহকোণে

        দু কথা বলি যদি কাছে তার

        তাহাতে আসে যাবে কিবা কার

 

        ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,

        বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।

যে কথা এ জীবনে   রহিয়া গেল মনে

        সে কথা আজি যেন বলা যায়-

        এমন ঘনঘোর বরিষায়

 

২৪৯

সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশী নায়ে,
  তাহারি রাগিণী লাগিল গায়ে॥
    সে সুর বাহিয়া ভেসে আসে কার   সুদূর বিরহবিধুর হিয়ার
        অজানা বেদনা, সাগরবেলার   অধীর বায়ে
                                              বনের 
ছায়ে॥

তাই শুনে আজি বিজন প্রবাসে হৃদয়মাঝে
  শরত্‍‌শিশিরে ভিজে ভৈরবী নীরবে বাজে।
     ছবি মনে নে আলোতে  গীতে যেন জনহীন নদীপথটিতে 
        কে চলেছে জলে কলস ভরিতে   অলস পায়ে
                                               বনের ছায়ে॥ 

 

                      ২৫০

এ পারে মুখর হল কেকা ওই,      ও পারে নীরব কেন কুহু হায়।

এক কহে, 'আর-একটি একা কই,  শুভযোগে কবে হব দুঁহু হায়।'

            অধীর সমীর পুরবৈয়াঁ  নিবিড় বিরহব্যথা বইয়া

                    নিশ্বাস ফেলে মুহু মুহ হায়

আষাঢ় সজলঘন আঁধারে  ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে-

'আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাল্গুনেরে মোর পাশে কে আনে,'

        ঋতুর দু ধারে থাকে দুজনে,  মেলে না যে কাকলি ও কূজনে,

                আকাশের প্রাণ করে হূহু হায়

  

                        ২৫১

রোদনভরা এ বসন্ত    সখী,     কখনো আসে নি বুঝি আগে।

মোর        বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে

             কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা,

             সারা দিন-রজনী অনিমিখা কার পথ চেয়ে জাগে

দক্ষিণসমীরে দূর গগনে    একেলা বিরহী গাহে বুঝি গো।

কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত    আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে।

             আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে    ব্যাকুল কর হানি বারে বারে-

             দেওয়া হল না যে আপনারে এই ব্যথা মনে লাগে

 

                         ২৫২

        এসো এসো ফিরে এসো, বঁধু হে ফিরে এসো।

আমার    ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, নাথ হে, ফিরে এসো।

                ওহে    নিষ্ঠুর, ফিরে এসো,

                আমার করুণকোমল এসো,

    আমার সজলজলদস্নিগ্ধকান্ত সুন্দর ফিরে এসো,

                আমার নিতিসুখ ফিরে এসো,

                আমার চিরদুখ ফিরে এসো।

    আমার সবসুখদুখমন্থনধন অন্তরে ফিরে এসো।

                আমার চিরবাঞ্ছিত এসো,

                আমার চিতসঞ্চিত এসো,

ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন,    ভুজ    বন্ধনে ফিরে এসো।

                আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো,

                আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো,

আমার    শয়নে স্বপনে বসনে ভূষণে নিখিল ভুবনে এসো।

                আমার  মুখের হাসিতে এসো,

                আমার চোখের সলিলে এসো,

আমার    আদরে আমার ছলনে আমার অভিমানে ফিরে এসো।

                আমার সকল স্মরণে এসো,

                আমার সকল ভরমে এসো,

আমার    ধরম-করম-সোহাগ-শরম-জনম-মরণে এসো

 

                   ২৫৩

তোমার গীতি    জাগালো স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া,

বাদলশেষে    করুণ হেসে যেন চামেলি-কলিয়া

    সজল ঘন মেঘের ছায়ে    মৃদু সুবাস দিল বিছায়ে,

    না-দেখা কোন্‌ পরশঘায়ে পড়িছে টলটলিয়া

তোমার বাণী-স্মরণখানি আজি বাদলপবনে

নিশীথে বারিপতন-সম ধ্বনিছে মম শ্রবণে।

    সে বাণী যেন গানেতে লেখা দিতেছে আঁকি সুরের রেখা

    যে পথ দিয়ে তোমারি, প্রিয়ে, চরণ গেল চলিয়া

  

                       ২৫৪

       যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে।

    সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে

আজ কেন মোর পড়ে মনে        কখ্‌ন তারে চোখের কোণে

        দেখেছিলেম অফুট প্রদোষে-

    সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে

আজ ওই চাঁদের বরণ হবে আলোর সঙ্গীতে,

    রাতের মুখের আঁধারখানি খুলবে ইঙ্গিতে।

    শুক্লরাতে সেই আলোকে দেখা হবে এক পলকে,

        সব আবরণ যাবে যে খসে।

    সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে

  

                     ২৫৫

বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি।

কোন্ সুদূরের আকাশ হতে  আনব তারে ডাকি

হাওয়ায় হাওয়ায় মাতন জাগে,  পাতায় পাতায় নাচন লাগে গো-

        এমন মধুর গানের বেলায় সেইশুধু রয় বাকি

উদাস-করা হৃদয়-হরা না জানি কোন্‌ ডাকে

সাগর-পারের বনের ধারে  কে ভুলালো তাকে।

আমার হেথায় ফাগুন বৃথায়  বারে বারে ডাকে যে তায় গো-

        এমন রাতের ব্যাকুল ব্যথায় কেন সে দেয় ফাঁকি

  

                         ২৫৬

ধূসর জীবনের গোধূলিতে  ক্লান্ত মলিন যেই স্মৃতি

মুছে-আসা সেই ছবিটিতে   রঙ এঁকে দেয় মোর গীতি

    বসন্তের ফুলের পরাগে  যেই রঙ জাগে,

    ঘুম-ভাঙা পিককাকলিতে  যেই রঙ লাগে,

        যেই রঙ পিয়ালছায়ায়  ঢালে শুক্লসপ্তমীর তিথি

সেই ছবি দোলা খায়   রক্তের হিল্লোলে,

সেই ছবি মিশে যায়     নির্ঝরকল্লোলে,

        দক্ষিণসমীরণে ভাসে,  পূর্ণিমাজ্যোৎস্নায় হাসে-

            সে আমার স্বপ্নের অতিথি

 

                       ২৫৭

আমার        জ্বলে নি আলো    অন্ধকারে

         দাও না সাড়া কি তাই   বারে বারে

তোমার বাঁশি আমার বাজে বুকে  কঠিন দুখে, গভীর সুখে-

        যে  জানে না পথ কাঁদাও তারে

          চেয়ে রই রাতের আকাশ-পানে,

          মন যে কী চায় তা মনই জানে।

আশা জাগে কেন অকারণে        আমার মনে ক্ষণে ক্ষণে,

            ব্যথার টানে তোমায়  আনবে দ্বারে

 

                        ২৫৮

নীলাঞ্জনছায়া, প্রফুল্ল কদম্ববন,

জাম্বুপুঞ্জে শ্যাম বনান্ত, নববীথিকা ঘনসুগন্ধ

মন্থর নব নীলনীরদ-পরিকীর্ণ দিগন্ত।

চিত্ত মোর পন্থহারা কান্তবিরহকান্তারে

 

                       ২৫৯

       ফিরবে না তা জানি, তা জানি-

আহা,    তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি

          গাঁথবে না মালা জানি মনে,

আহা,    তবু ধরুক মুকুল আমার বকুলবনে

প্রাণে     ওই পরশের পিয়াস আনি

           কোথায় তুমি পথভোলা,

তবু       থাক্-না আমার দুয়ার খোলা।

           রাত্রি আমার গীতহীনা,

আহা,     তবু বাঁধুক সুরে বাঁধুক তোমার বীণা-

তারে      ঘিরে ফিরুক কাঙাল বীণা

  

                      ২৬০

       দিনের পরে দিন যে গেল আঁধার ঘরে,

তোমার আসনখানি দেখে মন যে কেমন করে

       ওগো বঁধু, ফুলের সাজি  মঞ্জরীতে ভরল আজি-

       ব্যথার হারে গাঁথব তারে, রাখব চরণ-'পরে

পায়ের ধ্বনি গণি গণি রাতের তারা জাগে,

উত্তরীয়ের হাওয়া এসে ফুলের বনে লাগে।

   ফাগুনবেলার বুকের মাঝে   পথ-চাওয়া সুর কেঁদে বাজে-

   প্রাণের কথা ভাষা হারায়, চোখের জলে ঝরে


                            ২৬১

      না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে,

      দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি-পেয়েছি আঁধার রাতে

না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো-

      তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে

        তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল

        বীণাবাদিনীর শতদলদলে  করিছে সে টলোমল।

মোর গানে গানে পলকে পলকে ঝলসি উঠিছে ঝলকে ঝলকে,

        শান্ত হাসির করুণ আলোকে  ভাতিছে নয়নপাতে

 

                      ২৬২

    বিরহ মধুর হল আজি    মধুরাতে।

গভীর রাগিণী উঠে বাজি     বেদনাতে

            ভরি দিয়া পূর্ণিমানিশা    অধীর অদর্শনতৃষা

                কী করুণ মরীচিকা আনে আঁখিপাতে

    সুদূরের সুগন্ধধারা  বায়ুভরে

পরানে আমার পথহারা  ঘুরে মরে।

                কার বাণী কোন্‌ সুরে তালে  মর্মরে পল্লবজালে,

                    বাজে মম মঞ্জীররাজি সাথে সাথে

 

                          ২৬৩

ফিরে ফিরে ডাক্ দেখি রে পরান খুলে,  ডাক্ ডাক্ ডাক্ ফিরে ফিরে।

            দেখব কেমন রয় সে ভুলে

সে ডাক বেড়াক বনে বনে, সে ডাক শুধাক জনে জনে,

            সে ডাক বুকে দুঃখে সুখে ফিরুক দুলে

    সাঁজ-সকালে রাত্রিবেলায় ক্ষণে ক্ষণে

    একলা ব'সে ডাক্ দেখি তায় মনে মনে।

নয়ন তোরই ডাকুক তারে, শ্রবণ রহুক পথের ধারে,

    থাক্-না সে ডাক গলায় গাঁথা মালার ফুলে

 

                  ২৬৪

প্রভাত-আলোরে মোর  কাঁদায়ে গেলে

মিলনমালার ডোর  ছিঁড়িয়া ফেলে

        পড়ে যা রহিল পিছে সব হয়ে গেল মিছে,

            বসে আছি দূর-পানে নয়ন মেলে

একে একে ধূলি হতে কুড়ায়ে মরি

যে ফুল বিদায়পথে পড়িছে ঝরি

        ভাবি রবে না লেশ সে দিনের অবশেষ-

         কাটিল ফাগুনবেলা কী খেলা খেলে

  

                        ২৬৫

নাই যদি বা এলে তুমি  এড়িয়ে যাবে তাই ব'লে?

অন্তরেতে নাই কি তুমি সামনে আমার নাই ব'লে

    মন যে আছে তোমায় মিশে,    আমায় তবে ছাড়বে কিসে-

    প্রেম কি আমার হারায় দিশে  অভিমানে যাই ব'লে॥

বিরহ মোর হোক-না অকূল, সেই বিরহের সরোবরে

মিলনকমল উঠেছে দুলে অশ্রুজলের ঢেউয়ের 'পরে।

    তবু তৃষায় মরে আঁখি, তোমার লাগি চেয়ে থাকি-

    চোখের 'পরে পাব না কি বুকের 'পরে পাই ব'লে॥

  

                     ২৬৬

শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায়

সাথিহারা ঘরে মন আমার

প্রবাসী পাখি ফিরে যেতে চায়

দূরকালের অরণ্যছায়াতলে॥

কী জানি সেথা আছে কিনা আজও বিজনে বিরহ হিয়া

নীপবনগন্ধঘন অন্ধকারে-

সাড়া দিবে কি গীতহীন নীরব সাধনায়॥

হায়, জানি সে নাই জীর্ণ নীড়ে, জানি সে নাই নাই।

তীর্থহারা যাত্রী ফিরে ব্যর্থ বেদনায়-

ডাকে তবু হৃদয় মম মনে-মনে রিক্ত ভুবনে

রোদন-জাগা সঙ্গীহারা অসীম শূন্যে শূন্যে॥

 

                   ২৬৭

সে যে পাশে এসে বসেছিল,    তবু জাগি নি।

কী ঘুম তোরে পেয়েছিল    হতভাগিনী

    এসেছিল নীরব রাতে,    বীণাখানি ছিল হাতে-

    স্বপন-মাঝে বাজিয়ে গেল গভীর রাগিণী

জেগে দেখি দখিন-হাওয়া, পাগল করিয়া

গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায়  আঁধার ভরিয়া।

    কেন আমার রজনী যায়,    কাছে পেয়ে কাছে না পায়-

    কেন গো তার মালার পরশ    বুকে লাগে নি

 

                       ২৬৮

কোন্    গহন অরণ্যে তারে এলেম হারায়ে

কোন্    দূর জনমের কোন্ স্মৃতিবিস্মৃতিছায়ে

    আজ    আলো-আঁধারে

    কখন্-বুঝি দেখি, কখন্ দেখি না তারে-

    কোন্ মিলনসুখের স্বপনসাগর এল পারায়ে

    ধরা-অধরার মাঝে

    ছায়ানটের রাগিণীতে    আমার বাঁশি বাজে।

    বকুলতলায় ছায়ার নাচন ফুলের গন্ধে মিশে

    জানি নে মন পাগল করে কিসে।

    কোন্ নটিনীর ঘূর্ণি-আঁচল লাগে আমার গায়ে

  

                     ২৬৯

কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে।

মিলনের মাঝে বিরহকারায় বাঁধা রে

    সমুখে রয়েছে সুধাপারাবার,    নাগাল না পায় তবু আঁখি তার-

        কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে

আড়ালে আড়ালে শুনি শুধু তারি বাণী যে।

জানি তারে আমি, তবু তারে নাহি জানি যে।

    শুধু বেদনায় অন্তরে পাই, অন্তরে পেয়ে বাহিরে হারাই-

        আমার ভুবন রবে কি কেবলই আধা রে

  

                     ২৭০

অশান্তি আজ হানল একি দহনজ্বালা।

বিঁধল হৃদয় নিদয় বাণে বেদনঢালা

    বক্ষে জ্বালায় অগ্নিশিখা, চক্ষে কাঁপায় মরীচিকা-

        মরণসুতোয় গাঁথল কে মোর বরণমালা

চেনা ভুবন হারিয়ে গেল স্বপনছায়াতে

ফাগুনদিনের পলাশরঙের রঙিন মায়াতে।

    যাত্রা আমার নিরুদ্দেশা,    পথ-হারানোর লাগল নেশা-

        অচিন দেশে এবার আমার যাবার পালা

 
                       ২৭১

   স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা

জাগায় দেহে মনে    একি বিপুল ব্যথা

বহে মম শিরে শিরে    একি দাহ, কী প্রবাহ,

    চকিতে সর্বদেহে ছুটে তড়িৎলতা

ঝড়ের পবনগর্জে  হারাই আপনায়

দুরন্তযৌবনক্ষুব্ধ অশান্ত বন্যায়।

তরঙ্গ উঠে প্রাণে   দিগন্তে কাহার পানে-

    ইঙ্গিতের ভাষায় কাঁদে  নাহি নাহি কথা

 

                         ২৭২

শুনি    ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহ্বান।

মন    রয় না, রয় না, রয় না ঘরে, চঞ্চল প্রাণ

        ভাসায়ে দিব আপনারে    ভরা জোয়ারে,

        সকল-ভাবনা-ডুবানো ধারায়    করিব স্নান-

            ব্যর্থ বাসনার দাহ হবে নির্বাণ

                ঢেউ দিয়েছে জলে।

ঢেউ দিল, ঢেউ দিল,    ঢেউ দিল আমার মর্মতলে।

        একি ব্যাকুলতা আজি আকাশে, এই বাতাসে,

        যেন উতলা অপ্সরীর উত্তরীয় করে রোমাঞ্চদান-

            দূর সিন্ধুতীরে কার মঞ্জীরে  গুঞ্জরতান

 

২৭৩

দিন পরে যায় দিন,   বসি পথপাশে
গান
 পরে গাই গান   বসন্তবাতাসে॥
   ফুরাতে চায় না বেলা,  তাই সুর গেঁথে খেলা
       রাগিণীর মরীচিকা   স্বপ্নের আভাসে॥
দিন
 পরে যায় দিন,   নাই তব দেখা।
গান
 পরে গাই গান,   রই বসে একা।
   সুর থেমে যায় পাছে  তাই নাহি আস কাছে
   ভালোবাসা ব্যথা দেয়   যারে ভালোবাসে॥ 
 

                   ২৭৪

আমার    ভুবন তো আজ হল কাঙাল, কিছু তো নাই বাকি,

    ওগো নিঠুর, দেখতে পেলে তা কি

তার   সব ঝরেছ, সব মরেছে, জীর্ণ বসন ওই পরেছে-

    প্রেমের দানে নগ্ন প্রাণের লজ্জা দেহো ঢাকি

কুঞ্জে তাহার গান যা ছিল কোথায় গেল ভাসি।

এবার তাহার শূন্য হিয়ায় বাজাও তোমার বাঁশি।

তার    দীপের আলো কে নিভালো, তারে তুমি জ্বালো জ্বালো-

    আমার আপন আঁধার আমার আঁখিরে দেয় ফাঁকি

 
                     ২৭৫

      যখন    এসেছিলে অন্ধকারে

                চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে

হে অজানা, তোমায় তবে    জেনেছিলাম অনুভবে-

গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে

            তুমি    গেলে যখন একলা চলে

            চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।

তখন দেখি, পথের কাছে    মালা তোমার পড়ে আছে-

বুঝেছিলাম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে

  

                    ২৭৬

এ পথে আমি- যে গেছি বার বার, ভুলি নি তো এক দিনও।

আজ কি ঘুচিল চিহ্ন তাহার, উঠিল বনের তৃণ

তবু মনে মনে জানি নাই ভয়, অনুকূল বায়ু সহসা যে বয়-

    চিনিব তোমায় আসিবে সময়, তুমি যে আমায় চিন

একেলা যেতাম যে প্রদীপ হাতে নিবেছে তাহার শিখা।

তবু জানি মনে তারার ভাষাতে ঠিকানা রয়েছে লিখা।

পথের ধারেতে ফুটিল যে ফুল জানি জানি তারা ভেঙে দেবে ভুল-

    গন্ধে তাদের গোপন মৃদুল সঙ্কেত আছে লীন

  

                         ২৭৭

মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে,

যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখখানি-

            কী কথা ছিল যে মনে

    তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে-

    আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি,

            তুমি আছ দূর ভুবনে

    আকাশে উড়িছে বকপাঁতি,

    বেদনা আমার তারি সাথি।

বারেক তোমায় শুধাবারে চাই বিদায়কালে কী বল নাই,

    সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে

 

 

                  ২৭৮

কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে।

গন্ধ ছড়ালো ঘুমের প্রান্তপারে

    একা এসেছিল ভুলে    অন্ধরাতের কূলে

        অরুণ-আলোর বন্দনা করিবারে।

    ক্ষীণ দেহে মরি মরি    সে যে নিয়েছিল বরি

    অসীম সাহসে নিষ্ফল সাধনারে

কী যে তার রূপ দেখা হল না তো চোখে,

জানি না কী নামে স্মরণ করিব ওকে।

    আঁধারে যাহারা চলে    সেই তারাদের দলে

        এসে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে।

করুণ মাধুরীখানি    কহিতে জানে না বাণী

কেন এসেছিল রাতের বন্ধ দ্বারে

 
                        ২৭৯

        লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি,

     হারিয়ে গিয়েছে তোমার আখরগুলি

চৈত্ররজনী আজ বসে আছি একা,     পুন বুঝি দিল দেখা-

    বনে বনে তব লেখনীলীলার রেখা,

নবকিশলয়ে গো কোন্ ভুলে এল ভুলি তোমার পুরানো আখরগুলি

    মল্লিকা আজি কাননে কাননে কত

    সৌরভে-ভরা তোমারি নামের মতো।

কোমল তোমার অঙ্গুলি-ছোঁওয়া বাণী মনে দিল আজি আনি

    বিরহের কোন্ ব্যথাভরা লিপিখানি।

মাধবীশাখায় উঠিতেছে দুলি দুলি    তোমার   পুরানো আখরগুলি

 

                      ২৮০

            আজি    সাঁঝের যমুনায় গো

তরুণ চাঁদের কিরণতরী কোথায় ভেসে যায় গো

তারি সুদূর সারিগানে    বিদায়স্মৃতি জাগায় প্রাণে

    সেই-যে দুটি উতল আঁখি উছল করুণায় গো

আজ মনে মোর যে শুর বাজে কেউ তা শোনে নাই কি।

একলা প্রাণের কথা নিয়ে একলা এ দিন যায় কি।

    যায় যাবে, সে ফিরে ফিরে  লুকিয়ে তুলে নেয় নি কি রে

        আমার পরম বেদনাখানি আপন বেদনায় গো

  

                      ২৮১

সখী, আঁধারে একেলা ঘরে  মন মানে না

কিসেরই পিয়াসে কোথা যে যাবে সে, পথ জানে না

    ঝরোঝরো নীরে,    নিবিড় তিমিরে,   সজল সমীরে গো

    যেন কার বাণী কভু কানে আনে-কভু আনে না

 

                    ২৮২

        যখন   ভাঙল মিলন-মেলা

    ভেবেছিলেম ভুলব না আর চক্ষের জল ফেলা

দিনে দিনে পথের ধুলায় মালা হতে ফুল ঝরে যায়-

    জানি নে তো কখন এল বিস্মরণের বেলা

        দিনে দিনে কঠিন হল কখন বুকের তল-

ভেবেছিলেম ঝরবে না আর আমার চোখের জল।

হঠাৎ দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামে না যে-

    ভোলার তলে তলে ছিল অশ্রুজলের খেলা

  

                       ২৮৩

আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে

    আমার ফুলে আর কি কবে তোমার মালা গাঁথা হবে,

    তোমার বাঁশি দূরের হাওয়ায় কেঁদে বাজে কারে ডেকে

শ্রান্তি লাগে পায়ে পায়ে    বসি পথের তরুছায়ে

    সাথিহারার গোপন ব্যথা  বলব যারে সেজন কোথা-

    পথিকরা যায় আপন-মনে, আমারে যায় পিছে রেখে

 

                          ২৮৪

একলা ব'সে একে একে অন্যমনে  পদ্মের দল ভাসাও জলে অকারণে

হায়, রে, বুঝি কখন তুমি গেছ ভুলে ও যে আমি এনেছিলেম আপনি তুলে,

    রেখেছিলেম প্রভাতে ওই চরণমূলে  অকারণে-

    কখন তুলে নিলে হাতে যাবার ক্ষণে   অন্যমনে

    দিনের পরে দিনগুলি মোর এমনি ভাবে

    তোমার হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে হারিয়ে যাবে।

    সবগুলি এই শেষ হবে যেই তোমার খেলায়

    এমনি তোমার আলস-ভরা অবহেলায়

হয়তো তখন বাজবে ব্যথা সন্ধেবেলায় অকারণে-

চোখের জলের লাগবে আভাস নয়নকোণে  অন্যমনে

  

                     ২৮৫

তার    বিদায়বেলার মালাখানি   আমার গলে রে

        দোলে দোলে বুকের কাছে  পলে পলে রে

            গন্ধ তাহার ক্ষণে ক্ষণে  জাগে ফাগুনসমীরণে

                    গুঞ্জরিত কুঞ্জতলে রে

দিনের শেষে যেতে যেতে পথের 'পরে

    ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে।

            সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কেঁপে বনে,

                    কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে

  

                           ২৮৬

আমি    এলেম তারি দ্বারে,    ডাক দিলেম অন্ধকারে হা রে

         আগল ধ'রে দিলেম নাড়া-প্রহর গেল, পাই নি সাড়া,

            দেখতে পেলেম না যে তারে  হা রে

তবে  যাবার আগে এখান থেকে  এই  লিখনখানি যাব রেখে-

           দেখা তোমার পাই বা না পাই

           দেখতে এলেম জেনো গো তাই,

                ফিরে যাই সুদূরের পারে  হা রে

  

                  ২৮৭

দীপ নিবে গেছে মম নিশীথসমীরে,

ধীরে ধীরে এসে তুমি যেয়ো না গো ফিরে

        এ পথে যখন যাবে  আঁধারে চিনিতে পাবে-

                রজনীগন্ধার গন্ধ ভরেছে মন্দিরে

আমারে পড়িবে মনে কখন সে লাগি

প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি।

          ভয় পাছে শেষ তারে   ঘুম আসে আঁখিপাতে,

                ক্লান্ত কণ্ঠে মোর সুর ফুরায় যদি রে

  

                    ২৮৮

তুমি আমার ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে,

তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে

    কূলে যখন এলেম ফিরে  তখন অস্তশিখরশিরে

    চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে।

    আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে

লিখন তোমার বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা,

বাণী যে তার সোনার-ছোঁওয়া অরুণ-আলোয়-ঢাকা-

    এল আমার ক্লান্ত হাতে    ফুল-ঝরানো শীতের রাতে

    কুহেলিকায় মন্থর কোন্ মৌন সমীরণে।

    তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে

  

                    ২৮৯

সে যে   বাহির হল আমি জানি,

বক্ষে আমার বাজে তাহার পথের বাণী

    কোথায় কবে এসেছে সে  সাগরতীরে, বনের শেষে,

        আকাশ করে সেই কথারই কানাকানি

হায় রে, আমি ঘর বেঁধেছি এতই দূরে,

না জানি তার আসতে হবে কত ঘুরে।

        হিয়া আমার পেতে রেখে সারাটি পথ দিলেম ঢেকে,

            আমার ব্যথায় পড়ুক তাহার চরণখানি

 

                          ২৯০

কবে তুমি আসবে ব'লে রইব না বসে,    আমি চলব বাহিরে।

শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে,    আর  সময় নাহি রে

            বাতাস দিল দোল্‌, দিল দোল্;

        ও তুই  ঘাটের বাঁধন খোল্ ও তুই খোল্

    মাঝ-নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তরী বাহি র

আজ শুক্লা একাদশ, হেরো নিদ্রাহারা শশী

ওই    স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি।

        তোর  পথ জানা নাই, নাইবা জানা নাই-

        ও তোর  নাই মানা নাই, মনের মানা নাই-

   সবার সাথে চলবি রাতে সামনে চাহি রে

  

                    ২৯১

জাগরণে যায় বিভাবরী-

    আঁখি হতে ঘুম নিল হরি    মরি মরি

        যার লাগি ফিরি একা একা-আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা,

তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি

      বাণী নাহি, তবু কানে কানে  কী যে শুনি তাহা কেবা জানে।

          এই হিয়াভরা বেদনাতে,  বারি-ছলোছলো আঁখিপাতে,

ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি   মরি মরি

  

                      ২৯৩

একদা তুমি, প্রিয়ে,    আমারি এ   তরুমূলে

বসেছ ফুলসাজে    সে কথা যে গেছ ভুলে

        সেথা যে বহে নদী    নিরবধি    সে ভোলে নি,

        তারি যে স্রোতে আঁকা  বাঁকা বাঁকা  তব বেণী,

        তোমারি পদরেখা  আছে লেখা  তারি কূলে।

        আজি কি সবই ফাঁকি-সে কথা কি  গেছ ভুলে

গেঁথেছ যে রাগিণী    একাকিনী  দিনে দিনে

আজিও যায় ব্যেপে    কেঁপে কেঁপে   তৃণে তৃণে।

        ফাগুন আজো যে রে    খুঁজে ফেরে    চাঁপাফুলে।

        আজি কি সবই ফাঁকি-সে কথা কি গেছ ভুলে

  

                       ২৯৪

আমার     একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে

        ভরে রইল বুকের তলা, কারো কাছে হয় নি বলা,

        কেবল বলে গেলেম বাঁশির কানে কানে

আমার চোখে চেয়ে-থাকা তারার সাথে।

        এমনি গেল সারা রাতি,  পাই নি আমার জাগার সাথি-

        বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলেম গানে গানে

 
                           ২৯৫

  ও  দেখা দিয়ে যে চলে গেল    ও    চুপিচুপি কী বলে গেল।

      যেতে যেতে গো, কাননেতে গো ও কত যে ফুল দ'লে গেল

      মনে মনে কী ভাবে কে জানে, মেতে আছে ও যেন কী গানে,

      নয়ন হানে আকাশ-পানে-চাঁদের হিয়া গ'লে গেল

ও    পায়ে পায়ে যে বাজায়ে চলে বীণার ধ্বনি তৃণের দলে।

       কে জানে কারে ভালো কি বাসে,  বুঝিতে নারি কাঁদে কি হাসে,

       জানি নে ও কি ফিরিয়া আসে- জানি নে ও কি ছ'লে গেল

  

                  ২৯৬

কেন সারা দিন ধীরে ধীরে

    বালু নিয়ে শুধু খেলো তীরে

চলে গেল বেলা,  রেখে মিছে খেলা

    ঝাঁপ দিয়ে পড়ো কালো নীরে।

অকূল ছানিয়ে যা পাও তা নিয়ে

    হেসে কেঁদে চলো ঘরে ফিরে

নাহি জানি মনে কী বাসিয়া

পথে বসে আছে কে আসিয়া।

কী কুসুমবাসে  ফাগুনবাতাসে

    হৃদয় দিতেছে উদাসিয়া।

চল্ ওরে এই খ্যাপা বাতাসেই

        সাথে নিয়ে সেই উদাসীরে

  

                   ২৯৭

কী সুর বাজে আমার প্রাণে    আমিই জানি, মনই জানে

    কিসের লাগি সদাই জানি,  কাহার কাছে কী ধন মাগি-

            তাকাই কেন পথের পানে

দ্বারের পাশে প্রভাত আসে,  সন্ধ্যা নামে বনের বাসে।

    সকল-সাঁঝে বাঁশি বাজে, বিকল করে সকল কাজে-

            বাজায় কে যে কিসের তানে

 

                    ২৯৮

গহন ঘন বনে পিয়াল-তমাল-সহকার-ছায়ে

সন্ধ্যাবায়ে তৃণশয়নে মুগ্ধনয়নে রয়েছি বসি

        শ্যামল পল্লবভার আঁধারে মর্মরিছে,

        বায়ুভরে কাঁপে শাখা, বকুলদল পড়ে খসি

স্তব্ধ নীড়ে নীরব বিহগ,

নিস্তরঙ্গ নদীপ্রান্তে অরণ্যের নিবিড় ছায়া।

      ঝিল্লিমন্দ্রে তন্দ্রাপূর্ণ জলস্থ; শূন্যতল,

            চরাচরে স্বপনের মায়া।

        নির্জন হৃদয়ে মোর জাগিতেছে সেই মুখশশী

 

                    ২৯৯

কে উঠে ডাকি    মম   বক্ষোনীড়ে থাকি

করুণ মধুর অধীর তানে বিরহবিধুর পাখি

    নিবিড় ছায়া, গহন মায়া, পল্লবঘন নির্জন বন-

    শান্ত পবনে কুঞ্জভবনে কে জাগে একাকী

যামিনী বিভোরা  নিদ্রাঘনঘোর-

ঘন তমালশাখা  নিদ্রাঞ্জন-মাখা।

    স্তিমিত তারা চেতনহারা, পাণ্ডুগগন তন্দ্রামগন-

    চন্দ্র শ্রান্ত দিকভ্রান্ত  নিদ্রালস-আঁখি

 

                         ৩০০

   ওগো  কে যায় বাঁশরি বাজায়ে   আমার   ঘরে কেহ নাই যে।

    তারে মনে পড়ে যারে চাই যে

তার    আকুল পরান, বিরহের গান, বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে।

আমি    আমার কথা তারে জানাব কী করে, প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে

        কুসুমের মালা গাঁথা হল না,    ধূলিতে প'ড়ে শুকায় রে।

        নিশি হয় ভোর, রজনীর চাঁদ    মলিন মুখ লুকায় রে।

            সারা বিভাবরী কার পূজা করি  যৌবনডালা সাজায়ে-

            বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায়,   আমি কেন থাকি হায় রে